গল্প:-#মনের_মহারাণী
লেখিকা:-#Sohani_Simu
পর্ব:-09+10
রুমে শুয়ে বসে থাকতে থাকতে বোর হচ্ছিলাম তাই উঠে ধীরে ধীরে হেঁটে কিচেনে আসলাম।উমান ভাইয়া দাঁড়িয়ে সবজি কাটছেন।গরমে উনার গা ঘেমে গিয়েছে।টিশার্টের হাতাই কপালের ঘাম মুছছেন আর কুচি কুচি করে সবজি কাঁটছেন।দরজায় দাঁড়িয়েই ভ্রু কুচকে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি রান্না করছেন?’
উনি একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার কাজে মন দিয়ে বললেন,
‘খিচুড়ি।’
আমি ভেতরে যেতে যেতে বললাম,
‘পারেন আপনি?’
‘উনি সবজিগুলো জালিতে নিয়ে সিংকে ধুতে ধুতে বললেন,
‘না পারার কি আছে?’
আমি উনার পাশে দাঁড়িয়ে বললাম,
‘বাবাও পারে।আম্মু মাঝে মাঝে বাবার অফিসের কাজ করে দিত তখন বাবা রান্না করতো।আপনি ছোলা,পুঁইশাক আর ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করতে পারেন?আমার বাবা সব রান্না পারে।’
উনি মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘তুই পারিস না?’
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,
‘না আমি এখনও শিখিনি।’
উনি মাথা নাড়িয়ে শব্দহীন হাসলেন।চাল ধুয়ে নিয়ে আমার হাত টেনে চুলার সামনে দাঁড় করালেন। আমার পেছনে পিঠ ঘেষে দাঁড়িয়ে আমার দুই হাত ধরলেন।আমি ঘাড় ঘুরিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘কি করছেন?’
উনি আমার বাম হাত দিয়ে প্রশার কুকার স্টোভে দিয়ে বললেন,
‘আজকে আমার মহারাণী রান্না করবে।’
‘আমি পারিনা।’
উনি মৃদু হেসে আমার হাত দিয়ে চাল প্রেশার কুকারে ঢালতে ঢালতে বললেন,
‘তাহলে মানছিস তুই আমার মহারাণী?’
আমি যেন বোকা বন থেকে ঘুরে এলাম।মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘শুনুন আপনি আমার ভাইয়া হন।’
উনি আমার হাত দিয়েই প্রেশার কুকারে একে একে ভিজিয়ে রাখা ডাল,ছোলা,পুঁই পাতা কুচি,সবজি,মসলা, তেল দিয়ে প্রেশার কুকারের ঢাকনা বন্ধ করে তারপর আমার হাত ছেড়ে দিলেন।আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে আমার কোমড় জরিয়ে ধরে বললেন,
‘ভাইয়া ছিলাম,এখন আর নেই।এখন আমি তোর হাজব্যান্ড আর বড়াব্বুর ছেলে।ভাইয়া নয়,বুঝেছিস?’
আমি উনার হাত সরাতে সরাতে বললাম,
‘না বুঝিনি।বাবা বলেছে আপনি ভাইয়া তাই আপনি শুধু ভাইয়া।’
উনি মৃদু হেসে আমার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললেন,
‘বাবা যদি বলে হাজব্যান্ড তাহলে?’
আমি মাথা পেছনে হেলিয়ে বললাম,
‘তাহলেও নয়।’
উনি ফট করে আমাকে জরিয়ে ধরে বললেন,
‘বললেই হল?সবাই জানে তুই আমার বউ।একবার তুই মেনে নে দেখ তোকে একদম রাজরানী বানিয়ে রাখবো।’
আমি চোখমুখ খিচে বললাম,
‘উফ্ ছাড়ুন,লাগছে,আহ্!’
উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে কিঞ্চিত ভ্রু কুচকে বললেন,
‘কোথায় লাগছে?এখনও ব্যথা কমে নি?দেখি।’
উনি আমার গলায় হাত দিতেই আমার পেছনে প্রেশার কুকারের সাইরেন বেজে উঠলো।লাফিয়ে উঠে উনাকে জরিয়ে ধরে বললাম,
‘কে এসেছে?’
পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম এটা প্রেশার কুকারের সাইরেন।উমান ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘আর কেউ আসবেনা।কোনো ভয় নেই।এত ভীতু কেন তুই?মহারাণী মিতি খুব ভীতু।ভীতুর ডিম একটা।এই ডিম, চল অমলেট বানাই।তুই পারিস অমলেট বানাতে?’
আমার সত্যি অনেক ভয় লাগছে।এখন প্রায় রাত আটটা বাজে।বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।আবার যদি ওই লোকটা আসে?আমাকে যদি নিয়ে যায়?ওরা যদি কয়েকজন মিলে আসে উমান ভাইয়া একা কিছুই করতে পারবেননা।মনের মধ্যে কু ডাকা শুরু হল।উমান ভাইয়াকে জরিয়ে ধরেই বললাম,
‘ওই লোকটা যদি আবার আসে?’
উনি আমার মাথায় কিস করে বললেন,
‘বললাম তো আসবেনা।রুমে চল,এখানে অনেক গরম।’
আমি উনাকে ছেড়ে দিয়ে অসহায় মুখ করে বললাম,
‘উম ভ…।’
উনি হাত দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে বললেন,
‘খুব রাগ করলাম।আর কথায় বলব না তোর সাথে।থাক তুই তোর ভাইয়া নিয়ে।’
উনি স্টোভ অফ করে হন হন করে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেলেন।আমি জোরে হাঁটতে পারছিনা নাহলে উনার সাথেই যেতাম।উনি কিচেন থেকে বেড়িয়ে আমার রুমে ঢুকলেন।আমিও ধীরে ধীরে হেঁটে আমার রুমে আসলাম।রুমে এসে দেখি উনি ওয়াশরুমে ঢুকেছেন।আমি বিছানায় বসে উনার জন্য অপেক্ষা করছি।জানালা আর ব্যালকনির দরজা খোলায় আছে।বাইরে বাতাস হচ্ছে তাই জানালার পর্দাগুলো উড়ছে।রুমে আলো জ্বলছে তাই বাইরের সবকিছু অন্ধকার দেখাচ্ছে।আমি ভীত চোখে খোলা জানালার দিকে তাকািয়ে আছি।উমান ভাইয়া ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আমার দিকে একবার তাকালেন তারপর ধপ ধপ করে হাঁটতে হাঁটতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।আমিও আর দেরি না করে উনার কাছে যেতে লাগলাম।উনি কিচেনে যেয়ে খাবার বারছেন আর আমি কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি।উনি খাবার গুলো ডাইনিং টেবিলে আনলেন,আমিও উনার পেছন পেছন ডাইনিংয়ে আসলাম।উনি আবার কিচেনে গেলেন,আমিও গেলাম।আবার ডাইনিংয়ে আসলেন তাই আমিও আসলাম।উনি চেয়ার টেনে বসলেন,আমিও বসলাম।তারপর কিছু একটা ভেবে উনি আবার আমার রুমে গেলেন,আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনার পেছনে হাঁটা দিলাম।আমি রুমে আসতে না পারতেই উনি রুম থেকে দরকার সেরে বেরিয়েও আসলেন।আমি উনাকে দেখেই দাঁড়িয়ে থাকলাম।উনার হাতে মেডিসিন।আমার সামনে এসে আমার মুখে একটা মেডিসিন গুজে দিলেন।আমি বুঝতে পারলাম উনি এখন পানি নিতে যাবেন তাই আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলাম।উনি একগ্লাস পানি এনে আমার হাতে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসলেন।আমি মেডিসিন খেয়ে উনার পাশে গিয়ে বসলাম।ড্রইং রুমের সাথে লাগানো যেই ব্যালকনি আছে সেটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘সেদিন ওই লোকটা ব্যালকনিতে হাঁটছিল।আমি ব্যালকনির দরজার কাছে যেতেই আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।’
