#হৃদস্পর্শ ( পর্ব ২২)
লিখা : জামিয়া পারভীন তানি
লেকের নেশা কাটিয়ে সাইমারা আবার বাসে উঠে , বাস চলছে লেকের পাশ ধরে। এক পাশে লেক ও অন্য পাশে আবাসিক বাড়ি-ঘর, অসম্ভব সুন্দর পরিবেশ । বেশ কয়েক কিলোমিটার এভাবে যেতে যেতে বাস থামালো, গাইড জানালো,
• “এবার আমরা লেকের ওপারে যাবো।”
লেক পার হতে হতে প্রকৃতির অন্যরকম অনুভূতিতে মুগ্ধ হয়ে গেলো সবাই। লেক পার হয়ে গাইড ওদের দেখালেন চকলেট তৈরির কারখানা।
গাইড ওদের বলে,
• “ সুইজারল্যান্ডে চকলেট অনেক বিখ্যাত। ”
তারপর গাইড ক্যাবল কারে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন এক উঁচু পাহাড়ে। সেখানে একটি চমৎকার রেস্টুরেন্ট রয়েছে। ওখান থেকে লেক ভিউটা আরো সুন্দর দেখা যাচ্ছে।
এতো সুন্দর দৃশ্য দেখে ওরা অবিহিত হয়ে গেছে, এরপর ওরা রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার করে ।
খাবার শেষ করে কিছুক্ষণ সেখানে থেকে আবার নেমে আসে ওরা, লেকের অন্য পাড় ধরে গাড়ি চলতে থাকলো স্টারটিং পয়েন্টের দিকে।
হঠাৎ একটি বাড়ির সামনে গাইড গাড়ি থামিয়ে ওদের বললেন,
• “ এটি হচ্ছে নোবেলজয়ী বিখ্যাত জার্মান লেখক টমাস মানের বাড়ি। ”
এরপর দেখালেন বাড়ির পাশেই তার কবর।
সজীব সাইমাকে বলে,
• “ ইসসস যদি লেখক হতে পারতাম! এভাবেই বিখ্যাত হতে পারতাম! ”
• “ তুমি যা আছো সেটাই ভালো। ” সাইমা হাসিমুখে বললো।
আবারো বাস চলতে থাকল এবং বিকেল পাঁচটার সময় ওদের নামিয়ে দিলো। বিভিন্ন দেশের প্রায় ২৫জন পর্যটক একত্রে জুরিখ ভ্রমণ শেষ করলো। জরিখ থেকে বেরিয়ে আসলেও ওদের অন্তরে জুরিখের সৌন্দর্য গেঁথে গেছে।
ওরা বাস ধরে লজে ফিরে আসে সন্ধ্যার পর। সুপ্তি নিজের রুমে গিয়ে ক্লান্ত শরীর বেডে এলিয়ে দেয় । ঘুম চলে আসে মুহুর্তের মধ্যে।
“ ঘুরাঘুরি করলে মন ভালো থাকে, সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে কিছুটা চিন্তা আসে, মন সেগুলো নিয়েই ভাবতে শুরু করে। কেউ ডিপ্রেশনে ভুগলে সেটা থেকে বের হয়ে আসার অন্যতম উপায় হচ্ছে ট্রাভেলিং, এছাড়া সবার সাথে মন খুলে কথা বলা, সব দুঃখ শেয়ার করলেও অনেক হতাশা দূর হয়ে যায়। “
°°°
পরেরদিন সজীব সাইমা কে নিয়ে রেহানের দেওয়া ঠিকানায় নিয়ে যায়, স্নেহাকে সুপ্তির কাছে রেখে যায়। এতে সুপ্তি একটু মন খারাপ করলেও স্নেহা কে নিয়ে খেলা দিতে দিতে মন ভালো হয়ে যায়।
সজীব কলিংবেল দিলে এক ভদ্রলোক এসে দরজা খুলে দেয়, ইশারায় বসতে বলে চলে যায় লোকটি।
একজন মহিলা আসে ওদের সামনে, পুরোপুরি সুইস মহিলার মতো মনে হয় সজীব সাইমার।
মহিলা আধো বাংলায় কথা বলা শুরু করেন, কুশল বিনিময় করেন প্রথমে, এরপর বলেন,
• “ আমি জন্মগত বাংলাদেশী কিন্তু এখানে থেকে থেকে সুইসদের মতো হয়ে গিয়েছি। তো আপনারা যার জন্য এতদূর এসেছেন তার সম্পর্কে বলি। ”
• “ জ্বী বলেন, রেহান এখন কোথায় আছে?”
• “ সেটা পরে হবে! আগে শুনুন
আমি বাংলাদেশী হবার পরও সুইজারল্যান্ডে কিভাবে আসলাম! ”
• “ এটার সাথে রেহানের কি সম্পর্ক! ”
• “ আছে বলেই বলছি। ”
• “ ওকে বলুন। ”
ভদ্রমহিলা বলা শুরু করেন,
• “ আমার নাম আফিয়া, বাবা মায়ের আদরের মেয়ে ছিলাম। যখন আমার জন্মের দুই বছর পর আমার ভাই জন্ম নেয় আমার খুব ঈর্ষা অনুভব হতো। আমি তাকে সহ্য করতে পারতাম না। খুব রাগ হতো ভাইয়ের প্রতি, বলে বোঝানোর মতো নয়। একবছর এভাবেই আমি রেগে থাকতাম সবার সাথে। যখন আমার মামা মামী সুইজারল্যান্ড থেকে বাংলাদেশ ঘুরতে যাই, আমার কিউট চেহেরা দেখে উনারা উনাদের সাথে আমাকে নিয়ে যেতে চায়।
আমি এতোই আনন্দিত ছিলাম যে খুশিতে রাজি হয়ে যায়। আমার আম্মু সেদিন খুব কেঁদেছিলেন, কিন্তু তাকে হেলা করেছিলাম। ছোট্ট মন ছিলো তো আমার, বুঝতে পারিনি মায়ের ভালোবাসা।
এরপর সুইজারল্যান্ডের পরিবেশ পেয়ে আমি যেমন সুন্দরী তেমন ট্যালেন্ট হয়ে বেড়ে উঠেছি। ২৪ টা বছর কেটে গেলো বিদেশে, ততদিনে একই ভার্সিটির এক ইয়ার সিনিয়রের সাথে প্রেম করি চুটিয়ে। বিয়ে করে নিই ওকে আমি মামা মামীর সম্মতি নিয়ে। ”
এরপর আফিয়া থেমে গেলো, রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সজীব সাইমা একে অপরের দিকে চেয়ে আছে, কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেনা।
তবুও সাইমা সজীব কে জিজ্ঞেস করে,
• “ উনি এসব কেনো বলছেন? ”
• “ নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে!”
