মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই পর্ব ৭

0
365

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই
#মম_সাহা

পর্বঃ সাত

গ্রামে ভ্রমরী’র মৃত্যুর খবরের সাথে আলোড়ন জাগিয়েছে আরেকটা খবর, মৃত মধুসখীর খড়খড়ে ভাব উধাও হওয়ার খবর। এখনো পানি আসে নি তবে মৃত ভাবটা এখন নেই। আগের মতন অত খড়া নেই। নদীর বুক এখন কোমল হয়েছে। মাটি নরম।

জেলেদের মুখে অসাধারণ হাসি। নতুন সুখের দেখা মিলবে বলে। মধুসখী নদীটা বেশ লক্ষী নদী। এ বেঁচে উঠলে জেলেদের ঘরে পরিপূর্ণতা দিবে দু-হাত ভরে।

দীর্ঘ দু’দিনের অসুস্থতায় মিইয়ে গিয়েছে তিস্তা। আজ সকাল হতে হতেই স্নান করে রোদে এসে দাঁড়ালো তিস্তা। চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। মুখে দু এক খানা কালো দাগের উপস্থিতি। শরীরটাও সামান্য শুকিয়ে গিয়েছে।

হঠাৎ বাহিরের দূরের পথ থেকে গাড়ির শব্দ ভেসে এলো। গ্রামে অত গাড়ি তো আসে না। কেবল পুলিশের গাড়ি আসে। তবে কী বড় অফিসাররা গ্রামে এলো? ভ্রমরীর সাথে হওয়া অন্যায় এর কোনো খোঁজ মিললো?

তিস্তা ভেজা চুলে গামছা জড়ানো অবস্থায়ই ছুটে গেলো। তনয়া বেগম তখন রান্নাঘরে কেবল ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে ছিলো। গরম ভাত খেয়ে আমান শেখ দোকানে যান। বাজারে তার বড় মুদির দোকান আছে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় তার আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। তিস্তাও আজ স্কুলে যাবে। গরম ভাত পেটে থাকলে মাথা ঠান্ডা থাকবে। পেট শান্তি মানেই দুনিয়া শান্তি।

মেয়েকে হঠাৎ ছুটে যেতে দেখে তনয়া ডাক দিলো চওড়া কণ্ঠে। কে শুনে কার ডাক! তনয়ার ডাকে ঘর থেকে আমান শেখ বেরিয়ে আসলেন। ছোট্ট কণ্ঠে খানিকটা বিরক্ত ভাব মিশিয়ে বললেন,
-‘কী হয়েছে? ষাঁড়ের মতন চেঁচাচ্ছো কেনো? বাড়ির বউয়ের গলা গঞ্জের হাট অব্দি পৌঁছুচ্ছে বোধহয়।’

তনয়া বেগম ক্ষ্যাপে গেলেন। অসন্তোষ জনক কণ্ঠে বললেন,
-‘আমি কী করবো? মেয়ে একটা তো হয়েছে উড়নচণ্ডী। এই জ্বরে গোসল দিলো। এখন আবার কই জেনো ভেজা চুলে ছুটে গেলো। কী করবো আমি এ মেয়ে নিয়ে। আগুনে ভাত চড়িয়েছি। আপনি একটু গিয়ে দেখুন না কোথায় গেলো। মাথা আবার ঘুরিয়ে টুরিয়ে পড়ে গেলে হবে আরেক কেলেঙ্কারি।’

আমান শেখের কপালের ভাজ গুলো আরেকটু গাঢ়ো হলো। বিরক্তিটা সরে গিয়ে ভাঁজ পড়লো চিন্তার। মেয়েটা এত অসুস্থতার মাঝে ছুটোছুটি করছে? এ মেয়েটাকে নিয়ে সে যত চিন্তা করে বড় মেয়েটাকে নিয়ে তার এক ভাগ চিন্তাও করতে হতো না।
-‘চিৎকার চেঁচামেচি না করে আগে ওটা বললেই তো পারতে। মেয়েটা যে কার মতন হলো!’

কথা শেষ করে আমান শেখ হন্তদন্ত হয়ে হয়ে মেয়ের পিছে পিছে গেলেন। তনয়া বেগম একটু মুচকি হাসি দিলেন। মেয়েটা তার বাবার প্রাণ যেনো। এই যে, মেয়ের কথা শুনতেই বিরক্ত উবে গিয়ে চিন্তা হানা দিয়েছে মুখে। মেয়েটা অনেক ভাগ্যবতী।

শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো সে।

তিস্তা নিজের বাড়ি ছেড়ে বেশখানিকটা এগিয়ে গেলো। পথিমধ্যে ভীষণ ভীড়। সেখানটাই পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার আশেপাশে কত গুলো ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

তিস্তা এগিয়ে গেলো, মোড়ল সাহেবও এখানে আছে। নেপাল জেঠুকেও দেখা যাচ্ছে। মানুষটার শরীরে সাদা ধুতি আর একটা বেশ পুরোনো ফতুয়া। ফতুয়াটা’র রঙও সাদা কিন্তু পুরোনো হওয়ায় হলদেটে রঙ ধারণ করেছে। সাদা রংও কেমন ঘেটে যায় পুরোনো হলে! পুরোনো হলে সব কিছুই রঙ বদলায়। হোক জেঠুর ঢিলে ফতুয়া কিংবা রক্তমাংসের মানুষ।

