তোর নামের রোদ্দুর২ পর্ব 14

0
1609

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ১৪

-কবুল বলতে এতো সময় লাগাচ্ছিস?আবার এতো কাপাকাপি?তোকে তো তারমানে তুলেই নিয়ে যেতে হবে দেখছি!

বড়বড় চোখ করে শুদ্ধ ভাইয়ার দিকে তাকালাম।সে শব্দ করে হেসে দিলো।আমার হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বললো,

-ওভাবে তাকাস না ইয়ার!মজা করছিলাম তো জাস্ট!বাদবাকি বিয়েটা,ইনফ্যাক্ট সবটাই শুরু থেকে সবার সামনেই হবে।ডোন্ট ওয়ারি!বাট ইউ নো হোয়াট?আমি সব বিষয়ে সাথে আপোষ করতে পারবো,তোর বিষয়ে না।আমার লাগবে তোকে।তুই ছাড়া আমারও কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।হ্যাঁ,হয়তো মুখে বলতে পারছিস না,তবে আমি জানি,তুইও ভালোবাসিস আমাকে।নইলে দুবছর দেখা না করায় এতোটা অভিমান হতো না তোর,তাহমিনা বা আমার বলা হাজারটা নামের মেয়েটাকে নিয়ে এতোটা জেলাসি থাকতো না তোর।আচ্ছা সিয়া?এসব কবে বুঝবি তুই?কবে সবটা বুঝে স্বীকার করবি বলতো?

মাথা নিচু করে রইলাম।তার কথা শুনে কি আমার এই‌ অচেনা অনুভুতিগুলোকে ভালোবাসা বলা উচিত?ভালোবাসা তো আরো বিস্তৃত,আরো অসাধারন।তার মতোই।আমি একটা সাধারন মেয়ে হয়ে এই ছোটছোট,সাধারন অনুভুতিগুলোকে ভালোবাসা বলে দেবো?এতে অপমান করা হবে না?তাকে?তার অনুভুতিগুলোকে?

-সামনে দেখ সিয়া!রাতের আধারেও নদীর আশপাশ জুড়ে কতো রকমের আলো!

করলাম তাই।শো শো শব্দে বাতাস বইছে।শরীর ছুইয়ে মনপ্রান শীতল করে দিয়ে যাচ্ছে একদম।ঘাটে ভিড়ানো এক বেদেনৌকোর দিকে চোখ পরলো।ভেতরে তিনটে বাচ্চাকে জরিয়ে এক মহিলা শুয়ে,বাইরে নৌকার আগায় বসে এক লোক বেতের কিছু একটা বুনছে মনে হলো।ছোট্ট একটা দুনিয়া,কিন্তু কতো ভালোবাসায় মোড়ানো।ঠোটের কোনে হাসি ফুটলো আমার।শুদ্ধ ভাইয়া থুতনি ধরে তার দিকে ফেরালেন আমাকে।বললেন,

-দেখেছিস সিয়া?এই এতো রাতেও,আলোর উৎসগুলো কতো দুরে,তবুও মনে হচ্ছে যেনো কতো আলো চারপাশে!আলোয় ভরে উঠেছে আমাদের দুজনের ছোট পৃথিবী তাইনা?এর কারন জানিস?

চুপ রইলাম।উনি হেসে সামনে তাকিয়ে বললেন,

-ওই যে চাঁদহীন আকাশের জ্বলতে থাকা তারাগুলোর মিটমিটে আলো,দুর ওপারের বাড়িঘরের আলো,নদীর লঞ্চ,স্টিমারের আলো,ছোট ছোট জেলেদের ডিঙি নৌকোর কুপির আলো,পাশের রাস্তার দু একটা গাড়ির হেডলাইটের আলো,ল্যাম্পোস্টের আলো,আর তোকে ঘিরে উড়তে থাকা জোনাকির আলো,সবটাই আবছা লাগছে আমার সিয়া!আমি তো অন্য কোথাও আটকে!

বিস্ময় নিয়ে কাপাকাপা বললাম,

-ক্ কোথায়?

উনি আবারো আমার দিক ফিরলেন।টিকলিটা ঠিকমতো বসিয়ে দিলেন আমার কপালে,কানের কাছে ঝুলে থাকা নথটাও পরিয়ে দিলেন আলতোভাবে,আমার পিছনে দাড়িয়ে ঘাড়ের সবগুলো চুল সামনে দিয়ে দিলেন উনি।চোখ বন্ধ করে নিলাম।গলায় কিছুর উপস্থিতি টের পেতেই চোখ খুলে হাত লাগালাম গলায়।একদম চিকন একটা চেইন,তাতে রিংয়ের মতো ছোট্ট একটা পেন্ডেন্ট,সেই রিংয়ের ভেতর আবার আরো ছোট করে এস লেখা,অক্ষরটায় একদম ছোট ছোট পাথর বসানো।হীরের ওটা।তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

শুদ্ধ ভাইয়া আমার সামনে দাড়ালেন আবারো।লেহেঙ্গার ওড়নাটা পেছন থেকে গুছিয়ে মাথায় তুলে দিলেন।বা হাতে ধরিয়ে দিলেন ওটা।অবাক হয়ে বললাম,

-এসব…এসব কেনো শুদ্ধ ভ্…

উনি একটু পিছিয়ে ভ্রুকুচকে তাকালেন।আমিও কিছু না বুঝে হতবাক হয়ে একবার নিজের দিকে,একবার তার দিকে তাকাচ্ছি।বিরক্তি নিয়ে বললেন,

-এখনো ভাইয়া?

