#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_১৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
গ্যাঞ্জাম পার্টি এই প্রথম উপলব্ধি করল এই গ্যাং-এর কোনো একটি সদস্য ব্যতীত কতটা প্রাণহীন এই গ্যাঞ্জাম পার্টি। অর্ষার বাড়িতে গিয়ে অর্ষাকে পাওয়া যায়নি। কুসুম কাঠ কাঠ গলায় বলে দিয়েছিল, অর্ষার চাকরী হয়েছে। ওরা যেন আবার সেখানে গিয়ে কোনো তুলকালাম কাণ্ড না বাঁধায়। নিহাল এবং সুবাস না থাকলে গ্যাঞ্জাম পার্টির একজনও আজ কোত্থাও ঘুরতে যেত না। কিন্তু ওরা থাকায় অগত্যা সকলকেই যেতে হলো। তবে আড্ডা, ভ্রমণ কোনোটাই জমেনি। পুরো সময়টা ছিল নিষ্প্রাণ।
আহিলের মেজাজ ছিল তুঙ্গে। একটা দিনও রেস্ট নিতে দিলো না মেয়েটাকে! সে মনেপ্রাণে দোয়া করল এমন ভাই-ভাবি যেন আল্লাহ্ কোনো মেয়েকে না দেয়।
.
.
রাতে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফেরে অর্ষা। কেয়ার ছুটি ওর আগেই হয়েছিল। শরীরে যেন একটুও শক্তি আর অবশিষ্ট নেই। সেলসম্যানের কাজ যতটা সহজ সে ভেবেছিল তার চেয়েও বেশি কষ্টের। সারাটাদিন দৌঁড়াদৌঁড়ি আর কাজের ওপর। একটুখানি রেস্ট করার সময় নেই। রাতে সে কোনো রকম দুটো খেয়ে শুয়ে পড়ে। বিছানায় শরীর রাখতেই প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ব্যথা অনুভব করে। হাত-পা টান করতেই আস্তে আস্তে আরাম অনুভব করে সে। যত তাড়াতাড়ি কাজটির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে ততই তার জন্য ভালো।
কাৎ হয়ে শুয়ে কেয়ার দিকে তাকায়। কেয়া ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। তার দু’চোখের পাতায়ও অজস্র ঘুম। চোখ খুলে রাখা দায়। হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায় বন্ধুদের কথা। কাজের চাপে ওদের কথা মনে পড়ারও সুযোগ হয়নি। বাড়ি এসে যখন ও’কে পায়নি তখন নিশ্চয়ই ওরা কষ্ট পেয়েছে? রাগ করেছে কী? বন্ধুদের নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে করতেই ঘুম চলে আসে অর্ষার। শরীর এতটাই ক্লান্ত ছিল যে ফজরের সময়ও ঘুম ভাঙেনি।
কুসুম নিজেই উঠে এসে ডাকে। ভদ্রভাবে নয়। তার স্বভাবসুলভভাবেই ডেকে বলেছিল,’চাকরী নিয়েছিস বলে কি বাড়ির কাজকর্ম কিছু করা লাগবে না? সারাদিন সব কাজ তো আমাকেই করতে হবে। সকালে রান্নাটা তো অন্তত তুই করতে পারিস।’
ভাবির কথার উত্তর দেয়নি অর্ষা। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে অজু করে। নামাজ আদায় করে রান্না বসায়। উঠান ঝাড়ু দেয়। যা তার নিত্যকর্ম সব শেষ করে গোসল করে। খেয়ে-দেয়ে কেয়ার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ে।
রিকশায় বসে কেয়া জিজ্ঞেস করে,’রাতে কখন এসেছিস?’
‘সাড়ে দশটায়।’
‘দশটা পর্যন্ত জেগে ছিলাম। এরপর দেখি ঘুমে আর তাকিয়ে থাকতে পারছি না। তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’
উত্তরে অর্ষা মৃদু হাসল। কেয়া জিজ্ঞেস করল,’কাজ করতে কেমন লাগছে?’
‘ভালোই।’
‘প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবেই। পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু একটু সাবধানে থাকবি। মালিকের বউ যে দজ্জাল তা কিন্তু আগেই বলেছি।’
‘সব মালিকরাই কি এমন হয়?’