উমান ভাইয়া আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে উঠে গিয়ে টিভি অন করে দিলেন।টিভির কথা আমার মাথাতেই ছিলনা।রাজশাহী যাওয়ার আগে ডিস লাইন কেঁটে দিয়ে গিয়েছিলাম তাই ভেবেছি কাঁটায় আছে।যাক ভালই হল।এখন বসে থেকে কার্টুন দেখা যাবে।আমি মনে মনে খুশি হয়ে টিভির দিকে তাকালাম।উমান ভাইয়া রিমোট হাতে নিয়ে একটার পর একটা চ্যানেল ঘুরে দেখছেন।আমি উনার দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললাম,
‘চারশো একে দিন না,সিএনে।’
উনি চারশো বারোতে দিলেন।ডব্লিউ ডব্লিউ ই রেসলিং হচ্ছে।উনি আরাম করে বসে টিভি দেখছেন আর আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।প্রায় দশমিনিট পর উনি টিভি অফ করে উঠে ডাইনিংয়ে গেলেন।আমি খুশি হয়ে রিমোট নিয়ে কার্টুন নেটওয়ার্কে দিলাম।উমান ভাইয়া রাগী কন্ঠে বললেন,
‘খেতে আয়।’
আমি টিভির দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘পরে।’
উনি এসে টিভি অফ করে দিলেন।চোখ গরম করে আমার দিকে তাকাতেই আমি দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম,
‘যাচ্ছি,যাচ্ছি তো।’
ধীরে ধীরে হেঁটে এসে চেয়ারে বসলাম।উমান ভাইয়া আমার পাশে বসে আমার প্লেটে খিচুড়ি ডিম ভাজি আর একটু ঘী ছড়িয়ে দিয়ে আমাকে খেতে বললেন।আজকে আমার প্রিয় একটা খাবার রান্না হয়েছে তাই খুশি মনে খেতে লাগলাম।সবার আগে ছোলাগুলো বেছে খেতে লাগলাম।উমান ভাইয়া উনার প্লেট থেকে কিছু ছোলা বেছে আমার প্লেটে দিলেন।আমি উনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
‘বাবাও দেয়।’
উনি কিছু বললেন না।খাওয়া শেষ করে আমাদের প্লেট নিয়ে কিচেনে চলে গেলেন।উনি সিংকে বাসন পরিষ্কার করছেন আর আমি উনার পাশে দাঁড়িয়ে বলছি,
‘রাতে কিন্তু আমি একা থাকতে পারবোনা।আমার অনেক ভয় করছে।’
উনি কাজ করতে করতে বললেন,
‘নিজের ভাই হলে তোর সাথে থাকতাম কিন্তু আমি তো কাজিন ভাই।একসাথে থাকলে লোকে খারাপ বলবে।আমি পাশের রুমে থাকবো।’
হুহ্ ঢং!সারাদিন বউ বউ করে এখন আবার ভাই সাজার চেষ্টা করছে।মনে মনে কথাটা বলেই আমি থমথমে মুখ করে বললাম,
‘আচ্ছা ঠিক আছে।আপনি তাহলে আমার রুমের জানালাটা একটু বন্ধ করে দিয়ে আসুন প্লিজ।’
উনি হাত ধুয়ে টাওয়ালে মুছে বললেন,
‘পারবোনা।’
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।উনি কিচেন থেকে চলে গেলেন।আমি ধীরে ধীরে বাইরে এসে দেখি উনি ড্রইং রুমের সোফায় বসে ল্যাপটপ চালাচ্ছেন।আমি ল্যাপটপটাতো লুকিয়ে রেখেছিলাম তাহলে কি করে পেলেন!ভাবতে ভাবতে উনার পাশে গিয়ে বসলাম।উনি টেবিলের দিকে ইশারা করে বললেন,
‘মেডিসিন খেয়ে নে।’
আমি মেডিসিন খেয়ে চুপচাপ বসে থাকলাম।উনি এগারোটা পর্যন্ত ল্যাপটপে কাজ করলেন।আমি বসে বসে টিভি দেখছিলাম।উনি টিভি অফ করে ড্রইং রুমের লাইট অফ করে আমার পাশের রুমে চলে গেলেন।আমি দ্রুত উনার রুমে গেলাম।উনি রুমের লাইট অফ করে ল্যাম্প শেড অন করে বিছানায় শুয়ে পরেছেন।আমি তাড়াহুড়ো করে বিছানায় উঠে বললাম,
‘আমিও এখানে থাকি?’
