#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_২৪
#নবনী_নীলা
” ফাহাদের অতীতের সবটা জানবো বলেই আমি দেশে ফিরে এসেছি। নয়তো এইখানে ফিরে আসার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিলো না।”, খুব কঠিন গলায় বললো সুনেয়রা।
” বাট আই চেঞ্জ মাই প্ল্যান।তোমাকে আমি কিছু বলছি না। যা বলার আমি তোমার বাবা মানে আফজাল সাহেবের সাথে শেয়ার করতে চাই।” আদিল শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
সুনেয়রা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। হাতে থাকা রেড ওয়াইনের গ্লাসটা টেবিলের একপাশে রেখে বললো,” কিন্তু তুমি আমাকে সবটা বলবে বলেছিলে। তার মানে কি তুমি আমাকে বিশ্বাস করছো না?”
” তোমার কি মনে হয়? তুমি কি সেই বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছো? যেখানে ফাহাদ আর তোমার সম্পর্কটাই আমার কাছে ক্লিয়ার হয় নি। সেখানে তোমাকে বিশ্বাস করাটা কি বোকামি না?” তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো আদিল।
সুনেয়রা একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,” ঠিক আছে কি জানতে চাও বলো। আমি তোমাকে সব বলছি।”
আদিল তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” ফাহাদের সাথে তোমার কি করে বিয়ে হলো? আমার জানা মতে অবৈধ কাজে জড়িত থাকায় ওর শাস্তি হয়েছিলো। ”
” হ্যা, হয়েছিল কিন্তু বাবা ওকে ছাড়িয়ে নেয়। তারপর থেকেই ও বাবার সাথে কাজ করছে। আমাদের বিয়েটা হয়েছে ঠিক কিন্তু সবসময় ফাহাদ আর আমার মধ্যকার দূরত্ব দিন দিন
বেড়েছে। প্রথমে না বুঝলেও ধীরে ধীরে আমি সে সবই বুঝতে পারি। আমি ওকে ভালোবাসলেও ফাহাদ আমাকে ভালোবাসেনি।” নিচু স্বরে বললো সুনেয়রা।
” আমি তো ভেবেছিলাম আমার বোনকে ঠকিয়েছে তোমাকে ভালোবাসে বলে।”চোয়াল শক্ত করে বললো আদিল।
” তোমার বোনকে ঠকিয়েছে মানে?”, চমকে উঠে বললো সুনেয়রা।
” আমার বড় বোন আরোহী ভালোবেসে ওকে বিয়ে করেছিলো। বিয়ের পর হটাৎ সে উধাও তারপর খোঁজ নিয়ে জানা যায় সে জেলখানায় বন্ধি। অবৈধ কারবারের জন্যে তাকে অ্যারেস্ট করা হয়। শুধু তাই নয় ফাহাদ আমার বোনকে ঠকিয়ে তোমায় বিয়ে করেছে শুধু ক্ষমতার লোভে। আর এই সব আঘাতের কারণেই আমি আমার বোনকে হারিয়েছি। বাকি সব আমি নাই বা বললাম। তাই যেকোনো মূল্যে আমি ফাহাদের শেষ দেখতে চাই।” বলতে বলতে হাত মুষ্টি বন্ধ করলো সে।
” ফাহাদ আর আমার মাঝে অনেক দুরত্ব ঠিকই কিন্তু ওর কোনো ক্ষতি হোক সেটা আমি চাই না।”, কাঠ গলায় বলল সুনেয়রা।
” তোমার চাওয়া না চাওয়াতে তো কিছু হচ্ছে না। তুমি যতই ফাহাদের প্রতি নিজের কেয়ার ভালোবাসা দেখানোর চেষ্টা করো।কিন্তু তুমি নিজে ওকে ব্যাবহার করেছো। সো ডোন্ট অ্যাক্ট লাইক ইউ কেয়ার এবাউট হিম।”,তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো আদিল।
“দেখো আবরার এই বিষয়ে আমি তোমাকে কোনো হেল্প করতে পারবো না। অ্যাম রিয়েলি সরি।”,করুন দৃষ্টিতে বললো সুনেয়রা।
” আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে। সেইজন্যে তো আফজাল সাহেবের সঙ্গে দেখা করা চাই। ওনার বিরুদ্ধে ফাহাদ যেই ষড়যন্ত্র করছে সেটা ওনাকে জানাবার সময় হয়ে এসেছে।” বলতে বলতে আদিল উঠে দাড়ালো তারপর টেবিলে এক হাত রেখে ঝুকে দাড়িয়ে বলল,” ফাহাদকে পুলিশের হাত তুলে দিতে চাইলে সেটা আমি অনেক আগেই করতে পারতাম কিন্তু আবারো কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের লোক ওকে ঠিক বের করিয়ে আনতো।শাস্তিটাই তো ওর পাওয়া হতো না। তাই ওর উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা এইবার আমি নিজে করবো। তুমিও ওকে বাঁচাতে পারবে না।”
____________
বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও স্নিগ্ধা এখনো জেগে আছে। আজ কেনো জানি তার চোখে ঘুম নেই। তখন থেকে একটা বই মুখের সামনে নিয়ে বসে আছে কিন্তু আজ বই পড়ায় তার মন বসছে না। স্নিগ্ধা রেগে বইটা বন্ধ করে ফেললো। তারপর ঘড়ির দিকে তাকালো। বেশ রাত হয়েছে।
মানে ওই শাকচুন্নির সাথে দেখা করতে গিয়েছে তো উনার ফেরার নাম নেই। সারাদিন তার পিছু পিছু আর যখন তাকে প্রয়োজন তখনই সে উধাও। কি এমন কথা সেই মেয়ের সাথে যে এতো রাতে বাড়ির বাইরে থাকতে হবে।
কিছু বলাও যায় না বললেই জিলাপির মতন কথা পেচাতে থাকে। নাহ্ বউ থাকতে এতো রাতে বাইরে থাকবে কেনো সে?
আজকে আসুক একবার এই রুমেই জায়গা দিবে না সে। একদম রাত করে বাইরে থাকা ছুটিয়ে দিবে। আজ লোকটা স্নিগ্ধা তাসনিমের আসল রূপ দেখবে। অসভ্য একটা ছেলে। যতই হোক তারই তো বর। তার রাগ হবে না? অবশ্যই হবে। মেয়েরা নিজেদের বরের ব্যাপারে একটু বেশি পসেসিভ হয়। যতই বর তাদের পছন্দের হোক কিংবা অপছন্দের।
স্নিগ্ধা আবারো ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত একটা বাজে কিন্তু দেখো কোনো হদিস নেই লোকটার। স্নিগ্ধা উঠে দাড়ালো। তারপর ভিতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় পা তুলে বসে রইলো। আজ এই রুমে আদিলের জায়গা হবে না। যেখানে ছিল সেখানেই থাকুক সে।
______________
আদিল নিজের রুমের সামনে এসে বেশ অবাক হলো। দরজা বন্ধ কেনো? ভিতরে কি কেউ আছে নাকি দরজা লক হয়ে গেছে? লক হয়ে গেলে তো মুশকিল কারণ লকের চাবি তো তার কাছে নেই। আদিল অভ্রর রুমে এসে একবার দেখলো। স্পৃহা আর অভ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। স্পৃহা আর অভ্র এইখানে তাহলে স্নিগ্ধা কোথায়? রূমের ভিতরে নাকি! আদিল একটু অবাক হলো ব্যাপারটা ভেবে। স্নিগ্ধা দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি? কখনো তো এমন করে না।
আদিল সারা বাড়িতে খুঁজে দেখলো স্নিগ্ধা কোথাও নেই। তাহলে কি তার ধারণাই সঠিক? আদিল রূমের সামনে দাড়িয়ে আছে। নক করবে কিনা বুঝতে পারছে না। স্নিগ্ধা যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলে ঘুম ভাঙ্গানো ঠিক হবে না।
জিম নিজের রুমে যাওয়ার সময় আদিলকে এইভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বললো,” দরজা কি লক হয়ে গেছে?”
