মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই পর্ব ৬

0
388

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই
#মম_সাহা

পর্বঃ ছয়

সেই বিকেল হতে নিশ্চুপ তিস্তাকে খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যা পেরিয়েছে। মাস্টারমশাই’র বাড়িতে গিয়ে যখন খোঁজ করলো তিস্তা এসেছে কিনা তখন হতেই সবার ভিতর ভয় জেগে উঠলো। মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে আসে নি মেয়েটা গেলো কোথায়? এ পাড়া ওপাড়া খোঁজ চললো সারা বিকেল। মাস্টারমশাই ও খোঁজ শুরু করলো।

অবশেষে হঠাৎ বর্ষণে সিক্ত হওয়ার পর মাস্টারমশাই এর মনে পড়লো তিস্তার প্রিয় জায়গা খানার কথা। ছুটে গেলো মধুসখী’র পাড়ে। কতক্ষণ ঝোপঝাড় খুঁজে নিরাশ হলো সে। অতঃপর ঘাটের শেষ প্রান্তে চোখ গেলো তার। ঘাড় অব্দি চুল গুলো ভিজে লেপ্টে থাকা এক সিক্ত নারীর দিকে নজর গেলো প্লাবনের। এইতো, তার হারিয়ে যাওয়া শ্বাসের নতুন আশ্রয়। তার ভীত মনের আপনজন।

তিস্তা তখনও ঠাঁই ঘাটে বসে ছিলো। বৃষ্টিতে তার ভিজে নাজেহাল অবস্থা মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছায় নি। তার মস্তিষ্কের সচল নিউরন গুলো বারবার এটাই জানান দিচ্ছে মধুসখী’র সজীবতা।

মাস্টারমশাই তিস্তাকে পেছন থেকে বার কয়েক ডাক দিলো। ঝড়ের দাপটে হয়তো ডাক গুলো তিস্তার কান অব্দি আসে নি। হঠাৎ নিজের হাতে টান পড়ায় ধ্যান ভাঙলো তার। কিছুটা বোধগম্য হওয়ার আগেই চড় পড়লো গালে। ছিটকে গেলো সে কিছুটা। বিষ্মিত দৃষ্টিকে সামনে তাকাতেই দেখে মাস্টারমশাই এর বিক্ষিপ্ত মুখখানা। চোখ জোড়া ভীষণ ক্ষুব্ধ। শরীরের সাথে মাস্টারমশাই এর পাঞ্জাবিটা এঁটে সেঁটে আছে। কয়েক সেকেন্ডে মাস্টারমশাই’কে বেশ পর্যবেক্ষণ করা হয়ে গেলো তার।

হঠাৎ কানে ভেসে এলো অগ্নিবর্ষণ করার মতন কথা। মাস্টারমশাই চেঁচিয়ে বলছেন,
-‘এত রাতে এখানে বসে আছিস, ভয় ডর আছে তোর? কাল এত বড় একটা ঘটনায় যেখানে পুরো গ্রাম ভীত সেখানে তুই এত রাতে এই নদীর পাড়ে বসে আছিস! মাথা কী কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তোর? মানলাম ভ্রমরীকে তুই ভালোবাসতিস, তাই বলে পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা ভুলে যাবি?’

তিস্তার ততক্ষণে ধ্যান ফিরলো। চারপাশে তাকালো। আসলেই তো, এত রাত হয়ে গেছে! সে অবাক হয়। এত রাত অব্দি সে এখানে বসে ছিলো?

তিস্তার জবাব না পেয়ে মাস্টারমশাই আরেকটু রেগে যায়। হাত ধরে টান দেয় উপরে যাওয়ার জন্য। কিন্ত তিস্তা ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলে,
-‘মাস্টারমশাই, আমাদের সাথে খুব বড় কিছু হবে বোধহয়।’

মাস্টারমশাই এতক্ষণ পরে তিস্তার এমন রহস্যমাখা বাক্য শুনে হতভম্ব হয়। কী বললো তিস্তা! অনেক বড় কিছু হবে মানে? তিস্তা কী নিজের মাঝে নেই?

