ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব ১৫

0
1068

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব – ১৫

এমনি এক দুপুর বেলা কলেজ থেকে ফিরতে খালা টেনে নিয়ে গেল আমায়। ঘরে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

‘ফাইজান বিয়া করছে। হুঁনছোস নি?’

‘হুঁহ? কী বললে?’

খালা ভেড়ানো দরজার পানে বারকয়েক তাকালো। কণ্ঠ আরো নিচু করে বললো,

‘ফাইজান বিয়া করে ফেলছে রে! ঠিকঠাক হুনি নাই। তয় এইটুক হুনছি যে বিয়া করছে। খুলনার কোনো এক মাইয়া নাকি। একসাথে পড়ালেহা করতো।’

‘কার থেকে শুনলে খালা?’

‘বিয়ার খবর গতকাল এই বাড়িত আইছে। আমাগোরে জানায় নাই। কিন্তু এইসব খবর কি ধামাচাপা দেওয়া যায়? ঠিক কানে আইলো!’

আমি বিমূর্ত হয়ে রইলাম। খালা বার কয়েক ঢোক গিললো। তারপর সাবধান করে বললো,

‘চুপচাপ থাহিস। কাউরে কিচ্ছু জিগাইস না এই ব্যাপারে। হগ্গলের মন খারাপ। তুই হাতমুখ ধুইয়া আয়। চাইরডা ভাত খাবি।’

খালা চলে গেলো। কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে আমি বিছানায় বসে পড়লাম। আমার আর হাতমুখ ধোয়া হলো না। ভাতও খাওয়া হলো না! স্তব্ধ হয়ে পড়ে রইলাম।

ফাইজান ভাই আমাকে তার বোনের নজরে দেখে। প্রথম দিন দেখে, আমার দুঃখ অবলোকন করে হয়তো তার কষ্ট হয়েছে। হারানো বোনের কথা মনে হয়েছে। যার দরুণ বোনের আসনে বসিয়েছে। ফুলি বলে ডাকা শুরু করেছে। সব বুঝি আমি। তবে বোঝার আগেই আমার মাঝে অতি সূক্ষ্ম এক পরিবর্তন হয়েছিল।

এই মানুষটার প্রতি আমি কিছুটা দূর্বল ছিলাম। তার সাথে পরিচয় হওয়ার পর তার যত্নশীল ব্যবহার দেখে বড় ভালো লাগতো। মনে হতো কেউ পাশে আছে। আমার দুঃখ ভেবে দু-চার সেকেন্ড অপচয় করার মতো মানুষ আছে। তার ভরসা পেয়ে মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলেও নিজেকে দ্রুত সামলে নিতাম। মনে হতো অন্তত ফাইজান ভাই আছে। উনি কখনো আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিবে না। আমায় সাহস যুগিয়ে যাবে। পাশে থাকবে সবসময়। হ্যাঁ, সে এখনো পাশে আছে। তবে কতদিন থাকবে জানা নেই। তীব্র মন খারাপ নিয়ে আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। করুণা আর ভালোবাসা বরাবর গুলিয়ে ফেলেছি আমি। যেমনটা রাফি ভাইয়ের বেলায় হয়েছিল। আজও তাই হলো!

কাঁথা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম। কতদিন হয়ে গেল মাকে স্বপ্নে দেখি না। মা কেমন আছে? ছোট্ট পুতুল! পুতুল ভালো আছে? বড় আপা কি এখনো স্বামীর কথা ভেবে অশ্রু ঝরায়? জানি না! ওদের দেখা মিলে না। শুধু সেজো আপাকে মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি। আপা স্বপ্নে এসে হাসে। কেমন তাচ্ছিল্য ভরা সে হাসি। যেন আমার বেঁচে থাকা নিয়ে খুব মজা পাচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ আবার আপার দু-চোখ ভরা অশ্রু থাকে। আপাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি আমি। কিন্তু স্বপ্নে আপা কি সুন্দর করেই না কাঁদে। তার অশ্রুসজল দৃষ্টি কোনো পুরুষ দেখলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কাব্য রচনা করতো। ফাইজান ভাই যে মেয়েকে বিয়ে করেছে সে-ও কি সুন্দর করে কাঁদতে পারে?

