যেদিন তুমি এসেছিলে পর্ব ১৮

0
641

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_১৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
চমৎকার ভোরের দর্শন মেলে ভোর সকালে। মাঝরাতে বৃষ্টি হয়েছিল; যার নিদর্শন রয়ে গেছে ভোরেও। সোফায় শোয়ার দরুণ ঘুম তেমন একটা ভালো হয়নি অর্ষার। তবে সে ঘুমিয়েছে। শরীরে আর দু’চোখের পাতায় যখন ক্লান্তি থাকে, ঘুম তখন আর স্থান, কাল, পাত্র খোঁজে না। একটু ঘুমাতে পারলেই তখন জগৎ শান্তি।

রুমের মাঝে এখনো আবছা অন্ধকার। ঘুম ভাঙার পর কিছুক্ষণ থম মেরে স্থির হয়ে বসে থাকে অর্ষা। বারবার আল্লাহর কাছে দু’আ করছে যেন গতকালের সকল ঘটনা তার স্বপ্ন হয়। অথবা ভ্রম! সবটাই যে বাস্তব সেটা সে উপলব্ধি করতে পেরেছে মশার কামড় খেয়ে। ফজরের নামাজ পড়ার সময় এখনো আছে নাকি দেখা দরকার। দেয়াল ঘড়িটা যেই দিকে আছে সেদিকে এগিয়ে যায় সে। মুখটা কাছে নিয়ে সময় দেখার চেষ্টা করে। যাক, ভাগ্য ভালো। সময় আছে এখনো। সে চটজলদি ওয়াশরুমে চলে যায় অজু করার জন্য। অজু শেষ করে ঘরে এসে বিছানার দিকে তাকায়। আহনাফ এখনো ঘুমে বিভোর। একমনে ভাবল নামাজ পড়ার জন্য ডাকবে। আবার ভাবল, যদি রাগ করে? তাই সে সময় থাকতে নিজের নামাজটুকু আদায় করে নেয়।

খুব সন্তর্পণে বারান্দার দরজা খোলে। বৃষ্টির পানিতে বারান্দার ফ্লোর একদম টইটুম্বুর। গ্রিলে লেগে আছে এখনো বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোটা। অর্ষার যেটা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগল তা হচ্ছে বারান্দায় থাকা অপরাজিতা ফুলের গাছ। নীল রঙের ফুলগুলো বৃষ্টিস্নাতে আরো মোহনীয় ও আকর্ষণীয় হয়ে রয়েছে। আহনাফ কালেভদ্রে বাংলাদেশে আসে। তবুও বারান্দায় কত গাছ-গাছালি। এগুলোর দেখাশোনা কে করে? আমেনা বেগম নয়তো রেণু আপা নিশ্চয়ই। সে এগিয়ে গিয়ে অপরাজিতা ফুলকে ছুঁয়ে দিলো। মনটা এখন একটু একটু ভালো লাগছে। সে আকাশপানে তাকায়। আগে তার মন খারাপ হলেই সে আকাশের দিকে তাকিয়ে কথা বলত। কী বলত জানা নেই। অনেক কথাই বলত। নিজের সুখ, দুঃখ সবকিছু সে আকাশপানে তাকিয়ে আল্লাহকে বলত। এতে বিশেষ উপকারিতা কী তা সে জানে না; কিন্তু মন ভালো হয় এর সাক্ষী সে নিজেই।

ঘরের দরজায় করাঘাতের শব্দ হচ্ছে। সঙ্গে অস্পষ্টভাবে কারও গলার স্বরও শোনা যাচ্ছে। সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায় দরজা খুলতে। বাইরে আফরিন দাঁড়িয়ে আছে।

অর্ষাকে দেখেই মিষ্টি করে হেসে বলল,’শুভ সকাল।’

অর্ষা ম্লান হেসে বলল,’শুভ সকাল।’

‘ফ্রেশ হয়েছ?’

‘হ্যাঁ।’

আফরিন অর্ষাকে একবার আগাগোড়া পরখ করে বলল,’একেবারে গোসল করে শাড়ি পালটে ড্রয়িংরুমে আসো। চা খাবে? পাঠিয়ে দেবো?’

