#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ২১
সিফাত ভাইয়ার নানুবাড়ি থেকে সকালেই শেহনাজ মন্জিলের জন্য রওনা হলাম সবাই।একটাবারের জন্য শুদ্ধের দিকে তাকাইনি এ অবদি।তবে আশেপাশে নেভি ব্লু শার্ট পরিহিত চেনা অবয়বের উপস্থিতিকে অনুভব করেছি।সেও বলেনি কিছু আর।সারারাস্তা চুপচাপই ছিলাম।পায়েলটা রাতেই খুলে ব্যাগে পুরেছি।এ নিয়ে কথা উঠলেই আবার কাল রাতের কথা মনে পরে যাবে আমার।অস্বাভাবিক লাগতে শুরু করবে।
শেহনাজ মন্জিল পৌছে সবাই যার যার মতো ফ্রেশ হতে চললাম।পরদিনই দাদুভাইয়ের মৃত্যবার্ষিকী।কাজ অনেকটা গোছানোই এদিকে।তবুও শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতিতে সবাইকেই হাত লাগাতে হবে কিছুটা হলেও।দুপুরে খাওয়ার টেবিলে আব্বুকে চিন্তিত দেখলাম কিছুটা।খাওয়া ছেড়ে খাবার নাড়ছিলেন শুধু উনি।ওনার হাতে নাড়া দিয়ে বললাম,
-আব্বু?
উনি ধ্যান ছেড়ে বলে উঠলেন,
-হুম?
-খাচ্ছেন না কেনো আপনি?
-কই?এইতো,খাচ্ছি তো!খাচ্ছি।
স্বাভাবিকভাবে খেতে লাগলেন উনি।তার গম্ভীরতাতেই কেমন যেনো ভয় হচ্ছিলো মনে।এবার ঠিক লাগছে।এতোক্ষনে আবারো শুদ্ধের কথা মনে পরলো।মনে হচ্ছে কয়েকজন্ম পার হয়ে গেছে তার মুখ দেখি নি।আড়চোখে তারদিক তাকিয়ে দেখলাম সে মুখের খাবার না চিবিয়ে কপাল কুচকে আব্বুকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করছে যেনো।আমি তাকিয়েছি সেটা টের পেতেই হুট করে আমারদিক ফিরলেন উনি।চোখাচোখি হওয়ার আগেই চোখ সরিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।
লান্চ শেষে বেরোইনি রুম থেকে।বিকেলের দিকে জানালা দিয়ে দেখলাম বাগানে আব্বুকে বড়কাকু কিছু বলছেন চেচিয়ে।আব্বু শুধু কথাগুলো চুপচাপ শুনছেন।এভাবে কোনোদিন দেখিনি মেজোকাকু বা বড়কাকুকে আব্বুকে এভাবে বলতে।বিস্ময় আর আগ্রহ নিয়ে রুম থেকে বেরোলাম।শুনতে পেলাম বড়কাকু আব্বুকে বলছেন,
-তুমি এতোটা দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ করবে আমি ভাবতেও পারি নি ইয়াদ।আমি না হয় অফিসিয়াল কাজে একটু ব্যস্ত ছিলাম।মেজোজন তো গিয়েছিলো শশুড়বাড়ি।আসাদও চলে গেলো ওদের সাথে।তা বলে তুমি তো বাসায় ছিলে?তাইতো তোমাকেই এই দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছিলো।আর তুমিই এতোবড় একটা মিসক্যালকুলেশন করে ফেললে?কোনোদিন যা হয়নি আজ তা কেনো ইয়াদ?কিসের এতো চিন্তায় আছো তুমি?এতোটা কেয়ারলেস কেনো?কি হয়েছে?কি চলছে কি তোমার ভেতরে?
-কাকু?