ঘুরেফিরে ফাইজান ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। ফাইজান ভাই বিয়ে করেছে। তার কাছের কেউ, তার আপন কেউ হয়তো। আচ্ছা সে মেয়েটা কী খুব সুন্দর? হয়তো! তা না হলে ফাইজান ভাইয়ের মত মানুষের মন জয় করতে পারতো না। ইশ! মেয়েটা কত ভাগ্যবতী। আস্ত এক পৃথিবী পেয়ে গেছে নিশ্চয়ই।

দুদিকে মাথা ঝাঁকালাম। এসব চিন্তা বাদ। ভালো কিছু চিন্তার চেষ্টা করলাম। কিছুতেই মন খারাপ করবো না আমি। কিছুতেই নাহ! খুশির কোনো মুহূর্ত মনে করতে গিয়ে স্মরণ হলো আব্বা একবার ঈদে নতুন জামা এনে দিয়েছিল। ঈদের দিন সকালে গ্রামের হাট থেকে। সেদিন সম্পূর্ণ পৃথিবী পেয়ে গিয়েছিলাম যেন! ওই রকম প্রিয় মানুষ গুলোকে হাট থেকে আনা যায়না? কেন যায় না? প্রিয় মানুষ গুলোর ডুপ্লিকেট কেন হয় না? খুব কষ্ট হতে লাগলো আমার। চোখ বেয়ে আপনা আপনি পানি বের হলো। হুট করে সামান্তা আপুকে মনে পড়লো। আপু নিশ্চয়ই শুনেছে। সে ঠিক আছে তো?

সন্ধ্যাবেলা চেঁচামেচির তীক্ষ্ম আওয়াজে বের হলাম। উপর থেকে মরা বাড়ির মতো কান্নার শব্দ আসছে। দৌঁড়ে সিড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠলাম। সামান্তা আপুর ঘরের দিকে এগোতে বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। কাছে গিয়ে দেখি আপু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শরীর এলিয়ে দিয়েছে। কথা বলতে পারছে না। চোখ উল্টে উল্টে যাচ্ছে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম। আপুর কি হলো?

জুলি আন্টি কান্নাকাটি করছে। তাকে সরিয়ে দিলো সালেহা খালা। পানির বালতি এনে সামান্তা আপুর মাথায় পানি ঢাললো কয়েক মিনিট। আমি হাত পায়ের তালু ঘষতে লাগলাম। কিন্তু কোনো উপকার হলো না। আমার ভয় হতে লাগলো। আপুকে দেখে স্পষ্টত মনে হলো কিছু একটা খেয়েছে। আচমকা মস্তিষ্কে বিষ শব্দ টা এলো। তড়িঘড়ি করে বললাম,

‘কাউকে ডাকুন। হাসপাতালে নিতে হবে বড় মা।’

‘আমি ডাকতেছি!’

খালা ছুট দিলো। কিছুক্ষনের মধ্যে মঈন চাচা এসে উপস্থিত হলো। তারপর আপুকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। সাথে গেল বাড়ির সবাই। বাড়িতে থেকে গেলাম আমি আর সালেহা খালা। আরেকজন রয়ে গেছে। দাদী! বিলাপ করে কাঁদছে। যাকে এর আগে আরেকবার কাঁদতে দেখেছিলাম। যখন রাজ ভাইয়া কে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল।

__________

সে রাতে ভালো মতো রান্না হলো না। দুশ্চিন্তায় কিছু ঠিকঠাক করতে পারলাম না। খালা একটু পর পর সামান্তা আপুর কথা বলছে। হা হুতাশ করছে। এ বাড়ির ছেলেমেয়ে গুলোকে খালা ভীষণ আদর করে। নিজে নিঃসন্তান। এদের খুবই ভালোবাসে। দাদীর কান্না থেমেছে। ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। কিন্তু আপুর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

