#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
কথায় আছে, সবকিছুর লিমিট থাকা ভালো। অতিরিক্ত কোনো কিছু করা মানে হলো, কোনো না কোনো অঘটন ঘটানো। তবে এরমাঝেও কিছু জিনিস, কিছু ব্যাপার থাকে যা নিজের নিয়ন্ত্রণে চাইলেও রাখা যায় না। আহনাফের রাগও হচ্ছে সেরকম একটা বিষয়। সে স্বভাবে স্বল্পভাষী। প্রয়োজন ছাড়া কারও সাথে তেমন কোনো কথা বলে না। এমনকি নিজের বাবা-মা কিংবা ভাই-বোনের সাথেও নয়। কিছু মানুষ হয়তো বাইরের মানুষের সামনে ইন্ট্রোভার্ট থাকে; কিন্তু পরিবারের সামনে ঠিকই এক্সট্রোভার্ট। তবে আহনাফের ব্যাপারে পুরো বিষয়টাই আলাদা। যাকে বলে সম্পূর্ণ মানে সম্পূর্ণই আলাদা। সে বাইরের মানুষের সামনে যেমন, পরিবারের সামনেও তেমন। অর্থাৎ তার বাড়তি কোনো রূপ নেই। একটাই রূপ। পড়াশোনায় মেধাবী হওয়াতে ছোটোবেলা থেকেই স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি সব জায়গায় অনেকে তার বন্ধু হতে চেয়েছে। কিন্তু ঐযে তার গুরুগম্ভীর আর ইন্ট্রোভার্ট স্বভাব! এজন্য তার তেমন কোনো বন্ধু নেই। যারা আছে, তারা আহনাফের অতিরিক্ত রাগ সহ্য করেই আছে।
অর্ষাকে এভাবে মারধোর করতে দেখে তার রাগ চরম থেকেও চরমে পৌঁছে গেছে। রেগে গেলে তার হিতাহিত কোনো জ্ঞান থাকে না। আর জ্ঞানশূন্য হয়ে কী কী যে করতে পারে, সেটাও সকলের ধারণার বাইরে। সে ক্ষুব্ধ হয়ে এগিয়ে যাওয়ার পূর্বেই বাড়ি থেকে একটা মেয়ে বের হয়ে ওদের দিকে এগিয়ে যায়। আহনাফ থেমে যায় সেখানেই।
মেয়েটি ভাবিকে অর্ষার থেকে সরানোর চেষ্টা করছে আর বলছে,’কী করছ আপু? এভাবে মারছ কেন ওকে? ছাড়ো প্লিজ!’
ভাবি ধমক দিয়ে বলেন,’তুই এখানে এসেছিস কেন? ঘরে যা তুই। ওর কত্ত বড়ো কলিজা! আমার শাড়ি ছিঁড়ে ফেলেছে।’
অনেক কষ্টে সে ভাবির হাত থেকে অর্ষাকে ছাড়াতে সক্ষম হয়। কিছুটা রাগীসুরে বলে,’সামান্য একটা শাড়ির জন্য তুমি ওকে এভাবে মারছ?’
‘তোর এত দরদ কেন ওর জন্য? তুই আমার বোন নাকি ওর? আমার জীবনটা কয়লা করে দিচ্ছে এই মেয়ে!’
