#তুমি_নামক_যন্ত্রণা
#লেখনীতেঃ হৃদিতা ইসলাম কথা
পর্বঃ২ ও ৩
সেদিন ছিল,ভিষন আশ্চর্যের এক সুন্দর সকাল।কেন যেন সেদিন সকালটা একটু বেশিই সুন্দর মনে হচ্ছিলো আমার।
.
বসন্তের মিষ্টি সকাল।কোন এক অজানা পাখির মিষ্টি কন্ঠে ঘুম ভাঙলো আমার।আড়মোড়া ভেঙে উঠে বাবু হয়ে বসলাম আমি।একগাল হেসে লাফিয়ে নামলাম বিছানা থেকে।ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে মাত্রই রুমের সাথে লাগোয়া বেলকনির দিকে পা বাড়িয়েছে।বেলকনিতে পা রাখতেই শীতল হাওয়া গায়ে লাগলো।ভালো লাগা ছাড়িয়ে গেল শরীর মন জুড়ে।প্রকৃতির এই শীতলতা গায়ে মাখতেই।চোখে মুখে এক তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পড়লো।এমন সকাল আমার প্রতিদিনই কাম্য। প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার এই এক সুযোগ।
বেলকনিটা আমার পছন্দের গাছ দিয়ে মন মত সাজিয়েছি।বেলকনির পুরোটাই সবুজে আবৃত। যেন ছোটখাটো একটা বাগান।বেলকনি ভর্তি গাছগুলোতে পানি দিলাম।তারা যেন সতেজতার ছোয়া পেল।তারপর বেলকনির চারপাশে বাধানো হাফ রেলিং এ হাত রেখে ঝুকে দাড়ালাম নিচের দিকে। চোখ গেল বাড়ির দুপাশের ফুলের গাছ গুলোর উপর।কেমন মুর্ছা গেছে ওগুলো।শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি বাড়িতে না থাকায় কেউ ওগুলোর যত্ন করেনি বলে মনে হচ্ছে। আমি ছিলাম না বলেই হয়তো বাগানের ফুল গাছে পানি দেওয়া হয়নি।আমিও আর বিলম্ব না করে ছুটে গেলাম সেদিকে।মাকে দেখলাম রান্না ঘরে খুটিনাটি করছে। হয়তো নাস্তা বানানোর প্রস্তুতি করছে।শুক্রবার বলে সবাই আজ একটু লেট করেই উঠবে।পানি দেওয়ার জন্য পাইপ হাতে নিলাম।মনের সুখে গাছগুলোকে পানি খাওয়াতে লাগলাম।একসময় মনে হল ওরা যেন ভিষন খুশি।তেষ্টায় প্রান যেন তাদের বেরিয়ে যাচ্ছিলো।এখন সেই তেষ্টা মিটেছে।ঠোঁটের কোনে আলতো হাসি ফুটলো।হঠাৎ দেখলাম পানি আসা বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু বুঝে ওঠতো পারলাম না।তাই পিছনে ফিরলাম আমি।পিছনে ফিরে যা দেখলাম তাতে মাথা গরম হয়ে গেল আমার।আমার বিচ্ছু ভাইটা পাইপে পাড়া দিয়ে পানি আটকে রেখেছ। মেজাজটা বিগড়ে গেল মুহুর্তেই।চোখে মুখে ভয়াবহ রাগ নিয়ে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। পাইপটা আমার হাতেই বন্দী। দু কদম এগোতেই পানির পাইপ থেকে পা সরিয়ে নিল পিচ্চু। আর পানি ছিটকে আমি তৎক্ষনাৎ ভিজে গেলাম।বিস্মিত হলাম। মুখটা কিনঞ্চিত হা হয়ে গেল।হাত থেকে রীতিমত পাইপটা পড়ে গিয়ে জলগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। স্লো মস্তিষ্কটা আকস্মিকতা বুঝে উঠতে না পেরে হ্যাঙ হয়ে গেল।কয়েক মুহুর্ত অতিবাহিত হতেই সে সচল অবস্থায় ফিরে এলো।পরিস্থিতি বুঝতে পেরে রেগে তাকালাম পিচ্চুর দিকে।ও খিলখিল করে হাসছে আর সে হাসি দেখে গায়ে জ্বালা ধরছে আমার।
আমি তেড়ে যেতে নিতেই ও মাটিতে থেকে পাইপটা তুলে আমার দিকে ধরলো।জলের পাইপটা মুখ বরাবর ধরে রেখেছে যার জন্য চোখে মুখে জল পড়ছে অবিরাম। চোখ তুলে তাকাতে পারছি না।দুহাতের তালু সামনের দিকে ধরে আড়াল করার চেষ্টা করছি নিজেকে।তবে খুব একটা লাভ হচ্ছে না।তারপর চেচিয়ে বলে উঠলাম,
— পিচ্চু সাত সকালে কি শুরু করেছিস? ভিজিয়ে দিলি কেন আমায়?পাইপটা ছেড়ে দে বলছি।না হলে ভালো হবে না কিন্তু। ধরতে পারলে মাথায় তুলে একটা আছাড় দেব।
— সকাল বেলা আমি শুরু করেছি নাকি রাত থেকে তুই শুরু করেছিস আপু।আমার সব চকলেট চুরি করে খেয়ে নিয়েছিস।
ওই অবস্থাতেই চোখমুখ খিচে নিলাম।এই রে ধরা খেয়ে গেলাম বলে মনে হচ্ছে।আমি তবুও না জানার ভান করে অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় বললাম,
— আমি!
