নয়নতারা ৩৫

0
528

#নয়নতারা

পর্ব ৩৫

Suvhan Årag (ছদ্মনাম)

Suvhan Arag’s Storys

দুদিন কেটে গেছে

—-তারা কি হয়েছে তোর বলতো?

—-কিছু না ভাইয়া।

—-তুই বলবি কি না ?

—-সত্যি কিছু না।

—-কদিন ধরে দেখছি মন খারাপ করে থাকিস।আবার বলছিস কিছু না!

—-সত্যি।

—-সত্যি হলে ভালো।না হলে খারাপ।

—-চলো বাড়ি যাই।

—-আর কিছুক্ষণ থাক।

—-আমার কলেজের সময় হয়ে যাচ্ছে তো।

—-ওহ হো।ভুলেই গিয়েছিলাম।চল।

তারা সৈকতের সাথে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।সামনে হাটছে আর একবার করে পিছু ঘুরে দেখছে।নাফিজের আজ ও দেখা নেই।

;;;;;

ডাইনিং টেবিলে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন আব্রাহাম সাহেব।হাতে খবরের কাগজ।

—-তারা মা শোনো।

—-বলো মা।

—-আজ আমার নাইট শিফট আছে।খাবার রান্না করে ফ্রিজে রেখে দিয়েছি।কিন্তু তোমার টিফিনটা বানানো হয়নি।এতো আইটেম করতে গিয়ে দেখি আমার সময় হয়ে গেছে।আমি পাস্তার সবকিছু করে রেখেছি।তুমি শুধু আজকে ওটা নিজে রেঁধে নিও কেমন।গাসুকে বলেছি ও তোমার সাথে থাকবে।

—-ভালো হয়েছে।তুমি তো আমাকে কিচেনে যেতেই দেও না।

—-তোমার তো সুবিধা হবেই।শোনো বাইরের খাবার একদম খাবে না কিন্তু।

—-আচ্ছা।

—-আমি বের হচ্ছি।নিজের খেয়াল রেখো মা।ওষুধ ঠিক মতো খেয়ে নিও।

—-ঠিকাছে।

তারাকে কাছে টেনে কপালে চুম্বন করে বেরিয়ে গেলেন মাহমুদা বেগম সাথে আব্রাহাম সাহেব।

—-আফা চলেন মুই আপনারে হেল্পু করুমনে।

—-চলো।

—-তারা নিজের জন্য রাধবি না।আমার জন্য ও একটু রাখিস।

—-ঠিকাছে।

গাসুকে নিয়ে তারা রান্না ঘরে চলে গেল।

;;;;;

পথিমধ্যে ব্যাগ কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে তারা।কড়া রোদ।তারা কপালের ওপর হাত দিয়ে রেখেছে।

—-আংকেল আর কতক্ষণ?

তারার কথা শুনে ড্রাইভার গাড়ির নিচ থেকে বেরিয়ে এলো।

—-তারা মামোনি গাড়ি তে সমস্যা হয়ে গেছে।গ্যারেজে নিতে হবে মনে হচ্ছে।

—-এই যাহ।এখন কি করব?কলেজের তো দেরী হয়ে যাবে।

—-তুমি একটু দাঁড়াও।আমি বরং গাড়ি দেখে দেই।

ড্রাইভারের কথা শুনে হাত ঘড়ির দিকে তাকালো তারা।বেশ সময় হয়ে গেছে।এখন আর তার পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব না।

—-আংকেল,অনেকটা ই তো চলে এসেছি।আর বেশি পথ বাকি নেই।আমি হেঁটেই চলে যাচ্ছি।

—-না না।একদম না।তোমার এই পা নিয়ে হাঁটার কোনো দরকার নেই।

—-কিছু হবে না।সামনে এগোতে থাকি।গাড়ি পেলে উঠে পড়ব।আপনি গাড়ি নিয়ে গ্যারেজে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।

—-স্যার কিন্তু আমাকে বকবে।

—-আমি কিছু বলব না।আপনি যান।

—-আচ্ছা তুমি সাবধানে যেও।

তারা ড্রাইভারের সাথে কথা শেষ করে ক্রাচ নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো।

;;;;;

