#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ৩৪
-ই্ ইনসু,ইনসু আপু…আ্ আম্মুর….আম্মুর এক্সিডেন্ট হয়েছে!
হুহু করে কেদে দিলো ইরাম।কথাটা শুনে পায়ের তলার মাটি সরে গেলো আমার।ফোনটা হাত থেকে পরে গেছে।স্তব্ধ হয়ে গেছি যেনো।আয়ান চৌধুরীর ফোনকলের পর থেকে অস্থির হয়ে ছিলাম শুদ্ধকে সবটা জানাবো বলে।রুম তছনছ করে দিয়েছিলাম ওই মুখোশধারী লোকটার কুকীর্তির প্রমান জোগারের জন্য।এরইমাঝে ইরাম ফোন করে এই কথাটা বললো।টাল সামলাতে না পেরে পরে যাচ্ছিলাম।কেউ দুহাতে জরিয়ে ধরলো আমাকে।জলভরা চোখে দেখলাম শুদ্ধ আমাকে জরিয়ে ধরে আছেন।উনি ব্যস্ত হয়ে বললেন,
-কি হয়েছে?কি হয়েছে তোর সিয়া?কার ফোন ছিলো?কে ফোন করেছিলো?কে,কি বলেছে তোকে?কি হলো?বল তো!কে ছ্…..
আমি চিৎকার করে কেদে উঠলাম।শুদ্ধের শার্ট খামচে ধরে চেচিয়ে বলতে লাগলাম,
-আম্মু…আম্মুর নাকি….
-ক্ কি?কি হয়েছে আম্মুর?আমি….
উনি বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।জাপটে জরিয়ে কান্না করতে লাগলাম আমি।
-শুদ্ধ…আমার….আমার আম্মুর….
-ছোটমা?হ্যাঁ,ক্ কি হয়েছে ছোটমার?বল সিয়া!বল!কি হয়েছে ছোটমার?
আমি আরো জোরে কাদতে লাগলাম।আমাকে একহাতে জরিয়ে কপাল ধরে শুদ্ধ নিজেও দিশেহারার মতো করছেন।ফোনটা বের করে কল লাগালেন কাউকে।
-হ্ হ্যালো?হ্যালো ইমরোজ?ইমরোজ?ছ্ ছোটমা…ছোটমার ক্…
…..
ফোনটা বেডে ছুড়ে মারলেন উনি।তারপর আমার দুগাল ধরে মাথা উচু করে বললেন,
-কাদিস না সিয়া!শান্ত হ!কিচ্ছু হবে না ছোটমার!কিছুই হবে না দেখিস!
কোনো কথা কানে যাচ্ছে না আমার।পাগলের মতো বলতে লাগলাম,
-আমি আম্মুর কাছে যাবো।আমাকে আম্মুর কাছে নিয়ে চলুন শুদ্ধ।নিয়ে চলুন!
এরমধ্যে মাহি,আম্মু ঘরে ঢুকেছে।আম্মুও অস্থিরভাবে বললো,
-ইনসু?শুদ্ধ?ইনসুর কি হয়েছে?এমন করছে কেনো ও?কাদছে কেনো?কি হয়েছে ওর?
-আম্মু….আম্মু ছ্ ছোটমা একটু অসুস্থ্য হয়ে….
-কি?কি হয়েছে ছোটর?কি হয়েছে ওর?অসুস্থ্য মানে?এভাবে….
-আম্মু,শান্ত হও তুমি।কিছুই হয় নি ছোটমার।কিছুই হবে না।একদম ব্যস্ত হবে না তুমি,অস্থির হবে না বলে দিলাম।মাহি?আমি সিয়াকে নিয়ে বেরোচ্ছি।আব্বুও এখনই চলে আসবে অফিস থেকে।তুই আম্মুকে একটু…
-না শুদ্ধ!আমিও যাবো!আমিও যাবো শেহনাজ মন্জিল!আমি….
-হ্যাঁ,যাবে তো!আমিই নিয়ে যাবো তোমাকে।ছোটমা একটু সুস্থ্য হোক।
-না।আমি এখনই….