ভোলাভোলা মুখ করে বললাম।যেন এই পৃথিবীতে যদি কোন ভোলাভালা মানুষ থেকে থাকে তবে সেটা আমি।আমি ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।সে সত্বার অধিকারী। পিচ্চু পাইপ নিয়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।পানির গতি বাড়ছে। এক পর্যায়ে ছুট লাগালাম আমি।পিচ্চু নিজেও আমার পিছনে ছুটছে।এই ১০ বছরের বিচ্ছু ছেলেটাকে সামলানো বেশ মুশকিল। মাযের আদরের রাজপুত্র বলে কথা। তবে যতই ও মায়ের আদরের রাজপুত্র হোক আমিও আমার বাবার আদরের রাজকন্যা।
ভেজা কাপড়ে ছুটে চলেছি আমি আর আমার পিছনে আমার বিচ্ছু ভাইটা পানির পাইপ হাতে দৌড়ে চলেছে।রাগ লাগছে ভিষন ধরতে পারলে একটা আছাড় দিব।পাজি ছেলে।দিনদিন বেদ্দপ হচ্ছে।এই ছেলের জন্য আজ আমার জীবনটা ফিস ফ্রাই এর থেকেও বেশি ভাজা ভাজা হয়ে গেছে।বাবার কাছে ভিষন আহ্লাদী রাজকন্যা হলেও মা আমাকে একদম ভালোবাসেন না।সারাক্ষণ বকাঝকা।সবসময় এক্সট্রা বকাঝকা।বুঝি না আমি কি সত্যিই আমার আম্মুর মেয়ে নাকি আমাকে কোথাও থেকে কুড়িয়ে এনেছে।হুহ!ভালো লাগে না।এখানে উনার ছেলে যে আমাকে এভাবে টর্চার করে তার বেলা। আজ আসুক আব্বু বলে দিব আমি।তবে তাহলে তো আমার কান্ডকারখানা ও ধরা পরে যাবে।
পিছন ফিরে বারকয়েক পিচ্চু কে শাষালাম।
— দেখ পিচ্চু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।আমি তোর চকলেট চুরি করেছি কে বলেছে তোকে।তুই যে তোর সিক্রেট ড্রয়ারে চকলেট রাখছিস তা আমি কি করে জানবো।
— হ্যাঁ,সেটাই তো কথা।আমি আমার সিক্রেট ডয়ারেই চকলেট রাখছি তা তুই কেমনে জানিস বল?
জিভ কাটলাম আমি।ইশশ মুখ ফসকে বলে ফেলেছি।আর এখন বাজেভাবে ধরাও পড়ে গেলাম।এটা কি ঠিক হলো বলো বাচ্চাপার্টি।আমি অসহায় মুখ করে বললাম,
–একটু চকলেট ই তো খেয়েছি তাতে এমন করার কি আছে।তোর বউকে তো আর খাইনি।আমি কাল এনে দিব।
— হু! একটু চকলেট খেয়েছিস! আমার পুরো বক্স খালি করে ফেলেছিস।জানিস এটা আমার জন্য কতটা স্পেশাল।আজ তোর খবর আছে আপু।তুই একদমই ঠিক করিস নাই।
— দেখ পিচ্চু এভাবে সাত সকালে আমাকে ভিজিয়ে কি লাভ তোর।আমার যদি সর্দি হয় না তো তোর গায়ে মুছবো বলে দিলাম।
— ছিহ! আপু তুই এত নোংরা। তবুও তোর এইসব ফালতু কথায় কাজ হচ্ছে না।রোজ আমার চকলেট খাওয়া আর আজ তো….