প্লাবনের উত্তপ্ত রাগ হঠাৎ ঝিমিয়ে আসে। নেতিয়ে যায় তার বিশাল তেজ। একটু কোমল হয়। নিজেদের মাঝে অধিক দূরত্বটা খানিক ঘুচান। একটু এগিয়ে এসে স্নেহভরা হাতটা তিস্তার মাথায় রেখে কোমল কণ্ঠে বললো,
-‘কী বলছিস তিস্তা? কী হবে? তোর কী ভ্রমরীর জন্য খারাপ লাগছে? তাই এমন করছিস? কী হয়েছে বল?’

তিস্তা এবার নিজের নিষ্প্রাণ দৃষ্টি জোড়া মাস্টারমশাইয়ের উপর নিবদ্ধ করে। বৃষ্টির মাঝেও তিস্তার চোখের কোণে থাকা অশ্রুর কণা গুলো বেশ বোঝা যাচ্ছে। প্লাবনের টর্চ লাইটের আলোয় তিস্তার চোখের কোণে অশ্রকণা গুলো চিকচিক করে উঠলো।

মানবী’র চোখের কোণে অপ্রত্যাশিত অশ্রু দেখে ভীত হলো প্রেমে লেপ্টে থাকা পুরুষ। আহ্লাদী স্বরে বললো,
-‘কাঁদছিস কেনো তিস্তা? কী হয়েছে? চড় দিয়েছি বলে কাঁদছিস? আচ্ছা আর মারবো না। তবুও কাঁদিস না।’

প্লাবনের কোমল কণ্ঠে আহ্লাদ পেয়ে যায় তিস্তার চোখের অশ্রুকণা গুলো। আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেগে তারা ঝরতে আরম্ভ করলো। তিস্তা ভীত হলো। তার হঠাৎ করে ভীষণ ভয় চেপে ধরলো। সে স্থান, কাল,পাত্র সব ভুলে গেলো এক নিমিষে। দ্রুত গিয়ে মাস্টারমশাইয়ের হাত জড়িয়ে ধরলো। পৃথিবীর সব আকুতি ঢেলে দিলো তার কণ্ঠে। একটু আশার আলোর খোঁজে মাস্টারমশাইয়ের হাতখানা চেপে ধরে, আকুতি মাখানো কণ্ঠে বললো,
-‘আমাকে বাঁচান মাস্টারমশাই। আমি মরতে চাই না। আমাকে বাঁচান। মৃত্যু খুব কঠিন। আমি মরবো না।’

ভুল জায়গায় এমন অপ্রত্যাশিত কথা শুনে একটু থমকে যায় প্লাবন। তিস্তা মৃত্যু’র কথা কেনো বলছে! মেয়েটা কী ধীর ধীরে উন্মাদ হচ্ছে? এহেন কথা কেনো বলছে মেয়েটা! অতিরিক্ত শোকে কী তার মস্তিষ্কের সচলতা হারিয়েছে?

প্লাবনকে চুপ থাকতে দেখে তিস্তার ভীত মনে আরও ভয় ঢুকে গেলো। তবে কী মাস্টারমশাই তাকে বাঁচাবে না? এই পৃথিবীতে হঠাৎ করেই বেঁচে থাকার ভীষণ ইচ্ছে জাগছে তিস্তার। ভ্রমরী’র করুণ মৃত্যু দেখেই হয়তো তার এমন মৃত্যুভীতির উদয়। সে ভীত কণ্ঠে আবার বললো,
-‘আমাকে বাঁচাবেন না মাস্টারমশাই? আমাকে বাঁচাতে পারবেন না আপনি? তবে কী আমিও মারা যাবো? জমিদারের বউ মধুসখী’র মতন অত ভালোবাসা না পেতেই আমি মারা যাবো?’