-পাগলামি করো না আম্মু।এখন সিয়াকে সামলানো…
মাহি বললো,
-শুদ্ধ ভাইয়া,তুমি ইনসিয়া ভাবিকে নিয়ে বেরোও।ফুপিকে আমি ঠিক সামলে নেবো।এসো তোমরা।
একদন্ড না দাড়িয়ে আমাকে জরিয়ে ধরে বেরিয়ে এলেন শুদ্ধ।গাড়িতে বসে স্টার্ট দিলেন গাড়িটা।বুকে হাত গুজে সারাটা রাস্তা কেদেছি চিৎকার করে।কোনোদিক তাকাইনি আর।হসপিটালে গাড়ি থামতেই শুদ্ধকে রেখেই দৌড়ে ভিতরে ঢুকলাম।ইমারজেন্সির সামনের করিডরে শেহনাজ মন্জিলের সবাই।বড়মা,মেজোমা,ফুপি কাদছে।দীদুন লাঠিতে হাত রেখে স্থির দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে।মেজোকাকু আর রিফাত ভাইয়া ব্যতিত কোনো ছেলেমানুষ নেই।সোজা গিয়ে ইমারজেন্সি রুমের দরজায় বারি লাগালাম আমি।সীমা ভাবি এসে জরিয়ে ধরলো আমাকে।চেচিয়ে বললাম,
-ছেড়ে দাও!ছেড়ে দাও আমাকে ভাবি!আম্মু!কি হয়েছিলো?কিভাবে এসব হয়ে গেলো?
দীদুন এসে কাধে হাত রাখলো আমার।তাকে জরিয়ে আরো জোরে কেদে দিলাম।সবাই মিলে শান্ত হতে বলছে আমাকে।ইরামটা এসে জরিয়ে ধরে ফুপাতে ফুপাতে বললো,
-আপু?কেদো না প্লিজ এখানে।আম্মু আর আমি একটু বেরিয়েছিলাম আজ।আমারই কিছু কেনাকাটা…রোড পার হতে গিয়ে একটা গাড়ি আম্মুকে….
ও কেদে দিলো আরো জোরে।ওকে জরিয়ে আমিও কাদছি।আব্বুর কথা মনে পরতেই কান্না থামিয়ে বললাম,
-কাকু?আব্বু কোথায়?আব্বু কোথায় গেছে?আর ইমারজেন্সি রুমে শুধু নার্স কেনো?ডক্টর কোথায়?বলুন কাকু?কি হচ্ছে টা কি?
রিফাত ভাইয়া এগিয়ে এসে বললো,
-ইনসু,শান্ত হ!তোকে স্ট্রং থাকতে হবে এখন।
-মানে কি?আম্মুকে ওভাবে…
-ইনসু,এক্সিডেন্টে ছোটমার অনেকবেশি রক্তক্ষরন হয়ে গেছে।রক্ত দিতে হবে তাকে।রক্ত দেওয়ার আগে কোনো চিকিৎসাই হয়তো….
-তো দিচ্ছে না কেনো ব্লাড?কেনো থেমে আছে?যা করার করছে না কেনো?
রিফাত ভাইয়া মাথা নিচু করে বললো,
-ছোটমার ব্লাডগ্রুপ ও নেগেটিভ।আর ও নেগেটিভের ব্লাড কোথাও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।আশেপাশের হসপিটাল,ব্লাডব্যাংক গুলোতেও খবর লাগানো শেষ।হাতে সময়ও খুব কম।তাই ডক্টরেরা বলেছেন নিকটাত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করতে।ব্লাড গ্রুপ ম্যাচ করে এমন কারো রক্ত ইনস্ট্যান্টলি দিতে হবে তাকে।নইলে…কিন্তু তুই চিন্তা করিস না।কাকু ভাইয়ারা খোজ নিতেই গেছে।কোনো না কোনো ব্যবস্থা ঠিক….
আটকে গেলাম আমি।আব্বু,ইরাম,আমার তিনজনেরই ব্লাডগ্রুপ এ পজিটিভ।শেহনাজ মন্জিলের কারোটা ম্যাচ হলে এখনো আম্মুর চিকিৎসা থেমে থাকতো না।নানুবাসার দুই মামা,এক খালামনি।কার কাছে যাবো আমি এখন?
-ওইতো আব্বু এসে গেছেন!