বলেও থেমে গেল। আমি ভ্রু কুচকে বোঝার চেষ্টা করছি ওর কথার মানে।কি এমন ভাবছে ও।পরক্ষণেই মনে পড়লো এটাই তো সঠিক সময়। যেই না ওর দিকে একপা এগিয়েছি ও পানির পাইপটা আমার দিকে ধরলো।পানির ঝাপটা মুখে পড়তেই চোখমুখ কুচকে ফেললাম। পিছনে ছুটতে ছুটতেই হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেলাম।পড়ে যেতে নিলেই সে আমাকে আকড়ে ধরলো দুহাতে শক্ত করে।আচমকাই এমন হওয়াতে চমকে ওঠে চোখ বন্ধ করেছি আমি। ওদিকের ব্যাক্তি অপলকে চেয়ে আছে বাচ্চা মেয়েটার মুখের দিকে। কি অপরুপ মায়াবি একটা মুখ।পানিতে ভিজে চোখমুখ আরও স্নিগ্ধ লাগছে ।পানির ছিটে মুখের উপর মুক্ত দানার মত চিকচিক করছে।চুলগুলো ভিজে লেপ্টে আছে মুখের উপর। তারউপর খিচে বন্ধ করে রাখা চোখ জোড়া।অসম্ভব দৃষ্টি নন্দন সে দৃশ্য।চোখের ঘন পাপড়িগুলো ভিজে আরও বেশি ঘন লাগছে। বড়বড় পাপড়ি গুলো সৌন্দর্যের শিখরে তাদের অবস্থান বর্ননা করছে।উজ্জ্বল শ্যাম বর্নের এই শ্যামময়ীর পানে দৃষ্টি যেন থমকে গেছে তার।
আমি নিজের কোমরে অচেনা কোন স্পর্ষ পেলাম।শক্ত হাতের বাধন অনুভব করলাম।চট করেই চোখ খুললাম আমি।অচেনা মুখ দেখে ভড়কে গেলাম আমি। চট করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম তার থেকে।সে অপলকে তাকিয়ে আছে।পলক ফেলছে না।তার ওই গভীর চোখের হিমশীতল চাহনিতে আমাকে অস্বাভাবিক অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে।অস্থিরতা আর অস্বস্তি যেন ঘিরে ধরেছে আমায়।
উনি মুখ খুলে বললেন,
— এই মেয়ে তুমি….
আর কিছু বললেন না থেমে গিয়ে আমার গায়ের দিকে নজর দিল।কয়েক সেকেন্ডের জন্য একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকেই উনি পিছনে ঘুরে ভিষন রাগ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
— এভাবে সং সেজে বাইরে কি করছো?যাও বাড়ির ভিতরে যাও।
রেগে গেলাম আমি। কেরে এ? আসছে কই থেকে?আমার বাড়িতে ঢুকে আমার সাথেই জোর গলায় কথা বলছে।আবার ধমকাচ্ছে।সাহস তো কম না।আমিও ঝাঝালো কন্ঠে বললাম,
— এইযে মিষ্টার ধলা হনুমান।ঠিক করে কথা বলুন।আমার বাড়িতে এসে আমাকেই ধমকাচ্ছেন। আমার বাড়ি আমি যেখানে খুশি সেখানে থাকবো। আপনার তাতে কি? দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস।
আমার ঝাঝালো কথা শুনেই ভিষন ক্ষেপে গেছে বোঝাই যাচ্ছে। কিয়ৎক্ষন অপেক্ষা না করেই পিছন ঘুরলেন উনি।রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে তার। দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমার কথা তার মোটেও পছন্দ হইনি। আমি ভালো করে দেখলাম তাকে।প্রথমেই দৃষ্টি পড়লো তার চোখের দিকে।নীল জলরাশির গভীর সমুদ্রের ন্যায় দুটি চোখ।তবে এখন তা হালকা লালচে বর্নের মনে হচ্ছে। গালো খোঁচা খোঁচা দাড়ি।সিল্কি চুলগুলো কপালের উপর এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।ঘন কালো ঝাকড়া চুল।যা উনার ফর্সা মুখের সাথে বেশ মানিয়েছে।চুলগুলো বেশ বড় হওয়ায় চোখ পর্যন্ত এসে ঠেকছে।পরনের সাদা রঙের শার্টটা আমার গায়ের পানিতে ভিজে লেপ্টে আছে। বুকের ভিতরের লোমগুলোও দৃশ্যবান।ফর্সা বুকে কালো ঘন লোমগুলো যেন ভয়াবহ ভাবে নজর কাড়লো আমার।তৎক্ষনাৎ আমার দুর্বল মস্তিষ্ক জানান দিলো সে ভয়ংকর সুন্দর একজন মানুষ। আমি আগে এত সুন্দর কোন ছেলে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।আচ্ছা ছেলেটা কি সত্যি ই এত সুন্দর নাকি আমার চোখেই তাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুদর্শন যুবক বলে মনে হচ্ছে।২৪/২৫ বছরের এই যুবকের এমন ভয়ংকর রকমের রুপ দেখে হতবাক আমি।আচ্ছা আমি কি এই প্রথম ক্রাশ খেলাম নাকি এই অসভ্যটার উপর।