উনি অন্যপাশ ফিরে বললেন,
‘না, নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পর।’
আমি বিছানার উপর দাঁড়িয়ে উনাকে ডিঙিয়ে উনার অন্যপাশে গিয়ে বসলাম।উনি আমার দিকে তাকালেন।আমি উনার পাশে শুয়ে উনার উপর হাত-পা তুলে দিয়ে বললাম,
‘এটা আমার বাসা,আমার যেখানে খুশি সেখানে থাকবো।’
তারপর উনার গালে একহাত দিয়ে বললাম,
‘আর এটাতো মহারাজা তাই মহারাণীকে উনার সাথেই রাখতে হবে।’
উনি গাল থেকে আমার হাত সরিয়ে একটু নড়েচড়ে অন্যপাশ ফিরে শুলেন।আমি উনার টিশার্ট টানতেই উনি বললেন,
‘কথায় হবে না,ভালোবাসতে হবে।’
আমি উনার টিশার্ট ছেড়ে দিলাম।উনি আমার দিকে পাশ ফিরে বললেন,
‘বাবা-মা আর মিনি যেমন তোর আপনজন আমাকেও সেরকম আপন করে নিতে হবে আর ওদের মতোই ভালোবাসতে হবে।এখন তো চোখে রঙিন চশমা লাগিয়ে ঘুরছিস।যাকে দেখিস তাকেই ভাল লাগে।ডায়েরীর মধ্যে কত ছেলের ছবি।সবগুলো ক্রাশ,ক্রাশের অভাব নেই।আমিও কি তোর ক্রাশ?আমি ভালোবাসা হতেতে চাই।’
আমি উঠে বসলাম।উনার কথা শুনে লজ্জা লাগছে।উনি ক্রাশতো বটেই।কি সুন্দর উনি!সবসময় উনার সামনে থাকতে ইচ্ছে করছে আর উনার একটু এটেনশন পাওয়ার জন্য কত চেষ্টা করছি।উমান ভাইয়া শুয়ে থেকেই আমার একহাত বুকের উপর নিয়ে বললেন,
‘ভালোবাসার আগে ভালো লাগাটা জরুরী। একটা এক্সামপল দিই শোন।আয় শুয়ে পর আগে।’
উনি আমাকে শুয়ে দিয়ে আমার উপর দিয়ে হাত বারিয়ে ল্যাম্প শেড অফ করে দিলেন।অন্ধকারে থেকে আমার অভ্যাস নেই তাও কেন যেন ভাল লাগছে।উনি আমার একহাত ধরে বিরবির করে বললেন,
‘ঘুম পাচ্ছে।কাল কথা হবে।গুড নাইট।’
আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার কপালে কিস করে বললেন,
‘চোখ বন্ধ কর নাহলে অন্ধকারে উল্টা-পাল্টা কিছু দেখতে পাবি।’
আমি চোখ খিচে বন্ধ করে উনাকে জরিয়ে ধরে বললাম,
‘আমার রুমে চলুন,এখানে ভয় লাগছে।’
উনি ঘুম ঘুম কন্ঠে বললেন,
‘চুপ থাক নাহলে ছাদে রেখে আসবো।’
আমি চুপ হয়ে গেলাম।উনি ঘুমোচ্ছেননা জানি কিন্তু ঘুমোবার চেষ্টা করছেন।আমি ভাবছি আমার ডায়েরীটাকি উনি পুরো পড়ে ফেলেছেন নাকি কিছু অবশিষ্ট রেখেছেন।মান-সম্মান আর কিছু থাকলোনা।ক্রাশ-বাঁশ,ভালোলাগা-খারাপ লাগা থেকে শুরু করে ফার্স্ট পিরিয়ডের কাহিনীও লিখে রেখেছি ওটাতে।আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
‘উম ভাইয়া?’