‘চা খাব না।’

‘আচ্ছা।’ বলে আফরিন ঘরে একটু উঁকি দিলো। চাপাস্বরে অর্ষাকে বলল,’ভাইয়া এখনো ঘুমাচ্ছে?’

অর্ষা উপর-নিচ মাথা দোলাল।

‘আচ্ছা তুমি রেডি হয়ে নাও।’

আফরিন চলে যাওয়ার পর দরজা চাপিয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অলসতা তার কোনোকালেই ছিল না। সে কাজ করতে সদা তৎপর। তবে আজ অলসতা যেন প্রতিটি অঙ্গে অঙ্গে মিশে আছে। সে অলস ভঙ্গিতে রুমের এক কোণে পড়ে থাকা লাগেজের কাছে যায়। শাড়ি বের করে সোফার ওপর রাখে। পেটিকোট, ব্লাউজ আর ওড়না নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে গোসল করতে। আহনাফ ঘুম থেকে ওঠার আগেই গোসল সেরে শাড়িটা পরে ফেলতে হবে।

কিন্তু বিধিবাম! অর্ষা গোসল সেরে এসে দেখে আহনাফ বিছানায় নেই। তার মানে ঘুম থেকে উঠে গেছে। ঘরেও তো নেই। সে দ্রুত শাড়ি পরার চেষ্টা করল। শাড়ি পরার সময় আয়নায় দেখতে পেল, আহনাফ বারান্দা থেকে রুমে আসছে। অর্ষা লজ্জায়, সংকোচে কাবু হলেও আহনাফ একবারও চোখ তুলে এদিকে তাকায়নি। সোজা ওয়াশরুমে চলে গেছে। অর্ষার বুকচিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে।

শাড়ি পরা শেষ করে চুল আঁচড়াচ্ছিল ঐ সময়ে আবার দরজায় নক করে কেউ।

অর্ষা ভেতর থেকেই বলল,’দরজা খোলা আছে।’

সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে ঘরে প্রবেশ করে গ্যাঞ্জাম পার্টি। লামিয়া, রেশমি, জুঁই দৌঁড়ে এসে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে। অর্ষা কেঁদেই ফেলে। গতকাল থেকে যেই একাকিত্ব ফিল তার হচ্ছিল; এতক্ষণে সেটা ঘুচল।

লামিয়া ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,’কাঁদিস কেন বোকারানী?’

অর্ষা নিরবে শুধু কাঁদছেই। ওরা আবার ও’কে জড়িয়ে ধরে আদুরেকণ্ঠে বলল,’ওলে ময়নাপাখিটা! জান, বাবু কাঁদে না।’

আশিক বলল,’তোদের ন্যাকামিতে কি ওর কান্না থামবে? দাঁড়া আমি কবিতা শোনাচ্ছি। তার আগে তোরা সামনে থেকে সর।’ বলে সে নিজেই দু’হাতে ওদেরকে ঠেলে সরিয়ে দেয়।

অর্ষার ডান হাতের আঙুল ধরে ও’কে ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,’শুভলগ্নে করিস না কান্নাকাটি
তুই হচ্ছিস পাকা আম,
জিজু সেই আমের আঁটি।’

ওর উদ্ভট কবিতা শুনে কান্নার মাঝেই অর্ষা হেসে ফেলে। কী অদ্ভুত অনুভূতি তাই না? কাঁদতে কাঁদতে হাসার অনুভূতিটা আসলেই সুন্দর।

ওদের হাসি-ঠাট্টার মাঝেই আহনাফ ওয়াশরুম থেকে বের হয়। ওরা ওদের মতো এতটাই ব্যস্ত যে আহনাফের উপস্থিতিও টের পায়নি। সবাই ভালো আছে। খুশি আছে। শুধু ভালো নেই আহনাফ। মনে মনে সে এগুলোই ভাবছিল তখন দিদার আগে ও’কে দেখে।

একটু অপ্রস্তুতভাবে সকলকে দেখিয়ে বলল,’ঐতো দুলাভাই! ভালো আছেন ভাইয়া?’