জাবির এলো অনেক রাতে। এসে জানালো, আপু কিছুটা সুস্থ। অবশেষে চিন্তার ঝড় একটু কমলো। সে এসেছে খাবার নেওয়ার জন্য। হাসপাতালে অনেকে রয়েছে। কারো খাওয়া হয়নি। আমি আর খালা বক্সে করে খাবার সাজিয়ে দিলাম।

জাবির চুপচাপ। অহেতুক কথা বললো না। আপুর অসুস্থতার খবর শুনে হোস্টেল থেকে এসেছে সে। বসার ঘরে মন ভার করে বসেছিল। আমি এগিয়ে গেলাম। ছেলেটা শুকিয়ে গেছে। পড়াশোনার অনেক চাপ হয়তো।

‘আপনি এখান থেকে খেয়ে যান। খাবার বেড়ে দেই?’

জাবির এক পলক তাকালো। কেমন নিষ্প্রাণ চাহনি। চেহারায় গভীর চিন্তার চাপ। হুট করে মনে হলো ছেলেটা অনেক বড় হয়ে গেছে। সে ডানে-বায়ে মাথা নাড়লো। বলল,

‘খাবো না! ক্ষুধা নেই।’

‘অল্প একটু খান।’

‘সত্যি ক্ষুধা নেই।’

তার অসম্মতি কানে তুললাম না। প্লেটে খাবার বেড়ে দিলাম। জাবির আর না করলো না। এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। ভাত মেখে বলল,

‘বুবু ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছিল। এক ডজন প্রায়! আরেকটু দেরি হলে অঘটন ঘটে যেত।’

চমকে উঠলাম আমি। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। চোখের সামনে মা বোনের শায়িত দেহ ভেসে উঠলো। জাবির কয়েক লোকমা ভাত মুখে পুড়লো। হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে বলল,

‘বুবু হঠাৎ এই কাজ করলো কেন? সারাক্ষণ হাসি তামাশা করে, দৌড়াদৌড়ি করে। আচমকা এমন ভয়ংকর সিদ্ধান্ত কেন করলো মাথায় ঢুকছে না। তুই কিছু জানিস জুঁই?’

‘জানি না!’

নিঃশব্দে কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। জাবির আর প্রশ্ন করলো না। আমি নিজে থেকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘হাসপাতালে কে কে আছে?’

‘সবাই আছে। রাজ ভাইয়া এসেছে। ফাইজান ভাই খুলনা থেকে রওনা করেছে। এসে পৌঁছায়নি!’

‘ফাইজান ভাই আসতেছে?’

আমার অতিরিক্ত আগ্রহে চোখ তুলে তাকালো জাবির। আমি প্লেটে তরকারি তুলে দিলাম। কথা ঘুরিয়ে বললাম,

‘রাতে থাকবে কে সাথে?’

‘তুই যাবি?’

জিজ্ঞেস করলো জাবির। আমার যেতে ইচ্ছে করছে। ভীষণ রকম। খালাকে কতবার বলেছি, চলো খালা। দুজন গিয়ে দেখে আসি। কিন্তু খালা রাজি হয়নি। খালি বাড়ি, তাছাড়া দাদী একা। যাওয়া হয়নি। জাবিরের কথায় ভরসা পেয়ে বললাম,

‘আমি যাবো? কেউ কিছু বলবে না?’