শেষ কথাটা জলন্ত দৃষ্টিতে অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল ভাবি। উশকোখুশকো চুল নিয়ে মাথা নত করে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অর্ষা। ঘর থেকে তিয়াসের কান্নার আওয়াজ আসায় ভাবি আরো কিছু কথা অর্ষাকে শুনিয়ে দিয়ে ভেতরে যায়। এ সবটাই মূল ফটকের আড়াল থেকে আহনাফ দেখছিল। এদিকটা অন্ধকার থাকায় বাড়ির কেউ তাকে দেখেনি।
আহনাফের কৌতুহলের সাথে একটু ভালোও লাগল, এভাবে মারধোর আর গালাগালি করছে তবুও এই মেয়েটি ব্যতীত আর কেউ এলো না বাহিরে। কেমন পরিবার এটা? ওর ভাবনার আদি-অন্ত শেষ হওয়ার পূর্বেই অর্ষা আর মেয়েটি ভেতরে চলে গেছে। আহনাফের আর পার্সটি ফেরত দেওয়া হলো না। বাড়ির মানুষজন ওকে দেখে যদি আরো বেশি সিনক্রিয়েট করে? তাই সে পার্সটি নিয়ে আবার গিয়ে গাড়িতে বসল।
অর্ষা বিছানার ওপর বসে আছে। গ্লাসে করে পানি নিয়ে আসে কেয়া। অর্ষা চুপচাপ পানিটুকু পান করে। কেয়া আর কুসুম আপন দু’বোন। কেয়া-কুসুমের বাবা-মা যেমন বেঁচে নেই তেমনই রুহুল আর অর্ষার বাবা-মা’ও বেঁচে নেই। কুসুমের সাথে রুহুলের বিয়ে প্রেমেরই ছিল। বাবা গত হয়েছিল অর্ষার ছ’বছর বয়সে। মা দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছে বছর দুয়েক আগে। অস্বচ্ছল পরিবারে এখন একসাথেই বসবাস করছে রুহুল আমীন, কুসুম, ওদের একমাত্র ছেলে তিয়াস, অর্ষা আর কেয়া। কুসুমের বিপরীত চরিত্রটি কেয়া। সে সবসময় চেষ্টা করে অর্ষাকে নিজের বোনের অত্যাচার থেকে আগলে রাখতে।
গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে কেয়া জিজ্ঞেস করে,’ভাত খাবি?’
অর্ষা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে মৃদুস্বরে বলে,’খেয়ে এসেছি।’
‘তাহলে যা, শাড়ি পালটে নে। তারপর এসে শুয়ে পড়।’
অর্ষা শাড়ি পালটে থ্রি-পিস পরে নেয়। কেয়া শুয়ে পড়েছে। রাত পোহালেই সকাল সাতটায় তাকে শো-রুমে যেতে হবে। বর্তমানে সে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার পাশাপাশি একটা শো-রুমে সেলসম্যানের চাকরি করে। এতে মোটামুটিভাবে তার পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যা পয়সা বাঁচে সেগুলো বড়ো বোন কুসুমকে দিয়ে দেয়।
লাইট নিভিয়ে অর্ষাও গিয়ে কেয়ার পাশে শুয়ে পড়ে। মা মারা যাওয়ার পর এই বাড়িতে অর্ষার শুধু দুজন আপন মানুষ রয়েছে। কেয়া আর তিয়াস। ভাই তো আপন হয়েও পর। মা মারা যাওয়ার পর থেকে ভাইয়াও বদলে গেছে। ভাবির কথামতো চলে। ভুল-ঠিক বিচার করে না। ভাবির মুখে যা শোনে তা-ই বিশ্বাস করে। পরিশেষে হয়তো মার খেতে হয় নয়তো যা তা কথা শুনতে হয়। মাঝে মাঝে তো অর্ষার ইচ্ছে করে মরে যেতে। কিন্তু তার অত সাহস নেই। রক্ত দেখলেই যার অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম, তার পক্ষে সুইসাইড করা এত সহজ নয়।
সে প্রলম্বিত একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কেয়ার ওপর এক হাত রেখে বলে,’ঘুমিয়েছ?’
‘উঁহু! কিছু বলবি?’
‘তোমার নাম কেয়া না হয়ে কুসুম রাখা উচিত ছিল। কুসুম তো নরম হয়। কিন্তু ভাবি অনেক শক্ত প্রকৃতির মানুষ।’
কেয়া হেসে ফেলে। চোখ বন্ধ করেই বলে,’ঠিক বলেছিস।’
‘আপু, তোমায় না বলেছিলাম আমার একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে দিতে? তুমি শো-রুমে কথা বলেছিলে? লোক কবে নেবে তারা?’
