আমার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে সজোরে ধাক্কা মেরে ফ্লোরে ফেলে দিয়েছে আমার প্রাক্তন।বিয়ের লাল টকটকে বেনারসি পরণে থাকা আমার স্ত্রী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে৷
মেয়েটা প্রতিবন্ধী। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিয়ের কনেকে পা দিয়ে ঠেলে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমার প্রাক্তন আনিকা চিৎকার করে বলল,
“টাকার লোভে তুমি আমার নয় বছরের ভালোবাসা এভাবে জলে ভাসিয়ে দিলে? যে পুরুষ টাকার জন্য এত দিনের সম্পর্ক ভেঙে ফেলতে পারে সে জানোয়ার ছাড়া কিছুই নয়। আমি কোনো দিন তোমাকে মাফ করবো না।তুমি পস্তাবে, আমার কাছেই ফিরবে। কয়েকটা ঘন্টার ব্যবধানেই তুমি আমার কাছে ফিরবে।”
আনিকা এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না।ওড়নার কোণায় চোখ মুছতে মুছতে দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছে সে।
আমার স্ত্রী প্রনয়ী আমার শার্টের এক কোণা ধরে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে৷
তাকে হাত ধরে টেনে তোলার পূর্বেই আমার বন্ধু এসে প্রায় তাকে জড়িয়ে ধরে তুলে চেয়ারে বসালো।আদুরে গলায় তাকে জিজ্ঞেস করল,
“বুনু ব্যথা পাইছিস?”
প্রনয়ী মাথা দুপাশে দুলিয়ে না করলে আমার জিগরি দোস্ত আমায় বলল,
“ওদিকে আয়।কথা আছে।”
“কী কথা বল।”
“তুই কী রাগ করে আছিস?”
“না রাগ করবো কেন?আজ আমার বিয়ে। দেখ আমি কত খুশী। বাংলা সিনেমার ওমর সানির মতো বেকারত্ব ঘুঁচাতে, বাবার স্বপ্ন পূর্ণ করতে আমি নয় বছরের ভালোবাসা ত্যাগ করে বন্ধুর অসহায়, প্রতিবন্ধী বোনকে বিয়ে করছি। যাকে নিয়ে না আমি দাঁড়াতে পারবো কারো সামনে, না তাকে দিয়ে হবে আমার সংসার। এতদিন যে মেয়েটা আমাকে ভালোবেসে অপেক্ষা করে রইল?সেই মেয়েটা আজ বিয়ের আসর থেকে কেঁদে চলে গেল।আমি খুশী হবো না?”
“তবে তুই বিয়ের জন্য রাজী কেন হয়েছিলি?এই সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ তো তুই দেখছিস না!”
পিয়ালের কথা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করেনি নির্বেদ। দ্রুত পা ফেলে চলে এসেছে বাহিরে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে নিলো সে। নাক মুখ দিয়ে অনবরত বেরিয়ে আসছে নিকোটিনের ধোঁয়া।
সে ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে নির্বেদ বলল,
“সব কিছুর পোড়া গন্ধ হয় কিন্তু হৃদয় পোড়া গন্ধ হয় না কেন?
(২)
খেতে বসে নিজ পরণের কাপর নষ্ট করে ফেলেছে প্রনয়ী।তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রণব সাহেব।তার স্ত্রী রামিশা ছিল তার খালাতো বোন। রক্তের মাঝে বিয়ে হলে অধিকাংশ সময়ে না হলেও মাঝেমধ্যে এই সমস্যা হয়। সন্তানগুলো প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মায়।
তাদের প্রথম সন্তান ছিল ছেলে। রাজার ঘরে ঠিক রাজপুত্রের জন্ম।কিন্তু বয়স ছয় মাস হতে না হতেই সে ছেলের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেওয়া শুরু করলো।ডক্টর বলেছিল কম খাবার খাওয়াতে কারণ তার ওজন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছিল। যখন ক্ষুধা লাগতো বাচ্চাটা হাউমাউ করে কাঁদতো। পিয়াল যখন পেটে এলো তখন রামিশা ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলো।হঠাৎ একদিন ভোর বেলা তাদের প্রথম সন্তানের খিঁচুনি শুরু হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা যায় তাদের প্রথম সন্তান।
সন্তান হারিয়ে রামিশা দিন দিন আরো ভেঙ্গে পড়তে লাগে। বিভিন্ন সময় সে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টাও করে। নিজেকে দাবী করতে লাগে তার সন্তানের খুনী হিসেবে। কারণ সে তার সঠিক জন্ম নেয়নি।