‘থাক না গেলি! অনেক রাত হয়ে গেছে। চিন্তা করিস না। বুবু ঠিক আছে এখন।’

‘ঠিক আছে।’

খাওয়া শেষ হতে খালা খাবারের বক্স গুলো হাতে ধরিয়ে দিল। দাদীর সাথে আর দেখা করলো না। অনেক রাত হয়ে গেছে। দাদী ঘুমিয়ে পড়েছে। সে বেরিয়ে গেলো।

_________

সকালবেলা ফোনে খবর এলো। হাসপাতালে একজনকে যেতে হবে। টুকিটাকি কাজ আছে নাকি। সাথে সকালের নাস্তা নিয়ে যেতে বললো। আমি আর খালা দেরি করলাম না। ঝটপট নাস্তা তৈরি করে ফেললাম।

কিছুক্ষণ পরেই মঈন চাচা এলো। খালা তাকে খেতে দিল। এই ফাঁকে আমি জামা কাপড় পাল্টে নিলাম। চাচার খাওয়া শেষ হতে রওনা করলাম। খালা বাড়িতে রয়ে গেল।

হাসপাতাল বেশি দূরে নয়। চাচা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। আমার আব্বার কথা মনে পড়লো।

‘চাচা, আব্বা ভালো আছে?’

‘আছে ভালো।’

চাচা অনেক কথা বলে আমার সাথে। কিন্তু আব্বার কথা উঠলে আর কথা বাড়ায় না। দু চার শব্দের মধ্যে শেষ করে দেয়। কতবার তার কাছে ফোন নাম্বার টা চেয়েছি। চাচা দেয়নি। আব্বা নাকি আমার সাথে কথা বলতে চায় না। যোগাযোগ রাখতে চায় না। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। কাচের জানালা ভেদ করে দৃষ্টি বাহিরে দিলাম। বাহিরে ব্যস্ত নগরী। মানুষের ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেছে। সবাই তুমুল ব্যস্ত। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে দুদণ্ড সুখে থাকার জন্য, একটু ভালো ভাবে বেঁচে থাকার জন্য কি লড়াই করে যাচ্ছে সবাই!

গাড়ি থামলো এক ক্লিনিকের সামনে। প্রাইভেট ক্লিনিক। চাচার সাথে ভেতরে ঢুকে বিস্মিত হয়ে গেলাম। কোনো হাসপাতাল এতো সুন্দর হয় জানা ছিল না।

কেবিনের সামনের বারান্দায় ফাইজান ভাই আর রাজ ভাইয়া দাঁড়িয়ে ছিল। দুজন দুই প্রান্তে। দু দিকে মুখ করে! ফাইজান ভাইয়ের চোখে চোখ পড়লো। দ্রুত মাথা নিচু করে নিল সে। মানুষটার মুখ জুড়ে অপরাধবোধের গাঢ় ছায়া। কোনোরূপ জটিলতা ছাড়াই ধরা যায়। সবটা পড়ে ফেলা যায়। সে হয়তো ভাবেনি সামান্তা আপু এতবড় কাজ করে বসবে!

আমার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। কেবিনে প্রবেশের পথে রাজ ভাইয়া এগিয়ে এলো। বরাবরের মত বলল,

‘জুঁইফুল নাকি!’

তামাশা করার সময় নয় এটা। আমি উত্তর না দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। বড় মা, জুলি আন্টি আরো কয়েকজন ছিল। আমার অপরিচিত। তারা বেরিয়ে যেতে বড় মা কাপড়ের ব্যাগ চাইলো। আমি এগিয়ে দিলাম। সামান্তা আপু ঘুমিয়ে আছে। একরাতের ব্যবধানে কতটা শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি। চামড়া শুকনো! চোখের কিনারে শুষ্ক পানির রেখা। বড্ড মায়া হলো আমার।

বড় মা জুলি আন্টি কে বললেন,

‘জুলি তুই বাড়ি যা। গিয়ে একটু বিশ্রাম নে। দুপুরে গোসল করে একেবারে আসিস।’

‘আমি যাবো না। এখানেই থাকি। তুমি বরং যাও।’

‘তুই যা! তোর রাত জেগে অভ্যাস নাই। দেখ কেমন বিধ্বস্ত লাগছে তোকে। চিন্তার কিছু নাই আর। তুই যা।’

‘কলেজ আর নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম সবসময়। নিজের সন্তান দের দিকে নজর দিতে পারিনি। ওদের প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখিনি। আজ যদি কোনো অঘটন ঘটে যেত আপা?’