রোদের প্রখরতা।সূর্যের আলো পড়ে পিচঢালা রাস্তাটিকে দেখে দুর থেকে মনে হচ্ছে পানি।কিন্তু কাছে গেলেই কিছু নেই।মরীচিকার খেলা যাকে বলে।

কিন্তু এটা কি হলো?সব তো ঠিকঠিক ছিল।রাস্তার পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে ক্রাচ নিয়ে চলমান বোরখা পড়া মেয়েটিকে দেখে নাফিজ চমকে গেল।

হ্যাঁ নাফিজ ড্রাইভ করছিল।কোনো ড্রাইভার সাথে আনেনি।একটা কাজে তাকে যেতে হবে।আর সে নিজেও ড্রাইভিং শিখতে খুব ইচ্ছুক।তাই আর এই সুযোগটা সে হাতছাড়া করল না।অফিসের গাড়ি নিয়েই চলে এসেছে।

—-মায়াবতী,তোমাকে যতোই আমি ভুলতে যাই তুমি আরো বেশি করে হানা দিয়ে পড়ো আমার মনের ওপর।একদম মৌমাছির চাকের মতো আমাকে ঘিরে রাখো তুমি।

নাফিজ গাড়ি থামিয়ে বার বার হর্ন দিল।

এদিকে বার বার হর্ন এর শব্দ শুনে তারা দাড়িয়ে গেল।আগে নিজের দিকটা দেখে নিল।না সে তো ভুল সাইড দিয়ে হাটেনি।তাহলে কে হর্ন দেবে।তারা পেছনে ঘুরলো।পেছনে ঘুরে নাফিজকে দেখতে পেয়ে তারা আরো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

নাফিজ তখন গাড়ির দরজা খুলে নামছে।নাফিজ দরজা দিয়ে তারার দিকে এগিয়ে গেল।অনেক দিন পর আজ নাফিজ দেখছে তারাকে।অনুভূতি টা যে কেমন সেটা শুধু নাফিজ ই অনুভূব করতে পারছে।

এ যেন বুকের ভেতর এক চিন চিন বেদনার সৃষ্টি,ক্ষণিকের বজ্রপাত,আচমকা আলোকিত অন্ধকার শহর, আর অতঃপর বৃষ্টি!

দেখতে দেখতে নাফিজ তারার একদম মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।

—-কেমন আছেন তারা?খুব ভালো আছেন নিশ্চয়ই।থাকবেন না কেন!আমাকে কষ্ট দিতে তো আপনার বেশ লাগে।এতো নিষ্ঠুর কেন আপনি?একটু কি বোঝা যায় না আমাকে।

না নাফিজের মনের কথা মনেই রয়ে গেল।ঠোট দুটো আর কথা বলার জন্য নড়লো না।কিন্তু চোখ?সে তো একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে সামনে থাকা দুটি চোখের দিকে।ঐ দুটো চোখ ও যে শুধু এই দুটো চোখকেই দেখছে।একজনের চোখে অভিমানের ঝড়,তো আরেকজনের চোখে কিছু না পাওয়া প্রাপ্তি কে পাওয়ার আনন্দ।

ভনিতা না করে তারার মুখ থেকেই অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো সেই ছোট্ট ডাকটা যা নাফিজের উতলা মনকে ঠান্ডা করার জন্য ই যথেষ্ট।

—-ক্যাপ্টেন।

—-মনে আছে তাহলে!

নাফিজ মুখে ছোট্ট হাসির রেখা টেনে জবাব দিল।কিন্তু নাফিজের উওর টা মোটেও পছন্দ হলো না তারার।

—-মানে?মনে থাকবে না কেন?

—-ওহ!যাক তবুও মনে আছে।আমি ভাবলাম ব্যস্ত মানুষ আপনি।আমার মতো নগন্য মানুষের কথা আপনার মনে থাকবে কি?

—-নগন্য!

—-কিছু কি ভুল বললাম।

নাফিজের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করলো তারা।নাফিজের কথা চোখের দৃষ্টি সব কিছুতে যেন অভিমানের ছাপ স্পষ্ট।তারা বেশ বুঝতে পারল নাফিজ কেন এমন করে কথা বলছে?

—-ক্যাপ্টেন আপনি,,,,।

—-আপনি হেটে কোথায় যাচ্ছেন?