যদি সত্যি তাই হয়,তাহলে ওহ মাই আল্লাহ! বাচাও মুঝে বাচাও! আজ এই তেরো বছর বয়সে আজ অবধি হিরো ছাড়া কোন ছেলেকে দেখে সরাসরি ক্রাশ না খাওয়া এই আমি কি তবে এই ধলা হনুমানটার উপর ক্রাশড।ভাবতেই নিজের গালে নিজ হাতে দুইটা চড় থাপ্পড় লাগানোর চরম ইচ্ছে প্রতিরোধ করে ভাবলাম। আমরা ফ্রেন্ড সার্কোলের সবাই ক্রাশ খায়।রোজ রোজ ক্রাশ খায়।যেন ক্রাশ কোন মেডিসিন যেটা ওদের খাওয়াই লাগবে।নয়তো ওরা সুস্থ স্বাভাবিক থাকতে পারবে না।তবে এতদিন আমি কি ভাবে সুস্থ ছিলাম।আচ্ছা এটা কি কোন ব্যাধি নাকি।যে ব্যাধিতে আজ আক্রান্ত হলাম আমি।
এই অল্প সময়ের মধ্যেই হাজার রকমের কথা ঘুরপাক খেল আমার মাথায়।এই মান্ধাতার আমলের ঢিলা মস্তিষ্ক। এত অল্প সময়ে এত কিছু ভাবতে পারে। ভেবেও অবাক হলাম আমি।আমার অবাকের রেশ আর অদ্ভুত চাওনি কাটাতেই ধমকে উঠলেন।সামনের অবস্থান রত ব্যাক্তিটি।আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম।
ঝাঁঝালো গলায় কিছু বলবো তার আগেই দৌড়ে এল পিচ্চু।আর ছুটে এসেই কোলে চড়ে গেল লোকটার। আমি হা হয়ে তাকিয়ে আছি।আমার এই দুষ্টু ভাইটা এই অসভ্য পাজি লোকটার কোলে কেন চড়লো? আমার অবাকের রেশ কাটাতেই পারছিলাম না যেন।তার আগেই লোকটি টুকুস করে চুমু খেল পিচ্ছু কে।আমি হতবাক! চেনা নেই জানা নেই একটা মানুষ কি করে আমার ভাইকে চুমু খেতে পারে।আমি এবার বেশ রাগ নিয়েই বললাম,
— এই আপনি,,,
আর বলতে দিল না আমায় চোখ গরম করে চাইলো।আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। আমি কিছু বলার আগেই আবারো ঝাঝালো কন্ঠে বললো,
— ভিতরে যেতে বলেছি কথা কানে যায়নি।এখনো এখানে দাড়িয়ে আছো।যাও ভিতরে যাও।
ধুপ করেই মাথায় রাগ চড়ে বসলো আমার।রেগে গিয়ে বললাম,
— যাবো না ভেতরে।আমার ইচ্ছে।আপনি কে যে আমার আপনার কথা শুনতে হবে।
উনি কিছু না বলেই পিচ্চুকে কোল থেকে নামিয়ে দিল।আমার আরও খানিকটা কাছে এলো মুহুর্তেই।আমি মাথা পিছিয়ে নিলাম।উনি আমার উপর ঝুকে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,
— শরীর দেখানোর এতই যদি ইচ্ছে হয় এখানে না দাড়িয়ে থেকে রাস্তায় গিয়ে দাড়াও।সবাই দেখবে।
তার এমন জঘন্য কথা শুনে গা গুলিয়ে এলো আমার।নিজের দিকে চোখ পড়তেই বিষিয়ে উঠলো মন।কালো রঙের টিশার্ট টা গায়ের সাথে একেবারে লেপ্টে আছে।ওড়নাটা ছোটাছুটিতে পড়ে গেছে।প্লাজুটার অবস্থা ও বাজে। টিশার্টটা বেশ খানিকটা লম্বা ছিল ভাগ্যিস। নাহলে আমার মান সম্মান সব এই মুহুর্তে নিলাম হতো।এখনো আর বাকি আছে কি! কতটা বাজে কথা বলে অপমান করলেন আমায়।ভাবতেই চোখের কোটর বেয়ে দুফোটা জল গরিয়ে পড়লো।মাথা নিচু করে ছিলাম আমি।ছুটে গেলাম বাড়ির ভিতর।সকাল আটটা বাজে।তাই সব কেমন নিশ্চুপ।মানুষজন নেই।সবাই হয়তো ঘুমোচ্ছে।আম্মুকেও দেখলাম না।যেতে যেতেই পিচ্চুর বলা কথা শুনলাম।
পিচ্চু বললো,
— স্রোত ভাইয়া তুমি এত সকালে কি করে এলে বলো তো।তোমার সাথে আর কেউ আসেনি।
ওর কথা কানে পৌছুলে আমার।তবে গুরুত্ব দিলাম না।সে যেই হোক না কেন এভাবে আমাকে অপমান না করলেও তো পারতো।দৌড়ে রুমে এসে দরজা আটকে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ট্যাব ছেড়ে দিলাম।অঝোরে কাদছি আমি।না চাইতেও জল গড়িয়ে পড়ছে দুচোখ দিয়ে । নিরবেই।কোন শব্দ হচ্ছে সে কান্নায়। স্রোত ভাইয়া এভাবে বাজে কথা বলতে পারলো আমায়।আমি কি ইচ্ছে করে ভিজেছি।পিচ্চুটাই তো ভিজিয়ে দিল আমায়।একটু বুঝিয়ে বললেই তো হতো।এভাবে অপমান করার কি দরকার ছিল।আচ্ছা, এতটুকু সম্মান কি প্রাপ্য ছিল না আমার।রাগ হলো, অভিমান হলো। ভিষন অভিমান।এক আকাশ সমান অভিমান।
.
