#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
✨স্পেশাল পর্ব✨
পূর্নিমার চাঁদের আলো গলে পরছে পদ্মপুকুরে!সে আলোতে চিকচিক করছে বাতাসের ফলে পানিতে সৃষ্ট ছোটছোট তরঙ্গগুলো।গোলাপী রঙের বড়বড় পদ্মফুল ফুটে চাঁদের আলোকে পুরোটাই লুফে নিচ্ছে নিজেদের মধ্যে।কোনো কোনে থাকা হিজল গাছের ফুল পানিতে পরে লালের চাদর বিছিয়েছে খানিকটা জুড়ে।চারকোনা পুকুরটির চারপাশে বাকা হয়ে দাড়ানো নাড়িকেল গাছগুলোর আবছা অবয়ব যেনো নতমস্তকে বলছে,এ সৌন্দর্যের অববাহিকায় স্বাগতম তোমাকে।সিড়ি বাধানো ঘাট যেনো নিয়ে যাবে ওই চাঁদকে ছুইয়ে দেওয়ার কোনো স্বাপ্নিক রাজ্যে।
নানুবাড়ি থেকে দুমিনিটের পথও নয় এই পুকুরটা।দিনের আলোতে কয়েকবার দেখেছি।তবে এখন সম্পুর্নই অচেনা লাগছে জায়গাটা।এখানে এনেই শুদ্ধ ছেড়ে দিয়েছিলেন আমার হাত।কতোক্ষন হলো সবটা মনপ্রান ভরে শুধু দেখেই চলেছি তার হিসেব নেই।।বারবার মনে হচ্ছে,কোথায় হারালাম আমি?কোথায় নিয়ে আসলেন আমাকে শুদ্ধ?তার কথা মনে পরতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম তারদিক।কিছুটা দুরে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে একপায়ে আরেকপা পেচিয়ে দাড়িয়ে উনি।
তিমির!তবে তমসা নয়!রাত্রিবেলার কোনো আধারের উপস্থিতি মনেই হচ্ছে না আমার।চাঁদ যেনো আজ জেদ করেছে,মনমোহিনীকে অন্য দুনিয়ার অনুভুতিতে আসক্ত করে নিবে আজ।একটু দুরে দাড়ানো ব্যক্তিটির ঠোটের হাসিটা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে,তার মোহনীয় মুখটা দেখতে পারছি,সাদা শার্টের মতো ফর্সা চেহারাটাও চাদের উজ্জল আলোতে পুর্নপ্রকাশ্য।বাকি সবটাই এবার আবছা হয়ে এসেছে আমার।শুদ্ধ সোজা হয়ে দাড়ালেন।আমি চোখ সরিয়ে গুটিগুটি পায়ে নামতে শুরু করলাম সিড়ি দিয়ে।
পানির কাছে এসে সিড়িতে বসে দুবার পানি হাতে নিয়ে উপরে ছুড়ে মারলাম।মুক্তোদানার মতো জ্বলজ্বল করে উঠলো প্রতিটা পানিকনা।পানিতে শুদ্ধর প্রতিবিম্বে চোখ পরতেই ভেতরটা ধক করে উঠলো।পানি নাড়িয়ে দিয়ে এলোমেলো করে দিলাম সেই অবয়ব।শুদ্ধ ওভাবে দাড়িয়ে থেকেই বললেন,
-আর কতোবার কতোভাবে শুদ্ধকে উলোটপালোট করে দিয়ে শান্ত হবি তুই শ্যামাপাখি?
একটা শুকনো ঢোক গিললাম শুধু।জবাব দেওয়ার মতো কিছুই নেই আমার কাছে।দুহাত একসাথে করে আজলা ভরে পানি তুলতেই তার নিচে আরো একজোড়া হাত।হাতের মালিক ফিসফিসিয়ে বললো,
-আজ এই হাতে চাঁদ নেমে আসতে বাধ্য!
শুদ্ধ স্পর্শ করলেন আমার হাত।ডানপাশে আমার অনেকটাই কাছে হাটু গেরে বসেছেন উনি।আবেশে বন্ধ করে নিচ্ছিলাম চোখ।উনি বললেন,
-এই না না!চোখ বন্ধ করবি না একদম!সবটা যে সেজেছে শুধু ওই দু চোখের দৃষ্টিগোচর হবে বলেই!আচ্ছা বেশ!স্পর্শ করছি না আমি!সরিয়ে নিচ্ছি হাত!তুই তোর হাতদুটো আরেকটু বা দিক নে।
হাত সরে গেলো।আমি একপলক বিস্ময়ে তারদিক তাকিয়ে হাত সরালাম কিছুটা।সত্যিই চাদের প্রতিবিম্ব হাতে এসে পরেছে বলে মনে হচ্ছে।ঝিকঝিক করছে পানিটুক।পুকুরে তাকিয়ে সেই থালার মতো চাঁদের বিম্বটাকেও দেখলাম।সে তার জায়গাতেই স্থির।শুদ্ধ হুট করে হাতের কাছেরই একটা পদ্ম ছিড়ে কানে গুজে দিলেন আমার।তারপর প্যান্ট গুটাতে গুটাতে বললেন,
-কানে ফুলটা বেশি ভারী লাগছে?