—-কলেজে।গাড়িতেই যাচ্ছিলাম।মাঝরাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে।আর কোনো অটো ও পাই নি তাই হেটে যাচ্ছি।

—-চলুন আমি আপনাকে নামিয়ে দেব।উঠুন।

—-ধন্যবাদ।এটার দরকার নেই।আমি চলে যাব।আপনি বরং আপনার কাজে যান।

—-আমি আরিফপুর যাচ্ছি তারা।আপনার কলেজ তো বাধবে সামনে।উঠুন।

—- না থাক।আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।

—-আমি কি একবার ও বলেছি আপনাকে যে কষ্ট হবে আমার?

নাফিজ বেশ রাগি সুরে কথাটা বললো।নাফিজের কথা শুনে তারা চুপসে গেল বেলুনের মতো।

—-না বলেননি।

—-তাহলে?দুই লাইন বেশি বোঝেন কেন?যেটা বোঝাতে চাই সেটা তো বোঝেন না।

—-কি বোঝানোর কথা বলছেন?

—-আপনি চুপ চাপ গাড়িতে উঠুন।না হলে আমি স্যারকে ফোন দেব।

—-না।এই কাজ করবেন না।বাপি আবার কষ্ট করে আসবে।

—-তাহলে উঠুন।

—-উঠছি।

তারা রাগে গজগজ করতে করতে গিয়ে গাড়িতে উঠলো।নাফিজ ও ঠোঁটে বাকা হাসি দিয়ে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।

গাড়ি চলছে।তার চুপচাপ বসে আছে।নাফিজ ও কোনো কথা বলছে না তারার সাথে।বিষয়টি তারার একদম পছন্দ হচ্ছে না।তারা বার বার আড়চোখে দেখছে নাফিজকে।বার বার এটাই ভাবছে এই বুঝি নাফিজ তার সাথে কথা বললো।

—-কিছু বলবেন তারা?

নাফিজের কথা শুনে নড়ে চড়ে বসলো তারা।নাফিজ হয়তো খেয়াল করেছে তারার চাহনি।ভাবতেই তারার লজ্জা লাগছে।

—-কি হলো কিছু বলবেন?

—-আপনি আমার সাথে কথা বলছেন না কেন?

—-বলার কি খুব দরকার?

—-এতো পেচিয়ে কথা বলছেন কেন?

তারার কথায় নাফিজ আর উওর দিল না।

—-ক্যাপ্টেন।

—-হুম।

—-আপনি কি আমার ওপর রাগ করেছেন?

—-না তো।কিসের রাগ?আমার কি রাগ বলতে কিছু আছে নাকি?

নাফিজের হেয়ালি কথাগুলো তারার একদম হজম হচ্ছে না।উল্টা মনে হচ্ছে নাফিজের কথা গুলো একেকটা তীর।সব যেন তার বুকে গিয়ে বিধছে।

—-গাড়ি থামান।গাড়ি থামান।

—-আরে কেন?

—-গাড়ি থামান বলছি।

তারার কথা শুনে নাফিজ ব্রেক কষে তারার দিকে তাকালো।

—-কি হয়েছে?

তারা গাড়ির দরজা খুলতে গেলে নাফিজ আটকে দিল।

—-কি হয়েছে তারা?নামতে যাচ্ছেন কেন?এখনো দু মিনিটের রাস্তা বাকি।

—-আমি যাব না কলেজ।

—-কিহ!এই না বললেন যাবেন।

—-আমি যাব না।পারলে যেখান থেকে আমাকে গাড়িতে তুলেছিলেন সেখানে দিয়ে আসবেন।না হলে এখানেই দাঁড়ান আমি নেমে যাচ্ছি।

নাফিজ স্টিয়ারিং এর থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে তারার দিকে ভালো করে ঘুরলো।

—-কি হয়েছে তারা?

—-আমি বাড়ি যাব।

—-হঠাৎ মত বদল?

—-সেটা আপনাকে কেন বলতে যাব?

—-ও আচ্ছা।কিন্তু আপনি যদি এখন বাড়ি যান তাহলে আমি স্যারকে ফোন দেব।

—-কিহ !কেন?

—-আপনি কলেজ ফাকি দিয়ে বাড়ি বসে আছেন সেটা বলতে।

—-খবর দার না।

—-তাহলে কলেজ চলুন।

—-আমার কলেজের যেতে ইচ্ছে করছে না।

—-একটা জায়গায় যাবেন?