উনি মুখ দিয়ে বিরক্তের শব্দ করলেন।আমি মিনমিন করে বললাম,
‘আপনি তো আমাদের নিজেরই লোক তাইনা?আমার ডায়েরীর কথা প্লিজ কাউকে বলবেন না।’
উনি মৃদু হেসে বললেন,
‘ওকে বলবোনা বাট আমাকে আর ভাইয়া বলা যাবেনা।’
‘ওকে’
বলে আমি অন্যপাশ ফিরে শুলাম।উনি এবার আমাকে জরিয়ে ধরে বললেন,
‘ডাক দেখি কেমন পারিস।’
আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘উমান।’
উনি মুচকি হেসে বললেন,
‘শুধু উম বল।’
‘উম।’
‘আর একটু ভালোবাসে বল।’
‘উম।’
‘আবার।’
‘উম।’
‘বলতে থাক।’
আমি আরো দুবার বলে মুখে কুলুপ আটলাম।আর একবারও বলবোনা।নিজে তো একটা পাগল,তাই আমাকেও পাগল বানানোর প্রসেস শুরু করেছেন।
চলবে…………………
গল্প:-#মনের_মহারাণী
লেখিকা:-#Sohani_Simu
পর্ব:-১০
সকালের নাস্তা খেয়েই গমের চারাগুলো দেখতে উমানের সাথে ছাদে এসেছি।ছাদে প্রায় পনেরোটা টবে আমার বিভিন্ন ফুলের গাছ আছে।কোনো টবেই গমের গাছ বা চারা খুঁজে পেলাম না।পুরো ছাদ ভাল করে দেখে উমানের পাশে এসে দাঁড়ালাম।উনি ছাদের রেলিংয়ে বসে আছেন আর আমাকে দেখছেন।আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘গমের চারাগুলো কোথায়?’
উনি মুচকি হাসলেন।রেলিং থেকে নেমে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,
‘তোকে দেখাতে ইচ্ছে করছেনা।তাছাড়া দেখালেও দেখতে পাবিনা।’
আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে অবাক হয়ে বললাম,
‘ওগুলো দেখা যায় না?অদৃশ্য?’
উনি পেছনে ঘুরে তাকালেন।আবার আমার কাছে আসতে আসতে বললেন,
‘না অদৃশ্য নয়।বাদ দে ওসব কথা।চল নিচে যাই,বাইরে যেতে হবে আমার।তুইও যাবি।ব্যথা কমেছে এগুলোর?’
আমি গলায় হাত দিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘কমেছে কিন্তু বাইরে কেন যাব?যেতে ইচ্ছে করছেনা।’
উনি সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে বললেন,
‘একা বাসায় থাকতে পারবি?আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।’
একা আমি কিছুতেই থাকতে পারবোনা।আমি উনার পেছনে যেতে যেতে বললাম,
‘একা থাকতে পারবোনা।আপনি কোথায় যাবেন?আমিও যাব কিন্তু চারাগুলো তো দেখায় হল না।’
উনি নিচে যেতে যেতেই বললেন,
‘ওসব ভুলে যা না।তুই ওসব দেখে কি করবি?’
