#সম্পর্কের_বন্ধন
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৩
চামড়া পোড়া রোদ্দুরের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে ধরিত্রীর বুকে। রাস্তার ধারে কিংবা বাগানে শোভা পাচ্ছে গ্রীষ্মে ফোঁটা নানা রঙের ফুল।
কৃষ্ণেচূড়ার ডালে রক্তিমা আ’গু’ন ঝরছে। মৃদু বাতাসে কৃষ্ণেচূড়ার মুখে লাল টুকটুকে উপচে পড়া হাসি। এ যেনো এক অকৃত্রিম সৌন্দর্য। কৃষ্ণচূড়া হাসে বুঝি?
বৈশাখের দুপুরে প্রকৃতি হয়ে ওঠে কঠোর,রুদ্র,কঠিন।
মাঝেমাঝে তীব্র গর্জনে কেঁপে ওঠে অন্তরিক্ষ।
দিনটি শুক্রবার। সরকারি ছুটির দিন। চাকুরিজীবীদের ঘুমের দিন,প্রেমিক পুরুষের প্রণয়ের দিন। এদিনে রমনার বটমূলে দেখা মিলে জোড়া জোড়া কপোত-কপোতী। কেউ কেউ অন্তঃকরণে বাস করা হৃদয়ভেদী মানুষটির চোখে ভালোবাসা খুঁজে নেয়। কেউবা শরীরের ভাঁজে কা’মু’ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখের তৃষ্ণা মেটায়। মাঝেমধ্যে অগোচরে হাত গলিয়ে ক্ষণিকের আনন্দ খুঁজে নেয়।
শরীরের ভাঁজে কা’মু’ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্পর্শ’কাতর স্থানে হাত গলিয়ে দেওয়া, গভীররাত্রি নিদ্রাহীন কাটিয়ে মুঠোফোনে কিছু অশ্লীল কথা বলাকে সস্তা প্রেম বলা চলে।ভালোবাসা নয়!
শরীর ছুঁতে সবাই পারে।
কিন্তু হৃদয় ছুঁতে ক’জনই বা পারে?
মনটা আজ বিরিয়ানিকে ব্যকুল ভাবে আহ্বান করছে। তুহাকে বিরিয়ানি রান্নার কথা বলতেই তার চোয়াল চুপসে গেলো। দুঃখী চেহারায় জবাব দিলো,’অন্যান্য রান্না করা হলেও কোনোদিন বিরিয়ানি রান্না করিনি।’
শরীর ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো ইভান। কোমলতায় ভরপুর শিথিল কন্ঠে প্রতিধ্বনি তুললো।
‘আজ রান্নাটা না হয় আমিই করি।’
তুহা প্রসন্নচিত্তে হেসে সুধালো,’তবে আমি সাহায্য করি? সেই সাথে বিরিয়ানি রান্নাটা ও শেখা হয়ে যাবে।
হৃদয় শিথিল করা সেই মুগ্ধ হাসির খেলা ধাবমান রেখে ইভান মাথা দুলালো। যার অর্থ যথা আজ্ঞা বুঝালো।
দুজনে রান্নাঘরে একে অপরের বিপরীতে পাশাপাশি দাঁড়ালো।
ইভান মাংস,চাল প্রয়োজনীয় সব সামনে প্রয়োজন মতো সাজিয়ে রাখছে।
তুহা মন দিয়ে চপিং বোর্ডে কা’টা’কা’টি’র কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। চুলার মৃদু আঁচ তার উপর গ্রীষ্মের উত্তাপ।
অল্পক্ষণেই ঘাম ছড়ালো শরীর বেয়ে। সুতির থ্রিপিসের ওড়না কোমরে বাঁধা। ঘাড়ের কাছে কৃষ্ণ কেশর ঢিলে করে খোঁপা করা। দু’গাছি পাতলা চুল সিঁথির মতো মুখের সামনে দুলে যাচ্ছে। জামার গলা বড় হওয়া উন্মুক্ত গ্রীবা স্পষ্ট দৃষ্টিগোছর হচ্ছে।
গলা বেয়ে ঘর্ম ফোঁটা মুক্ত দানার মতো গড়িয়ে পড়ছে জামা ভেদ করে।
নাকের ডগা, অধরের উপরিভাগে ঘামের মোটা আস্তরণ।
ইভানের অন্তর্ভেদী নজর গিয়ে ঠেকলো তুহার উপর। ঢোক গিলে নজর এদিক সেদিক করলো। কিন্তু বেহায়া আঁখি জোড়া বুঝি অন্যদিকে নজর রাখতে নারাজ? ঘুরেফিরে তুহার উপরই বর্তাবে। এই মুহুর্তে বেপরোয়া কাজে মন উন্মাদ হয়ে উঠছে। এক্ষুনি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এক্ষুনি অনুচিত কিছু ঘটে গেলো সেটা অ’বৈ’ধ হবেনা। তবে তুহার সম্মতি যে এতে দারুণভাবে প্রভাব ফেলছে?