‘না। আমার মালিক তো অনেক ভালো। এখানে আপাতত কোনো লোক লাগবে না। যদি লাগে আমি তোকে এখানে নিয়ে আসব।’
‘আচ্ছা।’
কর্মস্থানে এসে রিকশা থেকে নামে দুজন। অর্ষার শো-রুমের তিনটা শো-রুম পরে কেয়ার শো-রুম। অর্ষা ভেতরে গিয়ে দেখে হাফিজ নামের ছেলেটা ফ্লোর ঝাড়ু দিচ্ছে।
জিসান নামের ছেলেটি জুতার ধুলাবালি পরিষ্কার করছে। অর্ষা কী করবে বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ বাদেই মালিকের বউ আসে। উনার নাম কামরুন নাহার। দেখতে বেশ মোটাসোটা, স্বাস্থবতী। গায়ের রং কালো। মুখে সবসময় রাগী রাগী ভাব থাকে একটা। দেখলেই ভয় লাগে।
কামরুন নাহার চেয়ারে বসে জিসানকে বললেন,’জিসান তুই সর। এই নতুন মেয়েটা জুতা পরিষ্কার করুক।’
জিসান একবার অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল,’সমস্যা নাই ম্যাডাম। আমি পারব।’
‘এত কথা বলিস ক্যান? কাজ করতে আসছে। কাজ না করিয়ে কি বসিয়ে রাখব?’
জিসান এ কথার পিঠে আর কিছু বলল না। অর্ষা এগিয়ে গিয়ে বলল,’কী করতে হবে?’
জিসান একটা সুতি কাপড় দিয়ে বলল,’আপনি এই সাইডের জুতাগুলো পরিষ্কার করুন। আমি এই সাইডেরগুলো করছি।’
অর্ষা মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। জুতা সব পরিষ্কার করা হলে অর্ষা পেছনের সাইডে গিয়ে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে কাস্টমার আসা শুরু করে। শো-রুমের মালিক এসে জিসানকে দায়িত্ব দেয় অর্ষাকে যেন সমস্ত কাজ শিখিয়ে দেয়।
অর্ষা কাপড়-চোপড় ভাঁজ করতে জানে। কিন্তু মার্কেটের কাপড়গুলো ভাঁজ করার নিয়ম বোধ হয় আলাদা। জর্জেট বোরকা, থ্রি-পিস ভাঁজ করতে গিয়ে তাকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। ওর অপারগতা দেখে জিসান হাসছে। জিসান এতক্ষণ চুপচাপ থাকলেও এবার বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। জিসানকে দেখে অর্ষার স্কুল লাইফের ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। তখন ক্লাস নাইনে পড়ত সে। তুষার নামে একটি ছেলে ছিল, যে একই স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ত। ছেলেটা অসম্ভব ভালোবাসত অর্ষাকে। অর্ষার যে তুষারকে ভালো লাগত না, এমনটা নয়। ওর’ও একটু একটু ভালো লাগত। কিন্তু এই ভালোলাগা ডাল-পালা গজানোর আগেই খবরটি অর্ষার ভাইয়ের কানে চলে যায়। সম্পর্ক না হওয়া সত্ত্বেও বিনা দোষে অনেক মার খেতে হয়েছিল অর্ষাকে। এরপর যদি তুষারের সাথে কোনো কথা বলে তাহলে তুষারকেও মারবে বলে হুমকি দেয়। তখন থেকে অর্ষা তুষারকে এড়িয়ে চলত। তুষার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর দেখা-সাক্ষাৎ’ও কমে গেছিল। আর এখন তো কোনো খোঁজ-খবরই নেই।
জিসানের কথা বলার স্টাইল, হাসি, দুষ্টুমি সব তুষারের মতো। এজন্যই অর্ষা আরো বেশি বিব্রত হয়। একই তো কাজ ঠিকঠাকভাবে শিখতে পারছে না, অন্যদিকে জিসানের দুষ্টুমি অর্ষাকে আরো বিচলিত করে তুলছে। লাঞ্চ টাইমে শো-রুমের এক আপুর সাথেই বাইরে খেতে গেল অর্ষা। মেয়েটা অর্ষার চেয়ে বেশ বড়ো। নাম সুস্মিতা।
খেতে খেতে সুস্মিতা বলল,’তোমায় একটা কথা বলি। জিসানের সাথে বেশি কথা বোলো না।’
অর্ষা ভ্রুঁ কুঞ্চন করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সুস্মিতা পানির বোতলে চুমুক দিয়ে বলল,’জারা নামের মেয়েটিকে দেখেছ না?’