আমি আবার জেদ ধরলাম।উনি আমার কোন কথা শুনলেন না।নিচে এসে উনি আমাকে রেডি হতে বলে পাশের রুমে চলে গেলেন।আমি দ্রুত একটা নীল জিন্স আর সাদা-কালো ঢোলা টপস পরে নিলাম।চুল গুলো চিড়ুনি করে হালকা ওজনের একটা ওড়না গলায় জড়াতেই আমার ডাক পরে গেল।উমানকে আসছি বলে আরও দশমিনিট ধরে সাজুগুজু করে তবেই ড্রইং রুমে আসলাম।উনি সোফায় বসে ভ্রু কুচকে ফোন টিপছেন।আমি তো উনাকে দেখেই এক দৌঁড়ে রুমে চলে বসলাম।আরও সাজতে হবে।কালো শার্টে উনাকে যা হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে উনার সাথে এভাবে বাইরে গেলে আমাকে সবাই উনার বাসার কাজের বেটি ভাববে।আমি রুমে আসতেই উনি আবার ডাকতে লাগলেন।আমি রুম থেকে চেঁচিয়ে বললাম,
‘যাচ্ছি,যাচ্ছি,ওয়েট করুন একটু।’
বাইরে থেকে উনি তাড়া দিয়ে বললেন,
‘এখনই চলে আয় নাহলে যাবার দরকার নেই তোর,লেইট লতিফ একটা!’
আমি ঝটপট আলমারি খুলে গাউনের মধ্যে কিছু ড্রেস চুজ করতে লাগলাম কিন্তু কোনটা পড়বো বুঝতেই পারছিনা।সারাজীবন বাইরে যাওয়ার আগে আম্মুই আমাকে ড্রেস চুজ করে দেয় তাই আজ একা একা চুজ করতে প্রবলেম হচ্ছে।আমি আলমারির দরজা খুলে আলমারির ভেতর প্রায় ঢুকেই গিয়েছিলাম।কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে হকচকিয়ে লাফিয়ে উঠে উমান ভাইয়া বলে চিৎকার দিয়ে চোখ খিচে বন্ধ করলাম।উমানের কন্ঠ শুনতে পেলাম।উনি আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে রাগী কন্ঠে বললেন,
‘উফ্ কানের পোকা মেরে দিয়েছিস একদম।এমনিতে তো ধাক্কা দিলেই উল্টে পরে যাস,গলায় এত জোর আসে কোথায় থেকে হুম?’
আমি আশেপাশে দেখে নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে ভীত কন্ঠে বললাম,
‘আমি ভেবেছিলাম ওই লোকটা আবার এসেছে।’
উনি আমার একগাল টেনে আমার কথায় ব্যঙ্গ করে বললেন,
‘আমি ভেবেছিলাম ওই লোকটা আবার এসেছে।’
বলেই উনি আমার হাত ধরে হাঁটা দিয়ে বললেন,
‘ওই লোকটা বেঁচে থাকলে তো আসবে নাকি?ও সেদিনই মরে গিয়েছে।সাক্ষাৎ মৃত্যু বুঝিস?….এখন সাদও নেই সাদের ভূতও নেই।’
আমি ভীত কন্ঠে তুতলিয়ে বললাম,
‘মমমানে?কককি বলছেন?’
উনি টেবিল থেকে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে মেইন গেটের কাছে এসে স্যান্ডেল খুলে সাদা কেডস পরতে পরতে বললেন,
‘মানে বুঝিসনি?মরে গেছে ও।আর কখনও আসবেনা।’
‘ক ক ককিভাবে মারা গেল?’
উনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘জুতোটাকি পরিয়ে দিতে হবে তোকে?’
