#শুরুটা_অন্যরকম
#পর্ব_১১
#অধির_রায়
নির্বণ নিজেকে রক্ষা করতে পারল না৷ ছোঁয়ার কাছে শেষে হার মানতে হলো। নির্বণের চোখে শুধু তার মা বাবার ছবি ভেসে উঠছে৷ নির্বণ জলে হাবুডুবু খাচ্ছে।নিজেকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে৷ ধীরে ধীরে জলের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে।
বৃষ্টি বাড়ির জেলেরা নদীতে মাছ ধরছিল৷ হঠাৎ করে জলে পড়ার বিকট শব্দ পেয়ে জেলেরা নৌকা ঘুরিয়ে নির্বণের দিকে আসে৷ তারাই নির্বণকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে।
নির্বণ আর কিছু বলতে পারল না৷ নির্বণ কান্নায় ভেঙে পড়ে। নির্বণ নিয়তির হাত চেপে রেখে কান্না করে করছে ৷ নির্বণের সাথে নিয়তিও কান্না করে করছে ৷ একটা মেয়ে কিভাবে জীবনটা শেষ করে দিল?
— নিয়তি চোখের জল মুছে বলে উঠে, ” আচ্ছা স্যার ছোঁয়ার সাথে আপনার পরিচয় হয় কিভাবে? কিভাবে তার প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়েন?”
নির্বণ নিয়তির দিকে তাকিয়ে মিহি কন্ঠে বলে উঠে, ” আজ বলতে আমার কোন দ্বিধা নেই৷ আমি আজ তোমাকে সব বলব।”
_________
–“আজ রাতে তুমি আর আমি এক থাকে থাকব। অনেক মজা হবে সুইটহার্ট। তোমাকে অনেক সুখ দিব।” ছোঁয়ার বুকের ওড়না টান দিয়ে দুইটা বখাটে ছেলে বসে উঠে।
— ছোঁয়া কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠে, ” প্লিজ দাদা! আমার সাথে এমন করবেন না৷ আমি তো আপনাদের বোনের মতো।”
— প্রথমজন অট্টাহাসি দিয়ে বলে উঠে, ” দুনিয়ার সব মেয়ে আমাদের বোন হলে আমাদের চাহিদা কে মেটাবে। ”
— করুন স্বরে হাত জোর করে বলে উঠে, “আমি আপনাদের পায়ে পড়ি৷ আমার সম্মান নষ্ট করবেন না৷” নারীর সম্মান নারীর কাছে সবচেয়ে দামী।
— “এই পল্টু আমার সুইট বেবির মুখটা বেঁধে গাড়িতে তুল। আজ আমাকে সোহাগ করবে, আমার এই সুইট বেবি৷” ছোঁয়ার গালে হাত দিয়ে বলে উঠে।
পল্টু ছোঁয়ার হাত পিছন দিক থেকে চেপে ধরে। বখাটের প্রথম ছেলে ছোঁয়ার মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দেয়৷ পল্টু ছোঁয়ার ওড়না নিয়ে পিছন দিক থেকে ছোঁয়ার হাত বেঁধে ফেলে। ঠিক তখনই রাস্তা দিয়ে ড্রাইভ করে যাচ্ছিল নির্বণ চৌধুরী।
নির্বণ গাড়ির ব্রেক কষে সিচুয়েশনে বুঝার জন্য৷ ল্যামপোস্টের আলোতে দেখা যাচ্ছে দুইজন ছেলে মিলে একটা মেয়েকে ইভটিজিং করছে৷ নির্বণ সময় নষ্ট না করে হকি খেলার স্টিক নিয়ে একটা ছেলেকে পিছন থেকে মাথায় আঘাত করে। ছেলেটি মাটিতে থুবড়ে পড়ে৷
— নির্বণের হাতে হকি স্টিক দেখে পল্টু বলে উঠে, ” ও হিরো, এখানে হিরোগিরি দেখাতে এসেছিস৷”