থতমত খেয়ে গেলাম।উনি আবারো বললেন,

-হিসাব কর সিয়া!দু বছর আগে তোকে একবার আংটি পরিয়েছি,এবার এসে আরো দু বার পরালাম,একবার তোর অজান্তেই রেজেস্ট্রি হলো,আবার সবার সামনে গায়ে হলুদ থেকে শুরু করে রেজেস্ট্রি,কবুল পরিয়ে বিয়ে করবো।কেসটা কি দাড়ালো?তিন তিনবার আংটি পরানো,দু দু বার রেজেস্ট্রি,তিনবার কবুল বলে বিয়ে করা বউ হবি তুই আমার।আর তুই এখনো আমাকে ভাইয়া বলে ডাকছিস?ধর্মে সইবে না সিয়া!পাপ লাগবে তোর!পাপ!যাকে বলে মহাপাপ!

ওনার কথা বলার ভঙিমায় হাসবো না কাদবো বুঝে উঠলাম না।সে উত্তরের আশায় আগ্রহ নিয়ে দাড়িয়ে।নিজেকে সামলে বললাম,

-আ্ আসলে,অ্ অভ্যাস তো…তাই…

-আদর করলেই সব অভ্যাস একদম জানালা‌ দিয়ে পালাবে।এবার সুন্দরমতো শুদ্ধ বলে ডাক,নইলে…

কথা শেষ না করেই বাকা হাসলেন উনি।গলা শুকিয়ে গেলো আমার।একটা শুকনো ঢোক গিললাম।উনি এগোতে গেলেই লাফিয়ে উঠে বললাম,

-বলছি বলছি,শুদ্ধ!বলেছি।বলেছি তো।শুদ্ধ।শুদ্ধ!

-ওয়াহ্!খুব বেশি আর তাড়াতাড়িই কাজে দিলো ডোজটা!তিনবার?ওগো শুনছো ডাকটাও আদায় করিয়ে নিতে পারতাম মনে হচ্ছে!

আমি ওভাবেই তাকিয়ে।উনি আবারো আরেকটু পিছিয়ে দাড়িয়ে বড়সড় করে হেসে বললেন,

-পারফেক্ট!

নিজের দিকে তাকালাম।উনি হাসতে হাসতেই এগিয়ে এসে কিছুটা ফিসফিসিয়ে বললেন,

-একদম বউ বউ লাগছে!

চোখ নামিয়ে নিলাম আমি।কান,গাল অসম্ভব গরম হয়ে গেছে আমার।উনি একবার আংটি,একবার গলার পেন্ডেন্ট, একবার নথ,তো একবার টিকলিটা ছুইয়ে দিয়ে বললেন,

-পৃথিবীর সমস্ত আলো এগুলোতে উপচে পরছে জানিস সিয়া?আমার পৃথিবীকে আরো ঝলমলে করে দিচ্ছে এরা।তুই সামনে থাকলে,কোনো অন্ধকার,কোনোদিনও গ্রাস করতে পারবে না আমাকে।কোনোদিনও না!

মুগ্ধতার বহর ধীরে ধীরে হৃদয়সিন্ধু দখল করে নিচ্ছে আমার।তারদিকে তাকালাম।আমার তো মনে হচ্ছে,তার বলা প্রতিটি আলোর প্রতিফলন তার সেই উজ্জ্বল চেহারাতেই নিমীলিতভাবে সমর্পিত।উনি একটু ঝুকে বললেন,

-যাওয়া যাক?

এতোক্ষনে যেনো হুশ ফিরলো আমার।মনে পরলো কোনো এক স্বাপ্নিক দুনিয়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন উনি আমাকে।কিন্তু বাস্তবে তো পিছনে ফেলে এসেছি শেহনাজ মন্জিল।ভয় দানা বাধতে লাগলো মনে।

-ভয় পাচ্ছিস?

….

শুদ্ধ আমার দুগাল ধরে বললেন,

-আমি আছি তো!ভরসা নেই আমার উপর?