আহনাফ ভদ্রতাসূচক মৃদু হেসে মাথা দোলাল। সেখানে আর না দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বাইরে বেরিয়ে যায়।

ওরা কিছুক্ষণ যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে অর্ষাকে বলল,’ভাইয়া কি রেগে আছে? নাকি মন খারাপ।’

অর্ষার ঠোঁটের হাসিও এবার মিলিয়ে যায়। গতকাল রাতে আহনাফের রাগগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। সে মাথা নত করে বলে,’দুটোই।’

রেশমি অর্ষাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,’থাক মন খারাপ করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।’

অর্ষা এ কথার কোনো প্রত্যুত্তর না করে বলল,’আহিল কোথায় রে? ও’কে তো আর দেখলাম না। তোদের সাথে দেখা হয়েছে?’

জুঁই মুখটা মলিন করে বলল,’দেখা হয়নি। রেগে আছে মনে হয়।’

‘ও কেন রাগ করবে? রাগ করার কথা আমার। ওর ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে হবে এটা জেনেও কেন ও কিছু বলল না? তোদের সাথে আহিলও তো জানে, আমি এখনই বিয়ে করতে চাইনি। নিজের একটা পরিচয় করতে চেয়েছিলাম। প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিলাম। তোদের না হয় কিছু করার ছিল না। কিন্তু ও তো পারত! তাহলে ও কেন আমাকে সাপোর্ট করল না?’ কথাগুলো বলতে বলতে অর্ষা ফুঁপিয়ে ওঠে।

আশিক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,’আহিলকে ভুল বুঝিস না বাবুই। ও কিছুই জানত না। বিয়ের পর সব জেনেছে। ও তো গেছিল ছোটো ফুপিকে এয়ারপোর্ট থেকে আনতে। আমরা আর ওর পরিবার কেন আগে কিছু জানাইনি এজন্য রেগে আছে।’

অর্ষার এবার নিজের ওপর রাগ, দুঃখ দুটোই লাগছে। না জেনে-বুঝে সে উলটো আহিলকে ভুল বুঝেছে।
____
ড্রয়িংরুমে আত্মীয়-স্বজনের মাঝে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে আহনাফ। সবাই রিসিপশনের আয়োজন নিয়ে আলাপ করছিল।

আহনাফ রাগের সঙ্গে বলে,’কীসের রিসিপশন? আমি কোনো রিসিপশনে যাব না।’

আমেনা বেগম অস্থির হয়ে বললেন,’এমন করে না বাবু। কত মানুষজনকে ইনভাইট করা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া সবকিছুর আয়োজন করা হয়েছে। বোঝার চেষ্টা কর।’

‘আমার কিছু বোঝা লাগবে না। প্রথম ভুলটা আমার ছিল। ভালোলাগাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছি। শত শত মানুষের সামনে অপমানিত হয়েছি। আর দ্বিতীয় ভুলটা করেছ তোমরা। তোমরা কেন কেয়ার বদলে অর্ষার সাথে আমার বিয়ের এনাউন্স করলে? এখন আমাদের ভুলের মাশুল এই নির্দোষ মেয়েটা কেন দেবে বলো? একটাবারও তোমরা আমার মতামত জানার কোনো প্রয়োজন মনে করলে না। তোমাদের সম্মান বাঁচাতে গিয়ে, ঐ মেয়েটার সম্মানের কথা ভাবতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে আমায় বিয়েটা করতে হলো। কিন্তু তোমরা জানো কতটা খারাপ লাগে আমার? অর্ষাকে দেখলেই আমার কেয়ার কথা মনে পড়ে। আমি সহ্য করতে পারি না। অপমানে, ঘৃণায় শরীর শিউড়ে ওঠে। অনেক হয়েছে। আমি আর কিছু করতে পারব না ব্যস!’ কথাগুলো বলে হাতে থাকা তোয়ালেটি পেছনের দিকে ছুঁড়ে মারে আহনাফ। চলে যাওয়ার সময় দেখতে পায় তোয়ালে পড়েছে অর্ষার গায়ে।

অর্ষা তোয়ালেটা হাতে নিয়ে ছলছল দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। শেষের অনেকগুলো কথাই সে শুনেছে। আহনাফ একবার ওর দিকে তাকিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। অর্ষা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে তার।

নিস্তব্ধ, গুমোট পরিবেশের রেশ কাটাতে খালামনিরা আর ফুপি অর্ষার হাত ধরে এনে তাদের মাঝখানে বসায়। চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,’আমেনা কী মেয়ে এনেছিস? বাচ্চা মেয়ে। শুধু কান্না করে।’

ছোটো ফুপি বলল,’বাচ্চারা একটু কাঁদেই বুঝছ। চকোলেট দিলেই দেখবে কান্না থেমে যাবে। আমি তো আসার সময় অনেকগুলো চকোলেট নিয়ে এসেছি। অর্ষা চকোলেট খাবে তো?’