‘আগে তোর পরীক্ষা শেষ হোক। পরীক্ষা তো চলেই এলো। তারপর দেখা যাবে।’
‘দেখা যাবে না। আমার চাকরী লাগবেই। বাড়িতে যদি আমিও কিছু টাকা দিতে পারি, তাহলে হয়তো ভাবি একটু হলেও আদর করবে।’
কেয়ার ভীষণ অসহায়বোধ হয় অর্ষার জন্য। একটু আদর-ভালোবাসার কাঙাল মেয়েটা প্রতিনিয়ত কত অত্যাচারই না সহ্য করে। তার মুখে বেদনার ছাপ ছড়িয়ে পড়ে। অন্ধকার থাকায় অর্ষার দৃষ্টিতে সেটা পড়ল না।
সে অর্ষার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,’আর কথা না বলে ঘুমা। সকালে কলেজ আছে না?’
‘হু। আপু?’
‘কী?’
‘চুলে হাত বুলিও না। ভাবি চুল টেনে মেরেছ তো, খুব ব্যথা লাগছে!’
কেয়ার চোখে এবার পানিই চলে আসে। তার বড়ো বোনটা এত নিষ্ঠুর কেন?
.
রুহুল আমিন তিয়াসকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছিল। তখন কুসুম ঘরে আসে। চোখে-মুখে তখনো রাগের প্রতিচ্ছবি ভেসে ছিল। রুহুলের কোল থেকে তিয়াসকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কান্না থামানোর চেষ্টা করছিল। প্রথমে কান্না না কমলেও আস্তে আস্তে তিয়াসের কান্না কমে আসে। রুহুল পাশ ফিরে শুয়ে ছিল। তিয়াসকে নিয়ে কুসুমও শুয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ মৌন থেকে রুহুল আমিন বলল,’তখন যে আমি মারতে গেলাম বাঁধা দিলে কেন? আর দিলেই যখন এখন তুমি অর্ষাকে মারলে কেন?’
কুসুম রাগে গমগমে কণ্ঠে বলে উঠল,’রাত করে বাড়ি ফিরেছে এজন্য তুমি মারতে গিয়েছিলে। ও তো আমায় বলে গেছিল, এজন্য তোমায় থামিয়েছি। কিন্তু ও কী করেছে জানো? আমার সবচেয়ে পছন্দের শাড়িটা ছিঁড়ে ফেলেছে। তাহলে মারব না কী করব? কোলে বসিয়ে আদর করব?’
রুহুল আমিন এ কথার পিঠে আর কিছু বলতে পারল না। কুসুম নিজেই বলল,’আপদটাকে কি তুমি বিদায় করবে না? এভাবে বসিয়ে বসিয়ে আর কতদিন খাওয়াবে? অভাবের সংসারে আবার পড়াশোনাও করাচ্ছ!’
‘কুসুম, আমি জানি অভাবের সংসারে তোমার মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু কী করব বলো? রক্তের বোন তো? একেবারে তো ফেলে দিতে পারি না। এখানে যে খুব আরামে থাকে তাও তো না। প্রতিটাদিন উঠতে, বসতে কথা শোনে, মার খায়। এমনদিন যায় যে ও মার খায় না? তুমি ভালো করেই জানো আমি মাকে কত ভালোবাসতাম। অর্ষাকে নিয়ে মায়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। অনেক পড়াশোনা করাবে ভেবেছিল। আমার তো আর এত সামর্থ্য নেই। অন্তত উচ্চ মাধ্যমিকটা দিক। তারপর না হয় বিয়েটিয়ের কথা ভাবা যাবে।’
‘অভাবের সংসারে আবার শখ, স্বপ্ন কীসের? পড়ে বলে কি কাজকর্ম কিছু করা যায় না? আমার বোন করছে না?’