প্রায় আধঘন্টা পর বেরিয়ে এলাম ওয়াশরুম থেকে। চোখমুখ ফুলে গোল আলু হয়ে গেছে। যেকেউ দেখলেই বুঝে যাবে আমি ভিষন কান্না করেছি।
কিছুক্ষণ পরই দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেলাম।আম্মু ডাকছে,
— কথা, এই কথা। কি করছিস তুই? বাইরে বের হ।সবাই বসে আছে ব্রেকফাস্ট করবে বলে।তুই কি করছিস? জলদি আয় তোর আব্বু বসে আছে।
— আম্মু আমার ভালো লাগছে না।এখন খাবো না ।বিরক্ত করো না।
— এক চড়ে সব দাঁত ফেলে দিব। বেয়াদব মেয়ে।এখনি খাবি তুই? বের হ বলছি।
বিরক্তিতে মনটা বিষিয়ে উঠলো আমার।মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে উঠলো।এক আকাশ সম বিরক্তি নিয়েই পা বাড়ালাম দরজার দিকে।দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বিরক্তিকর চেহারা নিয়েই খেতে বসলাম আমি।আমি আব্বুর সাথেই বসলাম। আব্বু পেপার পড়ছিলেন।পেপারটা রেখে আব্বু একপলক আমাকে দেখে বললো,
— আমার আম্মুটার কি হয়েছে? রেগে আছো মনে হচ্ছে।
— নাহ আব্বু কিছু হয়নি।ঠোঁটের কোনে আলতো হাসব টেনে বললাম।
— তাহলে চোখমুখ এমন ফুলে আছে কেন? কান্না করেছো?আম্মু কিছু বলেছে।
আম্মু কিচেনে কাজ করছিলো। আব্বুর কথায় বিরক্তিকর চেহারা নিয়েই ভ্রুকুচকে চেয়ে বললো,
–আমি আবার কি বলবো তোমার মেয়েকে! আর কেউ কিছু বললেই বা কেঁদে ভাসাতে হবে এটা কোন ধরনের কথা।
আম্মুর কথা শেষ হতেই আমি বললাম।
— আব্বু আমাকে কেউ কিছু বলেনি।
–তাহলে কি হয়েছে আমার প্রিন্সেস টার।
আব্বুর কথার প্রতিউত্তর দেওয়ার আগেই দেখলাম দিদুন, পিচ্চু আর স্রোত ভাইয়া আসছে টেবিলের দিকে।পিচ্চুটা কেমন একটা ভাব নিয়ে হাটছে।ঠিক স্রোত ভাইয়ার মত ওভার স্মার্ট হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা।হুহ! ঢং দেখলে আর বাচিনা টাইপ এক্সপ্রেসন দিলাম।তবে উনার দিকে দ্বিতীয় চোখ পড়তেই রাগে ড়া রি রি করে উঠলো আমার।দিদুন আমার ওপরপাশে বসলেন তারপাশে পিচ্চু। আর স্রোত ভাইয়া ড্যাঙ ড্যাঙ করতে করতে আমার পাশের চেয়ারটাতে বসলেন।রাগ,জেদ,ক্ষোভ সবটা তরতর করে বাড়তে লাগলো আমার।দিদুন পরিচয় করিয়ে দিলো।বললো,
— স্রোত চিনতে পারছিস। আমাদের কথা।যাকে সারাদিন তুই জ্বালাতি যে সারাক্ষন তোর ঘাড়ে চড়ে বসে থাকতো।
উনি ভিষন আশ্চর্যের মতন করে বললেন,
–কি বলো দিদুন!এই পিচ্চিটা। এত বড় হয়ে গেছে।
উনার মুখে পিচ্চি ডাকটা শুনেই যেন আগুনে ঘি ঢালার মত জ্বলে উঠলাম আমি। তবে কিছু বললাম না।চুপচাপ রইলাম।এখন ভেজাল না করাই ভালো।
— হুহ! বড় হয়ে গেছে।তুই তো এতবছরে ঠিক তেমনভাবে আসিস নি।এলও দু একদিনে আবার চলে গেছিস।আর ও তো মামু বাড়িতেই বেশি থাকতো তাই আর তেমন দেখা হয়নি বলেই চিনতে পারিস নাই।ও নিজেও তো কখনো তোদের বাড়িতে যায় নি তাই তোদের ঠিক দেখা হয় নাই।
সত্যি দেখা হবার কথা নয়।আমি দু একদিন ছুটি পেলেই ছুটে যাই মামার বাড়ি। আমাদের এখান থেকে দুঘন্টার পথ। গ্রাম্য অঞ্চল বলে বেশ ভালো লাগে আমার।তবে গ্রাম হলেও বেশ উন্নত। ওখানে সময় কিভাবে কাটে বুঝতেই পারি না।মামিরা বেশ আদর করে আমায়।কিছুদিন আগে সেখানেই ছিলাম।মামু আর নীলা এসে নিয়ে গেছে আমায়।কাল সন্ধ্যায় ফিরেছি আমি।তাই তার আসার কোন আগাম বার্তা ছিল না আমার কাছে।
আম্মু সবাইকে সার্ভ করছে আর আমাকে কথা শোনাচ্ছে।ভিষন বিরক্ত লাগছে।বিরক্তিতে সব ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এই বজ্জাত ছেলেটার সামনে এভাবে অপমান না করলে হয় না।আমি নাকি লেখাপড়ায় পুরাই ডাব্বা।কোনরকম টেনেটুনে পাস।আমার মায়ের কাছে ৮৫%নম্বর ও টেনেটুনে পাস মনে হয় বলে নিজের গালে সটান একটা চড় বসানোর ইচ্ছে হলো আমার।কেন টেনেটুনে পাস করলাম।ফেল করলেও ভালো হতো।আরও বললো সারাদিন শুয়ে বসে খাওয়া আর ফোন গুতোনো ছাড়া কোন কাজ নাই আমার।পড়ালেখা কেমনে হইবো।আর অনেক অপমান ই করলো।অন্য সময় হলে পাত্তা না দিলেও এখন বিশেষ রাগ হচ্ছে আমার।এই বজ্জাত ছেলেটাও বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনে চলেছে আর আড়চোখে আমানে দেখছি।বার কয়েক আম্মুর সাথে সায় দিচ্ছে।
চরম বিরক্তি নিয়ে কিছু না খেয়েই উঠে গেলাম।আম্মু বললো,
— কিরে কিছুই তো খেলি না।খাবার শেষ কর তার আগে উঠবি না।
–পেট ভরে গেছে আম্মু আর পারবো না।
— আমি কোন কথা শুনতে চাই না।
আব্বুর দিকে অসহায় চোখে চাইলাম।আব্বু চোখ দিয়ে সামলে নিচ্ছি বলে আশ্বাস দিল।
— থাক। ও যখন আর খেতে চাইছে না জোর করো না।মামুনি একটু পর আবার খেয়ে নিবে কেমন?