— নির্বণ হাতের তলায় হকি স্টিক আপ ডাউন করতে করতে বলে উঠে, ” এই মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে ভালো ভালোই চলে যা৷ তাহলে তোর অবস্থা তোর সঙ্গীর মতো হবে৷ ”
— পল্টু নিজের পকেট থেকে গুলি বের করে,” তুই আমার পথ থেকে সরে দাঁড়া। আমার পথে বাঁধা দিতে আসলে তোকে স্বর্গে পাঠিয়ে দিব৷”
— নির্বণ ভয়ে ভয়ে বলে উঠে, ” প্লিজ স্যার আমার কোন ক্ষতি করবেন না৷ আমি চলে যাচ্ছি৷ আপনার যা ইচ্ছা তাই করেন৷”
— চালাকি করার চেষ্টা করবি না গুলি চালিয়ে দিব৷
নির্বণ পিছনে ঘুরে পায়ের পাতার উপর ভর করে রাউন্ড করেই পল্টুর হাতে হকি স্টিক দিয়ে আঘাত করে৷ যার ফলে পল্টুর গুলি নিচে পড়ে যায়৷ নির্বণ পল্টুকে হকি স্টিক দিয়ে আঘাত করে আহত করে। ছোঁয়াকে নিয়ে সেখান থেকে তারাতাড়ি কেটে পড়ে।
— “এই মেয়ে রাত দু’টার পর তোমার বাহিরে কি কাজ থাকতে পারে? নাম কি তোমার?” ক্ষেপে বলে উঠে।
— কান্না করে দিয়ে, ” আমি ছোঁয়া। আমার মা অসুস্থ। উনার জন্য মেডিসিন নিয়ে ফিরছিলাম৷ তখন তারা আমার পথ আটকায়৷ ”
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমার বাসা এটাই আমি চলে যেতে পারব৷
ছোঁয়া চলে যায় তার বাসায়। নির্বণ ফিরে এসে আর ঘুমাতে পারেনা৷ চোখের সামনে ছোঁয়ার মায়াবী মুখটা ভেসে উঠে। এভাবে কিছুদিন পার হয়ে যায়৷ নির্বণ প্রায় ছোঁয়াকে ভুলে গেছে৷ হঠাৎ করেই ক্যাফেতে ছোঁয়ার সাথে নির্বণে দেখা৷ সেদিন নির্বণ ছোঁয়ার সাথে অনেক সময় কাটায়৷ এরপর থেকে চিরকুট লেখা। ফোনে কথা বলা৷ ধীরে ধীরে ছোঁয়ার ভালোবাসায় আটকে যায় নির্বণ।
_________
নির্বণ আর কিছু বলতে পারে না৷ কান্না করতে থাকে৷ আজ নিজেকে নিজের কাছে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। নির্বণ আর কিছু না বলে বিছানায় শুয়ে পড়ে৷ নিয়তি নির্বণকে বিরক্ত না করে নিয়তি ফ্লোরে শুয়ে পড়ে।
আঁধার কেটে নিয়ে আসে দিনের আলো। মানুষের মনে জাগিয়ে তুলে বেঁচে থাকার নতুন ইচ্ছা৷ সূর্য্যি মামার সকালের সোনালী রোদ্দুরের আলো থ্রাই গ্লাস বেঁধ করে নির্বণের চোখে পড়ছে৷ নির্বণ বিরক্তি নিয়ে ঘুম থেকে ওঠে যায়৷ নির্বণ ঘুম থেকে উঠে দেখে নিয়তি ফ্লোরে ঘুমিয়ে আছে।
— নিয়তির মুখে জল ছুঁড়ে মেরে, ” ভোরের প্রহর শেষ হতে চলছে মহারানী। উঠে নিজের কাজে যাও৷ ”
— ঘুম ঘুম নয়নে নির্বণের দিকে তাকিয়ে সুরু গলায় বলে উঠে, ” স্যার আপনি আমার গায়ে জল ছিঁড়ে মারলেন কেন? আমাকে ডাক দিলেই তো পারতেন৷ ”
— ডোন্ট কেয়ার লুক নিয়ে, ” যে লোক মরার মতো ঘুমিয়ে থাকে তাকে এভাবেই জাগিয়ে তুলতে হয়৷”