পুলিশ অফিসারদের কাছাকাছি যেতেই ভুড়িওয়ালা অফিসারের কথা ভেসে এলো,
-‘আমরা তো আমাদের মতন খুঁজছি, কিন্তু কোনো কিছুই পাচ্ছি না। কাউকে সন্দেহজনক মনে হচ্ছে না।’

অফিসারের কথার পরিপ্রেক্ষিতে মোড়লের কর্কশ কণ্ঠ ভেসে এলো,
-‘কিছুই পাচ্ছি না মানে কী? গেরাম থেইকা একটা মাইয়া এমন ভাবে মই’রা যাইবো আর আপনি পাচ্ছি না বইলা খালাস হইবেন তা তো হইতে পারে না। যত তাড়াতাড়ি পারেন হেই বেজন্মারে খুইজা বাইর করেন।’

অফিসার যেনো একটু ভড়কে গেলেন। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললেন,
-‘আমরা সব দেখছি। সবাই তো অনুসন্ধান করা শুরু করে দিয়েছে এখন দেখি কী করা যায়।’

নেপাল ঠাকুর এবার মুখ খুললেন। অসহায় কণ্ঠে বললেন,
-‘আমার কন্যার আত্মার শান্তির জন্য হইলেও ঐ নরপশুরে ধইরেন সাহেব। আমার আর কোনো চাওয়া নেই। কন্যা আমার শান্তিতে পরলোকে থাকুক। এই পৃথিবী তো আর তাকে শান্তি দিলো না। মা’হারা অভাগিনী টা।’

কথা থামিয়ে’ই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো নেপাল ঠাকুর। তিস্তারও চোখে জলে টইটুম্বুর হলো। পুকুরে আর সাঁতার প্রতিযোগিতা দেওয়া হবে না, ইচ্ছে হলেই ডাই’নী বলা যাবে না। ইচ্ছে হলেও কাউকে জড়িয়ে বলা হবে না, তুই আমার প্রাণের সই। মাঝে মাঝে মানুষ এত অসহায় কেন হয়ে যায়?

মোড়লের স্বান্তনার কণ্ঠ ভেসে এলো,
-‘আর কাইন্দা কী হইবো নেপাল? একলা মাইয়াটারে বিয়া না দিয়া ঘরে রাইখা শকূণের খাবার বানাইছো। তবে ভ্রমরী আমাগো গ্রামের মাইয়া। ওর সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার হইবো। তুমি বাড়ি যাও।’

মোড়লের কথায় সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া নেপাল জেঠু ছোট্ট বাচ্চাদের মতন মাথা নাড়িয়ে দুর্বল পায়ে হাঁটা ধরে বা’দিকের মাটির সরু রাস্তাটায়। পৃথিবীতে সবচেয়ে অসহায় বাবা সে। সন্তানের নির্মম মৃত্যু দেখার মতন অসহায়ত্ব আর কিইবা হতে পারে?

তিস্তার ছোট্ট মনে আকাশ আধাঁর করা বিষন্নতা হানা দিলো। মৃত সইয়ের জন্য যতটা না কষ্ট হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে নেপাল জেঠুর জন্য। মানুষটার দিন দুনিয়ায় আপন বলতে আর যে কেউ রইল না।

তিস্তা মাটির পথটার দিকে ছুটে গেলো। নেপাল ঠাকুর একটু হকচকিয়ে গেলো বোধহয় তাকে দেখে। যখন ঠাওর করতে পারলো এটা তিস্তা তখন ছোট্ট শ্বাস ফেললো। বিষন্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-‘মা, তুই এইখানে যে?’

জেঠুর কথায় ঠেলে কান্না এলো তিস্তার। জেঠুর হাতটা আঁকড়ে ধরে কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-‘তোমার খুব কষ্ট লাগছে তাই না, জেঠু?

নেপাল ঠাকুর মৃত হৃদয়টা নিয়ে খানিকটা হাসে। তিস্তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
-‘কষ্ট হবে সেটাই তো স্বাভাবিক রে মা। আমার এত্ত ছোট মেয়েটা এমন অকালে চলে যাবে কে জানতো?’

