#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩০
কাঁঠালগাছের বড় বড় ডালের ফাঁকফোকর থেকে পাখিদের কিচিরমিচির ডাক কানে ভাসছে।সেই মধুর সুরেলা কলতানেই ঘোর কাটলো তিহানের।তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি নামিয়ে তোহার থেকে একটু দুরত্ব নিয়ে দাড়ালো সে।
তিহান সরতেই হাতের ফুলগুলো মাটিতে রেখে মাথায় পুনরায় ওড়না টেনে নিলো তোহা।লজ্জায় লালাভ আভা এসে পরেছে দু’গালে।পকেট থেকে ফোন বের করলো তিহান।সময়টা দেখে নিয়ে মাথা বাকিয়ে দু’আঙ্গুলে কপালের কোঁণ ঘষে বললো,
—“আমি বাইরে বেরোবো,তুই যাবি সাথে?”
তোহা তাকালো।তিহান তার উওরের আশায় প্রশ্নাত্মক চাহনী নি:ক্ষেপ করে চেয়ে আছে।তোহার উওর না পেয়ে ভ্রু উচিয়ে আবারো ইশারা করলো তিহান।একটু আগালো তোহা।কিছু না বলে তিহানের হাত আঁকড়ে ধরতেই মুচকি হাসলো তিহান।নিজেও তোহার হাতের মুঠোটা শক্ত করে ধরে গেটের দিকে হাঁটতে লাগলো।
তিহানের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই তোহা বললো,
—“এই ভোরবেলা কোথায় যাবেন?”
—“একটু হাঁটবো।ভোরবেলা গ্রামের মাটির রাস্তা ধরে গন্তব্যহীন ভাবে হাঁটার একটা অদ্ভুত শান্তি আছে।বুঝলি?”
—“আপনি কিভাবে জানেন?আপনি তো শহরে থাকেন।”
—“আমি কি তোর মতো বাচ্চা নাকি?আজ পর্যন্ত হুটহাট কত জায়গা ঘুরতে গিয়েছি কোনো হিসাব আছে?এই গ্রাম বাংলার প্রকৃতি আমার ঢের চেনা আছে।তোর মতো ঘরকুনো ব্যাঙ নাকি আমি?গাধা!”বলে একহাতে নি:শব্দে লোহার মেইন গেটের হাঁতল ঘুরালো তিহান।ঠোঁট চেপে ধরলো তোহা।কোনরকম শব্দ ব্যায় না করে গেটটা খোলা হয়ে যেতেই কৌতুহলী কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
—“গেট খোলাই থাকে সারারাত?”
—“নাহ্,আমি মোসতাক চাচাকে বলে খুলিয়েছি।”
চকিতে আশেপাশে তাকালো তোহা।তার অস্থিরতা ভরা ভীত দৃষ্টি দেখে তিহান স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
—“শান্ত হ,উনি নেই এখানে।গেট খুলে দিয়ে চলে গেছে।এখন হয়তো নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে।”
তিহানের কথায় ছোট্ট করে স্বতিদায়ক একটা শ্বাস ছাড়লো তোহা।তিহান হাসলো।তোহার হাত টেনে তাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে মৃদু কন্ঠে বললো,
—“এত ভয় পাও কেনো?তোমার অসম্মান হবে এমন কিছু আমি কখনোই করবোনা।ভরসা রাখো।”
______________
গ্রামের মাঝারি প্রসস্তের রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তারা।কোন কথা নেই দুজনের ঠোঁটে তবু নিরবতার মধ্যেও যেনো হাজারো ভালোবাসার নিখুঁত নিস্তব্ধ বহি:প্রকাশ।এলোমেলো হাওয়া বইছে।ঠান্ডা শীতল ভোরের মাতাল হাওয়া।তারা হাঁটছে বেশ অনেকক্ষন যাবত।সকাল হয়েই গেছে প্রায়।দু একজন মানুষের আনাগোনাও শুরু হয়েছে।এতক্ষণ বেশ ভালো লাগলেও এখন রীতিমত হাঁপিয়ে উঠেছে তোহা।পা ব্যাথা করছে।
উপায়ন্তর তিহানের দিকে তাকালো সে।লোকটা নির্বিকার।কোনরকম অলসতা না নিয়ে অনায়াসে হেঁটে চলেছে।
মুঠো বন্দি থাকা ঘামে ভিজে যাওয়া হাতটা নাড়ালো তোহা।কাতর কন্ঠে ডাকলো,
—“তিহান ভাই..”