আমি মাথা নাড়ালাম।আজ আর গলা দিয়ে খাবার নামবে বলে মনে হয় না।যা মুখে দিয়েছি তাও গলায় আটকে আছে। আজকের মত এত ভিষন অপমানিত আমার জীবনে কখনোই হইনি।এই অসভ্য ছেলেটার সাথে সাথে আম্মুও রাজ্যের কথা শোনালো।এতদিন দেখা হইনি ভালোই ছিলাম।বড় আব্বু বড় আম্মু প্রায়ই আসে। সুযোগ পেলেই।তারা ভিষন আদর করে আমায়।তবে এই লোক আগে তো কখনোই আসে নাই তবে আজ কেন এলো? না এলেই ভালো ছিল।জীবনে এত অপমানিত হতে হতো না আমায়।
.
সারাদিনে ঘর থেকে বেরোলাম না।দুপুরে খেতে ডেকেছিল।যাইনি পড়ে খেয়ে নিব বলে। আম্মু বকাঝকা করেছে তবে কানে তুলিনি।রোজই করে তবে দিদুন তো আসে আমি না খেলে আমাকে নিতে।আজ এলো না কেন? এখন আর আমাকে কেউ ভালোবাসে না।সকালে আব্বুও আদর করে মুখে তুলে খাইয়ে দিল না।কেউ ঠিকভাবে বললো ও না।ভাবতেই মনটা ভিষন দুঃখে ভরে গেল আমার। তাই আর একবারও খেতে গেলাম না। সারাদিন মুখ ফুলিয়ে ছিলাম।
সারাদিন যেমন তেমন তবে রাতে আর থাকতে পারলাম না।ক্ষুধায় মরে যাবার মত অবস্থা। কি করবো? যাই হোক অন্যকারো উপর রাগ করে থেকে নিজের পেটকে অনশনে রাখার কোন মানেই হয় না।তাই সব ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম।সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে এখন চুপিচুপি খাবার খেয়ে নিলে কেউ টের পাবে না আর না আমাকে নিয়ে মজা করবে। আর ওই বদমাইশ ব্যাটা তো মনে হয় এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে।এই ব্যাটা এ বাড়িতে পা রাখার পর থেকেই কেউ আমায় আর ভালোবাসছে না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! নাহ যায় না! যাই হোক আগে পেটপুজো করে একে শান্ত করতে হবে।কি জোরে জোরে ডাকছে।
রাত প্রায় ১১ টা। আমাদের বাড়িতে ১০ঃ৩০ পর তো আর কেউ জেগে থাকে না।তাই চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে আশে পাশে উঁকিঝুঁকি দিলাম।নাহ সব জায়গায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। মানে সবাই এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে। আমি পা টিপে টিপে কিচেনের দিকে গেলাম।ফ্রিজ খুলতেই যাবো ওমনি কেউ আমার হাত ধরে ফেললো।আমার কলিজা ফাল দিয়ে উঠলো।আতকে উঠলাম আমি।এত রাতে ভুত টুত আবার নয়তো।ভাবতেই একটা শুকনো ঢোক গিললাম।ভয়ে ভয়ে পেছন ফিরলাম আমি। বাইরের আবছা হলদেটে আলো চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে আর ওই হলদেটে আলোর আদলে আমি একটা ভয়ানক সুন্দর মুখের মানুষকে আবিষ্কার করলাম।যে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।আমি ভয় পেলাম আরো বেশি করে এই ভুত আবার স্রোত ভাইয়ার রুপ ধরে আসেনি তো।ভেবেই চোখ বড়বড় করলাম। নিজেকে বাঁচানোর উদ্দোশ্য যেই না চিৎকার করতে যাবো ওমনি উনি আমার মুখ চেপে ধরলো।চোখমুখ ভিষনভাবে কুচকে আছেন উনি।যার দ্বারা উনার বিরক্তি প্রকাশ হচ্ছে নাকি রাগ বুঝতে পারলাম না আমি।ভয়ার্ত মুখ নিয়ে প্রসারিত চোখে উনার দিকে চেয়ে আছি।
উনি আমার মুখের খানিকটা কাছে এসে বললো,
–চেচাচ্ছিস কেন?