ইরামের কথায় পাশ ফিরলাম।দৌড়ে আব্বুকে জরিয়ে ধরতে যাচ্ছিলাম।কিন্তু উনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন।স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলাম।আজও তার অভিমান এতোটুকো কমেনি।মেজোকাকু এসে বললেন,
-ইয়াদ?ব্লাডের কোনো ব্যবস্থা…
-ইরামের খালামনির ব্লাড গ্রুপ এবি পজেটিভ।একমামা তো বিদেশ,আরেক জনের সাথে ব্লাডগ্রুপ ম্যাচ করেছে,কিন্তু তার ফিজিক্যাল হেল্থ স্টেবল না।ডক্টর মানা করেছে তাকে ব্লাড ডোনেট করতে।যদিও সে চাচ্ছিলো,অনেক জোরাজুরি করছিলো,আমিই ধমকে…
-ছোটমাকে ব্লাড আমি দেবো!
সবাই পিছনে তাকালো।শুদ্ধ!চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছেই আমার।শুদ্ধ সোজা আমার দিক এগিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,
-কাদিস না সিয়া!কিছু হবে না ছোটমার।আমার ব্লাডগ্রুপ ও নেগেটিভ।যতো ব্লাড লাগবে,আমি দেবো!
রিফাত ভাইয়া এসে জরিয়ে ধরলো শুদ্ধকে।তারপর শুদ্ধ ডক্টরের সাথে পা বাড়ালেন।এরমধ্যে বাকিসবাইও এসেছে হসপিটাল।বেশ কিছুক্ষন কেটে গেছে।চোখের জল শুকিয়ে যেনো কান্না কমে এসেছে।একধ্যানে আব্বুর দিকে তাকিয়ে আমি।উনি অসহায়ভাবে নিজদিক তাকিয়ে।আচমকাই মাথায় হাত দিয়ে শব্দ করে কেদে উঠলেন উনি।বরাবরই প্রচন্ড শক্ত মানুষ উনি।আম্মুর এতো কঠিন মুহুর্তেও উনি কেদেছিলেন কি না কে জানে,কিন্তু এই মুহুর্তে যেভাবে কাদছেন,তা সবার জন্যই বিস্ময়ের ছিলো।আমি আবারো কাদতে লাগলাম নিশব্দে।ইরামকে জরিয়ে রেখেছি।তাপসী আপু,যীনাত আপু,সীমা ভাবি আমাদের পাশেই বসে।দীদুন আব্বুর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
-বিয়ের দিন ইনসুর তোমার কাছে চাওয়া দোয়া আল্লাহতায়ালা কবুল করেছে ইয়াদ!
আব্বু জলভরা চোখে তাকালেন দীদুনের দিকে।একপা দু পা করে এগিয়ে গেলাম তার দিকে।তার সামনেই মেঝেতে বসে মাথা নিচু করে বললাম,
-আর কতো অভিমান করে থাকবেন?আমাদের কোনোভাবেই ক্ষমা করা যায় না আব্বু?
আব্বু জাপটে জরিয়ে ধরলেন আমাকে।কেদে দিলাম শব্দ করে।কতোদিন পর!কতোদিন পর উনি আমাকে এভাবে জরিয়ে ধরেছেন!আব্বুও কাদছেন।বললেন,
-ক্ষমা তো আমার চাওয়া উচিত মা!তোর এই পাপ্….
-এসব কি বলছেন আপনি আব্বু?বলবেন না এভাবে প্লিজ!পাপ হবে আমার!আপনি যা করেছেন সবসময় আমার ভালোর জন্য।ক্ষমা চেয়ে আমাকে ছোট করে দেবেন না প্লিজ!
-মা রে….
-ইমারজেন্সির পেশেন্টের বাসার লোকজন কে আছেন?
নার্সের কথায় আব্বু এগিয়ে গেলেন আমাকে ছেড়ে।আমিও এগোলাম।আব্বু বললেন,
-কি হয়েছে নার্স?পেশেন্ট….
-শি ইজ আউট অফ ডেন্জার!একদম ঠিক সময়ের মধ্যে ব্লাড দেওয়াতে এখন বাকিসব ট্রিটমেন্টগুলো শুরু করেছেন ডক্টররা।আশা করা যায়,তাড়াতাড়িই সুস্থ্য হয়ে যাবেন উনি!
