#গজপ্রিয়া~16
#Chhamina_Begam
-“ভাবি আমি একটু কথা বলতে চাইছি রানির সাথে ..”
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর মৌসুমী ,মুসু, রানি সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে মনিরার ঘরে । একসঙ্গে বসে থাকলেও রানির কান পড়ে আছে বাইরে মামার বলা কথা গুলোর ওপর । ওর আকদের অনুষ্ঠানে কাকে কাকে বলতে হবে সেটাই বোঝাচ্ছেন তিনি লাবিবকে । তখনই মৌসুমীর ফোনের রিংটোনের শব্দে আড্ডায় ব্যাঘাত ঘটলেও আশিক ফোন করেছে দেখে রানি বাদে সবাই খুশি হল । কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পরেই আশিক আবদার করে রানিকে ফোন দিতে । আশিকের সপ্রতিভ কথা বার্তায় মৌসুমী,মুসু মুখ টিপে হেসে উঠল ।
-” পাশেই আছে । নাও কথা বলো …” বলেই মৌসুমী ফোনটা এগিয়ে দেয় রানির দিকে । রানি একবার ফোনটার দিকে তাকায় । তারপর উঠে দাড়িয়ে বলে ,
-“ভাবি আমার মাথাটা খুব ব্যাথা করছে । আমি ঘুমাব..” বলেই কারো কোনো জবাবের অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে ।
মুসু মৌসুমী দুজনেই ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে । মৌসুমী আশিককে বলল,
-” ভাইয়া , আপনার হবু বৌ লজ্জা পাচ্ছে । আমার মনে হয় এখন ওকে বিব্রত করা ঠিক হবে না । ”
-” না না । ঠিক আছে । আমি রাখছি তাহলে ..”
-“হুম ”
মৌসুমী, মুসু দুজনেই আবার একচোট হেসে নেয় । আরো কিছুক্ষণ গল্প করে দুজনেই শুতে চলে যায় । শুধু মনিরা চিন্তিত হয়ে বসো রইল বিছানায় । তিনি স্পষ্ট খেয়াল করেছেন আশিকের ফোন আসার সাথে সাথেই রানির চেহারায় কেমন মেঘ জমে ছিল । রানি যে লজ্জা পাচ্ছে তা নয় । সে এই বিয়েতে রাজি তো ? জন্ম না দিলেও ছোট বেলা থেকেই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন রানিকে । তাই রানির নাড়ি নক্ষত্র অবধি জানেন তিনি । নিজের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে সে ভীষণ খুতখুতে । কারো চাপিয়ে দেওয়া কোনো কিছুই সে মেনে নিতে পারে না । ছোটবেলা থেকেই নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছের মালিক সে । তাই তো , শুধু মাত্র রানি চায় বলেই নিজেদের ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও রানিকে অত দূর পড়তে পাঠিয়েছেন । না হলে নিজের কোল খালি করে মেয়েকে কাছছাড়া করার ইচ্ছা কখনোই ছিল না মনিরার । রানির বিষয়ে কেউ কোনো সিদ্ধান্ত নিলে হয়তো রানি মুখ ফুটে কিছু বলবে না কিন্তু হাসি মুখে কখনো মেনেও নেবে না । এতকিছু ভেবে মনিরা চিন্তিত হয়ে পড়েন । অপেক্ষা করতে থাকেন লাবিবের বাবা কখন ঘরে আসবে আর কখন তিনি এই বিষয়ে কথা বলবেন ।
মৌসুমী ফোন রেখে দেওয়ার পর থেকেই মিটিমিটি হাসছে আশিক । ফোনটা টেবিলের ওপর রেখে কাউচে বসে চোখ বন্ধ করল । পুরোনো স্মৃতি গুলো মনে করে ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল আশিকের ।