‘হুম।’
‘জারার কিন্তু বেশ দাপট এই শো-রুমে। কামরুন ম্যামের বাড়িতেই থাকে। কাজে, কথায় এক্সপার্ট। তাই তো ম্যাম ও’কে নিজের বাসায় রেখেছে। তো জিসানের সাথে কিন্তু জারার সম্পর্ক রয়েছে। ও অনেকবার বাঁকাচোখে তাকিয়েছে। ঐ মেয়ের আচরণ তেমন ভালো নয়। ঝামেলা করতে পারে।’
অর্ষা হতাশ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ‘কিন্তু আমি তো কারও সাথে সেধে কোনো কথা বলি না।’
‘জানি। আসলে জিসানটা একটু এরকমই। ও সবার সাথেই দুষ্টুমি করে। কিন্তু জারার এসব পছন্দ না।’
‘আচ্ছা, আমি আরো এড়িয়ে চলব তাকে।’
লাঞ্চের পর আবার কাজ শেখা শুরু অর্ষার। জিসান একটু পরপরই এসে কাজের তদারকি করছে আর দুষ্টুমি করছে। অর্ষা রাগ করার, গম্ভীর হওয়ার ভান ধরে থাকে। কিন্তু জিসান এমন এমন কথা বলে যে, না হেসেও আর পারে না। সন্ধ্যার সময়ে দোকানে বেশ ভিড় হয়। এই সময়ে কাজ করতে হিমশিম খেতে হয় সকলকে। কয়েকটা দম্পতি ছোটো ছোটো বাচ্চা নিয়ে এসেছে। অর্ষা যেহেতু নতুন তাই বাচ্চা সামলানোর দায়িত্ব ও’কে দেওয়া হয়। যাতে করে বাচ্চাদের বাবা-মা শান্তিতে কেনাকাটা করতে পারে।
বাচ্চাগুলোর দূরন্তপনার সাথে অর্ষা পেরে ওঠে না। একটাকে সামলালে আরেকটা দৌঁড়ায়। শেষে হাফিজ এসে ও’কে সাহায্য করে। সন্ধ্যার পর ভিড় একটু কমে। মালিক বা তার বউ এখন কেউ নেই। একটু আরাম করে যে বসবে তারও উপায় নেই। সিসি ক্যামেরায় বাড়িতে বসেই তারা সব দেখে। অগত্যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাপড় ভাঁজ করা শেখে সে।
জারা অন্যপাশে ছিল। তার মাথার ওপর ফ্যান চলছে। শো-রুমে এসিও আছে। কিন্তু সবসময় ছাড়া হয় না। যখন অনেক কাস্টমার আসে তখন এসি ছাড়ে। জারা অর্ষাকে ডেকে পাশে বসায়। মনে মনে একটু ভয়ই পায় অর্ষা।
জারা অবশ্য কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি। হেসেই জিজ্ঞেস করেছে,’তুমি শুধু জব-ই করো?’
অর্ষা মাথা নাড়িয়ে বলল,’না। পড়াশোনাও করি।’
‘কীসে পড়ো?’
‘ইন্টার দিয়েছি এবার। তুমি?’
জারা একটু চুপ করে থেকে বলল,’আমি ভার্সিটিতে পড়ি।’
‘ওহ। কোন ইয়ার? কোন সাবজেক্টে?’
জারা চুপ হয়ে যায়। অর্ষাও জানত জারা হয়তো কোনো উত্তর দিতে পারবে না। কারণ সে সুস্মিতার থেকে জারার সম্পর্কে প্রায় সবই জেনেছে। জারা সেভেন পর্যন্ত পড়েছিল। এরপর আর পড়াশোনা হয়নি। তাহলে সবাইকে মিথ্যে বলার দরকার কী?
জারাকে অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিতে অর্ষা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,’তোমার চুলগুলো অনেক সুন্দর। সিল্কি।’
জারা হাসল। বলল,’থ্যাঙ্কিউ। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?’
‘জি।’
‘তুমি কি রিলেশন করো?’
‘না।’
‘করবে?’
