ধূসর রঙের প্রজাপতি ৪২

0
444

#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_42

ভোর ছয় টা নাগাদ ঢাকার সায়েদাবাদ বাস কাউন্টারে বাস এসে থামলো। সারা রাত নির্ঘুম কেটেছে দুজনের। এই কয়েক ঘন্টায় নিজে দের বেদনার বিসর্জন দিতে হয়েছে। কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে তো হবেই। আর সব কিছু অতি সহজে হবে এমন তো নয়। বাস থেকে নেমে মন মরা করে রইলো ঝিল।
প্রচন্ড মন খারাপ তাঁর । অভিনব নিজের মনের অবস্থা বোঝাতে ইচ্ছুক নয়। কারন এতে মেয়েটা আরো বেশি দূর্বল হয়ে যাবে। কোনো কথা বলছে না ঝিল । চোখের পানি গুলো গালে এসে শুকিয়ে রেখা হয়েছে।
অভিনবর অন্তঃকরনে ব্যথা অনুভব হলো। ঝিলের হাত দুটো মুঠো বন্দী করে নিলো। পর পর দু বার চুমু খেল। ডুকরে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। আবেগ কে লুকায়িত করার শক্তি তাঁর নেই।
অভিনব কে ছাড়া কিছু ভাবতে পারছে না। সর্বশেষ ব্যাথাতুর অনুভূতি গুলো গলায় এসে দলা পাকিয়ে গেছে। একটু ছোঁয়া পেয়েই কান্না হয়ে ঝরে পরছে। অভিনব অনুনয়ের স্বরে বলল
_ আমরা আর কিছু দিন পরে ফিরে যাই ?

_ নাহহ। এতে করে আমাদের দূরত্ব আরো বাড়বে। যত সময় তোমার কাছাকাছি থাকবো আমি ততো পাগল হয়ে যাবো।

_ তাহলে কাঁদছো কেন ?

_কি করবো তাহলে ? অনেক বেশি জড়িয়ে গেছি আমি। তুমি বুঝো আমার ভালোবাসা?

_ এই মেয়ে কি সব বলছো? আমি বুঝি না তোমায় ? একদম কাঁদবে না। আমরা খুব তাড়াতাড়ি একে অপরের হয়ে যাবো।সবার সম্মতি থাকবে তাতে। তুমি কাঁদলে আমি কি করে ঠিক থাকি বলো তো ?

ঝিল ফ্যাচ করে কাঁদতে লাগলো। দ্বিগুন বেড়ে গেছে কান্নার বেগ। অদ্ভুত লীলা খেলায় অন্তর কাঁপছে। তবু ও পারছে না সামলাতে।
বেশ অনেক ক্ষন অভিনবর বুকে মুখ গুঁজে কাঁদলো।

ঝিলের কান্না থেমে গেলে পার্কিং স্পট থেকে সমস্ত ডিটেলস দিয়ে নিজের গাড়ি টা নিয়ে নিলো। গাড়ি ড্রাইভ করার সময় দুজনের মাঝে একটা কথা ও হলো না। মৌনতা ফোন করেছে ঝিল নিজেকে স্বাভাবিক করে রিসিপ করলো।

_ আজ ফেরার কথা তো ঝিল ?

_ হ্যাঁ । আমি চলে এসেছি , এখন বাসায় যাচ্ছি।

_ ফোন করবি তো আমায় ? আমি তো দেখা করতে চেয়েছিলাম।

_ কয়েক দিন যাক তারপর না হয় দেখা করবো।

_ একটা কথা ছিলো ঝিল। তোর মুড কেমন এখন ?

_ প্রচন্ড বাজে।

_আচ্ছা তাহলে পরে বলবো কেমন ?

_ সিরিয়াস হলে এখনি বল মৌন। এতো হেজিটেট করছিস কেন ?

_ আরে না সিরিয়াস কিছু না। বাসায় পৌছে ফোন করিস।

_ আচ্ছা।

ঝিল ফোন রেখে দিলো। মনের অবস্থা একদম ই ভালো নেই। তাই মৌনতার কথা টা গাঁয়ে মাখলো না।
হঠাৎ করে ব্রেক কষলো অভিনব। ঝিল অবাক চোখে তাকালো। অভিনব একটু হেসে বলল
_ ফুচকা খাবে ?