দুটি প্রাপ্তমনস্ক মন,দেহ একই ছাদের নিচে থাকলে এরকম ইচ্ছে পোষণ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং ইভানের চাওয়াটা সম্পুর্ন হালাল। তবুও মনকে সায় দিলোনা।
শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে লম্বা শ্বাস ফেললো ইভান। রান্নায় মন রাখার চেষ্টা করে গমগমে স্বরে তুহাকে বলল,’ তুমি এখান থেকে যাও। রুম এলোমেলো হয়ে আছে। সেগুলো গুছিয়ে নাও।’রান্না আমি দেখছি।
তুহা ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল,’রুম অগোছালো কখন হলো?’সবতো গোছানোই আছে।
ইভান বিড়বিড় করে বলল,’রুমতো অগোছালো নয়। আমাকে করেছো অগোছালো। সম্পুর্ণ দোষ তোমার। শাস্তি অতি সন্নিকটে।
তুহা মাথা এগিয়ে ইভানের দিকে কান পেতে বলল,’ কি বলছেন? আমি বুঝতে পারছিনা।
ইভান ধমকের সুরে বলল,’এখানে দাঁড়িয়ে আমাকে বিরক্ত করছো কেনো? অনর্থক কিছু ঘটানোর ইচ্ছে আছে নাকি?
তুহা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো। লোকটা এমন আত্মভোলা ব্যবহার করছে কেনো?
তুহা কপালের ভাঁজ সরিয়ে সরলমনা হয়ে বলল,’তবে আমি বিরিয়ানি রান্না শিখবো কিভাবে?’
ইভান চোখ বন্ধ করে বুক ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে বলল,’দোষের ভাগীদার তুমি। তুহা বুঝলোনা।
ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।
ইভান তুহার পাশ থেকে পেঁয়াজ কুঁচি হাত বাড়িয়ে নেওয়ার সময় তুহার কানের লতিতে ওষ্ঠা ছোঁয়ালো। কয়েক সেকেন্ড পর দ্রুত সরে এসে নিজের কাজে মন দিলো। যেনো কিছুই হয়নি।
তুহা জমে গেলো। এই মুহূর্তটা কিসের ছিলো? ছোঁয়াটা কি ভালোবাসার?নাকি অনিচ্ছাকৃত। কপল দুটি রক্তিম আভায় রঞ্জিত হলো। চোখেমুখে উপছে পড়া লজ্জা। অগোছালো,এলোমেলো দৃষ্টি। দেহের উত্তাপ দ্বিগুণ হলো। দরদরিয়ে ঘাম ঝরে যাচ্ছে। অস্থির চাহনি লুকাতে রান্নাঘর থেকে ছুটে পালিয়ে এলো তুহা।
রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বসে রইলো। লজ্জার আভাস মিশ্রিত ঠোঁটে প্রণয়ের প্রগাঢ় হাসি।
সজোরে দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পেতেই ইভান পিছু ফিরে চাইলো। বিড়বিড় করে বলল,’গভীর স্পর্শে এই মেয়ে কোথায় লুকোবে? দেখার বড্ড ইচ্ছে
সেই স্থানটা কি আমার বক্ষঃস্থলে?’
তুহা আর রুম থেকে বের হলোনা। ইভান বিরিয়ানি রান্না শেষ করে দরজায় করাঘাত করলো। তখন তুহা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে। সদ্য গোসল করা ভেজা চুল তোয়ালের ছোঁয়া পেয়ে সমস্ত রস ঢেলে দিচ্ছে তাতে।
ইভান আবারও ঠকঠক আওয়াজ তুলে বলল,’আমি গোসলে যাবো তাড়াতাড়ি বের হও।
তুহা দরজা খুলে নতজানু হয়ে রইলো। ইভান তুহাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় বলল,’অনুভূতি কি খুব বাজে ছিলো?
তুহা মাথা তুললোনা। আড়চোখে একবার পরোখ করলো ইভানকে। ইভানের দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ ছিলো। তুহা ছুটে দরজার বাইরে এসে পড়লো।
ইভান নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসলো।
মেয়েটার রক্তিমা গাল দুটো দেখেই ইভান যেনো তার মন পড়ে নিলো।
ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় বসলো তৃষা। বিষন্নতায় উপচে আছে মন। খুব করে আজ বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছে। বাবা,মা,ভাই,ভাবি কারো কি মনে পড়ছেনা ওর কথা? এতটাই ঘৃ’ণা তার জন্য।
বাবা কিভাবে পারলো তার আদুরে মেয়েকে অস্বীকার করতে। তার আসার মুহূর্তে কেউ আটকালো না? একটি বার ফোন করে খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা ও বেঁচে আছে নাকি ম’রে গেছে?