তিহান ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো।মূহুর্তেই দৃষ্টি সরিয়ে বাঁকা হেসে ব্যাঙ্গ করে বললো,
—“এটুকুতেই ক্লান্ত!সাধেই কি তোকে ঘরকুনো ব্যাঙ বলি?”
মুহূর্তেই চোখের দৃষ্টি আগুন হয়ে গেলো তোহার।তিহানের হাতটা ঝাঁড়া মেরে সরানোর চেষ্টা করে সে উত্তপ্ত কন্ঠে বললো,
—“আপনি আমাকে বারবার “ব্যাঙ” বলেন কেনো?আমি কি আপনার মতো বুড়ো নাকি যে সবজায়গায় একা একা ঢিংঢিং করে ঘুরে বেড়াবো?খালামনি কে বলে আপনার ঘোরাঘোরি বন্ধ করতে হবে।”
এক ভ্রু উচিয়ে বাঁকা চোখে তাকালো তিহান।তোহার তখনো তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।সরু চোখে সেদিকটা দেখে নিয়ে একটানে তার হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো তিহান।চোখে চোখ রেখে বললো,
—“কি বললি?আবার বলতো?সেইম টোনে বলবি ওকে?”
তোহা থামলো।ছাড়ানোর জন্য নাড়াতে থাকা হাতটা নিস্তেজ হয়ে তিহানের হাতের মাঝে আবদ্ধ হয়ে রইলো।দৃষ্টি ঘুরালো সে।বিরবির করে বললো,
—“আপনি সত্যি সত্যিই একটা অসহ্য।”
তবে এরপর আর বেশিক্ষণ চললোনা তাদের পদচারণ।একটা রিকশা ডেকে সেটায় তোহাকে নিয়ে উঠে বসলো তিহান।শত হলেও,প্রেয়সীর পায়ে ব্যাথা করছে।প্রেমিক কি তা সহ্য করতে পারে?
_______________
শুক্রবারের উৎসবমুখর দুপুর।
খানিক আগেই শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে তোহা।পরণে কাঁচা হলুদ রংয়ের একটা সুতির জামা।চুলগুলো আধভেজা।স্বর্ণালী দাড়িয়ে আছে জানলার ধার ঘেঁষে।তার হাতে একটা লাল রংয়ের বোতল।ভ্রু কুচকে কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে সেটাই উল্টে পাল্টে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সে।
—“কি ওটা আপু?এভাবে দেখছো যে?”