নিয়তি চোখ বড় করে তাকাতেই নির্বণ ওয়াসরুমে চলে যায়৷ নিয়তি মনে মনে বলে উঠে, ” সালা খবিশ, তুই মানুষ হবি না৷ ছোঁয়ার তোর সাথে ঠিক কাজই করেছে। রাতে কত সুন্দর কথা বলল। এখনই গোমড়া মুখু হয়ে গেছে৷ মনে হয় জন্মের সময় মুখে নিম পাতার রস দিয়েছিল।
________
— মা আপনাকে আজ হাঁটতে হবে৷ এভাবে বসে থাকলে আর চলবে না৷
— অবাক হয়ে, ” কি আমি হাঁটতে পারব! ” আমার দ্বারা সম্ভব নয়৷
— কেন সম্ভব নয়? আপনি জানেন না ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়৷
— ইচ্ছা তো করে আবার সকলের সাথে হাঁটতে ঘুরে বেড়াতে। প্রকৃতির দৃশ্যগুলো উপভোগ করতে।
— আপনি আজ বাহিরে যাবেন৷ আজ আপনাকে বাগানে ঘুরতে নিয়ে যাব৷
— আনন্দের সাথে বলে উঠে, ” তুমি সত্যি বলছো! আমাকে বাহিরে নিয়ে যাবে৷ আমি সেই অনেকদিন থেকে বাহিরে বের হয়না৷ আমাকে একটু বাহিরে নিয়ে যাও৷”
— হুম বাহিরে নিয়ে যাব৷ তবে আমি নয়৷
— মুখটা ফ্যাকাশে করে বলে উঠে, ” তাহলে কে নিয়ে যাবে? আমার তাহলে আর যাওয়া হবে না৷ ”
— আপনাকে কেউ বাহিরে নিয়ে যাবে না৷ আপনি নিজে থেকে বাহিরে যাবেন৷
— কি আমি নিজে থেকে বাহিরে যাব! আর ইউ ক্রেজি? তুমি কি বলছো তা তুমি কি জানো?
— আমি পাগল নয়৷ আর আমি যা বলছি আমার আত্নবিশ্বাস থেকেই বলছি৷ আপনি ঠিক পারবেন, নিজ পায়ে হেঁটে বাহিরে যেতে। এখন ওঠেন তো৷ আর বসে থাকতে হবে না৷
— প্লিজ নিয়তি আমাকে এত বড় শাস্তি দিও না! আমার খুব ভয় লাগছে। যদি আমি পড়ে যায়৷ আমার তো এক পায়ের এখনো কোন শক্তি নেই৷
— “কে বলেছে শক্তি নেই? এইতো কত সুন্দর করে আপনি পা নাড়াতে পারছেন৷” নির্বণের মায়ের পা আপ ডাউন করে।
আমাকে ধরে ওঠার চেষ্টা করেন৷
নিয়তির হাত ধরে ওঠার চেষ্টা করেন। বার বার ওঠতে নিলেও পড়ে যাচ্ছেন৷ নিয়তির হাত শক্ত করে ধরে তিনি অবশেষে ওঠতে সক্ষম হন৷
— এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠেন, “আমি আর বাহিরে যেতে চায় না৷ আমি এখানেই ঠিক আছি৷”
— আপনি একদম ঠিক নেই৷ আমাকে ভর করে হাঁটার চেষ্টা করেন৷ আমি কোন কথা শুনতে চাই না৷
— পা ফেলব। আমি কি পারব?
— হুম পারবেন৷ আর হ্যাঁ পায়ে প্রচুর পরিমাণ ভর দেওয়ার চেষ্টা করবেন৷ মনে রাখবেন আপনার সমস্ত ভর আপনার পায়ে শক্তি ফিরিয়ে আনবে।
নিয়তির কাঁধের উপর এক হাত রেখে নিয়তিকে ভর করে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছেন৷ নিয়তির অনেক কষ্ট হচ্ছে। তবুও নিয়তি সেই কষ্টকে ভালোবাসার কাছে উৎসর্গ করে দিয়েছে। ডাইনিং রুমের মেইন দরজার কাছে আসতেই নির্বণের মা পা উল্টোভাবে ফেলার ফলে পড়ে যেতে নিলেই নির্বণ দৌড়ে এসে তাদের ধরে ফেলে।
— নির্বণ চোঝ রাঙিয়ে কর্কশ কন্ঠে বলে উঠে, ” একা পারবে না তাও একা করতে চাও কেন? মানুষের কাছে মহান সাজতে চাও৷ আজ যদি তোমরা পড়ে যেতে তাহলে কি হত?”