রুহুল আর কিছু বলল না। চুপ করে শুয়ে রইল। কুসুম একা একাই কিছুক্ষণ রাগারাগি করে নিজেও ঘুমানোর চেষ্টা করল। দিনদিন সংসার নিয়ে সে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। কেন জানে না, অর্ষাকে দেখলেই তার রাগ বেড়ে যায়। আপদ একটা!
_______
হালকা মিষ্টি রোদ্দুর সফেদ পর্দা ভেদ করে আহনাফের বিছানায় এসে পড়েছে। মৃদুমন্দ বাতাসের সহিত হালকা হালকা নড়ছে পর্দাটি। গতকাল রাতে সে জানালা লক করতেও ভুলে গেছে। সে আসলে ভিন্নধর্মী মানুষ। তার সুখ, আনন্দ, দুঃখগুলোকে সে সবার মতো করে প্রকাশ করতে পারে না। একমাত্র আদরের বোনকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়েছে, এতে বাকি সবার মতো তারও কষ্ট হয়। হচ্ছে। তবে সে সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। যার দরুণ সে ঠিকঠাক কাজ করতেও ভুলে বসেছে।
ফোন ভাইব্রেট হওয়ায় কাঁচা ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে আহনাফের। কাঁচা ঘুম বলছি কারণ, বাকি সবার মতো সেও গভীর রাতে ঘুমিয়েছে। সবাই রাত জেগে আফরিনের জন্য কান্নাকাটি করলেও আহনাফ তো সেটি করেনি। সে অনেক রাত অব্দি বারান্দার রকিং চেয়ারে বসে ছিল। ঘুম ঘুম ভাবটা অনুভব হয় ফজরের সময়। তবে আলসেমি করেনি। নামাজ পড়ে তারপর বিছানায় গা এলিয়েছে।
সে চোখ না খুলেই হাতড়ে হাতড়ে বালিশের সাইড থেকে ফোন হাতে নিয়ে রিসিভ করে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে,’হ্যালো।’
‘হ্যালো, ভাইয়া। ঘুমাচ্ছ তুমি?’ ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে মিষ্টিকণ্ঠে সুধাল আফরিন।
আহনাফের ঠোঁটের কোণেও তখন এক চিলতে হাসিররেখা প্রস্ফুটিত হয়। সে বিছানায় গড়াগড়ি করে উঠে বসে বলে,’এতক্ষণ ঘুমুচ্ছিলাম। তোর কণ্ঠ শুনে ঘুম ভেঙে গেছে।’
আফরিন হেসে বলল,’কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। তুই ভালো আছিস তো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভাইয়া। বাড়ির সবাই কোথায়?’
‘কেন? বাসায়ই তো।’
‘বাবাকে ফোন দিলাম ধরল না। মাকে দিলাম মা’ও ধরল না। তাই এখন তোমাকে ফোন করলাম।’
‘তোর বিরহে সারারাত সকলে কান্নাকাটি করে ভোররাতে ঘুমিয়েছে। তাই হয়তো সজাগ পায়নি।’
আফরিনের মনটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেল। তারও তো পরিবারের জন্য ভীষণ কষ্ট হয়। সে জিজ্ঞেস করল,’তুমি কাঁদোনি ভাইয়া?’
‘তোর কী মনে হয়?’
‘কী আর মনে হবে? তুমি যেই কঠোর! মনে তো হয় না।’
আহনাফ হেসে ফেলে। প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করে,’তোর শ্বশুরবাড়ির সবাই কেমন আছে? নাসিম কোথায়?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্ সবাই ভালো আছে। উনি ঘুমাচ্ছে।’
‘তুই কী করছিস?’
‘আমি বসে আছি। শাশুড়ি মা এতগুলো নাস্তা দিয়ে বলে গেছে সব শেষ করতে। আমি কি এত খাই বলো?’