—-কোথায়?

—-আমি যেখানে নিয়ে যাব।

তারা আর কোনো উওর দিল না।নিরবতা সম্মতির লক্ষন।এটাই মনে করে নাফিজ গাড়ি স্টার্ট দিল।নাফিজ কিছু না হলেও বেল ভালো বুঝতে পেরেছে তার কথাতে তারার মন খারাপ হয়ে গেছে।

তারা এদিকে কিছু না বলে আনমনে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।

;;;;;

—-এই গাসুয়া উঠে দাঁড়াও?

মোখলেস স্যারের কথা শুনে গাসু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।আজ সে অনেক দিন পর স্কুলে এসেছে।মান্থলি টেস্ট শুরু হয়েছে সেই সুবাদে।

—-এই যে মাথা নাড়িও না।তোমাকে তো বলছি।

—-ও স্যার।এই তো আই গাসুয়া সিমসাং।

গাসু স্যারের কথায় উঠে দাঁড়ালো।

—-তুমি ছাড়া এই ক্লাসে গাসু নাম কার আছে?

—-হক কথা স্যার।

—-তা পরীক্ষা দিচ্ছো নাকি খাতা কালেকশন করছো?

—-স্যার কি কইতাছেন !আই গাসুয়া সিমসাং খাতা ডিলেট করমু।নো নো হয়তো।আই তো সব পারি।

—-হ্যাঁ তাই তো কালেক্ট থেকে ডিলেট।

মোখলেস স্যারের কথা শুনে ক্লাসের সবাই হেসে দিল।

—-তা কি পরীক্ষা দিচ্ছো?

—-ঐ যে স্যার পাতিহাঁস।

—-কিহ!এই বলে তুমি সব পারো।এখন বলছো ইতিহাস কে পাতিহাঁস।তুমি তো বিষয়ের ই নাম জানো না।

—-ঐ তো ঐখান।

—-নেও তুমি যখন সব পারো তখন কিছু প্রশ্ন এর উওর দেও।

—-কন স্যার।

—-পানি পথের যুদ্ধ হয়েছিল কতো সালে?

—-পানি পথ!হেইডা কি কইলেন স্যার।পানি তে তো মাছ সাঁতার কাটে।এই মাথা টু ঐ মাথা।আমি তো এহনো অবধি পথ খুইজে পাইলাম না।

—-কিহ! আচ্ছা পরের টা বলো।না হলে তোমার খবর আছে।

—-কি স্যার?

—-নবাব আওরঙ্গজেবের নাতির নাম কি ছিল যিনি বাংলার নবাব ছিলেন?

—-স্যার এইটা তো একদম পিম্পিল উওর।

—-পিম্পিল!

—-ঐ স্যার সোজা।

—-ওহ সিম্পল।নেও বলো উওর।

—-আওরঙ্গজেবের পোলার থুক্কু মাইয়ার পোলার যেই নাম ছিল তাই।

—-চুপ।বেয়াদব।একটা প্রশ্নের উওর পারে না।

—-কি কন স্যার?আমি তো লিখা পুরো খাতা ভরে ফেলাইছি।

—-ও তাই।দেখি খাতা নিয়ে এসো।

—-আইতাছি স্যার।

গাসু বেন্ঞ থেকে উঠে খাতা নিয়ে স্যারের টেবিলে রেখে দাড়ালো।মোখলেস স্যার খাতা টা নিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করে কিছুক্ষণ দেখলেন।তারপর খাতাটা গাসুর হাতে দিলেন।

—-দেখলেন স্যার!

—-গাসু তুমি নিজে একটু পড়ে শোনাও তো।কি লিখেছো?

—-এক্ষুণি পড়তেছি।

গাসু পড়তে শুরু করলো,

—-বিটিশ গুলোন আআআ,,,ঐ ,,,মানে অঅ,, ,।

গাসু থেমে গিয়ে খাতাটা স্যারের হাতে দিল।

—-কি হলো গাসু?

—-স্যার পড়তে ন পারতাম।লিখা বুজা যায় না।

মোখলেস স্যার বেত নিয়ে রেগে উঠে দাঁড়ালেন,

—-ফাজিল মেয়ে,তুমি নিজের লেখা নিজে পড়তে পারো না।আমি কি পড়ব?

চলবে————-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here