আদিল না সূচক মাথা নাড়লো তারপর বললো,” দাড়াও দেখছি।” বলেই দরজায় দুবার নক করলো। কোনো সাড়া শব্দ নেই। কিন্তু তৃতীয় বার নক করতেই স্নিগ্ধা বিস্ফোরিত কণ্ঠে বলে উঠলো,” কি সমস্যা? বার বার নক করছেন কেনো? সবাই কি আপনার মত রাত জাগা পেঁচা নাকি! যে রাত জেগে বেড়াবে? আজকে আমি দরজা খুলবো না। যান যেখানে ছিলেন ঐখানেই যান। এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি এলেন কেনো?”
স্নিগ্ধার এমন কথা জিম আদিল একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। আদিল ভ্রূ কুচকে দরজার দিকে তাকালো। স্নিগ্ধার রাগের কারণ বুঝতে পেরে মুহূর্তেই ঠোঁট কামড়ে নিজের হাসি থামিয়ে জিমের দিকে তাকালো। জিম সন্দেহ জনক দৃষ্টিতে আদিলের দিকে তাকালো।
স্নিগ্ধা রাগে ফুলতে লাগলো। সে যে এতো কথা বললো লোকটার কোনো সাড়া শব্দ আছে? তাহলে কি সত্যি সত্যি চলে গেছে নাকি? এরপর তো আর নক করলো না। স্নিগ্ধার ভাবনার মাঝেই আবারো দরজায় টোকা পড়লো। স্নিগ্ধা উঠে দাড়ালো তারপর ভ্রু কুঁচকে আওয়াজ দিয়ে বললো,” কে? ”
দরজার ওপাশ থেকে জিমের আওয়াজ কানে ভেসে আসলো। জিম উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলছে,” দরজাটা খুলুন।”
স্নিগ্ধা কড়া গলায় বললো,” আপনি কি সুপারিশ করতে এসেছেন নাকি? শুনুন এইসবে লাভ হবে না। আমি আজকে দরজা খুলবো না।থাকুক উনি বাইরে।”
জিম ক্লান্ত গলায় বললো,” স্যারের অবস্থা ভালো না। প্লীজ দরজাটা খুলুন।”
নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ ” নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ” এবং ফলো করে সাথেই থাকুন।
স্নিগ্ধার বুকের ভিতরে ধুক করে উঠলো জিমের কোথায়। অবস্থা ভালো না মানে? এইজন্যেই কি আদিল তার কথার জবাব দেয় নি। স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে দরজা খুললো। দরজা খুলতেই স্নিগ্ধা দেখলো জিম আদিলকে ধরে রুমে ভিতর নিয়ে এলো। বেশামাল হয়ে পড়েছে আদিল। স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে আদিলকে ধরলো তারপর বিছানায় শুইয়ে দিলো কোনোভাবে।
স্নিগ্ধা ভয়ার্ত গলায় বললো,” কি হয়েছে ওনার?” জিম শান্ত গলায় বললো,” ভুলে মাশরুম সুপ খেয়ে নিয়েছেন। মাশরুমে আবার ওনার সমস্যা আছে। কিন্তু চিন্তার কারণ নেই আমি মেডিসিন পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
স্নিগ্ধার চোখ মুখে চিন্তা স্পষ্ট। জিম রুমে থেকে বেরিয়ে যেতেই সে ব্যাস্ত হয়ে আদিলের পাশে এসে বসলো। জিম যাবার সময় দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দিল।
স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে আদিলের কপাল আর গলায় হাত দিয়ে দেখতে লাগলো আসলেই কিছু হয়েছে নাকি। আদিল খুব ধীরে নিজের চোখ খুললো তারপর অস্পষ্ট সুরে বলল,” পানি।”
স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে বললো,” আচ্ছা আমি আনছি।” বলেই সে উঠে পড়ল তারপর টেবিল থেকে গ্লাসে করে পানি নিয়ে এসে আদিলের মাথার কাছে বসলো। আদিলকে খুব যত্নে নিজের বাহুতে জড়িয়ে ধরে বসালো তারপর পানি খাইয়ে দিলো। হটাৎ এমন অসুস্থ হয়ে পড়লো কেনো আদিল।
