#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১০
দিন চারেক আগে রাতের ট্রেনে স্টুডেন্টদের নিয়ে এক্সকারশনে এসেছে অর্ক, আরো দুজন টিচার সঙ্গে আছেন যদিও, কিন্তু তাঁরা একটু বয়স্ক, তাই ছাত্র, ছাত্রীরা ওর কাছেই বেশি আবদার করে। কদিন ধরেই রীতিমত হৈ হুল্লোড় চলেছে, আগামী কাল রাতে ফিরে যাবার পালা। তাই আজ ব্যাগ গুছিয়ে, সব কিছু ঠিক করে রেখেছে ও।
ওর যাওয়ার আগের রাতেই রুমা এবং সমরেশ এসে গিয়েছিলেন, ওনাদের দেখে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হয়েছে দুজনেই। অর্ক বারবার করে দিতি কে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে, এই কদিন যেনো একটু বেশি সাবধানে চলাফেরা করে ও। দিতি র মনের মধ্যেও একটু টেনশন হচ্ছিলো, যতোই হোক এখানের কিছুই শ্বশুর, শাশুড়ি চেনেন না। তাও অর্ক কে বুঝতে দেয়নি কিছু, ও বেচারা আরো টেনশন করবে।
পিচ রাস্তা থেকে নেমে ডান দিকের পায়ে চলা পথটা একদম হোটেলের সামনে দিয়ে নদীর ধারে গিয়েছে। ভোরের সূর্যের প্রথম আলো অল্প অল্প গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রাস্তার ওপরে পড়ছে, এই সময় টা খুব ভালো লাগে অর্কর। আশেপাশের সব ঘরের দরজা বন্ধ, ছাত্র ছাত্রীরা কেউই ঘুম থেকে ওঠেনি বোঝা যাচ্ছে, অর্ক আস্তে আস্তে নেমে এসে রাস্তায় পা রাখলো।
নদীর ধার বরাবর পর পর কয়েকটা কাঠের বেঞ্চ, অন্য সময় ভর্তি থাকলেও এতো ভোরে সব গুলোই খালি। তারই একটাতে বসে পড়লো অর্ক। ঠিক ওর পেছনেই ওদের হোটেলটা, সব কটা ঘর থেকেই নদীটা দেখা যায়। দিতি এখন কি করছে কে জানে! এতো ভোরে তো ঘুম থেকে ওঠেনি নিশ্চয়ই! তবু এই পরিবেশে বসে ওর খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে দিতির সঙ্গে, একটু ভেবে ফোনটা করেই ফেললো অর্ক।
অর্ক যাওয়ার পর থেকেই রাতে ভালো করে ঘুম হচ্ছে না দিতির, মনের মধ্যে কেমন যেন একটা ভয় ভয় ভাব সব সময়। শুধু ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছে ও, অর্ক না থাকাকালীন যেনো কিছু না হয়। ভোরের দিকে সবে মাত্র একটু চোখ টা বুজে এসেছিলো, এমন সময় অর্কর ফোন এলো। গলাটা শুনেই মনটা ভালো হয়ে গেলো দিতি র।
জায়গাটা খুব সুন্দর না?
খুব উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন করলো দিতি,
খুব সুন্দর, কিন্তু এতো দায়িত্ব যে উপভোগ করার সময় নেই। তোমার জন্যেও খুব টেনশন হচ্ছে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? সবাই যদি আসতে পারতাম তবেই এনজয় করতে পারতাম,
অর্কর কথায় খুশি হলো দিতি, ও ও তো যেতে চায়, কিন্তু উপায় কই!
আজ রাতের ট্রেনে উঠছি, তারপর আর কোনো চিন্তা নেই। আজকের রাতটা একটু সাবধানে থেকো,
দিতি জবাব দিলো থাকবে। ও যে নিজে কতটা টেনশনে আছে সেটা তো আর অর্ক জানে না!
কতক্ষন থেকে একা বসে আছি, আর কতক্ষন ওয়েট করবো?
কথা বলতে বলতে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলো দুজনেই, হটাৎ করেই ফোনের ওপাশের নারী কন্ঠ অদিতি কে চুপ করিয়ে দিলো। কেউ অর্কর ফোনে কথা শেষ হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে! কে সে! অর্ক কি তাহলে ওখানে একা নেই! কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একগাদা প্রশ্ন অদিতির মাথার মধ্যে ঘোরা ফেরা করতে লাগলো।অর্ক চমকে ফিরে তাকালো, ও তো কারোর সঙ্গে আসেনি! ওর জন্যে আবার কে অপেক্ষা করবে! ঘুরে তাকিয়েই অর্ক স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, ওর ঠিক পাশের বেঞ্চে রিয়া বসে ফোনে কথা বলছে, বন্ধুদের জন্যে অপেক্ষা করছে বোধ হয়!