অনেক দিন আগের কথা তখন নতুন ব্যাচ শুরু করেছে আশিক । বিকেলের নাইনের ব্যাচটায় বেশ কয়েকজন নতুন ছাত্রছাত্রী এসেছে । ঈশান কোণে ঘন কালো মেঘ গুরগুর শব্দে ক্ষণে ক্ষণে ডেকে উঠছিল । যথারীতি টিউশন তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দিলে সবাই যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিয়ে দিয়েছে । বাইরে টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ছে তখন । আশিক ছাতা হাতে বাইরে বেরিয়ে দেখে তার এক ছাত্রী বারান্দায় দাড়িয়ে আছে । সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল ,
-“তুমি যাওনি কেন এখনো ? একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে । বৃষ্টিও বাড়ছে আস্তে আস্তে । তুমি দাড়িয়ে আছ যে? ”
আশিকের প্রশ্নে মেয়েটি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল । মেয়েটির চোখ জোড়া ছলছল করছে । যে কোনো মুহূর্তে হয়তো কেদে দেবে । আশিক আবার জিজ্ঞেস করল,
-” তুমি কি কারো জন্য অপেক্ষা করছ ? কেউ নিতে আসবে তোমাকে? ”
মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে না জানাল । বাইরে তখন বৃষ্টির ছাট বাড়ছে । আশিক আবার প্রশ্ন করল,
-“ছাতা এনেছ ? ”
এবার কেদেই দিল মেয়েটা । আশিক একটু অপ্রস্তুত হল । বাঁ হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল,
-“আমি ছাতা এনেছিলাম । কিন্তু এখন খুঁজে পাচ্ছি না । ”
-“ওহ ”
আশিক কিছু একটা ভাবল । তারপর বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়ে বলল চিন্তা না করতে । সে বাড়ি পৌঁছে দেবে । বৃষ্টির মাঝে আর একজনকে পিছনে বসিয়ে সাইকেল চালানো সোজা কথা নয় । তাই নিজের সাইকেলটা ডান হাত দিয়ে ধরে বাঁ হাতে ছাতা ধরল আশিক। পাশে রানিকে নিয়ে হেটে হেটেই চলে এল হাফ কিলোমিটারের মতো । তখনি ছাতা হাতে দৌড়াতে দৌড়াতে উপস্থিত হল সম্রাট । আশিক জিজ্ঞেস করল ,
-” এই বৃষ্টিতে দৌড়াচ্ছিস কেন সম্রাট ? ”
-“ভাইয়া, আমার বাড়ির পাশেই ওর বাড়ি । তাই তুমি চলে যাও । অর্ধেক তো চলে এসেছেন বাকিটা আমি আর ও একসঙ্গে চলে যাব । ” হাপাতে হাপাতে বলল সম্রাট । আশিক দেখল বৃষ্টির জলে সম্রাটের কোমড় থেকে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে । তখনই পাশ থেকে রানিকে বলতে শুনল ,
-“তুই আমার ছাতা নিয়েছিস কেন ? ”
-” আরেএ দরকার ছিল। তাই …”নির্বিকার কন্ঠে বলল সম্রাট ।
-” তোর ছাতা থাকতে আমার ছাতা কেন নিয়েছিস ? ”
-” আমারটা ভেঙে গেছে । ” তারপর আশিকের দিকে ফিরে বলল ,
-“ভাইয়া, আপনাকে আর যেতে হবে না । আপনি ফিরে যান । আমি আর ও চলে যাব । ”
-“ঠিক আছে । যাও ”
রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আশিক দেখতে লাগল রানি আর সম্রাট মুষলধারে বৃষ্টিতেই একটা ছাতা নিয়ে ঝগড়া করতে করতেই চলে যাচ্ছে । রানি একবার ছাতা নিজের দিকে টানছে তো সম্রাট একবার নিজের দিকে টানছে । হালকা হালকা তাদের কথপোকথন শোনা যাচ্ছে ….