‘না।’
‘আরে একটা ভালো ছেলে আছে।’ বলে কসমেটিক্সের সাইডে বসে থাকা একটা ছেলেকে দেখায়। ছেলেটি কালো, দেখতেও তেমন নয়। আল্লাহর সকল সৃষ্টিই সুন্দর। তাই কাউকে নিন্দেমন্দ করতে নেই। তবে মানুষের দৃষ্টিতেই সৌন্দর্যের পার্থক্য রয়েছে। সেই দৃষ্টিতেই, এই ছেলে অর্ষার তুলনায় কিছুই নয়। কোনোদিক দিয়েই নয়। এরচেয়ে অনেক বেটার বেটার, সুন্দর, হ্যান্ডসাম ছেলের থেকে প্রপোজাল সে পেয়েছে। জারা কি তাকে এতটাই তুচ্ছ ভাবা শুরু করেছে?
অর্ষা নিরুত্তর রইল। জারা বলল,’ওর নাম রাকিব। দেখতে এত সুন্দর না হলেও মনটা কিন্তু খুব ভালো। পড়াশোনা না করলেও সমস্যা নেই। নিজেদের বাড়ি আছে। বাপ অনেক বড়ো লোক। এখানে চাকরী করে শখের বসে। তোমাকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ করেছে। চাইলে রিলেশন করতে পারো। বিয়ে করলেও সুখে থাকবে।’
অর্ষা এবার হেসে ফেলে। মৃদু হেসে বলে,’ওর বাপের অনেক টাকা, অনেক বড়ো লোক এসব দেখে আমি রিলেশনে যাব; আমার প্রতি এমন মনোভাব আনার কারণটা কি আপু?’
‘তেমন কিছু না। ও তোমাকে পছন্দ করে। তাই বললাম।’
‘তাকে বলে দেবেন, আমি তাকে পছন্দ করি না।’
‘ভেবে দেখতে পারতে।’
‘ভাবার কিছু নেই। রিলেশন করার মানসিকতা থাকলে অনেক সুন্দর এবং বড়ো লোক ছেলের সাথেই করতে পারতাম। অভাবের তাড়নায় চাকরী করতে এসেছি। এর মানে এই নয় লোভের বশবর্তী হয়ে কারও সাথে সম্পর্কে জড়াতে হবে।’
এতগুলো কথা অর্ষা কীভাবে বলে ফেলেছে সে নিজেও জানে না। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে কেন সবাই এমন তুচ্ছ ভাববে? সে তো তুচ্ছ নয়। হয়তো এজন্যই আজ এতগুলো কথা সে বলতে পেরেছে।
জারা একটুখানি সময় চুপ করে থেকে বলল,’আচ্ছা এটা বাদ দাও। আমার একটা কাজ করে দেবে?’
‘কী?’
‘জিসানকে পটাতে পারবে? সম্ভবত ও তোমাকে পছন্দ করে। ও’কে দিয়ে তোমায় ভালোবাসার কথা বলাতে হবে।’
‘এতে আমার লাভ?’
‘ও যদি তোমাকে ভালোবাসার কথা বলে তাহলে তোমার পড়াশোনার খরচ আমি চালাব।’
অর্ষা তাচ্ছিল্য করে বলল,’দরকার নেই আপু। সে যে আপনার বয়ফ্রেন্ড সেটা আমি জানি। এছাড়া আমার প্রতি তার অন্য কোনো মনোভাব নেই। যাকে ভালোবাসেন, তাকে বিশ্বাস করতে শেখেন। আমি যাই, অনেক কাজ পড়ে আছে।’
অর্ষার কান্না পাচ্ছে। নতুন জায়গায় আসতে না আসতেই এমন প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হওয়ার কি খুব দরকার ছিল? সবসময় তার সাথেই কেন এমন হবে!কোথায় গেলে সে একটু শান্তি পাবে।স্বস্তি পাবে!
সেদিনের পর থেকে জিসানকে সে পুরোদমে এড়িয়ে চলা শুরু করে। প্রয়োজনেও কোনো কথা বলে না। তেমন সামনেও যায় না। কাজ শেখে অন্যদের কাছে। জিসানও হয়তো কারণ আঁচ করতে পেরে গুটিয়ে যায়।
শো-রুমের মালিক অর্ষাকে চুপচাপ কাপড় ভাঁজ করতে দেখে জিজ্ঞেস করেন,’মন খারাপ নাকি পিচ্চি?’