জুলি আন্টি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। বড় মা তাকে সান্ত্বনা দিলেন। অনেক বুঝিয়ে তাকে বাড়ি পাঠালেন।

সামান্তা আপুর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আমাকে দেখে লাজুক হাসলো। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় কিছু বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যথার জন্য বলতে পারলো না। আমার বড্ড কষ্ট হলো। চোখের কোণ ভিজে উঠলো। আপুর কী দোষ? একজনকে ভালোবেসেছিল শুধু। তাতে এত শাস্তি কেন পাবে! এমন অসহ্য দুঃখ কেন পাবে যার জন্য তার বেঁচে থাকার ইচ্ছে মরে যাবে!

বড় মা সকালের নাস্তা করছেন। আমি কাপড় ভিজিয়ে এনে আপুর হাত মুখ মুছে দিলাম। জামা পাল্টে দিলাম। ডাক্তার তিনদিন হাসপাতালে থাকতে বলেছে। দরজার ওপাশে মানুষের পদচারণ। কানে আসছে। আমি না দেখেও বুঝলাম ফাইজান ভাই। তার পদশব্দ আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। ফাইজান ভাই কী ভেতরে আসতে লজ্জা পাচ্ছে?

অবশেষে ফাইজান ভাই ভেতরে এলো। বড় মা এক পলক দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। অন্য সময় হলে দৌঁড়ে কাছে যেতেন। অভিমানী সুরে এটা ওটা জিজ্ঞেস করতেন। আজ কিছুই বললেন না। বড় মায়ের অভিমানের কারণ ফাইজান ভাইয়ের গোপন বিয়ে। কাউকে না জানিয়ে এতবড় এক কাজ করে ফেলেছে। সবাই অভিমান করে আছে।

ফাইজান ভাই ভেতরে ঢুকে সোজা সামান্তা আপুর কাছে এলো। আপু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ। পরক্ষণে মাথা ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। ফাইজান ভাই রেগে গেল হঠাৎ। ধমকে বলল,

‘ইচ্ছে করছে এক থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেই। এই কাজ কেন করেছিলি?’

আপু উত্তর দিল না। তার হাতের দিকে তাকালাম আমি। বিছানার চাদর খামচে পড়ে রয়েছে। ফাইজান ভাই ফের গর্জে উঠলো,

‘তুই এতো ছেলেমানুষ রয়ে গেছিস সামান্তা? ছি! এতো আদর যত্ন নিয়ে সবাই বড় করলো আর তার প্রতিদান এভাবে দিতে নিয়েছিলি?’

‘ফাইজান থাম। ডাক্তার এসব ব্যাপারে কথা বলতে নিষেধ করেছে।’

বড় মা অভিমান ভেঙ্গে মুখ খুললেন। ফাইজান ভাই দিশাহারার মতো এদিকে ওদিকে তাকালো। শেষমেষ বড় বড় পা ফেলে বের হয়ে গেল। তার চলে যাওয়ার পর পরই আপু চোখ খুললো। চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। শুভ্র রঙের চাদরের নিচের দেহটা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠলো। আপু কাদঁছে। নিঃশব্দে কাদঁছে।

ফাইজান ভাই কি কখনো এই কষ্ট বুঝবে? বুঝবে প্রিয়জন হারানোর এই ব্যথা? এই যন্ত্রণা? সে কী কখনো কোনো মেয়েকে ভালোবেসে ছিল? নাকি তার ভালোবাসার মেয়েটিকে বিয়ে করেছে? আপুর যন্ত্রণা একমাত্র হৃদয় ভাঙ্গা মানুষ অনুভব করতে পারবে। যাদের হৃদয়ের খুব গভীরে বড়সড় এক ক্ষত। নির্দিষ্ট কিছু মুহূর্তে যে ক্ষতে যন্ত্রণা হয়। গভীর রাতে যে ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে!