এদিকে প্রণব সাহেব বেশ চিন্তিত ছিলেন কারণ জেনেটিক এবং ব্লাড ইকুয়েশন এর একটা কারণে তাদের সন্তান প্রতিবন্ধী জন্ম নিয়েছিল।যার সম্ভাবনা এবারো প্রবল ছিল।কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কৃপায় পিয়াল সুস্থ এবং আর পাঁচটা বাচ্চার মতোন জন্ম নেয়। এক সময় পিয়ালের সাহায্যে তার মা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।
ধীরে ধীরে পিয়াল বড় হতে থাকে। পিয়ালের বয়স যখন দশ, রামিশা আবার সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়ে।
কিন্তু এবার জন্ম হয় প্রণয়ীর। প্রণয়ী আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয়।
দেখতে সে সম্পূর্ণ মায়ের রূপ পেলেও তার বুদ্ধি স্বাভাবিক নয়। তাকে গভীরভাবে খেয়াল করলে বুঝতে পারা যায় সে হাতের কড় গুনে সবসময় হিসেবে ব্যস্ত থাকে।ঘাড় শক্ত করে রেখে শুধু মুখ অনবরত কাঁপতে থাকে তার। মাঝেমধ্যে সব ভুলে যায়।তার শারিরীক কোনো সমস্যা নেই তবে ভালো মন্দের বিচার সব সময় করতে পারে না।মাঝেমধ্যে হঠাৎ প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়, নার্ভাস হলে সে কাঁপতে থাকে। তাছাড়া সব’চে খারাপ যে দিকটা হলো প্রণয়ী রাগ উঠলে কামড়ে দেয়।
কাজের লোকগুলো তার আশেপাশে যায় না কিন্তু একজন খালা আছেন যিনি রামিশা বেগমের মৃত্যুর পর থেকে তার দেখাশোনা করে চলেছে।
আজ সন্ধ্যের ঘটনার পর প্রণয়ী কিছুটা ভয় পেয়ে আছে। আনিকা নামের মেয়েটা তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল তাই।
মেয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসলেন প্রনব সাহেব।পরম যত্নে খাবার খাইয়ে দিচ্ছেন মেয়েকে।
আনিকার জন্য যে তার খারাপ লাগছে না তা নয়।
কিন্তু বাবা হিসেবে সে স্বার্থপর। বড়ই স্বার্থপর।
আনিকা স্বাভাবিক মেয়ে, সে চাইলেই জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
কিন্তু প্রণয়ী?আজ বাদে কাল যখন বাবা থাকবে না তাকে কে দেখে রাখবে?
তাই নির্বেদকে প্রণয়ীর সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে দায়মুক্ত হয়েছেন প্রণব সাহেব।কিন্তু বার বার তার মনে হচ্ছে
আদৌও কী পৃথিবীর কোনো পিতা তার কলিজার দায়িত্ব কাউকে দিয়ে দায়মুক্ত হতে পারে?
(৩)
বিদেশি হরেকরকম ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে বাসরঘর। সেখানে বউ সেজে বসে থাকার কথা ছিল আনিকার কিন্তু ঘুমিয়ে আছে প্রণয়ী।মেয়েটার প্রতি ঘৃণা না সহমর্মিতা দেখাবে নির্বেদ?
সে নিজে আজ সকালে তার বন্ধুর বাবাকে বলেছিল
“প্রণয়ী ভালোবাসার স্পর্শ বুঝে আংকেল। যে কিছুই বুঝে না সে ভালোবাসার স্পর্শ বুঝে, ভালোবাসা বুঝে। ওর জন্য ভালোবাসার মানুষ খুঁজে আনুন।”
কে জানতো তাকেই বেছে নিবেন প্রনব সাহেব।
ফোনের শব্দে ধ্যান ফিরে নির্বেদের। স্ক্রীনে ভেসে উঠেছে আনিকার নাম।
কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে বলে উঠল,
“যে পুরুষ একজন নারীকে গভীর অন্ধকারে রেখে চলে যেতে পারে এর মানে দুটো হয়।
সে তাকে ভালোবাসে না এবং সে তাকে অবশ্যই ভালোবাসে না।
অভিনন্দন প্রাক্তন।তোমার আগামী জীবন এবং বাসর রাত সুখের হোক।আমি মেনে নিতে পারলাম না এটা আমার ব্যর্থতা। তুমি আমায় ভুলে গেলে এটা তোমার সফলতা। আজ যে টাকা, নামের জন্য আমায় ছাড়লে,একদিন তোমার সব হবে কিন্তু তুমি শূন্য থাকবে।না পাওয়া তোমায় ঘিরে রাখবে।
শুধু একটা অনুরোধ আমায় কাল একবার দেখতে এসো।একমুঠো মাটি আমার কবরে দিও।”
কল কেটে দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে কিছু ছবি পাঠায় আনিকা।যেখানে স্পষ্টত সে নিজেকে শেষ করবার জন্য পায়ের শিরা কেটে ফেলেছে।
চলবে
#রঙ_বেরঙে
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ১
ছবিয়ালঃলামিশা