আদিল ভিতরে আসার উপায় পেয়েছে ঠিকই কিন্তু সে স্নিগ্ধার হাত স্পষ্ট কাপতে দেখছে। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তখন স্নিগ্ধা ঘাবড়ে যায়। কি করবে সে বুঝতে পারে না। নিজেকে তখন অসহায় মনে হয়। স্নিগ্ধা অস্থির হয়ে বললো,” আপনার কি বেশি খারাপ লাগছে? এসি বাড়িয়ে দিবো? গরম লাগছে?” বলতে বলতে আদিলের কপালের সামনের চুলগুলো সরিয়ে দিলো। অস্থিরতায় ভরে গেছে স্নিগ্ধার চেহারায়। ঐ শাকচুন্নি আবার উল্টা পাল্টা কিছু খাইয়ে দেয় নি তো। স্নিগ্ধা এসি বাড়াতে যেই উঠতে যাবে আদিল খপ করে স্নিগ্ধার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো।
হটাৎ আদিলের এমন ব্যাবহারে স্নিগ্ধা বিষ্ময় নিয়ে তাকালো।বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো যখন আদিল মৃদু হেসে তাকালো। সেই হাসির আড়ালে দুষ্টু হাসিটা চোখে পড়তেই রাগে দাতে দাত চেপে তাকালো স্নিগ্ধা। স্নিগ্ধা বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” এতক্ষণ আপনি নাটক করছিলেন আমার সাথে?” বলেই নিজের হাত ছাড়াতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো সে। রাগটা এবার তার দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
[ #চলবে ]
#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_২৫
#নবনী_নীলা
স্নিগ্ধা বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” এতক্ষণ আপনি নাটক করছিলেন আমার সাথে?” বলেই নিজের হাত ছাড়াতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো সে। রাগটা এবার তার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আদিলের এই হাসিতে স্নিগ্ধা রাগান্বিত চোখে তাকালো তারপর নিজের সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে সরিয়ে আনতে চেষ্টা করতেই আদিল স্নিগ্ধার দুই হাত বিছানার সাথে চেপে ধরলো।
স্নিগ্ধা হকচকিয়ে তাকালো চোখের পাতা কয়েকবার ফেলে রাগী কন্ঠে বলল,”কি করছেন আপনি? ছাড়ুন আমাকে। আমি থাকবো না আপনার সাথে।”
আদিল স্নিগ্ধার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,” একটা মেয়ে সাথে দেখা করেছি বলে এতো রাগ? আমার বউ যে এত পজেসিভ সেটা তো আমার জানা ছিল না।”
আদিলের কথা শুনে স্নিগ্ধা চোখ বড় বড় করে তাকালো তারপর বললো,” কিসের পজেসিভ? হ্যাঁ! আপনি একটা মেয়ে কেনো হাজার হাজার মেয়ের সাথে দেখা করুন। আমার কি?”
আদিল তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,” তোমার কিছুই না? যদি কিছুই না হবে তাহলে তো তোমার রাগ করা সাজে না। কারণ তারাই শুধু রাগ করতে পারে যারা ভালোবাসে।তার মানে তোমার তো কিছুই যায় আছে না।”
স্নিগ্ধা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে তাকালো তারপর অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,” আমার কেনো কিছু যায় আসবে?”