অর্ষা নিরব রইল। এখনো তার দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। আনন্দের নাকি কষ্টের বোঝা কষ্টকর। বাড়ির মানুষগুলো তার প্রত্যাশার চেয়েও ভালো। আর যাই হোক, অন্যদের মতো ধনী-গরীব বাছ-বিচার করেনি। তাহলে হয়তো তার কষ্টের সীমাটুকুও আর অবশিষ্ট থাকত না। সবার সাথে চুপচাপ বসে থাকে সে। তারা আহনাফ, আফরিন আর আহিলের ছোটোবেলার গল্প শোনাচ্ছে। কিছু গল্প শুনে অর্ষা আনমনেই হেসে ওঠে।

আমেনা বেগম আফরিনের উদ্দেশ্যে বললেন,’আহিল কি ঘুম থেকে উঠেছে?’

‘হ্যাঁ। ওর বন্ধুরা তো ওর ঘরেই।’

‘কারও-ই তো নাস্তা করা হয়নি। আমি খাবার ট্রে-তে দিচ্ছি। বন্ধুরা সব ঘরে বসেই আড্ডা দিতে দিতে খেয়ে নেবে।’

আফরিন এগিয়ে গিয়ে মাকে চাপাস্বরে বলল,’মা, আহিল কিন্তু আমাদের ওপর খুবই রেগে আছে। সবাইকে দেখাচ্ছে, ও খুব স্বাভাবিক আছে। আসলে কিন্তু তা নয়।’

আমেনা বেগমের চোখে-মুখে ত্রাসের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। কনে বদল হওয়ার বিষয়টি এবং সেই কনে যে অর্ষা সেটা ছেলেকে না জানানোর অপরাধবোধ তার মনেও হচ্ছে।

সে চিন্তিত মনে ট্রে-তে নাস্তা সাজাচ্ছেন। শেষ হলে আফরিনকে বললেন,’অর্ষাকে সাথে নিয়ে যা। ও’কে দেখলে রাগ কমতে পারে।’

আফরিন তা-ই করল। অর্ষাকে নিয়ে গেল নাস্তা দিতে। নাস্তা আর অর্ষাকে রেখে সে বের হয়ে আসে। বন্ধুদের মাঝখানে না থাকাটাই উত্তম। আহিল একবার শুধু চোখ তুলে তাকিয়ে অর্ষাকে দেখেছে। এর পূর্বেও সে অর্ষাকে অনেকবার শাড়ি পরতে দেখেছে। কখনো তো অন্যরকম লাগেনি। আজ তাহলে এমন অন্যরকম লাগছে কেন? পূর্ণাঙ্গ মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। তবে বাকি সবার মতো যে অর্ষার ওপর-ও তার চাপা অভিমান রয়েছে সেটি স্পষ্ট হয়েছে অর্ষার এখানে আগমনের পর।

অর্ষা সবাইকে নাস্তা এগিয়ে দিয়ে আহিলেরটাও এগিয়ে দিলো। আহিল পূর্ণদৃষ্টি কিন্তু দৃষ্টিতে চাপা ক্ষোভ রয়েছে এমনভাবে বলল,’বাড়ির বউয়ের দায়িত্ব পালন করছিস?’

অর্ষা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বাকিরা নিরব দর্শক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। এ কথার প্রত্যুত্তরে অর্ষার ঠিক কী বলা উচিত? সে জ্ঞানশূন্য দৃষ্টিতে শুধু ফ্যালফ্যাল করেই তাকিয়ে রইল।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ভয়ে ভয়ে লামিয়া বলল,’তুই ওর সাথে কেন এভাবে কথা বলছিস?’

আহিল রক্তবর্ণ চক্ষু দ্বারা লামিয়ার দিকে তাকালেও শান্তকণ্ঠে বলল,’সবচেয়ে বেশি দোষ কি ওর নয়? ও কি পারত না আমি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে?’