-” আমি কিছু ভিজে যাচ্ছি কিন্তু সম্রাট ”
-” আরে আরে, টানছিস কেন ? আমিও তো ভিজে যাচ্ছি ”
-” নিজের ছাতা ভেঙেছিস কেন তাহলে ?”
-“আমি ভেঙেছি নাকি । অনিক কে মারতে গিয়ে ওর সাইকেলে লেগে ভেঙে গেছে । তাতে আমি কি করতে পারতাম । ”
-” কিছু করার নেই না । ভাঙার সময় তো মনে ছিল না । এখন তাহলে ভিজে ভিজে আয় । ” বলেই রানি ছাতা টেনে নিয়ে জোরে পা ফেলে এগিয়ে গেল । সম্রাট পিছু পিছু দৌড়াল ।
-” রানিইই, দাড়া আমার জন্য । আমি ভিজে যাচ্ছি । আরে , দাড়া না । ভিজলে জ্বর এসে যাবে । রানিইই..”
ধীরে ধীরে দুজনেই অদৃশ্য হয়ে গেল বৃষ্টির ঘন আস্তরণে । আশিক মুচকি হাসল । সেদিনই প্রথমবারের মতো অশ্রুসিক্ত কন্যার টলটলে চোখের মায়ায় আবদ্ধ হয়ে গিয়ে ছিল সে । এত বছর হয়ে গেল এখনো বেরিয়ে আসতে পারল না সেই মায়া থেকে ।
-“এত তাড়াহুড়োর কি খুব দরকার ছিল ? এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় আস্তে-ধীরে , সময় নিয়ে কি করা যেত না ? ”
-” কিসের কথা বলছ ? ”
-” কি আবার ! রানির আকদের কথা বলছি । তুমি মেয়েটার মতামত না নিয়ে কিভাবে এত বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারলে ?”
মনিরার কথায় রেগে গেল লাবিবের বাবা । কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন ,
-” তোমার মনে হয় আমি রানির কথা না শুনে কোনো সিদ্ধান্ত নেব । ওর সম্মতি ছিল বলেই তো কথা এগিয়েছি আমরা । ”
-” কিন্তু তবুও আমার মনে হচ্ছে ওকে আর একটু সময় দেওয়া উচিত ছিল আমাদের । ও ভেবে চিন্তে ওর সিদ্ধান্ত জানাতে পারত । কদিন পরেই না হয় হত আকদ । আশিক তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না । কিন্তু না, তোমার তো সব কিছুতেই তাড়া । তুমি রানিকেও মুসু ভেবে ভুল করছ না তো । যদি এমনটা ভেবে থাক রানি মুসুর মতোই তোমার বাধ্য মেয়ে । তবে কিন্তু ভুল করছ । তুমি তো চেনো রানিকে । সে নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে মর্যাদা দিতে জানে । পরে আবার আফসোস না করতে হয় । ”
-” আহঃ মনিরা । এত ভেব না । আমি তো চিন্তার কিছু দেখছি না । আশিক খুব ভালো ছেলে । ছোট বেলা থেকেই ওকে দেখে আসছি আমরা । তাই আলাদা করে কারো কাছ থেকে ক্যারেকটার সার্টিফিকেট আনার তো প্রয়োজন নেই । তাই তুমিও নির্বিঘ্নে থাক । ”
রাত অবধি এদিক সেদিক ঘুরে সবে মাত্র বাড়ি ঢুকেছে সম্রাট তখনি ডাকল রুমা ।
-” সম্রাট , একেবারে খেয়ে উপরে যাও । ”
সম্রাট ডাইনিং টেবিলের দিকে পা বাড়াল । ওয়াহিদ আর ওর বাবা তখন হাত ধুয়ে বসে পড়েছে । এখন শুধু ওদের সামনে খাবার আনার অপেক্ষা । সম্রাট ও ওয়াহিদের পাশে বসে পড়ল চেয়ার টেনে । এটা সেটা গল্প কতে করতেই রানির বিয়ের কথা তুলল ওয়াহিদ।
To be continue….