আদিল ভ্রু কুচকে তাকালো। স্নিগ্ধা এখনো মানতে নারাজ। মেয়েটা রেগে আছে ঠিকই কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলবে না। ঠিক আছে, আবরার ফাইয়াজ কম না সত্যি কথাটা একদিন না একদিন ঠিক তোমার মুখ থেকে বের করবে।
আদিল কিছুক্ষণ শান্ত দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে থেকে হাতে বাঁধন আলগা করল। তারপর স্নিগ্ধার পাশাপাশি শুয়ে মাথা নিচে দুই হাত রেখে বলল,” তোমার যখন কিছু যায় আসে না তাহলে আমাকে আগে বলতে পারতে আজ রাতে থেকে গেলেই পারতাম।”
আদিলের হঠাৎ এমন কথায় স্নিগ্ধা বড় বড় চোখ করে তাকালো। আজ রাত থেকে গেলে পারতো মানে? স্নিগ্ধা বিস্ফোরিত কন্ঠে বলল,” মানে?”
আদিল ভাবলেশহীন গলায় বলল,” হুম্, থেকে গেলে মন্দ হতো না। শুধু শুধু এলাম, আমাকে তো তোমার প্রয়োজন নেই।” বলেই ঘাড় কাত করে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো।
স্নিগ্ধার চোখে মুখে আগুন জ্বলছে। সে ক্রোধ নিয়ে বলল,’ হ্যাঁ এসেছে কেনো? এখনি চলে যান। গাড়ী বের করতে বলুন। চলে এসেছেন বলে খুব আফসোস হচ্ছে তাই না? আফসোস করতে হবে না আপনাকে আর। আপনি যান। এক্ষুনি যান।”দাঁতে দাঁত চিপে কথাটা শেষ করলো স্নিগ্ধা।
আদিল সূক্ষ্ম কন্ঠে বলল,” আমার জন্যে এতোক্ষণ অপেক্ষা করলে তোমাকে ফেলে কি করে যাই। এতো সুন্দর বউ রেখে কি যেতে ইচ্ছে করে নাকি?’ বলেই আদিল মৃদু হেঁসে তাকালো।
স্নিগ্ধা আরো চটে গিয়ে বলল,” কে বলেছে? আমি আপনার জন্য জেগে আছি। নিজেকে কি ভাবেন আপনি? আপনার যেখানে ইচ্ছা আপনি যান, যেখানে খুব খুশি আপনি থাকুন। আমি কে হই? আপনার কাছের মানুষের অভাব আছে নাকি?” বলে রেগে উঠে যেতে নিলো কিন্তু তার আগেই আদিল স্নিগ্ধার কোমর জড়িয়ে একদম নিজের কাছে নিয়ে এলো তাকে।
আদিলের হঠাৎ এমন কান্ডে স্নিগ্ধ হতবাক হয়ে তাকালো আদিল স্নিগ্ধার কপালের চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে খুব সুন্দর করে হাসলো। আদিলের অদ্ভুত সুন্দর হাসি স্নিগ্ধার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হল।
হঠাৎ মনে হচ্ছে অজান্তেই নিজের কোনো এক অনুভূতি সে প্রকাশ করে ফেলেছে, যে অনুভূতি সম্পর্কে সে নিজেও অব্যাহত নয়
স্নিগ্ধা একটা ঢোক গিলে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো তারপর নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো।
কিন্তু আদিল হাতের বাধন আরো শক্ত করে ফেলল আর অন্য হাত স্নিগ্ধার গালে ডুবিয়ে দিয়ে বলল,” তুমি কি জানো? রেগে গেলে তোমাকে কতটা সুন্দর লাগে?” ঘোরলাগা কন্ঠে অনুভূতির এমন অভিপ্রায় স্নিগ্ধার গাল দুটো লাল আভায় ভরে গেলো।
বুকের ভিতর ধুক ধুক বেড়েই চলেছে। আদিল স্নিগ্ধাকে নিজের আরো কাছে নিয়ে আসতে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল তার। স্নিগ্ধা আড়চোখে একবার আদিলের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল।
