#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৩৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
‘তোর কী লজ্জা-শরম কিছু নেই? মুখে কিছুই আটকায় না? কোথায় কী বলতে হবে সেটাও জানিস না?’
গম্ভীর হয়ে প্রশ্নগুলো লামিয়ার দিকে ছুঁড়ে দিল অর্ষা। লামিয়া তখন আপেল খাচ্ছিল। অর্ষার প্রশ্ন শুনে ভ্রুঁ জোড়া কুঞ্চিত করে রাখে।
আরো একবার আপেলের টুকরায় কামড় বসিয়ে বলে,’কী আজব! তুই এত হাইপার হয়ে যাচ্ছিস কেন? আমি তো খারাপ কিছু বলিনি।’
‘খারাপ কিছু বলিসনি, আবার ভালো কিছুও বলিসনি।’
‘কোনটা ভালো বলিনি বল তো?’
‘উনাকে তোর হানিমুনের কথা কেন জিজ্ঞেস করতে হবে? তখন নিহাল ভাইয়াও ছিল।’
‘তাতে কী এমন সমস্যা হয়েছে শুনি? সম্পর্কে তোর হাজবেন্ড আমার দুলাভাই হয়। আর আমার হাজবেন্ড তোর দুলাভাই হয়। এত আনইজি ফিল করার কী আছে?’
‘তোর মতো ঠোঁটকাটা স্বভাবের মানুষদের কাছে দুনিয়ার সবকিছুই স্বাভাবিক।’
লামিয়া এবার গাল ফুলিয়ে বলল,’কতদিন পর আমাদের দেখা হয়েছে! কোথায় একটু আদর-যত্ন করবি। তা না করে তুই আমায় বকতেছিস? বিয়ের পর এত চেঞ্জ হয়ে গেছিস? এখন আমাদের একটুও ভালোবাসিস না।’
অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে লামিয়ার কাঁদো কাঁদো মুখটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে এখানে এমন কী-ই বা বলল? সে একটু আহ্লাদী হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
‘তুই ভুল বুঝতেছিস লামু। আমি তো শুধু…’
‘তুই আর আমার সাথে কথাই বলিস না। চুপ থাক।’
অর্ষা তাকিয়ে থাকে নিরুত্তর হয়ে। লামিয়াও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। এরপর ব্যাগ থেকে ফোন বের করে বলে,
‘কেউ আমাকে বাড়ির ওয়াইফাই পাসওয়ার্ডটা দেবে?’
এই যাত্রায় অর্ষা হেসে ফেলে। ফোনটা নিয়ে ওয়াইফাই কানেক্ট করে দেয়।
লামিয়া সরাসরি হোয়াটসএপে গিয়ে ভিডিয়ো কল করে। ভাগ্য ভালো থাকায় সবাই তখন অনলাইনেই ছিল। একে একে সবাই কলে জয়েন করে।
লামিয়ার গোমড়া মুখ দেখে প্রথমেই সবাই জানতে চায়,’কী হয়েছে তোর? মুখটা ওরকম করে রেখেছিস কেন?’
লামিয়া কাঁদোকাঁদো স্বরে অভিযোগ করে বলল,’তোরা কি জানিস, আমাদের বোকারানী কত চেঞ্জ হয়ে গেছে?’
সবাই চোখ বড়ো বড়ো করে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। উৎকণ্ঠিত হয়ে রেশমি জিজ্ঞেস করে,’কেন রে? কী হয়েছে?’
‘ও আর আমাদের ভালোবাসে না!’
অর্ষা চুপচাপ লামিয়ার কাহিনি দেখছিল আর বাকি বন্ধুদের কথা শুনছিল। আশিক এবার মৃদু ধমক দিয়ে বলে,
‘নাটক না করিয়া, কী হইছে বলো ফেলিয়া। নয়তো এমন থা’প্প’ড় দিমু, পরে ফ্যাসফ্যাস করে দিবা কান্দিয়া।’
জুঁই এবার আশিককে পাল্টা ধমক দিয়ে বলে,’তোর বোরিং কবিতা আগে বন্ধ কর প্লিজ!’