অর্ষা মাথা তুলে তাকায়। মৃদু হেসে বলে,’না, বস।’
‘তাহলে এত চুপচাপ কেন। এখানে সব সেলসম্যানের থেকে তুমি ছোটো। হৈচৈ না করে সবসময় নিরব থাকো। এত শান্তশিষ্ট হলে হয়?’
অর্ষা কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। বসের বউ অতিরিক্ত রাগী হলেও বস মানুষটা বেশ ভালোই। রাকিবকে প্রত্যাখান করায় বেশ কিছুদিন অর্ষার ওপর ক্ষেপে ছিল সে। সামনা-সামনি পড়লে কিংবা চোখাচোখি হলেই রাগী দৃষ্টিতে তাকাত। এখন অবশ্য তেমন করে না। স্বাভাবিক বন্ধুসুলভ আচরণই করে। অর্ষাও আস্তে আস্তে সবার সাথে, সবকিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে। কাজে ভুল হলে কামরুন ম্যামের অজস্র ধমক, বকাও খেতে হয়। প্রথম প্রথম আড়ালে গিয়ে কাঁদত। এখন কান্না পেলেও কান্না আটকে রাখতে পারে। নিজের জন্য হলেও তাকে সবকিছু হজম করতে হবে।
_______
লামিয়া এবং জুঁইয়ের বিয়ে একদিনেই হবে। যেহেতু ওরা দুজন বান্ধবী এবং অপরদিকে নিহাল আর সুবাসও বন্ধু তাই একসাথে বিয়ে হওয়ায় দুই পরিবারের কারোরই কোনো আপত্তি নেই। অর্ষা বাদে বন্ধুমহলের সকলেই বিয়ের ডেট জানে। অর্ষার সাথে দুটো কথা বলারও সুযোগ নেই এখন। মেয়েটা এত বিজি থাকে! শুক্রবারে পর্যন্ত ডিউটি। তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ অর্ষার শো-রুমে গিয়ে সারপ্রাইজ দেবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। সকলে মিলে চলে যায় শো-রুমে। কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়েই অর্ষাকে দেখে। মেয়েটা আগে থেকে অনেকটা শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালিও পড়েছে মনে হচ্ছে। সামনে একগাদা কাপড়। সেগুলোই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাঁজ করছে সে।
লামিয়া কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে,’দোস্ত! ওর এই অবস্থা কেন?’
উত্তরে আশিক বলল,’কাজ করা এত সহজ কথা নয় রে। চল ভেতরে যাই।’
সবাই মিলে ভেতরে যায়। নিঃশব্দে গিয়ে অর্ষার সামনে দাঁড়ায়। অর্ষা কাজে এতটাই মগ্ন যে এতগুলো মানুষ তার সামনে দণ্ডায়মান সেটাও খেয়াল করেনি। পাশ থেকে যারা যখন ওদের বলল,’কী দেখবেন?’
তখন ভাবলেশহীন ভাবে সামনে তাকায় অর্ষা। আর তাকিয়েই অবাক হয়ে যায়। অজান্তেই খুশিতে চিৎকার করে ফেলে এবং পরক্ষণে দু’হাতে মুখ আবদ্ধ করে নেয়। দু’চোখে পানি টলমল করছে। আজ কতদিন পর ওদের সাথে দেখা? এক সপ্তাহ্? না এর-ও বেশি সময় হবে।
অর্ষা বেরিয়ে এসে ওদেরকে জড়িয়ে ধরে। আহিল, দিদার আর আশিক নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে রয়েছে। ভেতরে ভেতরে আনন্দ ও কষ্ট অনুভব করতে পারলেও মেয়েদের মতো সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। ওরা কান্নাকাটি করতে করতেই গল্প জুড়ে দেয়।
পাশ থেকে জারা গম্ভীর হয়ে বলে,’এটা গল্প করার জায়গা নয়।’
লামিয়া ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ বাঁকা করে তাকায়। রাগীকণ্ঠে বলে,’এখানে আমরা গল্প করতে এসেছি আপনাকে কে বলেছে? আর কে আপনি হ্যাঁ? শো-রুমের মালিক?’
জারা থতমত খেয়ে যায়। আশিক লামিয়াকে থামতে বললে লামিয়া দ্বিগুণ রাগ দেখিয়ে বলে,’থামব কেন? মালিক হলে বলুক যে মালিক হয়। আর কর্মচারী হলে কাস্টমারদের সাথে এমন ব্যবহার করার সাহস কোথায় পায়? ম্যানার্সলেস মেয়ে! কই বস কোথায় আপনার?’