আদিলের দৃষ্টি স্পষ্ট ও নিবিড় স্নিগ্ধা কিছু বলতেও পারছিনা। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। আদিল তার খুব কাছে চলে এসেছে। আদিলের নিশ্বাস তার গলায় আঁছড়ে পড়ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আদিল স্নিগ্ধার একদম কাছে চলে এসে অধর দুটি মিলিয়ে। স্নিগ্ধা চোখ বুজে হাত মুষ্টি বন্ধ করে ফেললো।
হটাৎ এতো ঘনিষ্ঠতা তাকে এক রক্তিম আবরণে ঢেকে দিয়েছে।
আদিলের স্পর্শ আরো গভীর হতেই স্নিগ্ধা দুই হাতে আদিলকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে হাপাতে লাগলো।
আদিল নিচের ঠোঁট কামড়ে এক বেসামাল দৃষ্টিতে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে চোখ পড়তেই অকারনেই শিউরে উঠলো স্নিগ্ধা। মস্তিষ্কের নিউরন সজাগ হতেই লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে ফেললো সে। দু হাতে নিজের ওষ্ঠ দুটি চেপে ধরে নিজের ভিতরে অন্য এক অনুভূতি আবিষ্কার করলো সে। নিজের এই অনুভূতি নিয়ে ভাবার আগেই বলিষ্ঠ এক হাত তার পেট স্পর্শ করলো।
প্রতিবারের মতন কেপে উঠলো সে। আদিল স্নিগ্ধাকে তার একদম ঘনিষ্ট করে জড়িয়ে ধরে তার চুলের ভাজে মুখ গুঁজে দিলো। শাড়ির আঁচল শক্ত করে চেপে ধরলো সে। দ্রুত নিশ্বাস ফেলতে লাগলো স্নিগ্ধা।আদিলের নিশ্বাস অনুভব করতে পারছে সে।নিজের উপর থেকে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে।
আদিল তার চুলের ভাজে মুখ গুজে ঘোর লাগা কণ্ঠে ” স্নিগ্ধা।” নামটা উচ্চারণ করেই থেমে গেলে। আদিলের এতো কাছে থাকার পরো আদিলের এমন ডাকে স্নিগ্ধার বুকের ভিতরটায় তোলপাড় শুরু হলো।
সেই মিষ্টি ভালোলাগার ডাক প্রত্যাখ্যান করে স্নিগ্ধা আদিলকে সরিয়ে দিতে বললো,” কি করছেন ছাড়ুন।?”খুব ধীর কণ্ঠে বললো সে।
কিন্তু মুহূর্তেই হাতের বাধন আরো শক্ত করে ফেললো আদিল।স্নিগ্ধা চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে ধরলো।
আদিল হাত বাড়িয়ে ঘাড়ের ওপর চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ফিচেল কণ্ঠে বললো,” অ্যাম গেটিং অ্যাডিক্টেড স্নিগ্ধা। নেশা ধরে যাচ্ছে যে আমার তোমার প্রতি।” কথাগুলো কর্নগোচর হতেই স্নিগ্ধা চোখ খুলে তাকালো। আড় চোখে একবার আদিলের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়লো তার। আদিলের চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো সে।
ভালোবাসার অদ্ভূত এই নেশা তাকেও যে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে, সে সেটা বুঝতে পারছে। কিন্তু তাকে পুরোপুরি গ্রাস করার আগেই হুশ ফিরল স্নিগ্ধার। নিজেকে সামলে নিয়ে তাকালো আদিলের দিকে। বেসামাল আদিলের হাত থেকে রেহাই পেতে তাকে ভয়াবহ একটা পদক্ষেপ নিতে হবে। স্নিগ্ধা একটা ঢোক গিলে আদিলের দিকে তাকালো।