আশিক তেলে-বেগুনে জ্ব’লে উঠে বলে,’হোয়াট! বোরিং কবিতা? কোনটাকে তুই বোরিং কবিতা বলছিস মূ’র্খ নারী! তোর কোনো আইডিয়া আছে? আছে কোনো আইডিয়া? আমি যদি কবিতার বই বের করি, হাজার হাজার মেয়ে ভক্ত আমার পিছু পিছু ঘুরবে। আর সেদিন লাইন ধরে তোদের আমার অটোগ্রাফ নেওয়া লাগবে। তবুও আমি তোদের পাত্তা দেবো না। বিশেষ করে তোকে। তোর কুইকুই স্বভাব আমার একদম পছন্দ না আন্টির বাচ্চা জুঁই!’
লামিয়া এবার চিৎকার করে বলে,’বা’লগুলা থামবি তোরা! তোদের ঝগড়া শোনার জন্য ফোন দিছি?’
সবাই এবার চুপ হয়ে যায়। আহিল বলে,’লামিয়া তুই বল কী হয়েছে?’
‘বলিস না ভাই দুঃখের কথা!’
নাক টেনে এবার লামিয়া সব বলল। সব শুনে বাকিরা হাসতে হাসতে শেষ। লামিয়ার এতে রাগ আরো বেশি হয়।
আহিল লামিয়াকে শান্ত করে বলে,’তুই রাগ করতেছিস কেন? অর্ষা ঠিকই বলেছে। সব কথা কি সবার সামনে বলা মানায়?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ এখন তো তুই ওর সাপোর্ট নিবিই। এসেছিলাম দুইটারে রোমান্টিক বানাব। আর এদিকে বোকারানী আমার বে’ই’জ্জ’তি করতেছে।’
অর্ষা এবার নিজের জায়গা ছেড়ে লামিয়ার পাশে গিয়ে বসে। গলা জড়িয়ে ধরে বলে,’আচ্ছা স্যরি। ভুল হয়ে গেছে আমার। মাফ কর এবার।’
লামিয়া মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। দিদার বলে,’ঝগড়াঝাঁটি অনেক হয়েছে। এবার মিলেমিশে যা দুজনে।’
লামিয়া মুখ গোমড়া করেই বলল,’আমি জুস খাব।’
অর্ষা হেসে বলল,’আমি নিয়ে আসছি।’
আশিক বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে বলল,’লামিয়া আসার সময় মনে করে কম্বলটা কিন্তু নিয়ে আসিস।’
‘মুখ খারাপ করিস না।’
‘ভালো কথা বললেও তোর মুখ খারাপ হয়। মন খারাপ হয়। মেজাজ খারাপ হয়। সব খারাপ শুধু তোর-ই কেন হয় বল তো?’
‘ধুর! তোর সাথে ঝগড়া পরে করব। এখন আমার কাজ আছে। ফোন রাখি।’
রেশমি জিজ্ঞেস করল,’তোর আবার কী কাজ?’
‘রোমান্টিক বানাতে হবে না দুইটারে? সেই কাজ।’
সবাই হেসে বলল,’অল দ্য বেস্ট।’
ফোন রেখে সোফার ওপর পা উঠিয়ে বসল লামিয়া। অ্যানিওন ওর সামনে ফ্লোরে বসে রয়েছে। ক্যাথিওন অর্ষার পিছু পিছু কিচেনে গিয়েছে।
লামিয়া অ্যানিওনের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বলল,’কী ব্যাপার বিল্লু? কী দেখো? তোমাদের বাড়ির কর্তা আর কর্তী যে এত আনরোমান্টিক জানো সেটা?’