হৈচৈ শুনে কামরুন নাহার এগিয়ে আসেন। বিনীতকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,’কী হয়েছে?’
এবার জুঁই বলল,’কেমন কর্মচারী দোকানে রেখেছেন আন্টি? সামান্য ম্যানার্সটুকু নেই। অর্ষা আমাদের কলেজ ফ্রেন্ড। ওর সুবাদেই এখানে এসেছি কেনাকাটা করতে। আর আপনার এই সেলসম্যান বলে কিনা এটা গল্প করার জায়গা নয়! এতদিন বাদে নিজের ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কথা বলব না আমরা?’
‘অবশ্যই। ও বুঝতে পারেনি। তোমরা কিছু মনে কোরো না।’
এরপর তিনি জারার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,’স্যরি বলো ওদেরকে।’
জারা অনিচ্ছাকৃতভাবে বলল,’স্যরি।’
ওর স্যরিকে কেউ পাত্তা দিলো না। আর সত্যি সত্যিই শো-রুম থেকে সবাই মিলে অনেক কেনাকাটা করল। কামরুন নাহার নিজে সবাইকে কফি খাওয়ালেন। এমনকি অর্ষার সাথে ওদের কথা বলারও সময় দিলেন। ওরা চলে যাওয়ার পূর্বে কিছু ব্যাগ অর্ষাকে দিয়ে বলল,’এগুলো তোর জন্য।’
আহিল আসার পর থেকে অর্ষার সাথে বিশেষ কোনো কথা বলেনি। যাওয়ার সময় নিজের আবেগ, কষ্ট কোনোটাই আটকে রাখতে পারল না। আদুরেভাবে অর্ষার মাথায় হাত রেখে বলল,’নিজের কী অবস্থা করেছিস! একটু খেয়াল রাখিস প্লিজ।’
অর্ষার দু’চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইছে। আহিল আলতো করে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে বলল,’সাবধানে থাকিস।’
সবাই চলে যাওয়ার পর সুস্মিতা, জিসান, হাফিজ, রাকিব এমনকি কামরুন নাহারও ওদের বন্ধুত্বের প্রসংশা করলেন।
.
.
একটানা প্রায় দু’সপ্তাহ্ কাজ করে শরীর নেতিয়ে গেছে অর্ষার। তাই বস আজকের জন্য ও’কে ছুটি দিয়েছে। দুপুর পর্যন্ত কোনো রকম একটুখানি ঘুমিয়েছে। তাতেও কুসুমের ঘ্যানঘ্যানানির শেষ নেই। ঘুম থেকে উঠে গোসল করে অল্প কিছু খেয়ে নেয়।
কুসুম শান্তকণ্ঠেই বলল,’তিয়াসকে নিয়ে একটুপর দোকানে যাস তো।’
‘কিছু লাগবে?’
‘কিছু কিনে দিস। বাইরে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছে। আমিই নিয়ে যেতাম। কোমরের ব্যথাটা বেড়েছে। হাঁটতে কষ্ট হয় এখন।’
‘আচ্ছা তুমি বিশ্রাম করো। আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
অর্ষা ভাবল এই সুযোগে বন্ধুদের সাথেও দেখা করা যাবে। দুপুরের রোদ কমতেই জমানো কিছু টাকা আর তিয়াসকে কোলে নিয়ে অর্ষা বেরিয়ে পড়ে। আগে ফেক্সিলোডের দোকানে যেতে হবে। কোনো একজনকে ফোন করে দেখা করার কথা বললে, সে-ই বাকিদের জানিয়ে দেবে।
পথিমধ্যে একদম সামনে এসে একটা গাড়ি থামে। গাড়িটা অর্ষার কেমন যেন একটু চেনা চেনা লাগছে। জানালার কাচ নামিয়ে স্টিয়ারিং-এ থাকা ছেলেটি যখন মাথা বের করল, তখন অজান্তেই অর্ষার ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত হয়।
এগিয়ে গিয়ে বিস্মিতকণ্ঠে বলে ওঠে,’আপনি!’
আহনাফ মুচকি হেসেই বলল,’কেমন আছো?’
‘ভালো আছি। আপনি কবে এসেছেন?’