মাথা ডানেবামে নাড়লাম।শুদ্ধ পানিতে পা ভিজিয়ে বসলেন।সোজা সামনে তাকিয়ে বললেন,
-বোর লাগছে?
মানা করলাম।উনি সোজা বসেই বললেন,
-ঘুম পাচ্ছে?
মাথা নিচু রেখে এবারো মাথা নাড়িয়ে না সুচক উত্তর দিলাম আমি।হঠাৎই শুদ্ধ একহাতে আমার কোমড় জরিয়ে ধরে কাছে টেনে নিলেন আমাকে।কেপে উঠলাম।হাতের পানি পরে গেছে।উনি আমার দিক তাকিয়ে বললেন,
-প্রেম প্রেম পাচ্ছে?
মাথা নাড়ানোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি যেনো।মুখের কথা তো আগেই গায়েব।শুদ্ধ ঠোট কামড়ে ধরে রেখে হাসি দিলেন একটা।চোখ নামিয়ে নিলাম আমি।উনি কোমড় ছেড়ে হাত বাড়ালেন সামনে।জ্বলজ্বল করে উঠলো তার হাতে দুলতে থাকা পায়েলটা।ওনারদিক তাকালাম।পা বাড়ানোর জন্য ইশারা করলেন আমাকে।একটু মাথা নেড়ে মানা করলাম,কটমটে চোখে তাকালেন উনি।খানিকটা ভয় পেয়েই জামা উচিয়ে পা এগিয়ে দিলাম।
শুদ্ধ নিজহাতে পায়েলটা পরিয়ে দিলেন আমার পায়ে।যদিও আমি চাইনি পায়ে হাত দিক উনি,তবে উনি চেয়েছিলেন।মানতেই হতো।শুদ্ধ বললেন,
-দামী নয়।হাটে চোখে পরেছিলো।তাই নিয়ে এসেছি।
কিন্তু আমার ভেতরটা তো অন্য কথাই বললো।সে যে বললো,ওটার দাম নিজেকে বিলীন করেও দিতে পারবি না তুই ইনসু।আচমকাই শুদ্ধ পানি ছিটিয়ে দিলেন আমার পায়ে।শরীরের শিহরন লুকিয়ে সমস্ত শক্তিতে উঠে দাড়িয়ে ছুট লাগালাম।কিন্তু সিড়ির শেষপ্রান্তে এসেই থেমে গেলাম।ওড়নায় টান পরেছে।গলা আটকে আসছে আমার।তবুও কাপাকাপা গলায় বললাম,
-ছ্ ছাড়ুন!ক্ কেউ দেখে…
-রাত দুটো বাজে।আর তুই আমার বউ!
আর কি বলবো?মাঝরাত,কেউ আসবে না।তার বউ,কেউ দেখলেও কিছু বলবে না।তার বউ?আবারো শুকনো ঢোক গিললাম আমি।শুদ্ধ ততক্ষনে ঠিক পিছনে দাড়িয়েছেন আমার।টের পাচ্ছি।উনি বললেন,
-তোর অনিচ্ছাকৃত ছোয়াও আমার কাছে ঠিক কি তা তুই জানিস না সিয়া।পাঁচবছর আগের সেই শার্ট খামচে ধরা থেকে শুরু করে এমনটা কয়বার হয়েছে তার গুনে গুনে প্রতিটা মুহুর্তের হিসাব দিতে পারবো আমি।কতোটা আনন্দের ছিলো সে মুহুর্তগুলো!আমার জীবনকে এমন আনন্দে ভরিয়ে দিতে একটা তুইই যথেষ্ট শ্যামাপাখি।
চুপ রইলাম।উনি বললেন,
-এমনই একটা রাত!এমনি একটা চাঁদ!এমনই মোহনীয় চাঁদের আলোতে আলোকিত হওয়া অবনী!আর তার মাঝে আমার রোদ্রময়ীর উজ্জ্বলতা!সে সময়টার জন্য অপেক্ষার প্রহরগুলো এতোটা কঠিন কেনো সিয়া?