• “ সেটাই তো বুঝতে পারছিনা আমি। ”
আফিয়া নাস্তার ট্রে নিয়ে আসলেন। সজীব বলে উঠে,
• “ মিস আফিয়া, আমরা তো এখানে খেতে আসিনি। ”
• “ মিস না মিসেস। ”
• “ সরি”
• “ এগুলো গ্রহণ করলে খুশি হবো। আপনারা খান আমি আমার কথা বলছি। ”
• “ ওকে ”
সজীব জুস গ্লাসে ঢেলে নেয়, সাইমাকে একটা এগিয়ে দেয়। আফিয়া আবার বলা শুরু করে।
• “ বিয়ের পর মনে হয় আমি নতুন জীবন শুরু করার আগে মায়ের দোয়া নেওয়া উচিৎ। বিষয়টা ওর সাথে শেয়ার করি। ও আমাকে অভয় দেয় আমি যেনো আগে যায়, ও ১০ দিন পরে আসবে।
আমার সব কাগজপত্র রেডি করে দেয়, খুব বেশী এক্সাইটেড ছিলাম নিজের মা কে আমি দেখবো অনেক দিন পর।
সুইজারল্যান্ড এ অনেক কেনাকাটা করি, ও নিজে চয়েস করে সব কিছু কিনে দেয়। মায়ের জন্য, বাবার জন্য, ভাইয়ের জন্য। আমার ভিতরের ফিলিংস টাই চেঞ্জ হয়ে গিয়েছিল। হাজার হোক জন্মদাতা, জন্মদাত্রী বলে কথা।
ঢাকায় এসে নামার পর জানতে পারি প্রতিদিন ঢাকা টু রাজশাহী বিমান যায়না। বাধ্য হয়ে বাসের টিকিট করে নিই। নিজের দেশের প্রতি অন্যরকম ফিলিংস কাজ করছিলো। আহহ! আমার নিজের দেশের ঘ্রাণ ই আলাদা, না জানি মায়ের গায়ের গন্ধ কতো সুমধুর হবে! ”
আফিয়া কিছুক্ষণ থামে, আফিয়ার মুখ টা গম্ভীর হয়ে যায়। সজীব তখন জিজ্ঞেস করে,
• “ এরপর কি হলো মিসেস আফিয়া! গিয়েছিলেন মায়ের কাছে? ”
অনেকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আফিয়া বলা শুরু করলো,
• “ আমি অনেক ছোট তে দেশ ছেড়েছিলাম! মামা মামীর দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছায় সেখানে। কিন্তু দেখি পুরো বাড়িতে মানুষ ভর্তি, বুঝতে পারছিলাম না কি হয়েছে! তবে মায়ের চিৎকার করা কান্নায় বুঝে গেলাম খারাপ কিছু হয়েছে। আমি আমার মাকে জড়িয়ে ধরি। আম্মি বললেন, আমি কে? হায়রে নিজের মেয়েকেও ভুলে গেছে। আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি। বলি আমি তোমার মেয়ে আফিয়া।”
আফিয়া কাঁদছে, অনেক কষ্ট বুকে জমে আছে। সব শেয়ার করে নিজেকে ধরে রাখতে পারছেনা হয়তো !
সাইমা আফিয়ার পাশে গিয়ে বসে, ধীর গলায় বললো,
• “ আপনি কাঁদবেন না প্লিজ! সব খুলে বলুন এরপর কি হয়েছিলো!”
আফিয়া চোখের পানি মুছে ফেলে, তারপর বললো,
• “ আম্মুকে আমার পরিচয় দেবার পর আম্মু আমাকে জড়িয়ে কান্না করতে থাকে। কান্নার বেগ বেড়ে যায় আম্মুর, আমাকে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে, তুই আসলি এতো বছর পর অথচ তোর ভাই টা আর নেই রে আফিয়া। আমি অবাক হয়ে যায়, জোরে করে বলি, নেই মানে কি বলতে চাও তুমি? আম্মু বললো, তোর ভাইকে কারা জানি গুলি করেছে। তোর ভাই আর নেই আফিয়া! ”
গুলির কথা শুনে সাইমা উঠে দাঁড়ায় , আফিয়ার উদ্দেশ্যে বললো,
• “ কি বলছেন কি আপনি? কে আপনার ভাই? কারাই বা তাকে হত্যা করে? ”
আফিয়া উঠে যায় , দেয়ালে থাকা পর্দা সরিয়ে দেয়। সাইমার হৃদয় ধক করে উঠে, এ যে তার চিরচেনা, এক সময়ের ভালোবাসা!
চলবে…..