— উম্ উম্ উম্….
আমি উম্ শব্দ করে চোখ দিয়ে আমার হাতের দিকে ইশারা করছি।উনি বুঝতে পেরে মুখ ছেড়ে দিলেন। কিন্তু দুরে সরলেন না।এমনিতেই উনি মুখ চেপে ধরায় শ্বাস আটকে আসছিলো আমার তারউপর আবার উনি আমার এত কাছে আছে।যা আমার ভিষন অস্বস্তি আর অস্থিরতা দুটোই সৃষ্টি করছে।উনার শরীরের অদ্ভুত রকমের ঘ্রানটা যেন আরো বেশি বাড়িয়ে দিচ্ছে আমার হৃৎস্পন্দন।এত জোরে জোরে বিট করছে যেন মনে হচ্ছে এখুনি লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে ওটা।আমি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি।উনার দিকে তাকানোর সাহস নেই আমার।
তবুও বুঝতে পারছি উনি একধ্যানে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।আমি এবার একটু নড়েচড়ে উঠতেই উনি শুধালেন।
— এত রাতে কিচেনে কি করছিস তুই?
আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।কি বলবো,
— আ্ আমি প্ পানি নিতে এসেছিলাম।
— তোর রুমে তো পানি আছে দেখলাম আমি।
আমি চমকে চাইলাম।উনি কি করে জানে আমার রুমে পানি আছে।তবে আমাকে মুখ খোলার সুযোগ দিলেন না উনি। বলে উঠলেন,
–এই এই এই! তুই এত রাতে চোরের মত কিচেনে ঢুকেছিস কেন বলতো? ধান্দাটা কি তোর? বাই এনি চান্স খাবার চুরি করতে নয়তো!
আমার মুখ এবার হা হয়ে গেল। সাথে কিঞ্চিৎ রাগও হলাম।চোখমুখ শক্ত করে বললাম,
— আমার বাড়িতে আমি খাবার চুরি করবো কেন?
— তাহলে এত রাতে কি চাই তোর?
— যা ইচ্ছে তাই।আপনাকে কেন বলবো! আপনি কেন কাউকেই বলবো না আমি।সরুন বলছি যেতে দিন আমায়।
বলতেই উনি আরো ঘেষে দাড়ালেন আমার সাথে। যেন আমার কথাটি তার কর্নপথে যায়নি।মিশে যেতে চাইলেন আমার সাথে। ঘাবড়ে গিয়ে চোখমুখ খিচে বুঝে ফেললাম।কিন্তু এমন কিছুই হলো না।আমি চোখ খুলে দেখলাম উনি একহাতের উপর আরেকহাত রেখে সে হাত থুতনিতে ঠেকিয়ে কেমন অদ্ভুদ চাহনীতে দেখছেন আমায়।আমি উনার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।হুট করে উনি এসে একহাতে আমার কোমর জরিয়ে কাছে টানলেন।আমি স্তম্ভিত। হঠাৎ ঘটা এমন আকস্মিক ঘটনায়।অবাক চোখে তাকিয়ে আছি।আচমকাই গালে ঠান্ডা কিছুর আভাস পেলাম।এতক্ষণের কিছুর ধ্যান জ্ঞান ছিলনা বোধহয়। হঠাৎ হঠাৎ এমন সব কান্ড ঘটছে।আমার মস্তিষ্ক তা নিতে পারছে না।বারবার হ্যাঙ হয়ে যাচ্ছে।গালে ঠান্ডা আইসক্রিম গুলো কাতর স্পর্শে জিভ দিয়ে চেটে খেয়ে নিলেন। উনার এহেন স্পর্শে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ব্যক্তির ন্যায় কাপছি আমি।পরমুহূর্তেই আমাকে ছেড়ে আইসক্রিম নিয়ে চলে গেলেন উনি।আমি এখনো আটকে আছি।যাওয়ার সময় পিছন না ঘুরেই বললেন,
— ফ্রিজে তোর পছন্দের ভুনা খিচুড়ি তোলা আছে। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।ওই ছোট্ট মাথায় ওতো বেশি প্রেসার দিস না।ফেটে যাবে।
আমি বোকার মত তার কথা শুনলাম।সাথে সায়ও দিলাম।এতক্ষণে ঘোরের মধ্যে ছিলাম।হঠাৎ কানে একটা আওয়াজ এলো।তাতেই ঘোর ভাঙলো আমার।এতক্ষণ কি হচ্ছিলো ভাবার চেষ্টা করলাম তবে কিছুই বুঝতে পারলাম না।উল্টো মাথাটা ভিষন ব্যাথা করছে।তাই ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে ভুনা খিচুড়ি নিয়ে গরম করে ঘরে চলে এলাম।ইশশ! আফসোস হচ্ছে। আমার প্রিয় খাবার রেধেছিল আম্মু।আর আমি সারাদিন না খেয়ে ছিলাম।তবে আম্মু কেন বললো না যে আজ আমাে পছন্দের ভুনা খিচুড়ি রান্না হয়েছে জানলে তো সব রাগ ভেঙে চলে যেতাম আমি।
আর কিছু না ভেবেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।কিন্তু ঘুম ভাঙতেই বাধলো আরেক বিপত্তি। ঘুমুঘুমু চোখ খুলতেই দেখলাম আমার চোখের সামনে আম্মু।উনি আমার বিছানার একপাশে উপুর হয়ে কিছু করছে। সকাল সকাল আম্মুকে আমার ঘরে দেখে উঠে বসলাম আমি।ঘুমুঘুমু চোখমুখ ডলে নিলাম।তারপর পরিষ্কার ভাবে দেখতে পেলাম। আম্মু আমার কাপর গুছিয়ে দিচ্ছে।আমি অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে আম্মুকো বললাম,
— আম্মু কি করছো তুমি সকাল সকাল? আমার কাপড় কেন গোছাচ্ছো?