আদিলের দুরত্ব কমিয়ে আনতেই স্নিগ্ধা সুযোগ বুঝে আদিলের গলায় সজোরে এক কামড় বসিয়ে দিলো।আদিল ভ্রু কুঁচকে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্নিগ্ধা আদিলকে সরিয়ে দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো।
তারপর দৌড়ে দরজার কাছে চলে গেলো।প্রথমে দরজা খুলতে পারছিলো না তবে পরে কয়েকবার টানতেই দরজা খুলে গেলো। তারপর স্নিগ্ধা কড়া চোখে একবার আদিলের দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। দরজা খুলে যাওয়ায় আদিল বেশ বিরক্ত হলো। জিমকে দিয়ে এসব কাজ হবে না তার জানাই ছিলো।
আদিল ঘাড় কাত করে একবার আয়নায় নিজের গলার দিকে তাকালো। একদম দাগ বসিয়ে দিয়েছে স্নিগ্ধা। কিন্তু পরক্ষনেই আদিল নিচের ঠোঁট কামড় হেসে ফেললো।
____________________
এই বাড়ি থেকে বের হওয়া যায় না কেনো সেটাই স্পৃহা বুঝে উঠতে পারছে না। কম দিন তো হলো না উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।
মানে বাড়ি আর বাগানের মাঝেই নিজেকে আটকে রাখতে হয়। বাড়ির বাইরে না গেলে হয়তো এই আরোহী রহস্যের সমাধান হবে না।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্পৃহা অবাক হয়েছে।কারণ অভ্র আর তার পাশে এসে স্নিগ্ধা ঘুমিয়ে আছে।
হটাৎ এইরুমে এসে ঘুমাবার কি প্রয়োজন পড়লো তার? স্পৃহা মুখ কুচকে বিছানা থেকে নামলো। তার মাথা গরম হয়ে আছে। আর সে এই বাড়িতে বন্দী জীবন কাটাতে পারবে না। বাড়ির বাইরে তো সে যাবেই।
ঘুম থেকে উঠে স্পৃহা চোখ কচলাতে কচলাতে নিচে নেমে দেখলো জিম একজন স্টাফের উপর ভীষন রাগারাগি করছে। জিমের বিস্ফোরিত কণ্ঠে রীতিমত ভয় পেয়ে তাকালো সে। যাকে জিম এতো বকাবকি করছে সে একটা কথাও বলছে না রীতিমত কাপছে। স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গেলো। ভোর হতে না হতেই লোকটা হিরোগিরি দেখতে শুরু করেছে।
স্পৃহা জিমের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো তারপর কোমর হাত দিয়ে বললো,” এভাবে চেঁচাচ্ছেন কেনো? ভালো করে কথা বলা যায় না?”
স্পৃহার কন্ঠ শুনেই সে বুঝেছে মেয়েটা আবার এইখানে এসেছে এখন উল্টা পাল্টা কথা বলে তার মাথা খাবে। জিম দাতে দাঁত চিপে বিরক্তি নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তারপর কঠিন গলায় বললো,” সব ব্যাপারে তুমি কথা বলতে আসো কেনো? দেখছনা কথা বলছি?”
স্পৃহা ভ্রূ কুচকে বললো,” কথা বলছেন কোথায়? আপনি তো ধমক দিয়ে লোকটাকে তিন হাত মাটির নিচে পুঁতে ফেলেছেন।”
জিম রেগে গিয়ে বললো,” তুমি আর তোমার এই স্টুপিড কথাবার্তা আমার সাথে কথা বলতে আসবে না। বুঝতে পেরেছো?” বলেই পাশের স্টাফকে বললো,” আর তুমি গেস্ট রূমে গিয়ে বসো। তুমি আসলে কার রেফারেন্সে এইখানে এসেছো সেটা না জানা অব্দি তোমার কোথাও যাওয়া চলবে না।” জিমের কথা শুনে লোকটা একবার মাথা তুলে তাকালো। জিম কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” কি হলো শুনতে পাও নি, কি বলেছি?”