আমি কিছু বলার আগেই শুদ্ধর গলা।পেছন ফিরলাম।আব্বু কাকুও তাকিয়েছেন পাশে।শুদ্ধ দাড়িয়ে আছেন পেছনে।হাতে কিসব কাগজপত্র।উনি একপলক আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে পাশ কাটিয়ে বড়কাকুর দিকে এগোলেন।হাতের কাগজটা ধরে বললেন,
-কাকু,এখানে কিছু ডিটেইলস্ এড করা হয়নি।যেসব এন্টি দেওয়া ছিলো,তাতে আমাউন্টগুলোও ঠিকমতো বসানো হয়নি।আমি সবেমাত্র চেক করলাম সবটা।এবার হিসেবটা মিলেছে দেখো।আর তোমাকে পরেরবার যেসব জিনিসপত্র আনার বিষয়ে বলা হলো,সেগুলো আগেই আনা হয়ে গেছে।স্টোররুমে ছিলো ওগুলো।জামাল মামাই এনে দিয়েছে নাকি।আমার মনে হয় ছোটকাকু ভুলে গিয়েছিলো যে সে ড্রাইভার মামাকে ওসব আনতে পাঠিয়েছিলো।
বড়কাকু তার হাত থেকে কাগজগুলো নিলেন।তারপর ওগুলোতে চোখ বুলাতে লাগলেন।আব্বু শুদ্ধর দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে।তারপর মাথা নিচু করে বিরবির করে বললেন,
-আমি তো জামালকে ওতোসব আনতে দেইনি।ওকে তো জাস্ট…
-মামা বললো পরে নাকি তুমি আরেকটা লিস্ট দিয়েছিলে তাকে ছোটকাকু?
-হ্যাঁ,কিন্তু ওটা তো…
বড়কাকু বললেন,
-যাক!সবটা ঠিকই আছে।ভাগ্যিস শুদ্ধ তুমি দেখেছিলে।যাই হোক।ইয়াদ?এবার চলো,এখনো কয়েক জায়গায় খবর পৌছানো বাকি।
উনি চলে গেলেন।আব্বু আবারো বললেন,
-ওই লিস্ট তো আমার ছিলো না।রাধুনীর ছিলো!ও অতিরিক্ত জিনিস এড কেনো করবে?
শুদ্ধ বললেন,
-এখন রাধুনীর যদি মনে হয়ে থাকে এগুলো দরকার,ও তো এড করবেই লিস্টে,তাইনা?আর লিস্টটা তুমি দিয়েছিলে মামাকে,তাই মামা ক্রেডিটটাও তোমাকেই দিলো।
একটু চুপ থেকে আব্বু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন একটা।সে স্বস্তির কারন শুদ্ধ।আমার ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গী।ভেবেই ঠোটের কোনে হাসি ফুটলো আমার।পা বাড়িয়ে হাসি লুকিয়ে চলে আসলাম ওখান থেকে।
সন্ধ্যায় কাজ করে সবাই ক্লান্ত ছিলো।আব্বু কাকুরা বেরিয়েছেন কোথাও।ইমরোজ ভাইয়াও নেই।শুদ্ধও গায়েব।এলোমেলোভাবে ড্রয়িংরুমে পরে ছিলাম সবাইমিলে।কোনো কথা নেই কারো মুখে।একপ্রকার ঝিমোচ্ছি।আম্মু,ফুপি বড়মাও আমাদের সাথেই বসে।হঠাৎই শুদ্ধ হাতে কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে বাসায় ঢুকলেন।ঠিকঠাকমতো উঠে বসে দেখলাম পিছনে ইমরোজ ভাইয়ার হাতেও কয়েকটা প্যাকেট।শুদ্ধ বললেন,
-গাইস!সবার জন্য রিফ্রেশমেন্ট হাজির!একটু রিল্যাক্স করো এবার সব।
তাপসী আপু বললো,
-এখন আবার কি শুদ্ধ?
যীনাত আপু বললো,
-আরে,শুদ্ধ যখন এনেছে,স্পেশাল কিছুই হবে।চলো গিয়ে দেখি!
ওরা এগিয়ে গিয়ে প্যাকেটগুলো নিলো।প্যাকেটগুলো খুলতেই সবার মুখে হাসি।ওগুলোর ভেতরে পিৎজা।ইশান ভাইয়া বললো,
-শালাবাবু?ফুল ফ্যামিলি প্যাক পার্সেল এনেছো?