স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সবাই।আব্বু আমাকে আর ইরামকে জরিয়ে ধরলেন।বাকিসবাইও খানিকটা শান্ত হয়েছে।আব্বু বলে উঠলেন,
-শুদ্ধ কোথায়?
আশেপাশে তাকালাম।সত্যিই শুদ্ধ নেই!কোথায় উনি?আব্বু আবারো বললেন,
-কি ব্যাপার রিফাত?ওর তো ব্লাড দিয়ে কেবিনেই থাকার কথা।কত নম্বর কেবিন ওর?
রিফাত ভাইয়া মাথা নিচু করে বললো,
-শ্ শুদ্ধ কেবিনে নেই ছোটকাকু!
থমকে গেলাম।কোথায় গেছেন উনি এই শরীর নিয়ে?কেনো গেছেন?আজকের এই বিভীষীকাময় দিনটাকে আশীর্বাদে পরিনত করে দিয়েছে সে আমার জন্য।আম্মুর সাথে সাথে আব্বুকেও ফিরিয়ে দিয়েছে আমার কাছে।তার বিশ্বাস আবারো জিতে গেছে।এই মুহুর্তে,এই পরিস্থিতিটাই সত্যিই বদলে দিয়েছে সবটা।তবে উনি কোথায়?আব্বু বললেন,
-কেবিনে নেই মানে?কোথায় গেছে ও?
-হসপিটালে নেই।কাউকে কিছু না বলে একপ্রকার লুকিয়েই বেরিয়ে গেছে ও!
-কিহ্?বেরিয়ে গেলো?তোমরা কোথায় ছিলে?সবেমাত্র ব্লাড ডোনেট করে ও এভাবে বেরিয়ে গেলো?ওর শরীরটা দুর্বল!গেছে যখন নিজেই ড্রাইভ করছে হয়তো!একটু খেয়াল রাখবে না তোমরা?কল করো ওকে!রাইট নাও!
আমি আব্বুর কাছ থেকে সরে দাড়ালাম।তাড়াহুড়োয় ফোনটাও আনি নি।পাশে দাড়ানো তামিম ভাইয়ার ফোনটা কেড়ে নিয়ে শুদ্ধকে কল করতে যাবো,যীনাত আপু ডাক লাগালো।
-ইনসু!
ওর হাতে একটা চিরকুট।তাড়াতাড়ি নিলাম ওটা।আপু বললো,
-নার্স দিয়ে গেলো।
চিরকুট খুললাম আমি।এটা শুদ্ধর লেখা।
” প্রথমেই বলি,সিয়াকে এই চিরকুট এখনই দেখিও না।আমি চাই ও এখন ছোটমা,ছোটকাকুর সাথে ব্যস্ত থাকুক।আমাকে নিয়ে নয়।আর সরি আপু।তোমাদের সাথে,সিয়ার পাশে থাকা হলো না ওখানে।এখন আবার সবাই মিলে ফোন করতে শুরু করো না।রিসিভ করা হবে না আমার।আসলে অফিসে একটু ঝামেলা হয়েছে।একটু!তবে আব্বুর পক্ষে একা সবটা হ্যান্ডেল করা সম্ভব না।তাই বেরিয়ে আসতে হলো।সবাইকে বলে আসতে গেলে আর যেই হোক,ছোটকাকু ছাড়তো না আমাকে জানি।তাই এভাবে চলে আসা।ডক্টরের সাথে কথা হয়েছে আমার মাত্রই।দেখো,এতোক্ষনে হয়তো ওটি থেকে বেরিয়েও গেছেন উনি।ছোটমা সুস্থ্য হয়ে যাবে।টেনশন করো না।আর হ্যাঁ,সিয়াকে দেখো আপু!আর কাদতে দিও না ওকে।অনেক তো হলো,ছোটকাকুকে বলো,এ কয়েকদিনের সবটা আদর যেনো একেবারে উজার করে দেয় ওকে।সিয়াকে বলো,আমি দুর্বল শরীর নিয়ে ড্রাইভ করে আসিনি।ড্রাইভার মামা ছিলো আমার সাথে।এটাও বলো,একটু সময় দিতে আমাকে।সবটা ঠিক করে তাড়াতাড়িই ফিরবো আমি!
-শুদ্ধ ”
#চলবে….