চোখ বন্ধ রেখেই পা বাড়ালাম আমি।নিতে পারছি না তার এসব কথা।দম বন্ধ লাগছে আমার।শুদ্ধ এক হাত টেনে কোনো একটা গাছের সাথে আটকে ধরলেন আমাকে।
-আজ যে শুনতেই হবে তোকে সিয়া!একটু অংশীদার হ?আমার এই অপেক্ষার রোদ্দুরের উত্তাপের?একটু?
আর এতোটুকো নড়াচড়া করি নি আমি।উনি হাত ছেড়ে দিলেন আমার।চোখ বন্ধ রেখে শুনতে পেলাম শুদ্ধ বলছেন,
-জানিস সিয়া?সে সময়টা,সে সময়টা একান্তই আমাদের হবে!একান্তই আমাদের দুজনার!পাঁচবছর অপেক্ষার রোদ্দুরে পুড়ে বিশুদ্ধ হওয়া শুদ্ধের সবটুকো পাগলামী ভালোবাসায় জরিয়ে নেবো তোকে।কাছে এসে আমার সবটুকো প্রেমের বর্ষন তোকে উজার করে দেবো।হৃদয় প্রাঙনে তোর আগমনকে রাঙিয়ে নেবো আমার ভালোবাসার রঙে।দগ্ধ মনকে ভরিয়ে নেবো তোর শীতল হৃদস্পন্দনে।অশান্ত হৃদয়ের সব ব্যাকুলতাকে বদলে দেবো তোকে বুকে জরানোর স্বস্তিতে।চন্দ্রিমার নির্জন আলোকে আপন করতে রাতজাগা একজোড়া চকোরকে সাক্ষী রেখে সে রাতের চাঁদের আলো হবে তোর নামে।আর আমি বিলিন হবো আমার রোদ্রময়ীর নামের রোদ্দুরে।এমনটাই হবে সিয়া!এমনটাই হবে দেখিস!
জমে গেলাম।দু হাতে খামচে ধরে রেখেছি জামাটা।শুদ্ধর উষ্ণ নিশ্বাস চোখেমুখে লাগছে।গা ঘেমে উঠেছে।গলা দিয়ে গরিয়ে পরছে ঘাম,টের পাচ্ছি।তার বলা কথাগুলোতে নিজেকে এলোমেলো লাগছে।ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে,আবার এই কথাগুলো বারবার শুনতেও ইচ্ছে করছে।চোখ মেলে তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে,আবার চোখ বন্ধ করে রেখে এভাবেই তার শ্বাসপ্রশ্বাস গুনতে ইচ্ছে করছে।
অতিকষ্টে এলোমেলো চাওনিতে তাকালাম তার দিক।সে মুচকি হেসে হাত বাড়ালো আমার দিকে।আবারো চোখ খিচে বন্ধ করে নিলাম।গালটা গাছের গায়ে ঠেকিয়ে লেপ্টে গেলাম একদম।শুদ্ধ আমার দুগাল ধরে আবারো নেশালো কন্ঠে বললেন,
-তুই এমন কেনো সিয়া?আমাকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য সদাপ্রস্তুত যাকে বলে।তুই জানিস?যখন এভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিতে গিয়ে তোর দ্রুতচলা উষ্ণ শ্বাস একটু ছুইয়ে দেয়,পাগল হয়ে যাই আমি।কখনো কখনো শুনতেও পাই তোর হৃদস্পন্দন,ইচ্ছা করে সেগুলোর ঢিপঢাপ আওয়াজকে আজীবনই শুনতে থাকি।যখন এভাবে চোখ খিচে বন্ধ করে নিয়ে ভয়ে চুপসে যাস,তোর ওই চোখে ঠোট ছুইয়ে তাদের কম্পন থামিয়ে দিতে ইচ্ছা করে।যখন লজ্জায় নুইয়ে শ্যামারঙা গালদুটো লাল করে ফেলিস,সেগুলোকে দুহাতে আকড়ে ধরে তোকে আরো কাছে নিয়ে আসতে ইচ্ছা করে।ওই ঠোটজোড়া যখন…
উনি হাতের আঙুল ছুইয়েছেন আমার ঠোটে।তৎক্ষনাৎ চোখ মেললাম আমি।উনি সেহাত নামিয়ে নিলেন।কম্পিত শরীরে তার আবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে দৌড় লাগিয়ছি,শুদ্ধ হাত ধরে ফেললেন আমার।শ্বাস প্রশ্বাস জেটবিমানের গতি পেলো যেনো।উনি এগিয়ে এসে আমার পিঠের সাথে বুক ঠেকিয়ে দাড়ালেন।চুলে নাক গুজে দিয়ে ঘোর লাগা গলায় বললেন,
-এতোটা ভয় মিসেস ডট ডট ডট?জেনে রাখুন,আপনার অনুমতি ছাড়া আপনাকে কিছু করবে না শুদ্ধ।শুদ্ধের যে বড্ড ইচ্ছা!ওই দু চোখে শুদ্ধের জন্য তৃষ্ণা দেখার!যে দুই চোখ শুদ্ধকে পুড়িয়েছে,তাদের ওই শুদ্ধকেই কাছে পাওয়ার ব্যকুলতা দেখার বড্ড ইচ্ছা!খুব ইচ্ছা,আপনার চোখে একরাশ ভালোবাসার পাগলামী দেখার!খুব ইচ্ছা!খুব!
