ধূসর রঙের প্রজাপতি ৪৩

0
419

#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_43

মেজাজের শীর্ষে চলে গেছেন ইববান শিকদার। রাগে গা ঘিন ঘিন করছে। তামিমের মুখে বিষাদের ছায়া। একটু দূরে দু হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে সাদাদ।শীতের মাঝে ও ঘেমে গেছে ছেলেটা। ক্লান্তি তে চোখ মুখ ডেবে গেছে। ইববান নিজের রাগ কে দমিয়ে অতিশয় শান্ত কন্ঠে বললেন
_ আরফানের অবস্থা কেমন ?

_ মাথা ফেঁটে গেছে কাকা , ডান সাইটে অল্প হেমারেজ হলে ও হাতের কব্জি তে বেশ ব্যথা পেয়েছে।

_ মির্জাপুর যেতে বারন করেছিলাম না ? কেন গেছে ?

লিটন শিকদার মাথা নিচু করে আছেন। ফোঁস করে দম ফেলে বললেন
_ শান্ত হও ভাই। ছেলেটার মাথা ঠিক ছিলো না ,না হলে মির্জাপুর কখনোই যেতো না।

_ কিসের মাথা ঠিক নেই ? বেঁচে ফিরেছে এতেই যাহহ। পুরো গাজীপুর জানে মির্জাপুরের সাথে শিকদার বংশের কলহ আরফান ভুল করলো কি করে ?

তামিম এতোক্ষনে মুখ খুললো।
_ কাকা শান্ত হও তুমি । জানো ই তো সামনেই নির্বাচন। মির্জা বংশের কেউ যেন ঝামেলা না করে তাই আরফান ভাই গিয়েছিলো । তোমাকে বলেই যেত তুমি তো কাছে ছিলে না।

প্রচন্ড খেপে যায় ইববান । সামনে থাকা গ্লাস টা ঠেলে ফেলে দেন। বিক্ষিপ্ত গ্লাস টা মেঝে তে গড়াগড়ি খেতে থাকে। শরীর কাঁপছে, মির্জা বংশ যে দোষ ত্রিশ বছর পূর্বে করেছে সেই দোষের কোনো ক্ষমা নেই। তাহলে কিসের সখ্যতা তাঁদের সাথে ?

দোতলা থেকে নেমে আসে অভিনব। সব কিছু তাঁর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মামনি কাঁদছে আর এ দিকে চেঁচামেচির শব্দ। প্রচন্ড রহস্যময় দ্বিধা দ্বন্ধ নিয়ে এগিয়ে যায় অফিস কক্ষে। দরজায় নক করে বলে
_ আসবো ?

অভিনবর মাত্রাতিরিক্ত শীতল কন্ঠে সবাই ঘুরে তাকায়। ইববান চোখ দিয়ে সবাই কে ইশারা করেন। অভিনব সেটা দেখে ফেললে ও কথা বাড়ায় না। হাসি মুখে তামিম এগিয়ে আসে।
_ আরে ভাই আসো না , নক করার কি প্রয়োজন।

_ না তেমন কিছু না। তামিম একটা কথা বল তো মামনি রা কাঁদছে কেন ?

তামিমের মুখ টা বিষাদে ভরে উঠে। ফোঁস করে দম ফেলে সে। মুখের অভিব্যক্তি মুহুর্তেই পাল্টে যায়। এক রাশ কষ্ট নিয়ে বলে
_ আরফান ভাই হসপিটালে।

_ হোয়াট !

লিটন উঠে আসেন। অভিনবর কাঁধে হাত রেখে বলেন
_ এক্সিডেন্ট করেছে। যাই হোক ওর বউ কে খবর টা দেওয়া হয় নি। তুই কি একটু রিমার বাপের বাড়ি থেকে রিমা কে নিয়ে আসবি ?