শুদ্ধ বললেন,
-হুম।সবার জন্যই তো আনা।
আম্মু,বড়মা মিলে সার্ভ করে দিলো সবাইকে।এরমধ্যে ফুপি মেজোমা,সেজোমাকেও নিয়ে এসেছে।আমি দীদুনকে নিয়ে এসে দেখি কাকুরাও বসে খাচ্ছেন সবার সাথে।আব্বু একটা সিঙ্গেল সোফায় বসে।উনি খান না ওসব।দীদুনকে ডাইনিংয়ে বসিয়ে তার দিকে এগোতে যাচ্ছিলাম।যীনাত আপু আব্বুর সামনে একটা প্লেট ধরলো।আব্বু সেটাতে চোখ বুলিয়ে বললেন,
-পিৎজার সাথে পাস্তাও ওর্ডার করেছো যীনাত?শেহনাজ মন্জিল তবে আজ আমার পছন্দ অপছন্দের কথাও মনে রেখেছে?
আব্বু খুশি হয়ে হাতে নিলেন প্লেট।যীনাত আপু বললো,
-এসব শুদ্ধ এনেছে ছোটমামা।
একপলক শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে খেতে লাগলেন আব্বু।এককোনে দাড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দুটো মানুষকে দেখে চলেছি।একজন আজীবন আগলে রেখে এসেছেন।তারপর আর এমন একজনকে চুজ করেছেন আমার জন্য,যাকে চোখ বন্ধ করে আজীবন ভরসা করার আশ্বাস তৈরী হয়ে গেছে আমার ভেতরে ভেতরে।সবাইকে নিয়ে ভাবেন উনি।এতোটা সুখ?আর এ সুখের সবটাই আমার!সবটা!
_____________
কাল দাদুভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো।সে কাজগুলোতেই কাল সারাটাদিন ব্যস্ততা ছিলো,কিন্তু প্রায় প্রতিমুহুর্তে মনে পরেছে তাকে।কান্না পেয়েছে প্রচন্ড।গত দু বছর আংটি পরানো নিয়ে তার প্রতি অভিমান ছিলো আমার।আর এখন আত্মগ্লানী হয়।সে যা করে গেছে,তাতে সবার ভালোই ছিলো।আমার অন্তত এখন অনুধাবন এটাই,ওই আংটিই আমার জীবনের সবথেকে বড় পাওয়া ছিলো।তার মাধ্যমে শুদ্ধ এসেছেন আমার জীবনে।মন খারাপ করে জানালার থাই গ্লাস সরিয়ে উপরে বসে ছিলাম।হয়তো গাল বেরিয়ে কয়েকফোটা পানিও বেরিয়ে গেছে এসব ভাবতে ভাবতে।কাধে কারো স্পর্শে নিজেকে সামলে গাল মুছে পাশ ফিরলাম।যীনাত আপু দাড়িয়ে।আপু মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-নানুভাইকে মিস করছিস তাইনা?
ওর কোমড় জরিয়ে ধরে হুহু করে কেদে দিলাম আমি।আপু আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
-পাগলী মেয়ে!কাদছিস কেনো ওভাবে?তোর কান্না যে নানুভাইয়ের সহ্য হতো না মনে নেই?
-আ্ আপু… আমি….
আপু আমার হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে দিলো।চোখ মুছে দিয়ে বললো,
-শোন ইনসু,একদিন না একদিন সবাইকে মরতেই হবে।মৃত্যু প্রকৃতির নিয়ম।আর তার থেকে বড় কথা নানুভাই সম্পুর্ন সন্তুষ্টি নিয়ে চোখ বুজেছিলো।তার সন্তুষ্টির কারন তুই ছিলি ইনসু!তার কথা রেখেছিলি তুই।হাতে তুলেছিলি শুদ্ধর পরানো আংটি।তাই এখন আর নিজেকে এতোটুকো কষ্ট দিস না।তুই ভালো থাকলে সেও খুশি হবে।নিজেকে ভালো রেখে তার জন্য দোয়া কর,দেখবি,সবটাই ভালো হবে।
আপুর কোলে মাথা রাখলাম।কান্না কমে আসলো আমার ধীরেধীরে।বেশ কিছুটা সময় পর আপু শান্তভাবে বললো,
-আমরা সবাই কাল চলে যাচ্ছি ইনসু।
সবাই,কাল,চলে যাওয়া তিনটা কথাই কয়েকবার কানে বাজলো আমার।আস্তে করে মাথা তুললাম আমি।আপু আমার গাল ধরে কিছুটা করুনভাবেই বললো,
-সকালে তুই চলে আসার পরই তোর আর শুদ্ধর বিয়ের ব্যাপারে দীদুন কথা তুলেছিলো।ছোটমামা বলেছে সবেমাত্র সিফাত ভাইয়ার বিয়ে হলো,আরেকটা বিয়ের প্রিপারেশনের জন্য কিছুটা সময় দরকার।আর তাছাড়া বাসায় কালই একটা শোকের আয়োজন ছিলো,তাই এরমধ্যে তেমন কোনো অনুষ্ঠান করা ভালো দেখাবে না।বড়মামা,মেজোমামা এমনকি সেজোমামাও একমত তার কথার সাথে।সেজোমামারও নাকি জরুরি কাজ পরে গেছে ঢাকায়।মেবি অফিসিয়াল ঝামেলাও হয়েছে কোনো।তোদের বিয়েটা আরো কয়েকদিন পেছোবে ইনসু!
ওকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলাম আমি।আপু আমার হাত মুঠো করে বললো,
-দীদুন অনেক করে বলেছিলো জানিস তো তোদের….
-তোমরা কালই চলে যাবে?
-হুম।
-আপু,আর কয়েকটা দিন থেকে যাও না তুমি!
যীনাত আপু বিস্ময় নিয়ে বললো,
-ইনসু?বিয়েটা এখন হচ্ছে না!আর তুই সে কথাকে ছেড়ে আমার যাওয়াটাকে প্রায়োরিটি দিচ্ছিস?
এবার আমি ওর হাত মুঠো করে ধরে বললাম,
-এখন হচ্ছে না।একদিন হবেই।কেউ তো আর হারিয়েও যাচ্ছি না,পালিয়েও …
আপু ভ্রু বাকিয়ে তাকালো আমার দিকে।কি বলেছি বুঝ আসতেই তাড়াতাড়ি কথা ঘোরাতে বললাম,
-ত্ তোমাকে খুব মিস করবো।তুমি চলে গেলে আমি কি করে থাকবো বলোতো?
-আমাকে?নাকি….
-ইনসু?
আপুর কথা শেষ করার আগেই ডাক পরলো।দীদুন এসেছে ঘরে।উঠে এগিয়ে তার হাত ধরে বললাম,
-বাব্বাহ!তেপায়া মানুষটা অসময়ে এ ঘরে?কিছু বলবে দীদুন?
দীদুন মৃদ্যু হাসলো।বললো,
-একটা কাজ করে দে তো ইনসু!ছাদে রাখা আচারের কৌটাগুলো নিয়ে আয় তো!রোদ পরে গেছে।তুলে রেখে দেই এবার।
মাথা নেড়ে একপলক যীনাত আপুর দিকে তাকিয়ে পা বাড়ালাম ছাদের দিকে।ছাদে উঠে কৌটাদুটো হাতে নিতেই চোখ পরলো বাসার সামনের রাস্তায় বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটায়।একদম টুকটুকে লাল হয়ে আছে ফুলে ফুলে।কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম ওইদিক।কৌটাদুটো কোলে করে পিছন ফিরতেই ভেতরটা ধক করে উঠলো আমার।ছাদের দরজায় পিঠ লাগিয়ে তাতে এক পা ঠেকিয়ে দাড়িয়ে শুদ্ধ।এপাশ থেকে লাগিয়ে দিয়েছেন উনি দরজাটা।উস্কখুস্ক চুল,মেরুন শার্টটার উপরের বোতামদুটো খোলা,তৃতীয়টাও ঠিকমতো লাগানো না।নিচদিক একধ্যানে তাকিয়ে আছেন উনি।দু পা পিছিয়ে গেলাম।
শুদ্ধকে এতোটা বিধ্বস্তভাবে এরআগে কখনো দেখি নি আমি।যে ছেলেটা তার পার্সোনালিটির জন্য সবখানে সমাদৃত,তার এই অবস্থা দেখে ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো আমার।কোটোদুটো দুহাতে বুকের সাথে আরো শক্তভাবে জরিয়ে ধরে গুটিগুটি পায়ে কিছুটা এগোলাম আমি।ওনার কোনো হেলদোল না দেখে থেমে গেলাম।বিয়েটা কয়েকটা দিন পিছিয়েছে শুনে এই অবস্থা করে ফেলেছেন উনি চোখমুখের।নাকি অন্য কোনো কারন?
#চলবে…