প্লাবন হতভম্ব। মেয়েটা কী বলছে আবোলতাবোল! সে তিস্তার বাহুতে ভরসার হাত রেখে বলে,
-‘তুই কেনো মরবি? মৃত্যু কী এত সোজা? এসব বলছিস কেনো!’
-‘কারণ মধুসখী জীবিত হওয়া শুরু করছে বোধহয়।’

বৃষ্টির দাপটে কথাটা ক্ষাণিক অস্পষ্ট হয়ে কানে যেতেই ভড়কে যায় প্লাবন। বিষ্মিত কণ্ঠে বলে,
-‘কী!’

তিস্তা তার ডান হাতের তর্জনী আঙুল টা সামনের দিকে তাক করলো। অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
-‘মধুসখী আজ বৃষ্টির জল শুষে নিচ্ছে না। তার মানে সে জীবিত হতে চাচ্ছে। তার মানে আমাকে মরতে হবে মাস্টারমশাই! আমি জন্ম নিয়েছি আর মধুসখী মৃত ঘোষিত হয়। এখন মধুসখী জীবিত হচ্ছে, তবে কী আমার মৃত্যু ঘনিয়ে এলো?’

প্লাবন তিস্তার কথার ভিত্তিতে সামনে তাকায়। টর্চের আলো মধুসখী’র উদ্দেশ্যে মারতেই পিলে চমকে উঠে তার। না চাইতেও দু পা পিছিয়ে যায়। মনে ভেসে উঠে কিছু যুক্তিহীন বিশ্বাস। মধুসখী’তে আজ খড়খড়ে মাটি নেই। ভিজে উঠেছে সে। এত বছর পর তার এহেন পরিবর্তন কেনো? তবে কী,,,

নাহ্, আর ভাবতে পারে না প্লাবন। নিজের অবস্থান ভুলে যায় সে। জড়িয়ে ধরে তিস্তাকে। ভীত কণ্ঠে বলে,
-‘এসব কী বলছিস তুই? কিছু হবে না তোর। কিসের সাথে কী মিলাচ্ছিস! দেখবি কাল রোদের আলো পড়তেই মধুসখী আবার খড়খড়ে হয়ে গিয়েছে। তুই চিন্তা করিস না।’

তিস্তা কী ভেবে যেনো ক্ষানিক হাসে। নিভু নিভু কণ্ঠে বলে,
-‘আমায় বাঁচাবেন তো মাস্টারমশাই? নাকি মধুসখী বেঁচে যাবে! গ্রামের জেলেদের ঘর কী তবে রমরমা হবে আবারও?’

প্লাবন আর কিছু বলার আগেই অনুভব করলো তিস্তার শরীর ছেড়ে দিয়েছে। হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। অনেক সময় একটানা বৃষ্টিতে ভিজার ফলে হয়তো এ দশা। প্লাবন আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে তিস্তাকে কোলে তুলে নিলো। ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছে। তার মনে হচ্ছে মধুসখী পিছন থেকে তার পা টেনে ধরছে। সুন্দর মধুসখী হয়তো রাক্ষসী রূপ ধরে বলছে তিস্তাকে তার কাছে দিয়ে যেতে।

মাস্টারমশাইয়ের ভীত মন আরও ভীত হলো। সে দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে পাড়ে উঠে গেলো। মধুসখী কেনো, কাউকেই সে দিবে না তিস্তাকে। তিস্তা কেবল তার।

____

তিস্তার নিস্তেজ শরীরটার দিকে তাকিয়ে বার বার ডুকরে কেঁদে উঠছে লতিকা বেগম। তিস্তার বাবাও মন খারাপ করে বসে আছে চারপায়া টাই। তিস্তার মা কেবল মেয়ের মাথার কিনারায় বসে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। প্লাবন দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে আছে।