আমি অপ্রস্তুত হয়ে জুতো পরতে পরতে আবার একই কথা জিজ্ঞেস করলাম।উনি দরজা খুলে বললেন,
‘অনেক লেইট হয়ে গিয়েছে।দয়া করে চলুন এবার।এসে নাহয় জমিয়ে গল্প করা যাবে।’
ঠোঁট উল্টে উনার সাথে বাসা থেকে বেরিয়ে আসলাম।গাড়িতে বসে কম করে হলেও একশোবার উনাকে জিজ্ঞেস করেছি কিছু বলেননি।আধ ঘন্টা পর উনি আমাকে নিয়ে উনার একটা মেয়ে ফ্রেন্ডের বাসায় আসলেন।উনার এই ফ্রেন্ডকে আমি চিনি।বিয়ের দিন দেখেছিলাম।আপুটার নাম সৌরভী।উমান আপুটাকে একটু সাইডে নিয়ে গিয়ে বিরবির করে কি যেন বললেন।তারপর আমাকে আপুর কাছে থাকতে বলে কালো শার্ট খুলে আমার মুখে ছুড়ে বললেন,
‘রাখ এটা।’
তারপর উনি শপিং ব্যাগ থেকে একটা নীল টিশার্ট বের করে পরলেন।মাথার চুল উল্টে-পাল্টে মুখে কালো মাস্ক আর চোখে সানগ্লাস পরে বাসার ভেতর দিকে কোথাও চলে গেলেন।আমি সোফায় বসে ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।সৌরভী আপুও উনার পেছন পেছন চলে গেলেন।আমি উনার শার্ট সোফায় রেখে একা একা বসে থাকলাম।মন খারাপ লাগছে।উনি আমাকে এখানে একা রেখে সৌরভী আপুকে নিয়ে ভেতরে গেলেন কেন?মনের মধ্যে এমন প্রশ্নের উদয় হতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম।গুটি গুটি পায়ে ভেতরের দিকে যেতেই সৌরভী আপু ফিরে আসলেন।আমাকে দেখেই মিষ্টি হেসে বললেন,
‘মিতি,চলো আমরা গল্প করি।’
আমি কৌতূহলি হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘উমান ভাইয়া কোথায় গেলেন আপু?’
সৌরভী আপু আমাকে নিয়ে সোফায় বসে বললেন,
‘ওর একটু কাজ আছে।বাহিরে গেল,কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।বাই দ্যা ওয়ে,তুমি এখনও ওকে ভাইয়া বলে ডাকো?’
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
‘মাঝে মাঝে..’
সৌরভী আপু ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘তুমি বসো আমি তোমার জন্য একটু নাস্তা নিয়ে আসি।’
আমি আপুর হাত ধরে আটকিয়ে দিয়ে বললাম,
‘না না আপু,আমি নাস্তা করে এসেছি এখন আর কিছু খেতে পারবোনা।আপনি ফ্রি থাকলে আমার কাছে একটু বসুন না।আপনাকে একটা কথা বলবো।’
উনি মুচকি হেসে বললেন,
‘একটু বসো,আসছি আমি।’
সৌরভী আপু উনার খোলা চুলগুলো হাতখোপা করতে করতে কিচেনের দিকে চলে গেলেন।একটু পর ট্রেতে করে নাস্তা নিয়ে এসে আমার পাশে বসলেন।আমাকে খেতে বলে বললেন,
‘বল না,কি বলবা?’
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম,
‘মানে আমি উনার সম্পর্কে একটু জানতে চাই,আপনি উনার ফ্রেন্ড নিশ্চয় উনাকে খুব ভাল করে জানেন।’
সৌরভী আপু মুচকি হেসে বললেন,
‘উমানের সম্পর্কে যাই বলিনা কেন কম বলা হবে।’
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
‘মানে?’