অভিনব মাথা ঝাঁকায় । লোকেশন নিয়ে চলে যায়। ইববান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। লিটনের বুদ্ধি তে অভিনবর কাছে বিষয় টা ধামাচাঁপা দেওয়া গেল।
ছেলেটাকে এসব ভেজালে জড়াতে চান না ওনি।

*

” রাহেলা চাচি , রহিম চাচা কোথায় তোমরা এন্টি সেপটিক টা নিয়ে আসো। ”

রাফাতের ডাকে হুরমুরিয়ে আসে তাঁরা। মাহিন কে ধরে সোফায় বসিয়ে দেয় রাফাত। ছেলেটার হাতের অবস্থা নাজেহাল। কাঁচের বোতলের বেশ কিছু টা অংশ ঢুকে গিয়েছে।

এন্টি সেপটিক এনে দিতেই রাফাত যত্ন নিয়ে পরিষ্কার করতে থাকে।
ঝাঁঝালো ব্যথায় আহ করে আর্তনাদ করে উঠে মাহিন। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে রাফাত বলে
_ কেন এমন টা করতে গেলে ? মারামারি করার মতো কিছু কি হয়েছিলো?

_ ভোট নিয়ে বলছিলো কিচ্ছু বলি নি। বিনয় তো নয় ই বরং অসভ্য দের মতো ভাষায় টান এনে কথা বলে ।
আমার বোনের নামে খারাপ কথা বলে ছেড়ে দিবো ?

_ হোয়াট ! ঝিলের নামে কি বলেছে ?

_ কোনো ভাবে জেনে গেছে প্রায় সময় ই বাসা থেকে পালিয়ে যায় ঝিল ।সেই কারনে দুটো নোংরা ভাষা ব্যবহার করেছে।
সহ্য হয় নি আমার। সামনে থাকা কাঁচের বোতল টা মাথায় ফাটিয়ে দেই।

রাফাত দাঁত কিরমির করে উঠে। চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। আরফানের কল্লা টা কেঁটে ফেলতে পারলে শান্তি মিলতো। রাফাত হাক ছেড়ে বলে
_ রহিম চাচা বাবা কাকা দের খবর দাও। বলবে গাজিপুর নিয়ে ঝামেলা হয়েছে দ্রুত বাসায় আসতে।

রহিম চাচা চলে যান। রাফাতের হাঁক দেওয়া ডাকে ছুটে আসে ঝিল। করিডোর থেকে মাহিনের হাতের অবস্থা দেখে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে।
শত হাত দূরে থেকে ভাইয়া বলে আর্তনাদ করে উঠে। রাফাত হতচকিয়ে যায়। মাহিন নিজের হাত লুকাতে ব্যস্ত।
ঝিলের চোখে অজ্রস ধারার মেলা। রাফাত বলে
_ ভাইয়া ঠিক আছে।একটু খানি কেটেছে জাস্ট ।

_ থামো তুমি । এতো রক্ত ঝরছে আর বলছো একটু খানি কেটেছে ।

_ বনু আমি ঠিক আছি। একদম চিন্ত করিস না।

_ ভাইয়া

মাহিন কে জড়িয়ে ধরে ঝিল। চোখের পানি গুলো বুক ফাটা আর্তনাদ। ভাইয়ের হাত টা জড়িয়ে ধরে। রক্তে মেখে যায় শরীর। কিছুক্ষনের মাঝেই ডাক্তার এসে হাজির।
ঝিলের মাথায় হাত বুলিয়ে মাহিন বলে
_ পাগলামি হয়েছে ? রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছিস। ফ্রেস হয়ে আয় ততক্ষণে আমার ব্যান্ডেজ টা করা হয়ে যাবে।

নাক টেনে চলে যায় ঝিল। মাহিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঝিল সম্পর্কে আড়াল করতে চেয়ে ও পারছে না।
ছোট থেকেই ঝিল কে আড়ালে রেখেছে। যাতে করে ঝিলের স্বাধীনতায় ব্যাঘাত না ঘটে।
চারদিকে শত্রুর অভাব নেই। কে কখন ক্ষতি করে দেয়।

রুমে এসে ফ্রেস হয়ে নেয় ঝিল। ভাইয়ের কাঁটা হাত টা মনে হতেই বুক জ্বলে উঠে। কতোটা ক্ষত হয়েছে।
ফোনে নাম্বার ডায়াল করে ফোন দেয়। এক বার রিং হতেই ফোন রিসিপ হয়। যেন ফোনের ই অপেক্ষা করছিলো।
_ ঝিল !