‘খেতে হবে। ওখানে একদম লজ্জা করলে চলবে না। এখন থেকে ওটাই তোর বাড়ি। ওরাই তোর সবচেয়ে আপনজন। সবাইকে নিজের মানুষ ভাববি আফরিন। কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবি না।’
‘আচ্ছা ভাইয়া। আমি এমনকিছু কখনোই করব না, যাতে আমার কারণে তোমাদের কখনো অসম্মান হয়।’
আফরিনের সাথে আরো কিছু কথাবার্তা বলছিল তখন আহনাফ খেয়াল করল, দরজায় সাদা পর্দার ওপাশ দিয়ে ছায়া জাতীয় কিছু। এত সকালে কে উঠল ঘুম থেকে?
আহনাফ আফরিনকে বলল,’তুই খেয়ে নে পাখি। আমি তোকে পরে ফোন করব।’
‘আচ্ছা ভাইয়া। আব্বু-আম্মু উঠলে আমায় ফোন দিতে বোলো।’
‘ঠিকাছে।’ বলে ফোনের লাইন কেটে দেয় আহনাফ। তারপর গুটিগুটি পায়ে ঘর থেকে বের হয়। বাড়ি পুরো নিরব, নিস্তব্ধ। কাজের লোক হলে তো আগে আহনাফের রুমে চা দিতে আসতো। রান্নাঘর থেকেও তো কোনো আওয়াজ আসছে না। তাহলে এই সময়ে কে এলো? গতকাল রাতে কি বাড়ির মেইন দরজা লক করেনি?
ডানপাশের করিডোরে শেষপ্রান্তের রুমটা আহিলের। সূতরাং যে-ই এসেছে সে আহিলের রুমেই প্রবেশ করেছে।
আহনাফও আহিলের রুমে যায়। পর্দা সরিয়ে দেখে সম্পূর্ণ সাদা পোশাকে আবৃত একটা মেয়ে খাটের পাশে, আহিলের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর আহিল ঘুমাচ্ছে মরা’র মতো।
আহনাফ ভরাট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’কে?’
হকচকিয়ে পেছনে তাকায় অর্ষা। আহনাফকে দেখে ঘাবড়ে যায়। শুনতে হাস্যকর লাগলেও সত্য যে, ভয়ে তার হাত-পা কাঁপছে। বেশি কাঁপছে পা। মনে হচ্ছে এখনই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মেঝেতে বসে পড়বে। অর্ষা স্বভাবতই নরম, ভীতু প্রকৃতির মেয়ে। যথেষ্ট ধৈর্যশীলও বটে। কিন্তু সরলতা যেন মাত্রাতিরিক্ত বেশি।
অর্ষাকে দেখে মুখের বর্ণ পরিবর্তন হয় আহনাফের। গতকাল রাতে ওমন মারের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠতেই কণ্ঠ শীতল হয়। সে শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’তুমি এখানে কেন?’
অর্ষা আমতা আমতা করে বলে,’ইয়ে মানে…আহিলকে ডাকতে এসেছিলাম।’
‘তোমার কি সত্যিই কোনো আক্কেল-জ্ঞান নেই? এত সকালে একটা ছেলের রুমে এভাবে ঢুকে গেলে?’
অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকে। সে তো প্রায়ই আসে এই বাড়িতে। সত্যি বলতে আহনাফ-আহিলের মা অসম্ভব ভালো মানুষ। তার আদর ও আশকারায় অর্ষার অবাধ চলাফেরা রয়েছে এই বাড়ির আনাচে-কানাচে। কখনো তো এটা মনে হয়নি যে, আহিলের রুমে ঢুকতে হলেও তার সেন্স প্রয়োজন। সে কি আসলেই এতটা ননসেন্স?
আহনাফ কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,’কিছু বললেই এমন চুপ করে থাকো কেন?’