‘দোস্ত পরিস্থিতিটা আসলে কীরকম ছিল তোকে ঠিক বোঝানো সম্ভব নয়। নইলে তুই-ই ভাব মস্তিষ্ক কতটা ফাঁকা হলে তোর পরিবার, এমনকি আমরাও তোকে খবরটা জানাতে ভুলে গেছি?’ বলল রেশমি।

আহিল শ্লেষেরসুরে বলল,’এক্সকিউজ চাইলে অনেকভাবেই দেখানো যায়। ব্যাপার না।’

আহিলের তীক্ষ্ণ রাগের সামনে অর্ষার কথা বন্ধ। মুখ ফুটে একটা কথাও সে বলতে পারছে না। নিদেনপক্ষে সে যে কতটা পরিস্থিতির শিকার ছিল এটা কীভাবেই বা তার প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে বোঝাবে?

পরিস্থিতি ধীরে ধীরে ভারী থেকেও ভারী হয়ে উঠছিল। কথার স্রোত কোথা থেকে কোথায় গিয়ে ঠেকবে বোঝা মুশকিল। তাই আশিক চেষ্টা করল পরিস্থিতিটা অন্তত স্বাভাবিক করার।

সে আহিলের ওয়ারড্রবের ওপর থেকে আহিলের গিটার এনে অর্ষার হাতে দিয়ে বলল,’মান-অভিমান পরে হবে ভাই। আগে একটা গান হোক। ওয়েদার কিন্তু জোশ!’

অর্ষার গান গাওয়ার মুড নেই। আর না আছে গলার জোর। আশিক কোন সেন্সে এখন তাকে গান গাইতে বলছে বুঝতে পারছে না সে। পরক্ষণে আশিকের ইশারায় বুঝে নিল, হয়তো তার গান শুনে আহিলের রাগ কমতে পারে। তাই অনিচ্ছা কিন্তু সর্বোচ্চ চেষ্টার সহিত গ্যাঞ্জাম পার্টির প্রিয় গানটি গাওয়া শুরু করে সে। সাথে গিটারের টুংটাং আওয়াজ। গিটার বাজানো সে আহিলের থেকেই শিখেছিল।
সে কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে গান শুরু করে,

‘‘পুরো পৃথিবী একদিকে
আর আমি অন্যদিক,
সবাই বলে করছ ভুল আর
তোরা বলিস ঠিক।
তোরা ছিলি তোরা আছিস
জানি তোরাই থাকবি,
বন্ধু বোঝে আমাকে
বন্ধু আছে আর কি লাগে?’’

গান শেষেও আহিলকে দেখা যায় ফোনে বুদ হয়ে থাকতে। যেন সে কোনো গান-ই শুনতে পায়নি। সবাই ভেবেছিল আহিলের হয়তো এতে রাগ ভাঙবে। কিন্তু তাও রাগ ভাঙেনি। উলটো আহিল ঘর থেকেই চলে যায়।

দুপুরের মধ্যেও আহিলের আর কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া গেল না। বন্ধুরা সব খেয়ে-দেয়ে দুপুরেই চলে যায়। আবারও বাড়িতে একা হয়ে যায় অর্ষা। জহির চৌধুরী আহনাফের মনের কথা ভেবে শেষমেশ রিসিপশনের অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে দেন।

অর্ষা আফরিনের রুমে শুয়ে ছিল। সেই সময়ে রেণু এসে বলে,’আপা কি ঘুমাইছেন?’

অর্ষা মাথা একটু উঁচু করে বলল,’না। কিছু বলবেন?’

‘না মানে ঘরডা পরিষ্কার করতাম।’

অর্ষা বুঝল না পরিপাটি করা ঘর আর কি পরিষ্কার করার আছে? তাকে চুপ থাকতে দেখে রেণু বলল,’বেশিক্ষণ লাগব না। আপনে ততক্ষণ বড়ো ভাইজানের ঘরে থাহেন। আমি ডাক দিমুনে।’

অর্ষার যা বোঝার বুঝে নিল। দুই মেরুর দুজন মানুষকে শুধু শুধু কাছাকাছি আনার বৃথা চেষ্টা করছে বাড়ির মানুষজন। সে একমনে ভাবল ড্রয়িংরুমে যাবে। কিন্তু সেখানে মানুষ গিজগিজ করছে। তাই সে আহনাফের রুমেই গেল। রুম ফাঁকা। সম্ভবত আহনাফ বারান্দায় আছে।