—“নানুতো বললো,আলতা।”ছোট্ট করে উওর দিলো স্বর্ণালী।
—“কি বললে?আলতা?”বলেই বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো তোহা।স্বর্নালির কাছে যেয়ে বোতলটা হাতে নিয়ে মুখ খুললেই লাল রংয়ে আঙ্গুল মেখে গেলো।আৎকে উঠলো সে।বিরক্তিতে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলেও স্বর্ণালির সামনে তা প্রকাশ না করে চুপচাপ বোতলটা আটকে ওয়াশরুমে যেয়ে হাত ধুঁয়ে আসলো।
বাড়ির ছেলেরা এখন বাসায় নেই।সবাই পান্জাবি পরে নানার সাথে মসজিদে গেছে।খালুরাও নেই।
সেজন্য তারা দুজন নেমে রান্নাঘরের দিকে গেলো।স্বর্ণালির হাতে এখনো আলতার বোতলটা বিদ্যমান।রান্নাঘরে আফিয়া আতিয়া নানু সবাই আছে।তারা দুজনও বসলো।তবে খানিকবাদে সেখানটায় আর মন
টিকলোনা তোহার।একদৃষ্টিতে কিছুক্ষন পাশের তাঁকের উপর রাখা বোতলটার দিকে চেয়ে থাকলো সে।মনের মধ্য তখন আলতা পরার অদম্য ইচ্ছা জেগে উঠছে আস্তে আস্তে।
॥
কাঁঠালগাছের নিচের বসার জায়গাটায় পা তুলে বসেছে তোহা।তার একহাতে আলতার বোতল।আরেকহাত লাল রংয়ে মাখামাখি।হলুদ রংয়ের জামাকপড় পর্যন্ত মেখে যাচ্ছে তবুও আলতা পরার তীব্র জেদ পেয়ে বসেছে তাকে।মূলত এটা কোন কঠিন কাজ না তবুও প্রথমবার করার কারণে তা ঠাওর করতে একবারেই অপারগ তোহা।কালো ভ্রু জোড়া কুচকে আছে।বাচ্চাদের মতো চেপে রাখা ঠোঁটে বিরক্তির আভাস।
একপর্যায়ে বেশ অনেক গুলো আলতা ঢেলে দেয়ায় তা পায়ের কোণা গড়িয়ে টুপটুপ করে ঘাসের উপর পরতেই একটা শক্তপোক্ত হাত তার পা টা টেনে নিলো।চমকিয়ে তাকালো তোহা।তিহানের পরণে সাদা পান্জাবি।মাত্রই বোধহয় ফিরেছে সবাই।
তিহানের একহাতে পানির বোতল।আশেপাশে তাকিয়ে পা সরিয়ে নিতে চাইলো তোহা।তিহান দিলোনা।
পানির বোতল থেকে পানি ঢালতে ঢালতে আর অপরহাতে আলতাগুলো ডলে ডলে উঠাতে উঠাতে বললো,
—“যেটা পারিসনা সেটা করিস কেনো?ভরদুপুরে আলতা পরার শখ হয়েছে?ইডিয়ট।”
তোহার খারাপ মেজাজ আরো বিগরে গেলো।দাঁতে দাঁত চেপে সে বললো,
—“আপনার কি সমস্যা?আমার পা,আমি আমার হাত দিয়ে পরছি আপনার কি হয়েছে?”
তোহার রাগত কন্ঠের বিপরীতে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো তিহান।ভেজা পা টা রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিতে দিতে তোহার দিকে তাকিয়ে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে কন্ঠে হাসির রেশ টেনেই বললো,
—“পরতে আর পারছো কই “হলদেপাখী”?”বলে তোহার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে নিলো সে।নিজের হাঁটুর উপর তোহার পা রেখে নিজের একআঙ্গুলে আলতা ভরিয়ে সুন্দর করে নিখুঁত ভাবে পরিয়ে দিতে লাগলো।
কয়েকফোঁটা গড়িয়ে পরলো তার ধবধবে সাদা পান্জাবিতে।সেদিকে ভ্রক্ষেপ করলোনা তিহান।একমনে আলতা পরানোর ধ্যানে নিমজ্জিত সে।
হঠাৎই সামনে নিজাম রহমান কে দেখে পিলে চমকে উঠলো তোহার।সে এদিকেই এগিয়ে আসছে।তৎক্ষণাৎ তোহা এক ঝটকায় পা সরিয়ে নিতে গেলেও তিহান বাঁধা দিয়ে বললো,
—“সমস্যা কি?”
উওরে তোহা ভীত ভীত কন্ঠে চাপা গলায় বললো,
—“পা ছাড়ুন।নানা আসছে এদিকেই।ও আল্লাহ!”
নানার কথা শুনেও বিন্দুমাত্র বিচলিত দেখালোনা তিহানকে।তোহা তখন মাথা নিচু করে রেখেছে প্রচন্ড ভয়ে।লোকটা নির্ঘাত তাকে তুমুল লজ্জায় ফেলবে আজ।এরই মাঝে তাদের একদম কাছাকাছি এসে উপস্থিত হলো নিজাম রহমান।
~চলবে~
[❤️]