‘ইয়ে আসলে…এখন তো আর এত সকাল নেই। সাড়ে নয়টা বাজে। আমি এসেছিলাম আহিলকে কলেজে নিয়ে যেতে।’ হাতঘড়িতে সময় দেখে বলল অর্ষা।
আহনাফ কিছুটা নরম হওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সে তো স্বভাবসুলভ ভাবেই রগচটা স্বভাবের। তাই তার সাধারণ কথাগুলোকেও রাগী রাগী শোনায়।
সে অর্ষাকে আপাদমস্তক দেখে জিজ্ঞেস করল,’তোমার পরনে কি কলেজের ইউনিফর্ম?’
‘হ্যাঁ।’
‘সম্পূর্ণ সাদা! এক মুহূর্তের জন্য ভূত ভেবেছিলাম।’
অর্ষা আহত দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকায়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ কলেজেই সম্ভবত কলেজের স্টুডেন্টসদের ইউনিফর্ম সাদা দেওয়া হয়। এখন এজন্য যদি দেখতে ভূতের মতো লেগে থাকে, সেক্ষেত্রে সে কী করতে পারে?
অর্ষাকে বিমর্ষ দেখে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে আহনাফ। মেয়েটা কি পার্সের কথা ভুলে গেছে? এতক্ষণে তো একবারও জিজ্ঞেস করল না। সে এই প্রসঙ্গে কিছু বলতে যাবে তখন অর্ষাই বলল,’আহিলকে ডাকি?’
আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,’কেন?’
‘কলেজে যাবে না?’
‘না। গতকাল অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে। তুমি চলে যাও।’
অর্ষার এবার দুঃখে কষ্টে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। প্রতিদিন তাকে কলেজে যাওয়া এবং আসার জন্য ২০ টাকা করে দেওয়া হয়। তার বাড়ি থেকে কলেজ বেশি দূরে নয়। যেতে দশ টাকা রিকশা ভাড়া আর আসতে দশ টাকা। কিন্তু সে তো সেই টাকা খরচ করে ফেলেছে। প্রতিদিনই করে। কারণ আহিলের কথামতো প্রতিদিন ২০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে আগে সে আহিলের বাসায় আসে। আহিল বাইক নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করে। অর্ষা আসলে এক সঙ্গেই কলেজে যায়। এই বাড়ি থেকে কলেজও বেশ দূরে। এদিকে দশটায় ক্লাস। সময়ও কম। হেঁটে যথাসময়ে পৌঁছানো সম্ভব নয়। ওদিকে প্রথম ক্লাস মিস গেলে স্যাররা বাড়িতে ফোন করবে। বাড়িতে ফোন করলে ভাইয়া মেরেই ফেলবে। অর্ষার এখন মুমূর্ষু অবস্থা।
অর্ষাকে চিন্তিত চিত্তে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আহনাফ জিজ্ঞেস করল,’কী হয়েছে?’
সে বিষাদিত কণ্ঠে বলল,’কিছু না। আমি তবে যাই।’
‘আচ্ছা।’
অর্ষা যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আহনাফ পিছু ডেকে বলল,’শোনো।’
‘জি?’
‘একটু আমার ঘরে আসো তো।’
অর্ষা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করে,’কেন?”