অর্ষা পা টিপে টিপে বারান্দার দরজায় যায় দেখার জন্য, আহনাফ সেখানে আছে কিনা। তার ধারণাই ঠিক। প্যান্টের পকেটে দু’হাত রেখে সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দৃষ্টি বারান্দার বাইরে। অর্ষা ফিরে আসছিল আহনাফ তখন পিছু ডেকে বলল,’শোনো।’

অর্ষা চমকে যায়। পা টলছে না যেন।ভয়ে ভয়ে আহনাফের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। আহনাফের দৃষ্টি তখনো বাইরে।

সে কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,’তোমার নূপুরের আওয়াজ শুনে বুঝেছি তুমি এসেছ।’

অর্ষা নিশ্চুপ। শুধু মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।

প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে আহনাফ বলল,’ভাগ্য মানুষকে কোথায় এনে দাঁড় করায় তাই না? কখনো কি ভেবেছি, তোমার সাথে কথা বলতে হলে তোমার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করবে না? হ্যাঁ, সত্যিই তোমার দিকে আমার তাকাতে ইচ্ছে হয় না এখন। কষ্ট হয়। এরচেয়েও বেশি হয় রাগ। আর এই রাগটুকু আমি কিছুতেই সংবরণ করতে পারি না। কখনো ভাবিনি ভালোলাগাও মানুষকে এভাবে পালটে দেয়। এতদিন তো ভালোবাসার নানাবিধ, নানারকম গল্প শুনতাম। আর আমার বেলায় হলো কী? শুধুমাত্র ভালোলাগাটুকুই আমায় কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে দেখো। তবে তোমার আর কেয়ার মাঝে একটুখানি যোগসূত্র রয়েছে। কেয়ার প্রতি ভালোলাগাটা শুরু হয়েছিল তোমার মাধ্যমেই। সেই বৃষ্টির রাতে যখন দেখলাম, তোমার আপন ভাই তোমায় ভাবির হাত থেকে বাঁচাতে না এলেও কেয়া এসেছিল। তারপর কীভাবে যে ভালোলাগাটা বেড়েছিল আমি জানিনা। প্রথম কোনো মেয়ের প্রতি আমার সফ্ট কর্ণার কাজ করেছে; আর সেই মেয়েটা তুমি। ছোটোবেলা থেকেই আমি মেয়েদের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতাম। মা আর আফরিন ব্যতীত মেয়েদের সঙ্গ আমার খুবই কম। কেয়ার সাহায্যকারী মনোভাব, ভালো ব্যবহার এসব দেখেই ও’কে ভালো লেগেছিল। অন্যদিকে তোমার বোকা বোকা চাহনী, তোমার অসহায়ত্ব, তোমার ওপর অত্যাচার, শো-রুমে কাজ করার সময় ঘর্মাক্ত মুখশ্রী এসব ছিল তোমার প্রতি আমার সফ্ট কর্ণারের অন্যতম কারণ। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস; ভালোলাগা অপমান করে সফ্ট কর্ণারকে জীবনের সাথে যুক্ত করে দিয়ে গেল। যার প্রতি না চাইতে ও প্রতিটা মুহূর্তেও আমার অসহ্য ফিল হচ্ছে।’

একটু থেমে সে অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল,’যদি আমি তোমাকে একেবারে ছেড়ে দেই, তুমি আমায় ক্ষমা করবে তো?’

অর্ষা এতক্ষণ মাথা নত করেই আহনাফের কথাগুলো শুনছিল। শেষ কথাটি শুনে সেও আহনাফের দিকে তাকায়। কথাটা কি বুকে লাগল? আহনাফ এভাবে কেন বলল? আর বলল-ই না হয়; অর্ষার কেন এমন লাগছে? এত খারাপ অনুভূতি কেন হচ্ছে? আহনাফের মতো তারও তো আহনাফের প্রতি কোনো অনুভূতি নেই, ভালোলাগা, ভালোবাসা কিছুই নেই। তবে? বৈবাহিক পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ বলে?

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here