তিস্তা জেঠুর চোখের কোণে অশ্রু টুকু মুছে দেয়। ছোট্ট তিস্তা বেশ ভরসাময় নারীর মতন বললো,
-‘কেঁদো না জেঠু। এই যে তোমার ভ্রমরী তিস্তার মাঝে আছে। যখন ইচ্ছে হবে ছুটে আসবে। দেখবে তিস্তার হাসিতে ভ্রমরীর খিলখিল হাসিখানা।’

মধ্যবয়স্ক নিঃস্ব মানুষটা কেঁদে দেয়। বাচ্চাদের মতন মাথা দুলাতে দুলাতে বলে,
-‘ঈশ্বর তোর মঙ্গল করুক মা। ভ্রমরীর মতন আর কোনো ফুল জেনো ঝড়ে না যায়। আমি আসছি মা।’

তিস্তা আর কিছু বলার আগে পুরোহিত জেঠু ছুটে চলে গেলো। নিজের দুর্বলতা না দেখানোর অদম্য ইচ্ছেয় লোকচক্ষুর আড়াল হলো বোধহয়।

তিস্তা নিজের অশ্রু টুকু মুছে নিলো। ছোট্ট শ্বাস ফেললো। হঠাৎ পেছন থেকে ভরাট পুরুষালী কণ্ঠে চমকে উঠলো। পিছনে তাকিয়ে দেখে মোড়লের ডাক্তার ছেলে, মাহিন।

মাহিন হাসিমুখে এগিয়ে এলো। মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-‘তুমি তো তিস্তা তাই না? শরীর কেমন এখন?’

তিস্তা মুখ কুঁচকে ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-‘ভালো।’
-‘শুধু ভালো? না, অনেক ভালো?’

মাহিনের এমন কথায় সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় তিস্তা। বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
-‘আমার জ্বর কমিয়েছেন বলে কী এত প্রশ্ন করা লাগবে? আমার উত্তর দিবো না। যান।’

মাহিন তিস্তার কথায় আরেকটু হেসে দেয়।হাসিমাখা কণ্ঠে বলে,
-‘না, আমি তো এমনেই জিজ্ঞেস করেছি। তা এখানে কেনো?’

-‘মন চেয়েছে তাই আসছি। আপনার সমস্যা?’

মাহিন তিস্তার উত্তর শুনে হা হয়ে গেলো। এত তেজ মেয়েটার!

তিস্তা বাড়ির পথে হাঁটা ধরে। পথের মাঝে তার বাবার সাথে দেখে হয়। আমান শেখ নিজের মেয়েকে দেখতেই এগিয়ে গেলেন। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,
-‘কী রে মা, কোথায় গিয়েছিলি? তোর না শরীর অসুস্থ? চল বাড়ি চল।’

তিস্তা বাবার হাত ধরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বাবা’রা বুঝি এত ভালো হয়? সব বাবাদের সন্তান যেনো বেঁচে থাকে। কারণ বাবাদের প্রাণ যে তাদের সন্তানের মাঝে।

____

ইচ্ছে না থাকা সত্বেও এক বান্ধবী’র বিয়েতে এসেছে তিস্তা। সব বন্ধু-বান্ধব তাকে জোর করে নিয়ে আসছে বললেই চলে। তিস্তার মন ভীষণ খারাপ। ভ্রমরীর চলে যাওয়ার পর আর কিছুতেই তার মন বসছে না। তার মাঝে গত দু’দিন যাবত মাস্টারমশাই গ্রামে নেই। স্কুলের কাজে সদরে গিয়েছে।

হঠাৎ তিস্তা অনুভব করলো তার পিছে কেউ দাঁড়িয়েছে। চমকে তাকাতে দেখলো মাস্টারমশাই এর হাসি হাসি মুখ। তিস্তাকে তাকাতে দেখে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,
-‘কিরে, তুই এসেছিস। ভালো হয়েছে ঘর থেকে বের হয়েছিস। সবার সাথে মিশলে ভালো লাগবে।’

কে শুনে কার কথা? দীর্ঘ দু’দিন মাস্টারমশাইকে না দেখার তৃষ্ণা মিটাতে ব্যস্ত তিস্তারানী। এই মানুষটাকে না দেখে মনের মাঝে মরুভূমির সৃষ্টি হয়েছে।

তিস্তাকে ড্যাবড্যাব তাকিয়ে থাকতে দেখে প্লাবন সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-‘কিরে, জ্বর কমেছে?’

তিস্তার ধ্যান ভাঙলো। মাথা নিচু করে বললো,
-‘হ্যাঁ কমেছে। কখন এলেন?’
-‘এই তো একটু আগে। রিমুর বিয়েতে তো আগেই দাওয়াত দিয়েছিলো। তাই সোজা এখানে চলে আসলাম।’

তিস্তা আর কিছু বলে না। মনের মাঝে ভীষণ মন খারাপটা এখন আর নেই। কেনো!

তিস্তা আনমনেই রিমুর দিকে তাকায়। বধূ বেশে তার ছোট বান্ধবী কত বড় লাগছে। হঠাৎ একটা বিষয় নজর কাড়ে তিস্তার। রিমুর বর, রিমু ঘেমে গেছে বলে তার রুমালটা আড়ালে এগিয়ে দিলো। ভীষণ মিষ্টি একটা দৃশ্য।

হঠাৎ তিস্তা মাস্টারমশাই এর দিকে তাকিয়ে আনমনেই বললো,
-‘আমার না ভীষণ বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে মাস্টারমশাই।’

তিস্তার নিচু কণ্ঠের স্বচ্ছ কথায় হতভম্ব মাস্টারমশাই। এ মেয়ে কী বলছে। বিয়ে বিয়ে আবার পায় কীভাবে!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here