ভয় পাওয়ার মতো আহনাফ কিছু বলেছে কিনা বুঝতে পারল না। তবুও শান্তকণ্ঠে বলল,’তোমার পার্সটা নিয়ে যাও।’
অর্ষা তো পার্সের কথা বেমালুম ভুলেই বসেছিল। অকেজো জিনিসের কথা মনে রেখেই লাভ কী? অকেজো বলার কারণ হলো, পার্সটা শুধুমাত্র শো অফ ছিল। ওতে টাকা-পয়সা কিছুই ছিল না। ওহ স্যরি, ছিল। ২০ টাকা ছিল। সেই টাকা দিয়েই তো রিকশা ভাড়া দিয়ে বিয়েতে এসেছিল। বাকি রইল ফোন? ফোন তো তার কোনোকালেই ছিল না। খুব বেশি জরুরী হলে সে ভাবি কিংবা কেয়ার ফোন থেকে মিসডকল দেয়।
আহনাফকে ফলো করতে করতে তার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অর্ষা। এবার আর আহনাফ ওকে ঘরে ঢুকতে বলল না। টেবিলের ওপর থেকে পার্স এনে হাতে দিলো। কয়েকবার গতকাল ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থমকে গেল। অযথা মেয়েটাকে অস্বস্তিতে ফেলে কাজ নেই।
অর্ষা পার্সটি নিয়ে বলল,’আসছি আমি।’
‘যাও।’
অর্ষা হাত ঘড়িতে সময় দেখে। ৯:৪৫ বাজে। মাত্র ১৫ মিনিটে হেঁটে কলেজে যাওয়া অসম্ভব। সে বাড়ি থেকে বের হয়ে দ্বিধান্বিত মন নিয়ে রাস্তার মাঝেই পায়চারি করতে শুরু করে। দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে ভাবে কলেজে যাবে নাকি বাড়িতে ফিরে যাবে। মার তো আজ কপালে এমনিতেও আছে, ওমনিতেও আছে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে অর্ষার গতিবিধি লক্ষ্য করছিল আহনাফ। মেয়েটা কি শুধুই বোকা? নাকি একটু পাগল স্বভাবেরও? সমস্যাটা কী? আহনাফ এবার নিজেই বের হলো বাড়ি থেকে। অর্ষা তখনো মনস্থির করতে পারেনি যে,কী করবে। ততক্ষণে আরো পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেছে।
‘রাস্তায় এমন চড়কির মতো ঘুরছ কেন?’
আচমকা সেই ভরাট,গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর থেকে কথাগুলে ভেসে আসায় পিলে চমকে যায় অর্ষাকে। মানুষটাকে কেন যে অসম্ভব রকম ভয় পায়, নিজেও বুঝতে পারে না।
অর্ষা হাসার চেষ্টা করে বলল,’না, মানে এমনি। আমি যাচ্ছি।’
অর্ষা উলটোপথে হাঁটা ধরে।
‘কলেজ তো এদিকে। তুমি ওদিকে কোথায় যাচ্ছ?’
‘বাড়ি যাচ্ছি। আজ কলেজে যাব না। আমার কাছে টাকা নেই।’ শেষ কথাটা মুখ ফসকেই বলে ফেলল অর্ষা।
আহনাফ এবার অবাক না হয়ে পারল না। কলেজে যাওয়ার মতো টাকাও নেই? অর্ষার সম্পর্কে না চাইতেও তার অনেক কৌতুহল জমা হতে শুরু করে। সে এর পূর্বে এমন অদ্ভুত কোনো মেয়ে দেখেনি। আপাতত বিষয়টিকে সাইডে রেখে বলল,
‘ক্লাস মিস দিতে হবে না। আমি তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি। দাঁড়াও দু’মিনিট। আমি গাড়ি নিয়ে আসি।’
আহনাফকে এই মুহূর্তে অর্ষার দেবদূত বলে মনে হলো। যাক বাবা, আজ তবে ভাই-ভাবির মারের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে। একটুর জন্য আল্লাহ্ তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
সে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলে,’আল্লাহ্, তুমি আসলেই অনেক দয়ালু। অনেক ভালো অনেক, অনেক। অশেষ শুকরিয়া জানাই তোমার দরবারে। তুমি আমায় বাঁচিয়েছ। বাড়িতে ফিরেই আমি দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ব প্রমিজ।’
আহনাফ গাড়ি নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। জানালা দিয়ে দেখছে অর্ষার কাণ্ড। সেও মনে মনে ভাবে, এই মেয়ে সত্যিই পাগল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,’যাবে নাকি দাঁড়িয়ে থাকবে?’