আম্মু তাড়া দিয়ে বললো,
— বেশি কথা না বলে তাড়াতাড়ি ওঠ বলছি।ছেলেটা সেই কখন থেকে বসে আছে তোর জন্য। আর তুই কিসের ঘুম দিয়েছিস? সকাল থেকে ডেকে চলেছি।উঠার নাম নেই।এখন এগারোটা বাজে উঠেছিস।যা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নে।
— কিন্তু আম্মু আমি রেডি কেন হবো? কোথায় যাচ্ছি? আর কে বসে আছে?
— আমি।আমার সাথে যাচ্ছিস আর তাই তুই এখন রেডি হবি।
গলা শুনে দরজার দিকে চাইতেই দেখলাম ওই অসভ্য ছেলেটাকে।সকাল সকাল এর মুখটাই দেখতে হলো দিনটাই খারাপ যাবে আমার।উফফ! তাকে দেখেই চরম বিরক্তিতে ছেয়ে গেল আমার মন।তবে আম্মু তো উনি আসার পর থেকেই বেশ খুশি।যেন আমি না ওইটাই ওনার আদরের ছেলে।আমার জন্য একটুও ভালোবাসা নেই।আমি রাগ নিয়েই বললাম,
— আমি রেডি হচ্ছি না।আপনার সাথে কোথাও যাচ্ছি না।আপনাকে বসে থাকতে কে বলেছে চলে যান আপনি যেখানে যাওয়ার।
আমার কথায় তার ভাবাবেগ হলো বলে মনে হলো না।তিনি কিছু বললেন না। তবে সঙ্গে সঙ্গে আম্মুর ধমকে প্রান ওষ্ঠাগত আমার।ভুবন কাপানো ধমক দিয়ে বললেন,
— এক চড় দেব বেয়াদব মেয়ে।বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না তুই?নাকি তোকে শেখায় নি?একটা মাইরও মাটিতে পড়বে না তোর।আর যদি দেখেছি স্রোতের সাথে এরকম বেয়াদবি করতে।চুপচাপ গিয়ে রেডি হ। যা।
আম্মুর কথায় ভিষন মন খারাপ হলো।মুখটা লটকে গেল মুহুর্তেই।লটকানো মুখ নিয়েই একটা ড্রেস নিয়ে চলে গেলাম ওয়াশরুমে।একেবারে গোসল সেরে বেরিয়েছি।কোনরকম নাস্তা করলাম।ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে জানতে পারলাম উনি আমার জন্যই এখানে এসেছেন।আর এক সপ্তাহ পর তিশা আপুর বার্থডে + এঞ্জেমেইন্ট দুটোই।উনার জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন।তাই উনি এই সময় টা আমার সাথে কাটাতে চান বলে চলে এসেছেন আমাকে নিতে। এতক্ষন সব বিরক্তির মত মনে হলেও তিশা আপুর কথা ভেবে ভালো লাগলো।তবে রাগও হচ্ছে এই লোকটা তো ওখানে থাকবে৷ আবার আমাকে একা পেয়ে হুটহাট উল্টোপাল্টা কাজ করবে নাতো।ভাবতেই কেমন ভয়ে সিটিয়ে গেলাম।কালকের ঘটনাই তো এখনো মাথা থেকে বের করতে পারি নাই।তাইতো কাল সারারাত ঘুম হয় নাই।যতবার ঘুমাতে গেছি।এসবই চোখে ভেসেছি।সবাইকে বিদায় দিয়ে রওনা হলাম আমরা। উনার গাড়িতে করেই যাচ্ছি।তবে আমি পেছনে আর উনি সামনে।বাড়ি থেকে বের হবার সময় সবাই বারবার করে বলেছিল আমাকে সামনে বসতে।তবে আমি ভয় পাই বলে এড়িয়ে গেছিআমি অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে বসে আছি।ভাবখানা এমন যেন গাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। হুট করেই গাড়ি……..
#চলবে………