ততোক্ষনে দিতি ধৈর্য্য হারিয়েছে, একের পর এক প্রশ্নবাণ অর্কর দিকে ধেয়ে এল সঙ্গে সঙ্গেই,
তোমার সঙ্গে কে আছে?
অর্ক তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো, অদিতি যা! এক্ষুনি না ভুল বুঝে ফোনের মধ্যে উল্টোপাল্টা কথা শুরু করে! নদীর ধার বরাবর হেঁটে যেতে যেতে একটু নিচু গলায় বললো,
আমার স্টুডেন্ট, ও ফোনে কারোর সঙ্গে কথা বলছে, বন্ধুদের জন্যে অপেক্ষা করছে বোধহয়।
বাবা! একেবারে তোমার পাশে বসেই ফোনে কথা বলছে! কে সে? সামান্য সভ্যতা ভদ্রতা নেই! একজন কথা বললে একটু দূরে গিয়ে কথা বলতে হয় এটকুও জানে না!
বিরক্ত গলায় বললো অদিতি, অর্ক তাড়াতাড়ি পেছন ফিরে তাকালো। কেউ শুনতে পেলো না তো! দিতি যা চিৎকার করে বলছে! অদিতি আবার জিজ্ঞেস করলো,
কে সে? বললে না তো?
চারপাশ দেখে নিয়ে গলাটা একটু নামিয়ে উত্তর দিলো অর্ক,
রিয়া।
অদিতি একদম চমকে গেলো, এই মেয়েটা কেই তো দেখেছিলো ও! যদিও অর্ক একটা অন্য নাম বলেছিলো, নামটা এখন আর মনে নেই।
ও ওখানে কখন এলো? বলোনি তো?
আমি নিজেই জানিনা কখন এসেছে! আমি তো তোমার সঙ্গে কথা বলছিলাম, খেয়াল করিনি। আর ও কখন এসেছে তাতে আমাদের কি এসে যায়? তুমি যা বলছো বলো না, আমি ওখান থেকে উঠে এসেছি,
বলতে বলতে হোটেলের রাস্তায় এগিয়ে গেলো অর্ক। মনে মনে নিজেও একটু বিরক্ত হলো, মেয়েটা এতো জোরে ফোনে কথা বলে যে, যে কেউ শুনলে ভাববে পাশের কারোর সঙ্গে কথা বলছে। যখন হোটেলের গেট দিয়ে ঢুকছে তখন ওর কৌশিকের সঙ্গে দেখা হলো, ও ফোনে কথা বলতে বলতেই নদীর দিকে হেঁটে যাচ্ছে। অর্ক বুঝলো রিয়া সম্ভবত ওর সঙ্গেই কথা বলছিলো, আর বেশি কিছু না ভেবে ও নিজের ঘরে ঢুকে গেলো।
একা একা এখানে বসে আছিস?
রিয়ার পাশে বসতে বসতে বললো কৌশিক, রিয়া ঘাড় নাড়লো,
আমার একা ভালো লাগে।
তাহলে আর আমাকে ডাকলি কেনো? একাই তো ভালো থাকিস তুই!
তা নয়! এই পরিবেশে একা বসে থাকতে ভালো লাগে, মনে হয় এখানেই থেকে যাই! বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না!
উদাস গলায় বললো রিয়া, কৌশিক হেসে ফেললো,
তুই এখানে থেকে যাবি? ভালোই তো! তোর বাবার তো পয়সার অভাব নেই! একটা জায়গা কিনে ফেলতো। বেশ আমরাও মাঝে মাঝে এসে থাকবো!
রিয়া কৌশিকের দিকে খুব করুন দৃষ্টিতে তাকালো,
মজা করছিস! আমি কিন্তু করছি না! বিশ্বাস কর আমার বাড়ি ফিরতে সত্যি ইচ্ছে করে না!
এবার কৌশিক সিরিয়াস হলো, একটু চুপ করে থেকে বললো,
তুই তো কোনোদিনও সেই ভাবে কোনো কিছু শেয়ার করিস নি আমার সঙ্গে! আজ পর্যন্ত তোর সঙ্গে মেট্রো থেকে নামা সত্বেও তোর বাড়িতে কোনোদিনও ডাকিস নি। শুধু তোর বাবার কথা শুনেছি, কাকু, কাকিমা কাউকেই দেখিনি আজ পর্যন্ত!