অর্ষা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বলে,’হ্যাঁ, হ্যাঁ।’
তারপর সে গাড়িতে উঠে বসে।
অর্ষা হাতঘড়ি দেখছে আর ছটফট করছে। আহনাফ নির্বাক। এদিকে সময় যেন সময়ের তুলনায়ও দ্রুতবেগে চলছে। অর্ষা অস্থির হয়ে বলে,’আপনি কি জোরে গাড়ি চালাতে পারেন না?’
রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে আহনাফের। সে বিরক্তিভাজন দৃষ্টিতে অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলে,’সিটবেল্ট বেঁধে নাও।’
অর্ষাও কথামতো সিটবেল্ট বাঁধতে শুরু করে। তার পূর্বেই স্পিড বাড়িয়ে আহনাফ ঝড়ের গতিতে ড্রাইভ করতে শুরু করে। অর্ষা কোনো রকম মৃদু চিৎকার করে বলে,’হায় হায়! এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছেন কেন? এক্সিডেন্ট হবে তো। মরে যাব! প্লিজ আস্তে চালান।’
আহনাফ তবুও গাড়ির স্পিড কমায় না। কিছুক্ষণ আগে তাকে বিদ্রুপ করার আগে মনে ছিল না কথাটা? অর্ষা ভয়ে সংকুচিত, অস্থিরতার সাথে টাল সামলাতে পারছিল না। তাই দু’হাতে শক্ত করে আহনাফের পেশিবহুল বাহুতে এক হাত দিয়ে খামচে ধরে আর অন্য হাত দিয়ে আহনাফের টি-শার্ট খাঁমচে ধরে। অর্ষার এমন কাণ্ডে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেও, পরমুহূর্তে হঠাৎ করেই জোরে ব্রেক কষে আহনাফ। সঙ্গে সঙ্গে অর্ষা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গাড়ির স্টিয়ারিং এর ওপর। তবে তার আগেই স্টিয়ারিং-এর ওপর হাত মেলে ধরে অর্ষাকে কভার করে আহনাফ, যাতে অর্ষা ব্যথা না পায়। কয়েক মিনিটে কী থেকে যে কী হয়ে গেল অর্ষা কিছুই বুঝতে পারল না। সে তো ভেবেছিল আজই বোধ হয় জীবনের শেষ দিন। মাথা ফেটে হয়তো রক্তও পড়া শুরু হয়েছে। তবে সে অবাক হয়, যখন মাথা তু্লে তাকিয়ে দেখে তার কিছুই হয়নি; বরং আহনাফ ওকে ব্যথা পাওয়া থেকে কভার করেছে।
অর্ষা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে দেখে সে রক্তচক্ষু দিয়ে অর্ষার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এখানে তার কী দোষ? গাড়ি জোরে চালাল সে, জোরে ব্রেক কষল সে; আবার রাগও দেখাচ্ছে সে। এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? মনে মনে এসব বললেও অর্ষার মুখটা ছিল ফাটা বেলুনের মতো। সে তখন খেয়াল করে কলেজের সামনে এসেই আহনাফ ব্রেক কষেছে। তবে এভাবে তাকিয়ে কেন আছে? উফ! অস্বস্তিতে পা-ও জমে বরফ হয়ে আছে। গাড়ি থেকে যে নামবে তাও পারছে না।
আহনাফ রাগী কিন্তু চাপাস্বরে বলল,’দেখো তো কী করলে!’
অর্ষা আহনাফের দৃষ্টি অনুসরণ করে আহনাফের হাতের দিকে তাকায়। অর্ষার নখের আচড়ে হাত কেটে রক্ত বের হচ্ছে। ও আল্লাহ্! প্রতিটা বার এই মানুষটার সামনে এলে একটা না একটা অঘটন কেন ঘটবেই? অর্ষা চোরের মতো মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে। পালাতে হবে এখান থেকে!
চলবে…