_ হুমমম। কাল ফোন না দিতে পারার জন্য স্যরি। রাতে পাপার কাছে গিয়েছিলাম।

_ সমস্যা নেই। নাস্তা করেছো ?

_ হুমম। তুমি খেয়েছো ?

_ হ্যাঁ। শোনো আমি না হসপিটালে আছি , পরে কথা বলি?

_ হসপিটাল !

_ হুমম।

_ তুমি ঠিক আছো ? তোমার কিছু হয় নি তো ? হসপিটালে কেন ?

_ শান্ত হও। আমি ঠিক আছি , আমার এক ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে। মাথা ফেটে গেছে ।

_ কন্ডিশান কেমন ?

_ সেফ ই আছে। আমি রাখছি , আর আজ পাপা আর মম আসবে।
আই উইস সব কিছু ঠিক হয়ে যায়।

_ হুমমম সেটাই যেন হয়।

ফোন রাখে ঝিল। বুক ভারী হয়ে গেছে। মৌনতার আসার কথা। এখনো আসছে না কেন ?

দুপুরের দিকে এক হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ নিয়ে আসে মৌনতা। ঝিলের অবস্থা তখন দেখার মতো।
সব থেকে বাজে বিষয় হলো মৌনতার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ হয়ে গেছে। আর মেয়েটা এক গাঁদা শপিং করেছে।
_ মৌন এটা কি শুনছি ?

_ যা শুনেছিস তাই !

_ আজব। ব্রেক আপ কেন হলো তদের ?

_ বাজে মানুষের সাথে ব্রেক আপ ছাড়া আর কি হবে বল তো ?

_ মৌন !

_ কি করবো আমি ? অনেক চেয়েছিলাম, বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওহ থাকতে চায় না আমার সাথে। আমার থেকে ও সুন্দরী কে পেয়েছে কি না।

কথা গুলো চিৎকার করেই বললো মৌনতা। চোখ দুটো ভিজে গেছে। তব্ধ হয়ে বসে পরলো ঝিল। ডিবাইনে থাকা ফ্লাওয়ার ভাস টা ছিটকে পরলো পায়ে। খানিক টা ব্যথা পেলে ও টু শব্দ করলো না।
চোখ দুটো ভিজে গেছে মেয়ে টার। হঠাৎ করে মৌনতা কে জড়িয়ে ধরলো। ডুকরে কাঁদছে মৌনতা।
_ মৌন তুই একদম ভাববি না। যে তোর যোগ্য না তাকে সাথে রাখার মানেই হয় না।

_ ভালোবাসতাম খুব।

_ ঘৃনা কর , ঘৃনা করতে হবে।

_ ঝিল।

ঝিল কে জড়িয়ে ঝমঝম করে কাঁদছে মেয়েটা। নাকের পানি চোখের পানি একাকার হয়ে গেছে। দু বান্ধবীর কান্না দেখে রোহন থমকে গেল। না চাইতে ওহ রুমে ঢুকলো।
চোখ দুটো খুলেই রোহন কে দেখতে পেয়ে ছিটকে দূরে সরে গেল মৌনতা।
মৌনতার হঠাৎ এমন আচারনে ভ্রু কুঁচকে তাকায় ঝিল।
_ কাঁদছিস কেন ঝিল ?

_ ভাইয়া তুমি !

_ চোখে পানি কেন ?

_ আরে কাঁদবো না বলো ? বান্ধবীর সাথে কতো দিন পর দেখা ।

_ উফফ বনু সুন্দরবন থেকে এসেই ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছিস। বাঘের সাথে প্রেম হলো না তো ?