— নিয়তি ভয়ে ভয়ে বলে উঠে, ” আসলে স্যার আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি ঠিক৷ প্লিজ ক্ষমা করে দেন৷ ”
— নির্বণের মা অবাক হয়ে বলে উঠে, ” নিয়তির তোমার মাথা ঠিক আছে৷ তুমি কাকে স্যার বলছো?”
নিয়তি জিহ্বায় কামড় দেয়৷ নির্বণও নিয়তির দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ভুল জায়গায় ভুল কিছু বলে ফেললে কেমন সিচুয়েশনে পড়তে হয় নিয়তি আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে৷
— নির্বণ মুচকি হেঁসে, ” আসলে মা নিয়তি আগে আমাদের অফিসে কাজ করত। সেখান থেকে আমাকে স্যার বলে। আসলে তার কাজের এক্টিভিটি দেখে আমি..”
— আর লজ্জা পেতে হবে না৷ আমি বুঝতে পারছি৷ আমাকে একটু বাগানে দিয়ে আয়৷
— ওকে মা৷
— নির্বণ তার মাকে পাঁজাকোলা নিতেই নিয়তি বলে উঠে, ” না না ভুলেও এমন কাজ করবেন না৷ মাকে হাঁটাতে হবে৷”
— দেখতে পাচ্ছো তো মায়ের কষ্ট হচ্ছে। মা হাঁটতে পারছে না৷ কেন জিত ধরে বসে আস?
— আপনি বুঝার চেষ্টা করেন। মাকে এখন হাঁটাতে হবে৷ মাকে এইটুকু কষ্ট সহ্য করতে হবে। মাকে হাঁটতে শিখতে হবে। আপনি বরং মাকে ধরে হাঁটানো শেখান৷
নির্বণ নিয়তির কথা বুঝতে পেরে তার মাকে পাঁজাকোলা থেকে নামিয়ে ধরে ধরে বাগানে নিয়ে আসে৷ মাকে দোলনায় বসিয়ে দেয়৷
নির্বণের মা অনেকদিন পর বাহিরে আসতে পেরে অনেক খুশি৷ চোখ বন্ধ করে সবকিছু উপভোগ করছে। আজ সামডে সেজন্য নির্বণ তার মায়ের পাশে বসে আছে। আজ অফিস বন্ধ।
— নির্বণ তার মাকে হালকা করে জড়িয়ে ধরে,” মা আমি আর কিছু চাইনা৷ তুমি তারাতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও৷ আমি এটাই চাই৷”
নির্বণের মা কিছু বলতে নিয়েও থেমে যায়৷ ডাক্তার তো বলেছে তিনি আর মাত্র ৩০ দিন বাঁচবে। দেখতে দেখতে ১২ দিন কেটে গেছে। নির্বণ তার মায়ের ফ্যাকাসে মুখ দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারে।
— মাকে সাহস জুগিয়ে বলে উঠে, ” মা ডোন্ট ওরি। তোমার কিছু হবে না৷ ডাক্তারের তো সব কথা সত্যি হয় না৷ অনেক সময় তো ভুল হয়৷”
— নিয়তি নির্বণের পায়ের পাশে বসে বলে উঠে, ” মা আপনি কোন চিন্তা করবেন না৷ সৃষ্টি কর্তা আমাদের সাথে কোন অন্যায় হতে দিবেন না৷ জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে তিনটা জিনিসে আমাদের কোন হাত নেই৷ আপনাকে আমি আজ হসপিটালে নিয়ে যাব৷ কোন চিন্তা করতে হবে না৷”
এমন সময় বাগানে অরিন নামের একটা সার্ভেন্ট আসে৷ এসেই নিয়তিকে বলে উঠে, ” ছোট ম্যাম আপনি যেগুলো কাজ দিয়েছিলেন সব কলমপ্লেইন।”
— নির্বণ অবাক হয়ে, ” হোয়াট ইস কলমপ্লেইন৷”
নিয়তিও বুঝতে পারছে না কলমপ্লেইন কি? পরে বুঝতে পারল সে সব কাজ শেষ করেছে৷
— নিয়তিকে অরিনকে কাছে টেনে, “কলমপ্লেইন না৷ কমপ্লিট হবে।”
— ছোট ম্যাম ওটা কলমপ্লেইন হবে৷ আমি কলমপ্লেইনই বলব।
অরিনের কথা শুনে উপস্থিতি সবাই হেঁসে উঠে৷
চলবে…..