লোকটা চোখ নামিয়ে ফেললো তারপর হা সূচক মাথা নেড়ে চলে গেলো। লোকটা চলে যেতেই জিম স্পৃহার দিকে তাকালো। স্পৃহা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। জিম চলে যেতে নিলো স্পৃহা পথ আটকে বললো,” আচ্ছা এই লোকটা কি কোনো দামী গ্লাস ভেঙে ফেলেছে যে এমন উত্তম মাধ্যম কথা শুনালেন?”
জিম ভ্রূ কুচকে বললো,” হোয়াট ননন্সেস? ঐ লোকটা যাই করুক তোমার এতো চিন্তা হচ্ছে কেনো?”
স্পৃহা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” আপনি এতো কথা পেটে রেখে ঘুমান কি করে? বদহজম হয় না আপনার?”
জিম বিরক্তি নিয়ে তাকালো তারপর স্পৃহার হাত ধরে টেনে ওকে সরিয়ে দিয়ে উপরে উঠে গেল।
জিম আদিলের রূমের সামনে এসে থামলো। রূমের দরজা খোলা দেখে সে ভিতরে চলে এলো। আদিল এখনো ঘুমিয়ে থাকলেও তাকে জাগিয়ে তোলা জরুরী। জিমের কাছে আর কোনো উপায় নেই। জিম নিজের ফোনের অ্যালার্ম রিং টা বাজিয়ে ফোনটা আদিলের মাথার কাছে রেখে দিল। হটাৎ ফোনের এমন আওয়াজে ধীরে ধীরে আদিলের ঘুম ভাঙলো।
ঘুম ঘুম চোখে তাকাতেই জিমকে দেখে ভ্রূ কুচকে তাকালো সে। জিম ফোনটা হাতে নিয়ে অ্যালার্ম বন্ধ করে পকেটে ভরে বললো,” একটা জরুরী কথা আছে। আপনাকে এক্ষুনি উঠতে হবে।”
আদিল ঘুম ভরা চোখে উঠে বসলো তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,” বেলা সাতটায় তোমার কি প্রয়োজন পড়লো জিম?”
জিম নিচু স্বরে বললো,” এই বাড়িতে আমার একজনকে সন্দেহ হচ্ছে। নতুন একজন স্টাফ নাম আলম। তাকে আমার সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। তাকে নাকি রমিজ মিয়ার অনুপস্থিতে রাখা হয়েছে? আপনি এই ব্যাপারে কিছু জানেন?”
আদিল ঘুম থেকে উঠে চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবলো। ভাবতে ভাবতে তার কপালে ভাঁজ পড়লো। কারণ এমন কাউকে সে অনুমতি দিয়েছে বলে তো মনে হয় না। আদিল বেশ কিছুক্ষন ভাবলো তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বললো,” নাহ্। আমি কাউকে অনুমতি দেই নি। লোকটা কোথায় আছে এখন?”
” আপাদত গেস্ট রুমে যেতে বলেছি।”, চিন্তিত সুরে বললো জিম।
আদিল মাথা নেড়ে বললো,” সন্দেহজনক কিছু তোমার নজরে পড়েছে?”
জিম হা সূচক মাথা নেড়ে বললো,” ভোর পাঁচটা থেকে খেয়াল করেছি সে সারা বাড়ি ঘুরে বেরিয়েছে। বেশ কয়েকবার অভ্রর রূমে গিয়েছে। আর আরোহী ম্যাডামের রূমের সামনে গিয়ে বেশ কিছুক্ষন দাড়িয়ে ছিলো।”
[ #চলবে ]