অ্যানিওন ম্যাউ ম্যাউ করে ওঠে।
‘ম্যাউ ম্যাউ করো কেন? জানো নাকি জানো না? আচ্ছা যাই হোক, তুমি চুপ করে বসে থাকো। আমি কাজ করি।’
এরপর সে ফোনটা হাতে নিয়ে কী যেন করতে থাকে। অর্ষা জুস নিয়ে আসলে সে না তাকিয়েই বলল,’রাখ টেবিলের ওপর।’
জুসের গ্লাস রেখে অর্ষাও পাশে বসে। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ধৈর্যহারা হয়ে বলল,’এত মনোযোগ দিয়ে ফোনে কী করছিস?’
‘কাজ করছি।’
‘কাজ? কী কাজ?’
‘রোমান্টিক হওয়ার উপায় খুঁজতেছি গুগলে।’
‘কী! পাগল হয়ে গেছিস নাকি তুই? মাথা ঠিক আছে?’
‘সবই ঠিক আছে। শুধু তোরাই ঠিক নেই। আনরোমান্টিকের বস্তা!’
অর্ষা এবার লামিয়ার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল,’এত মহান কাজ করার কোনো দরকার নেই ম্যাম। আপনি জুস খান।’
লামিয়া জুসের গ্লাস নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল,’আচ্ছা বেশ। গুগল-টুগল বাদ। আমি নিজে থেকে তোকে কিছু ট্রিক্স শেখাচ্ছি।’
‘চুপ করবি?’
‘না। আচ্ছা তোরা কখনো চু’মু খেয়েছিস?’
অর্ষা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। লামিয়া উৎসাহের সাথে কাছে এসে শরীর ঘেঁষে বসে। হাত ধরে বলে,’আহা! লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আমিই তো! বল না।’
‘প্লিজ! তোর এসব ফা’উ’ল কথা বাদ দে বইন।’
‘শোন, এগুলা ফা’উ’ল কথা না। রোমান্টিক কথা। তোরা যদি এমন আনরোমান্টিক থাকিস তাহলে আমাদের গ্যাঞ্জাম পার্টির আর খালা, মামা কিছু হওয়া লাগবে না। আমি তোকে শিখিয়ে দিলে সমস্যা কী?’
‘রাখ তো! সে যে কত রোমান্টিকতা বোঝে তা আমার জানা হয়ে গেছে। সেদিন তোদের কথামতো রাগ ভাঙানোর জন্য গান শুনালাম তাকে ডেডিকেট করে। তার পছন্দের খাবার রান্না করলাম। তার জন্য শাড়ি পরলাম। সাজলাম। আর সে কিনা! মানে কী বলব আর! জাস্ট বিরক্ত লাগে আমার।’
‘এই যা! তুইও দেখি তার ওপর রেগে আছিস?’
‘এমন করলে রাগ হবে না?’
‘অবশ্যই হবে। থাক, ব্যাপার না। এখন তো আমি এসেই পড়েছি। সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।’
‘বাদ দে তো। তোর কিছু করা লাগবে না। তোরা ঘুরতে এসেছিস। ঘোরাফেরা কর। ইনজয় কর। ঐ ব্যাটাকে রোমান্টিসিজম বোঝাতে হবে না। শেখাতেও হবে না।’
‘শোন, রোমান্টিসিজম সব মানুষের মধ্যেই থাকে। কেউ প্রকাশ করতে পারে, আবার কেউ প্রকাশ করতে পারে না। সমস্যাটা হয় তোর মতো লাজুক আর তার মতো চাপা স্বভাবের মানুষদের জন্য।’
অর্ষা এই বিষয়ে আর কিছু না বলে অন্য কথা বলল,’কিছু খাবি? বানিয়ে দেবো?’
‘উম! চটপটি খেতে ইচ্ছে করছে খুব। বানিয়ে দিবি?’
‘অবশ্যই। তোর যা খেতে ইচ্ছে করবে আমাকে বলবি শুধু।’
লামিয়া খুশিতে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে বলল,’থ্যাঙ্কিউ জানু।’
অর্ষা কিচেনে যাওয়ার পর লামিয়া লিলিয়ার রুমে গেল। লিলিয়াকে বলল, সে যেন অর্ষাকে সাহায্য করতে না যায়। লিলিয়া জানতে চাইল,’ম্যামের সাথে তোমার কথা হয়েছে?’