আপু সোফায় পা তুলে বসলেন।কোলের উপর কুশন নিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
‘মানে তোমার বর সাধারন কেউ নয়।তুমি তো ওর ব্যাপারে কিছুই জানোনা।উমান আর সাদের সাথে আমাদের পরিচয় আমরা যেদিন প্রথম কলেজে গেলাম সেদিন।প্রথম দিনই সিনিয়রদের সাথে মারামারি করে ক্যান্টিনের চেয়ার টেবিল ভেঙ্গে কি অবস্থা করেছিল ওরা।প্রায় একমাস আমরা ভয়ে কেউ ওদের সাথে কথা বলিনি।ওরা নিজের মতো আসতো,ক্লাস করতো চলে যেতো আর কেউ ওদের নামে উল্টা-পাল্টা কিছু বললে মাইর শুরু।সিনিয়ররা প্রতিদিন ওদের জন্য কত প্ল্যান-প্লটিং করতো তার কোনো হিসেব নেই।প্রতিদিন এই বিচার সেই বিচার লেগেই থাকতো।উমানের দাদুর অনেক পাওয়ার তাই ওদের কলেজ থেকে বের করে না দিয়ে সবাইকে বলে দেওয়া হল এই দুইজন মহা গুন্ডা,কেউ ওদের সাথে মিশবেনা,ওদের থেকে দূরে থাকবে সবাই।’
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
‘গুন্ডা?মহাগুন্ডা?’
সৌরভী আপু মৃদু হেসে বললেন,
‘তার থেকেও বেশি কিছু।সেসব কথা থাক।আমি তোমাকে এসব বলছি উমান জানতে পারলে রাগারাগি করবে।একটুতেই অনেক রেগে যায়।ওর ব্যাপারে আর কি জানবা?পড়াশুনায় ভাল।অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে।টরেন্টোতে একটা ফিজিক্স রিসার্চ ইন্সটিটিউটে জব করত।এখন বেকার।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘বেকার?উনি না বিজনেস করেন?’
‘আরে না।বিজনেস করবে কেন?এমনি দেশে এসে আঙ্কেলের দিকটা একটু দেখে।সায়েন্টিস্ট ও।বিগ ব্যাং রিলেটেড কি যেন নিয়ে রিসার্চ করতে গিয়ে প্রবলেম হয়েছে।ওকে আর সাদকে অফিস থেকে বের করে দিয়েছে।দেশে আসার পর সাদকে কারা যেন কিডন্যাপ করেছে।উমান এখন কি যেন করছে।আমি অত জানিনা।তোমার বাবাও তো এসবের সাথে জড়িত।উনি কিসের যেন সিডস্ নিয়ে কাজ করছিলেন।’
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
‘গমের না?’
আপু সোফার নিচে দুই পা নামিয়ে দিয়ে বললেন,
‘জানিনা কিসের।তুমি তো কিছুই খাচ্ছো না।আইসক্রিম খাবা?আনছি আমি।’
আমার আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে তাও ভদ্রতার খ্যাতিরে বললাম,
‘না না আপু আনতে হবেনা,খাবনা আমি।’
আপু আমার কথায় কান দিলেননা।উনি আইসক্রিম নিতে চলে গেলেন।আমি ভ্রু কুচকে আশেপাশে খেয়াল করতে লাগলাম।এত বড় দোতলা একটা বাসায় আপুটা একা থাকে কি করে!আপু আইসক্রিম নিয়ে ফিরে আসতেই বললাম,
‘আপু,আপনি এত বড় বাসায় একা থাকেন?’
আপু আমার হাতে একবাটি আইসক্রিম দিয়ে আমার পাশে বসে বললেন,
‘একা থাকিনা তো।শাশুড়ি,ভাশুর,দেবর,ননদ,আর তোমার ভাইয়াকে নিয়ে থাকি।ওরা কেউ বাসায় নেই।দেবর আর ননদ ভার্সিটে গিয়েছে।শাশুড়ি মা উনার বোনের বাসায় গিয়েছেন আর আমার ভাশুর তোমার ভাইয়ার সাথে থানায়।তুমি মনে হয় আমাকে এখনও চিনোনা।নাসিরকে চিনো?আমি নাসিরের ওয়াইফ।’
আইসক্রিম খাচ্ছিলাম।আপুর কথা শুনে আইসক্রিম শ্বাসনালীতে উঠে গেল।কাশতে কাশতে আপুর দিকে তাকাচ্ছি।এই মেয়ে বলে কি!নাসির ভাইয়া কবে বিয়ে করলো!নিষাদ ভাইয়াও কি বিয়ে করেছে!
চলবে….