_ ভাইয়া।

রোহন হো হো করে হেসে উঠলো। ঝিল ও হাসলো। প্রচন্ড অস্বস্তি তে পরে গেল মৌনতা। হাসবে নাকি কাঁদবে ঠিক ঠাওর করতে পারলো না। পরিশেষে হেসেই ফেললো।

*

কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। একটু আগেই অহেদ সরকার আর ইহরিমা সরকার এসেছেন। মামা রা দরজা বন্ধ করে আছেন। ইহরিমা প্রচন্ড ভেঙে পরেছেন। অভিনব আশ্বস্ত করে বলল
_ প্লিজ মম। এভাবে হেরে যেও না। মামনি রা কতোটা খুশি হয়েছে দেখো ! মামা রা ও মেনে নিবেন।

_ ইহরিমা প্লিজ এভাবে কেঁদো না। গত ত্রিশ বছর ভাইদের জন্য কেঁদে ই চলছো।

_ কি করি বলি তো ? সবাই আমাকে দেখা মাত্র ই ঘরে গিয়ে ডোর লক করে দিলো। এত টাই ঘৃনা করে আমায় ?

_ ইহরিমা এমন কেন ভাবছো ? তোমার ভাই রা ও খুশি হয়েছে দেখো।

_ ভাবি তুমি দেখো ই না কতোটা ঘৃনা করে আমায়।

ইহরিমা মুখে হাত গুঁজে কাঁদতে লাগলেন। অহেদের বুক ভারী হয়ে গেল। ত্রিশ বছর পেরিয়েছে, ভালোবাসার কোনো কমতি রাখেন নি। তবু ও দিন শেষে ইহরিমার চোখে জল।
অভিনবর ফোন বাজছে। ঝিল প্রচন্ড টেনশনে আছে। অভিনব ফোন রিসিপ করলো না। টেক্সট করে জানালো পরে সব বলবে।

মিনিট পনেরো বাদেই দরজা খুলে গেল। বিস্ময়ে চেয়ে আছে সবাই। তিন ভাইয়ের চোখ মুখ শক্ত হলে ও চোখ দুটো বলে দিচ্ছে প্রচন্ড কেঁদেছেন।

ইহরিমা উঠে দাঁড়ান। আলগা পায়ে এগিয়ে যায়। ইববান হাত দিয়ে বাঁধা দেয় ইহরিমা শুনেন না। ভাইয়ের পায়ে লুটিয়ে পরেন।
অহেদ অবাক হন। তিনি তাঁর স্ত্রী কে সর্বোচ্চ ভালোবাসা আর সম্মানে রেখেছেন। যদি ও ইববান তাঁর বড় ভাই তবু ও বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠে।
এক ভালোবাসার জন্য কতো টা কষ্ট পেতে হচ্ছে।
ত্রিশ বছর পরে ও কি মেনে নিবেন না ?

_ আমাকে মাফ করা যায় না ভাইয়া ?

_ রুবি

ইববানের গলা ধরে আসে। বোন কে আদর করে রুবি বলেই ডাকতেন। আড়ষ্ঠতা ছাড়াই আবেগের টানে বলে ফেলেছেন।
ইহরিমা উঠে দাঁড়ায়। লিটনের কাছে যায়। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ও পারেন না ওনি। সবার সামনেই কেঁদে উঠেন। ইহরিমা ভাই কে জড়িয়ে হো হো করে কেঁদে উঠেন।
মুজাহিদের বুক ভারী হয়। অস্ফুটন স্বরে বলে
_ আপা !

ভাই বোনের মিল বন্ধনে অহেদ কেঁপে উঠেন। এই ভালোবাসা ছেড়ে চলে এসেছিলো ইহরিমা। ঠিক কতো টা ভালোবাসলে এমন কাজ করতে পারে মানুষ। ইহরিমার প্রতি আজ মাত্রাতিরিক্ত শ্রদ্ধা জেগে উঠে। ছলছল নয়নে বলে উঠেন
_ আমার জীবনে আসার জন্য ধন্যবাদ ইহরিমা।

কথা টা ধীরে বললে ও পাশে থাকা অভিনবর কর্নপাত হয়। বাবার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরায়। চোখ যেন থমকে গেছে এই ভালোবাসা তে। সত্যি ই তো পরিবারের ভালোবাসা কে উপেক্ষা করে অন্য একজনের হাত ধরে চলে আসা এতো সহজ ?
ঠিক কতো টা ভালোবাসলে মানুষ পরিবার ছাড়ে।

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here