এত রাতে গ্রামে ডাক্তার পাওয়া টা অসম্ভব হলেও এত রাতেও তিস্তা ডাক্তারের চিকিৎসা পাচ্ছে। তাও গ্রামের ডাক্তার না। শহুরে ডাক্তার। মোড়ল সাহেবের বড় ছেলে মাহিন। গত সপ্তাহে সে শহর থেকে এসেছে। শহরে সে ডাক্তারি পড়াশোনা করে। গ্রামের লোকে বলে, মোড়লের পুরো উল্টো তার ছেলে। যেমন ভদ্র, তেমন নম্র। অনেক মিশুকও। সে ডাক্তারি পড়াশোনা করছে বর্তমানে।

তিস্তার এমন অবস্থা দেখে দিক বেদিক ভুলে তিস্তার বাবা শেষমেশ মাহিনের কাছে যায়। এত ঝড়বৃষ্টিতে মোড়ল ছেলেকে আসতে দিতে না চাইলেও মাহিন বাবার কথা অমান্য করে ছুটে আসে।

নিজের কাছ থেকে কিছু ওষুধপত্র তনয়ার দিকে এগিয়ে দিলো মাহিন। বেশ নম্র কণ্ঠে বললো,
-‘চাচী,এই ওষুধ গুলো ওরে খাইয়ে দিবেন। রাতের মাঝে জ্বর নেমে যাবে আশারাখি।’

তনয়া বেগম দ্রত ওষুধ গুলো নিয়ে মাথা নাড়িয়ে কৃতজ্ঞতার স্বরে বললেন,
-‘আপনি বড় উপকার করলেন।’

মাহিন ছোট্ট হাসি দিয়ে বললো,
-‘আমি আপনার ছোট। আপনি অন্তত আমাকে আপনি বলে লজ্জা দিবেন না। আপনার ছেলের মতনই আমি। আজ তাহলে আসি।’

তিস্তার বাবা আমান শেখ উঠে দাঁড়ালো। ইতস্ততা ভরা কণ্ঠে বললো,
-‘আপনার পারিশ্রমিক টা কত যদি বলতেন,

মাহিন উঠে দাঁড়ালো। বিনয়ী কণ্ঠে বললো,
-‘লজ্জা দিবেন না এসব বলে। আপনারা আমরা একই গ্রামের। আমাদের আবার কিসের পারিশ্রমিক? আপনাদের জন্যই ডাক্তারী পড়ছি। আপনাদের কাজে আসার জন্য ই তো এতসব। রাতে কোনো সমস্যা হলে নির্দ্বিধায় আমাকে জানাবেন। আজ আসি তাহলে।’

অতঃপর মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘আপনি তো গ্রামের সবার পছন্দের মাস্টারমশাই প্লাবন তাই না? আপনার অনেক প্রশংসা শুনি। আজ দেখেও নিলাম। একদিন দেখা করবো আপনার সাথে। ভালো থাকবেন।’

মাস্টারমশাই ও বিনয়ের সাথে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ আচ্ছা।

মাহিন নিজের ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে গেলো। তার পিছে পিছে এগিয়ে দেওয়ার জন্য আমান শেখও গেলো। মাহিন বের হতেই লতিকা বেগম মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন,
-‘এতদিন শুইন্যা আইছি এ পোলা নাকি অনেক ভালা। আজ দেখলামও। মোড়লের মতন চা’মাড় বেডার এত ভালা পোলা! তারে উপরওয়ালা বাঁচায় রাখুক।’

তিস্তার মা তনয়া বেগমও তিস্তার মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে কৃতজ্ঞতার হাসি দিলেন।

কিন্তু মাস্টারমশাই এর মনে চলছে ভিন্ন দ্বন্দ্ব। সে মাহিনের চোখে অন্য কিছু দেখেছে তিস্তার জন্য । মুগ্ধতা বলা যায় সেটাকে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here