‘আজ সকালে।’ বলে তিয়াসের গাল টেনে আদর করে দেয়। এদিকে তিয়াসও গাড়িতে ওঠার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। কোনোভাবেই অর্ষা ও’কে সামলাতে পারছে না।
আহনাফ হেসে তিয়াসের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দেয়। তিয়াসও একদম লাফ দিয়ে আহনাফের কোলে চলে যায়। ছোট্ট বলে জানালা দিয়েই যেতে পেরেছে। ও’কে কোলে নিয়ে আহনাফ বলল,’তোমাকে তো জানালা দিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তুমি ওদিক দিয়ে গাড়িতে ওঠো।’
অগত্যা অর্ষাকেও গাড়িতে উঠতে হয়। তিয়াস শান্ত হয়ে আহনাফের কোলে বসে আছে। আহনাফ জিজ্ঞেস করে,’কোথায় যাচ্ছিলে?’
‘এমনিই তিয়াসকে নিয়ে একটু হাঁটতে বের হয়েছিলাম।’
‘উদ্দেশ্যহীন?’
‘ঠিক তা নয়। ভেবেছিলাম বন্ধুদের সাথে দেখা করব।’
‘তাহলে তো বিরক্ত করে ফেললাম।’
‘সমস্যা নেই। আপনি হঠাৎ দেশে আসলেন? কোনো জরুরী কাজে?’
‘আর বোলো না! তোমার আন্টির মাথায় ভূত চেপেছে। কয়েকদিন ধরেই কান্নাকাটি করছিল দেশে আসার জন্য। আসার পর এখন আরেক কাহিনি শুরু করেছে।’
‘কী হয়েছে?’
‘বিয়ে করতে বলে।’
অর্ষা হেসে ফেলে। বলে,’বেশ তো! করে ফেলুন।’
আহনাফ এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বলল,’তোমার জব কেমন চলে?’
অর্ষা অবাক হয়ে পালটা প্রশ্ন করে,’আপনি জানেন আমি জব করি?’
আহনাফ মৃদু হেসে বলল,’হুম।’
‘ওহ আচ্ছা। হ্যাঁ, ভালোই চলছে।’
‘তোমার বাড়ির সবাই কেমন আছে?’
‘ভালো আছে।’
বাজারে ফেক্সিলোডের দোকানের সামনে গাড়ি আসতেই অর্ষা বলে,’এখানেই নামিয়ে দিন।’
আহনাফ গাড়ি থামায়। কিন্তু তিয়াস তো যেতে নারাজ। অনেক হম্বিতম্বি করে তারপর আহনাফের থেকে আলাদা করতে হয়েছে। আহনাফ অর্ষাকে নামিয়ে দিয়ে বাড়িতে যায় সোজা। সে যখন বাড়িতে ঢোকে, আহিল তখন বাইক নিয়ে বের হয়। নিশ্চয়ই অর্ষার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে।
পার্কিংলটে গাড়ি পার্ক করে আহনাফ ভেতরে যায়। রেণু এসে শরবত দিয়ে যায়। আমেনা বেগম রান্নাঘরের টুকিটাকি কাজ শেষ করে ছেলের কাছে আসেন। জিজ্ঞেস করেন,’সকালে আসতে না আসতেই কোথায় চলে গেছিলি?’
‘একটু দরকার ছিল।’
‘বিকেলে আর কোনো দরকারি কাজ রাখিস না।’
‘কেন?’
‘মেয়ে দেখতে যাব।’
‘কী আজব! এর মাঝে মেয়ে দেখার ডেটও ফিক্সড করে ফেলেছ?’
‘অবশ্যই। তোর আশায় তো অনেক ছিলাম। আর কত? তোর সময় তো আর আসেই না।’
‘এত তাড়াহুড়া করার কী আছে বলো তো মা?’
‘কারণ আমার একটা বউ মা চাই।’
আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। শরবতের গ্লাসটি সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে সোজা হয়ে বসে। রুদ্ধশ্বাসে বলে,’মেয়ে দেখতে যেতে হবে না। আমার একজনকে ভালো লাগে। আমি তাকেই বিয়ে করতে চাই।’
আমেনা বেগম বিস্মিতকণ্ঠে জানতে চান,’সত্যিই? কাকে?’
‘কেয়াকে। অর্ষার বেয়াইন।’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]