চেচিয়ে বলতে ইচ্ছে করলো-নিজের চেয়েও বেশি।কিন্তু বলতে পারি নি।গলাতেই আটকে ছিলো কথাটা।শুদ্ধ হাত ধরেই নিয়ে এসে গাড়িতে বসিয়ে দিলেন আমাকে।তারপর ঘুরে এসে ড্রাইভিং সিটে বসলেন।ততক্ষনে আমি সিটের উপর দু পা তুলে হাটু জরিয়ে বসেছি।বাকা হয়ে শুদ্ধর দিক হয়ে বসে তার দিকেই তাকিয়ে‌ আছি একধ্যানে।উনি স্টেয়ারিং ধরে সামনে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,

-এভাবে তাকিয়ে থাকলে এক্সিডেন্ট হওয়ার আগেই তোর নজরে ঘায়েল হয়ে মারা পরবো আমি।

ধ্যান ভাঙলো।পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসলাম আমি।অন্যসময় হলে হয়তো লজ্জা পেতাম।কিন্তু এখন রাগটা জেগে উঠেছে।একনজর আবারো তারদিকে তাকালাম।কল্পনায় তার পান্জাবিটার কলার ধরে,চোখে চোখ রেখে,দাতে দাত চেপে বলে দিয়ে আসলাম,
-আর কোনোদিন মরার কথা বললে মেরে ফেলে মরে যাবো!

সেটা কল্পনাতেই ছিলো।জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।শুদ্ধ আচমকাই আমার মাথা চেপে ধরলেন তার বুকে।শান্তভাবে বললেন,

-তোর কি মনে হয়?তোকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবো আমি?শুনতে পাচ্ছিস এদের লাবডাব?এর মানে বুঝতে পারছিস?সিয়ার সাথেই এরা জুড়ে আছে,আর এদের সাথে সিয়া।কোনোভাবে দুরে রাখতে পারবো না তোকে,থাকতে পারবো না আমিও।যেখানেই থাকবি,মনে রাখিস,শুদ্ধ কখনো তোর পিছু ছাড়বে না।তাই কখনো লুকোচুরি খেলার কথা চিন্তাও করিস না আমার সাথে।কখ্খনো আলাদা হতে দেবো না তোকে আমার থেকে।কোনোদিন না!বলেছি তো!শুদ্ধর সিয়া শুদ্ধরই!ওর হয়েই থাকবে।সবসময়!

কপালে ঠোট ছুইয়ে আমার সিটবেল্টটা লাগিয়ে দিলেন উনি।হাসি ফুটলো মুখে।মাথা নিচু রেখেই মুচকি হাসলাম।টের পেলাম কিছুটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেও খানিকটা হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন শুদ্ধ।

___________

শেহনাজ মন্জিল পৌছালাম আমরা।গাড়ি থেকে নামলাম।গুটিগুটি পায়ে এগোলাম বাসার দিকে।গেইট খোলা।ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই পরিবারের প্রতিটা সদস্যের উপস্থিতিতে গায়ে কাটা দিলো আমার।শুদ্ধ পাশে দাড়িয়ে হাত ধরলেন আমার।একপলক তারদিকে তাকালাম।পরমুহুর্তেই চোখ সোজা সিঙ্গেল সোফায় বসা আব্বুর দিকে চলে গেলো।সে শক্তভাবে বসে।চোখ নামিয়ে নিলাম আমি।দীদুন বললো,

-যীনাত?ইনসুকে নিয়ে ভিতরে যা!

শুদ্ধ আমার হাত ধরে রেখেই বললেন,

-দীদুন,সবটা…

-যা বলার আমি বলে দিয়েছি দাদুভাই।আর হ্যাঁ।তোমরা সবাই আর কিছুদিন থাকছো শেহনাজ মন্জিল।সবাই মানে সবাই।চারদিন পর যে ওনার মৃত্যুবার্ষিকী সেটা নিশ্চয়ই তুমি ভুলে যাওনি আসাদ?ইয়াদ?তুমি?

সেজোকাকু,আব্বু দুজনেই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালেন।মানে ওনারা থাকবেন।এখানে ঠিক কি ঘটেছে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আমি।কেনো যেনো মনের ভিতরটায় ভয় হচ্ছে প্রচন্ড।আব্বুর গম্ভীরতা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে সে ভয়টা।অস্থির লাগছে আমার।শুদ্ধর দিকে তাকাতেই সে মাথা নেড়ে বুঝালো শান্ত হতে।হাতটা ছেড়ে দিলেন উনি।যীনাত আপু এগিয়ে এসে বললো,

-চল ইনসু,রুমে চল!

নিচদিক তাকিয়ে পা বাড়ালাম রুমের দিকে।তবে হাত পা কাপছে আমার।যীনাত আপু তো এখানেই ছিলো,কি হয়েছে সবটাই জানে ও।আমাকেও বলবে সবটা।কিন্তু তা ঠিক কি?

#চলবে…

[ছোট হয়েছে বলে রাগ করবেন না কেউ প্লিজ।সারপ্রাইজ লিখে আর লিখতে বসতেই পারি নি।রি চেইক করিনি আজ।ভুলগুলো বুঝে নেবেন❤]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here