উনি ছেড়ে দিলেন আমার হাত।শান্তভাবে বললেন,
-ঘরে ফিরে যা!
বিস্ময় নিয়ে পিছন ফিরলাম আমি।শুদ্ধ দুহাত পকেটে গুজে দাড়িয়ে।ঠোটে মৃদ্যু হাসি।তবে কি উনি রাগ করেছেন?তা যে সইবে না আমার।মানতে পারবো না আমি।ফাকা মাথা নিয়ে দু পা এগোলাম তারদিকে।গাছের পাতা কিছু অংশে আটকে দিয়েছে চাঁদের আলো।তার গালে পরেছে শুধু কিছুটা।ভেতরের ঢিপঢাপ শব্দকে তোয়াক্কা না করে অজান্তেই তার গালের চাপ দাড়িগুলো ছুইয়ে দিতে যাচ্ছিলাম।উনি আমার হাত ধরে ফেললেন।আলতো চুমো দিয়ে বললেন,
-রাগ করিনি শ্যামাপাখি!বলেছি তো,সবার সামনে নিজের করে নেবো তোকে।এই পদ্মপাড় তো শুধু শুদ্ধের প্রেমের সাক্ষী রইলো।বাকিটুক তোলাই থাক?
মুগ্ধতায় মনপ্রান ছেয়ে গেলো।চোখ ভরে উঠতে লাগলো আমার।শুদ্ধ একটু শব্দে হেসে দুগালে হাত রাখলেন আমার।বললেন,
-এখন আবার রাগ করি নি,তারও প্রমান দিতে হবে তাইতো?টিপিকাল বেঙ্গলি ওয়াইফ!ফাইন!
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে।শুদ্ধ একটু হেসেই ঠোট ছোয়ালেন আমার কপালে।কপালের পরে থাকা কিছু চুল কানে গুজে দিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললেন,
-জানিস শ্যামাপাখি?ইচ্ছে করে সবটা ছাড়ছুড় দিয়ে তোকে নিয়ে কোথাও চলে যাই।যেখানে শুধু আমি আর তুই!শুধু শুদ্ধ,আর ওর সিয়া!যেখানে তোর নামের রোদ্দুরে আমি প্রেমের বর্ষন ঝড়াবো!যেখানে ভালোবাসার কোনো উত্তল প্রবাহে ভাসিয়ে নেবো তোকে!দুজনে মিলে হারাবো,স্বপ্নের কোনো পৃথিবীতে!খুব তাড়াতাড়ি এমন একটা পৃথিবী হবে আমাদের শ্যামাপাখি!আমার সবটুকো ভালোবাসাকে সহ্য করার জন্য তৈরী হ সিয়া!শুদ্ধের ভালোবাসার স্পর্শে,কোনো অতল সুখসমুদ্র পারি দিতে তৈরী হ!
উনি আমার গাল ছাড়তেই একছুটে চলে আসলাম বাড়িতে।তাকাইনি আর পিছনে।নইলে তার কথাগুলো…আমার শ্বাস থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো ওগুলো।রুমে ঢুকে ঘুমন্তই পেলাম সবাইকে।বিছানায় বসে হাপাচ্ছি।গালে হাত দিলাম।যেনো এখনো তার স্পর্শ লেগে আছে সেখানে।পায়ের পায়েলটা রিনরিন করে উঠলো।থাম!কেউ জেনে যাবে!আমার হৃদস্পন্দনও কেউ শুনে নেবে তোর এই শব্দের সাথে।শুদ্ধর বলা কথাগুলো মনে পরতেই দুহাতে ঢেকে নিলাম মুখ।ভেতরটা যেনো চেচিয়ে বলছে,ভাগ্যিস চলে এসেছিস!আর কিছুক্ষন ওখানে থাকলে তার কথায় মরন হতো তোর ইনসু।মরন হতো তোর!
#চলবে….