লামিয়া এক চোখ টিপে বলল,’হ্যাঁ। আন্টির সাথে কথা হয়েছে।’
এরপর সে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। লিলিয়া মুচকি হাসে। লামিয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে গার্ডেনে যায়। সেখানে বেঞ্চে বসে আহনাফ আর নিহাল গল্পগুজব করছিল। লামিয়াও ওদের সাথে যোগ দেয়। আহনাফ ভয়ে ভয়ে থাকে। কখন আবার মুখ ফসকে কী বলে ফেলে কে জানে!
লামিয়া মুখটা অপরাধীর মতো করে বলল,’আমরা এসে আপনাদের ঝামেলায় ফেলে দিলাম তাই না ভাইয়া?’
‘এসব কথা কেন বলছ? অবশ্যই এমন কিছু নয়।’ বলল আহনাফ।
‘এমন কিছুই। আসার পর থেকে অর্ষা এটা, সেটা রান্না করছে। এখন আবার একা একা আমার জন্য চটপটি বানাচ্ছে। আমি কত করে বললাম, আমিও একটু হেল্প করি। শুনলই না। উলটো বলল আমি যেন নিহালের সাথে সময় কাটাই। তাই বললাম, তাহলে মেইডকে ডাক। মেইডের নাকি হঠাৎ করেই শরীরটা খারাপ তাই অর্ষা একাই সব করবে। এখন আমার খুব খারাপ লাগছে ভাইয়া।’
আহনাফ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’তুমি টেনশন কোরো না। আমি আছি তো! তোমরা গল্প করো। আমি যাচ্ছি ওর কাছে।’
আহনাফ চলে যাওয়ার পর লামিয়া খিলখিল করে হেসে ওঠে।
চুলোয় ডাবলি বুট আর আলু সেদ্ধ দিয়ে টক আগে বানিয়ে ফেলেছে অর্ষা। এখন কাঁচা মরিচ, পেয়াজ, শসা কুচি করছিল। আহনাফ তখন রান্নাঘরে আসে। অর্ষা একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। সে ভেবেছিল হয়তো কিছু নিতে এসেছে। কিন্তু যখন দেখল, আহনাফ কিছু নিচ্ছে না, আবার যাচ্ছেও না তখন ঘুরে তাকাল।
গম্ভীরকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,’কিছু খুঁজছেন?’
আহনাফও গম্ভীর হয়ে বলল,’না। তোমাকে হেল্প করতে আসলাম।’
‘দরকার নেই।’
‘কেন দরকার নেই?’
‘কারণ আমি পারব তাই।’
‘তুমি পারবে তো কী হয়েছে? ওরা তো আমারও গেস্ট। আমিও ওদের আপ্যায়নে অংশগ্রহণ করতে চাই।’
‘লাগবে না বললাম না?’
‘তোমার হেল্প না লাগলে নাই। বাট আমি হেল্প করব। কী করা লাগবে বলো? কোনটা বাকি আছে?’
‘কিছুই বাকি নেই। এগুলো কাটা হলেই হয়ে যাবে। টকও বানিয়ে ফেলেছি।’
‘তো বেশ! আমিও কাটব।’ বলে আহনাফ অর্ষার পেছনে দাঁড়াল। অর্ষার দু’হাতের ওপর নিজের দু’হাত রেখে সেও কাটাকুটির জন্য প্রস্তুত হয়।
আহনাফের হঠাৎ করে এভাবে সজ্ঞানে এত কাছে আসায় চমকে ওঠে অর্ষা। শিড়দাড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দটা আবার শুরু করেছে। সে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আহনাফকে দেখার চেষ্টা করল। লজ্জায় তা আর হয়ে উঠল না। অর্ষার হাত চলছে না বলে, আহনাফ নিজেই এবার অর্ষার হাত ধরে শশা কুচি করছে। আর অর্ষা যেন রোবটের মতোই কাজ করে যাচ্ছে।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]