গিয়ে কি করবি! তোর ভালো লাগবে না! আমাদের বাড়িতে জানিস তো সব সময় অশান্তি হয় বাবা মায়ের মধ্যে। আর তাছাড়া বাবা কিরকম তোকে তো বলেইছি! ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করে না!
কি নিয়ে এতো সমস্যা তোদের? প্রশ্নটা একটু পার্সোনাল হয়ে গেলো না?
কথাটা বলেই লজ্জায় পড়লো কৌশিক, রিয়া কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মৃদু গলায় বললো,
হ্যাঁ, সব কথা বলতে চাইলেও বলা যায় না রে! আমি যেগুলো তোকে বললাম, আর কাউকে বলিস না প্লিজ! তোকে অনেক কিছু তাও বলতে পারি, কিন্তু সবাই কে সেটাও পারিনা! আমি খুব বেশি ভালো নেই রে!
এভাবে কেনো ভাবছিস! অশান্তি তো সব বাড়িতেই কম বেশি হয় তাই না? তাই বলে তুই ভালো থাকবি না কেনো?
তুই জানিস না! এই যে বাবার জন্যে তোদের কে বাড়িতে ডাকতে পারিনা বা গাড়ি নিয়ে কোথাও যেতে পারি না, এটা কেউ বিশ্বাস করে না। সবাই ভাবে আমি মিথ্যে কথা বলি!
রিয়ার গলায় মন খারাপের সুর শুনে কৌশিকের খারাপ লাগলো, খানিকটা আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললো,
এটা ঠিক নয়! এরকম কেউ ভাবে না! তুই এগুলো নিজেই ভাবছিস! আমি জানি তুই হয়তো কোনো কোনো সময় তিয়াসার কথা শুনে এটা মনে করেছিস, তবে এটা আমাদের সবার কথা নয়। আসলে তিয়াসার রাগের কারণ অন্য, যদি আমরা অনির্বাণের গাড়ি নিয়ে যেতে চাই তাই!
জানিনা কেনো ও আমাকে পছন্দ করে না! আমি তো কোনোদিনও ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি! আমি ঠিক করেছি মনে মনে, পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে আমি আর কারোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবো না!
এটা কি আমার জন্যেও প্রযোজ্য? পারবি করতে এরকম?
একটু দুঃখের গলায় বললো কৌশিক, রিয়ার চোখ ছলছল করছিলো।
পারবো! জানিস তো, আজ পর্যন্ত আমি যাদের ভালো চেয়েছি, ভালো বেসেছি, তারা সবাই আমার থেকে দূরে সরে গিয়েছে! তারা কেউ আমার কথা ভাবে নি! তাই আমিও এখন কারো কথা ভাবি না! কেনো ভাববো বলতো? একতরফা আমিই কেনো কষ্ট পাবো সব সময়!
সে তুই দু একজনের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখতেই পারিস, কিন্তু তাই বলে সবার সঙ্গেই করিস না। কেউ তোকে ভালোবাসে না, এটা ঠিক না! কাকু একটু কড়া হয়তো কিন্তু ভালো তোকে নিশ্চয়ই বাসেন!
কৌশিকের কথায় মাথা নাড়লো রিয়া, খুব থেমে থেমে বললো,
না রে বাসেনা! আগে হয়তো বাসতো, কিন্তু এখন আর ভালোবাসে না! এমনকি মাও তাই! আমি বাবা কে বেশি ভালোবাসি বলে মায়ের রাগ হয়, মায়ের সঙ্গে যেহেতু বাবার বনে না, তাই আমি যেনো বাবার সঙ্গে বেশি কথা না বলি, এটা মায়ের ইচ্ছে! যাকগে! ওসব বেশি ভাবিনা আর, কয়েকটা মাস, তারপরে বাইরে কোথাও চাকরি নিয়ে চলে যাবো।
নদীর ওপারের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইলো রিয়া, আর কোনো কথা বললো না। কিছুক্ষন পরে কৌশিক আস্তে আস্তে বললো,
এতো কিছু জানতাম না রে! আগে তো কোনোদিনও বলিস নি, শুনে খারাপ লাগছে! সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করিস না, এরকম অনেকেরই হয়।
রিয়া ঘাড় নাড়লো,
কিচ্ছু ঠিক হবে না আর। তবে এটা ঠিক যে অনেকেরই হয়। আমি যখন এখানে এলাম তখন অর্ক স্যার বউয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন। জানি না কি নিয়ে রাগারাগি হলো, স্যার উঠে চলে গেলেন যাতে আমি শুনতে না পাই!
কৌশিক কৌতূহলী হলো,
তুই কি করে বুঝলি বউয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন?
রিয়া হাসলো,
কি যে বলিস! বউ না বন্ধু সেটা কথার ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় না নাকি!
ক্রমশ