_________

ছাদে উঠেছিলাম শুকনো কাপড় আনার জন্য। হাসপাতাল থেকে অনেক ময়লা কাপড় আনা হয়েছে। সেগুলো ধুয়ে শুকাতে দিয়েছিলাম। কাপড় নিয়ে ফেরার পথে দরজার কাছে রাজ ভাইয়ার মুখোমুখি হলাম। সে দুপুর বেলা হাসপাতাল থেকে সরাসরি বাড়ি এসেছে। রাজ ভাইয়ার চেহারার উজ্জ্বলতা কিঞ্চিৎ কমে এসেছে। প্রথম দিন যখন দেখেছিলাম কাগজের মতো সাদা ছিল। দেশের আবহাওয়া লেগে গায়ের রঙ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আমি একপাশে সরে তাকে জায়গা করে দিলাম। কিন্তু সে এগোলো না। বলল,

‘জুঁইফুল! ছাদের গাছে পানি দাও না?’

‘দেই তো!’

‘উহু! দেও না। দিলে গাছ শুকিয়ে যেতো না। ওই দিকে দেখো জুঁইফুলের চারাগাছ মরে যাচ্ছে।’

ছাদের এক পাশে জুঁই ফুলের চারা। আমি হালকা পায়ে এগিয়ে গেলাম। গাছটা জাবির লাগিয়েছে। কেউ জানে না। অনেকে চিনে না এটা জুঁই ফুল। এতোবড় বাড়ি। এতো মানুষ। যার যার মতো ব্যস্ত থাকে। ছাদে কে কোন গাছ এনে লাগালো দেখার সময় নাই। তবে বড় মা একবার ছাদে এসে খেয়াল করেছিলেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন,

‘এইটা জুঁই ফুলের গাছ না? ছাদে কে লাগালো?’

আমি সামান্তা আপুর নাম বলেছিলাম। আর কারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি। জাবির বলেছিল ফুলের বিশেষ যত্ন নিতে। কাজের চাপে হয়ে উঠে না। ঠিকমত পানি না দেওয়ায় শুকিয়ে গেছে। মৃতপ্রায়!

‘সামান্তা কি ঐ ফাইজান হারাম’জাদা কে পছন্দ করতো?’

চমকে উঠলাম আমি। চারা গাছ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাজ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। সে ইতোমধ্যে সিগারেট ধরিয়েছে। নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,

‘আমি কিভাবে বলবো।’

‘সামান্তা ওকে পছন্দ করে ফেলেছিল। দেশে ফেরার পর পরই আমি বুঝতে পেরেছি। ভাগ্যিস সামান্তার কিছু হয়নি। ওর কিছু একটা হলে ফাইজানকে নিজ হাতে খুন করতাম আমি।’

রাজ ভাইয়ার কণ্ঠ শুনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। দেহ জুড়ে শীতল এক রক্তস্রোত বয়ে গেল। সারাক্ষণ পাগলামি আর হাসি তামাশা মেশানো কণ্ঠে অন্যকিছুর উপস্থিতি। ভয় হতে লাগলো আমার।

‘আমি যাই!’

উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্রুত পা চালালাম। দরজা অবধি পৌঁছাতে রাজ ভাইয়া পথরোধ করলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতবুদ্ধির মতো চেয়ে রইলাম। পাশ কাটিয়ে যেতে নিতে সে বাহির থেকে ছাদের দরজা ভিড়িয়ে দিল। ততক্ষনে হাতের অর্ধ খাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়েছে। বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল আমার। ধড়ফড়ানি বেড়ে গেলো। চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে। সেই ঘনিয়ে আসা সন্ধায় রাজ ভাইয়া ভয়ংকর এক কাজ করলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here