কতশত অভিমান আর অভিযোগ জমা হলো ধূলো পড়া আস্তরণের ন্যায়। যা জমা হয়ে পর্বতসম হলো।
লালছে চোখজোড়া সিক্ত হলো নোনাজলে। চোখের পাতা বুঝলেই টুপ করে গড়িয়ে পড়বে কয়েক ফোঁটা জল।
কলিংবেলের অনবরত শব্দে সবটুকু বিরক্তি ঢেলে তৃষা উঠে গিয়ে দরজা খুললো। সামনে শামিমকে দেখেই তার মেজাজ খিঁচড়ে গেলো। মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিতে চাইলো পারলোনা। শামিম দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো।
ভেতরে সোফায় আয়েশ করেই বসলো। তৃষা রেগে গিয়ে বলল,’ এখানে কেনো এসেছো?
শামিম উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা। উল্টো তৃষাকে প্রশ্ন করলো,’কাঁদছিলে কেনো? আমার কথা মনে পড়াতে কাঁদছিলে বুঝি? দেখো আমি চলে এসেছি।
তৃষা গলার স্বর উঁচু করে বলল,’তোমার ফা’ল’তু কথা বাদ দিয়ে এখান থেকে যাও। আমি এখন তোমার সাথে ঝগড়া করার মুডে নেই।
শামিমের গলার স্বর খানিকটা নরম হলো। স্বর নিচু করে বলল,’ আচ্ছা সব কিছু ভুলে নতুন করে শুরু করা যায় না? আমাকে ভালোবাসা যায় না? আমি যাই করিনা কেনো এটা সত্যি যে আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি। আচ্ছা আমার কোনদিকে প্রবলেম আছে বলো। আমি চেঞ্জ হয়ে যাবো। তবুও একটু ভালোবাসা দাও। দেখো বাবা মাও আমাকে দূরে ঠেলে রাখছে। আমি যেনো তাদের চোখে বি/ষ হয়ে গেছি। এবার তুমি যদি দূরে ঠেলে দাও তবে আমার আর বাঁচার উপায় থাকবেনা।
আমি মানছি আমি যা করছি তা ভালো কাজ না। আমি সব ছেড়ে দেবো। তবুও তুমি একটিবার বলো তুমি আমায় ভালোবাসবে।
বাবা মায়ের কথা তুলতেই তৃষা মুখ চেপে কেঁদে উঠলো।
শামিম ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,’ তৃষা কাঁদছো কেনো? দেখো আমি আর তোমাকে কষ্ট দেবোনা।
তৃষা ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,’ওই তুহার কারণে আমার বাবা মা আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। অস্বীকার করছে আমি তাদের মেয়ে। তুমি পারবে ওকে শাস্তি দিতে? ওর সংসার ছিন্নভিন্ন করে দিতে? ওর চোখে পানি দেখে আমি তৃপ্তি পাবো। আমার চেয়ে সুখী তখন আর কেউ হবেনা।
শামিম তৃষার হাতে হাত রেখে বলল,’তুমি যা চাইছো তাই হবে। শুধু একবার বলো আমাকে আর দূরে ঠেলে দেবেনা। বলো!
তৃষা শামিমের হাতের উপর তার অন্যহাত রেখে শামিমকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করলো।
কি কি করতে হবে সেটা আমি তোমায় সময় হলেই বলে দেবো। শামিম তৃষার কথায় সায় জানিয়ে সুখী মনে ফিরে গেলো ফ্ল্যাট ছেড়ে।
শিষ বাজাতে বাজাতে মনে মনে বলল,’একবার শুধু তোমাকে আমার সাথে বিদেশে নিতে পারি তখন পাখি খাঁচায় বন্দী করবো। অন্য ছেলের জন্য আমাকে ব্যবহার করছো তুমি? জীবনে আর বাংলাদেশের মুখ দেখবেনা। শামিমের খাঁচায় বন্দী হয়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে। তুমি ভাবছো আমি কিছুই জানিনা? কি কি করছো সব খবর যে শামিমের নখদর্পনে।
শামিম যাওয়ার পর দরজা আটকে তৃষা ধূর্ততার সহিত হাসলো। তোর আর ইভানের সুখে ভরা সংসারের কি হবে ভেবেই আমার কান্না পাচ্ছেরে তুহা।
আমার পরিবার থেকে আমাকে আলাদা করার শা’স্তি পেতে হবে তোকে।
এমন সস্তা ছেলেকে আমি আর আমার জীবনে চাইনা। নেহাত পছন্দ হয়েছিলো বলেই ওর এত অ’হংকার। দুদিন পর সব ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। যখন সবাই থু থু ছিটাবে মুখে।
শামিম ছেলেটা বড্ড বোকা। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে আমাকে ছাড়া আর কিছুই দেখছেনা। শুধু আমার কাজটা হয়ে যাক তোমার ব্যবস্থাও ততদিনে করে ফেলবো জান।বলেই বক্র হাসলো তৃষা।
#চলবে………