*

মির্জাপুরে প্রবেশ করতেই ঝিলের চিত্ত কেঁপে উঠলো। আর মাত্র কিছু সময়। অভিনবর থেকে দূরে যেতে হবে। বুকে শূন্য তা যেন খা খা করছে। অভিনবর চোখ মুখ কেমন কালচে হয়ে গেছে।
অনুভূতি ছাপানোর ক্ষমতা সে হারিয়েছে। জীবন নাটকীয়তার থেকে ও নাটকীয় । আজ যাকে নিয়ে পথ চলছি কাল সে পাশে নেই। ব্যাথা ভোলা কি যায় ?
প্রেমের ব্যাথা তো তর তর করে বাড়ে। বিচ্ছেদের নীল ব্যাথা কি করে সহ্য করে তাঁরা?
এতো সহজ ছেড়ে দেওয়া ?
সড়ু রাস্তার পাশে গাড়ি থামায় অভিনব। ঝিলের বাসা টা চকচক করছে। অভিনব এক পলক তাকিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো। ঝিলের দিকে তাকাতেই বুকে চিন চিন ব্যাথা অনুভব হলো। হাতে মুখ গুঁজে কাঁদছে মেয়েটা।
অথচ আগের বার কতোটা হাসি খুশি ছিলো।
_ কেঁদো না প্লিজ।

_ কি করে থাকবো আমি ?

_ আমি তো আছিই। রোজ নিয়ম করে হাজার একটা কল করবো। দুদিন বাদে ঘুরতে ওহ যাবো প্রমিস।

ঝিলের মন গললো না। হুমড়ি খেয়ে পরলো অভিনবর গাঁয়ে। অভিনবর হৃদস্পন্দন গুলো যেন স্থির হয়ে গেছে। এই পাগলী মেয়ে টাকে ছাড়া থাকবে কি করে ?

_ প্লিজ ঝিল।

_ আমি পারছি না অভিনব। আমি পারছি না সামলাতে। কষ্ট হচ্ছে খুব।

ঝিলের মাথা টা উঁচু করে নিলো। চুল গুলো গুছিয়ে কপালে চুমু খেলো। মেয়েটার হিচকি উঠে গেছে। এভাবে অসুস্থ হয়ে যাবে। চোখের পানি গুলো গাল বেয়ে ঠোঁটে এসে লাগছে। তা দেখে অভিনবর বেশ হাসি পেল।
বিষয় টা খুব তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে ঝিল প্রতিবাদের সময় পেল না। অভিনবর আর্দ্র ঠোঁটের স্পর্শে কেঁপে উঠলো। দু হাতে জড়িয়ে ধরলো।

অভিনব নিজেই দিশাহীন হয়ে পরলো। ঝিলের গলায় মুখ গুঁজে নিশ্বাস নিলো। কি করে থাকবে ?

ঝিল আর কাঁদলো না। হাসি মুখে বিদায় দিতে হয়। তাই জোড় করে হাসি ফোটালো। যদি ও সে হাসি টা স্থায়ী হলো না। অভিনব বুকে হাত গুঁজে গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে রইলো।
এক পা দু পা করে আগাতে লাগলো ঝিল। ঝিলের চলে যাওয়া বুকে রক্তক্ষরণ করছে। তবু ও নিজেকে সামলে নিলো অভিনব। দীর্ঘশ্বাস গুলো লুকিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

মেইন গেট থেকে এক পলক তাকালো ঝিল। অভিনব চলে গেল ভাবতেই মাথা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। সময় মানুষ কে কতোটা বদলে দেয়।
সময়ের আবর্তনেই আমাদের চলতে হয়। সব কিছুই থাকে হাতের বাইরে।

*

বাড়ির মেইন ফটক দিয়ে ঝিল কে আসতে দেখে দৌড়ে আসে আহনাফ। পুরো হতবাক হয়ে গেছে। কারন আর ও কয়েক দিন পর ঝিলের আসার কথা।
ঝিল একটু হাসে তবে হাসি হাসি মুখের বদলে ছলছল নয়নে তাকায়।
আহনাফের বুক ভারী হয়। আদুরে গলায় বলে
_ কি হয়েছে বনু ? কাঁদছিস কেন ?

_ কত দিন পর দেখলাম তোমাদের।

_ বনু।

ঝিল কে জড়িয়ে ধরে আহনাফ। নিজের কান্না আটকাতে পারে না মেয়েটা। ঝরঝরে কাঁদে, আহনাফ প্রচন্ড শকড। এর আগে ও ঝিল পালিয়েছে। আর অনেক দিন পর বাড়ি ফিরেছে তখন তো খুব রেগে থাকতো। অথচ আজ কাঁদছে। কোনো বিপদ হয় নি তো ?
অজানা ভয়ে বুক কেঁপে উঠে। ঝিলের মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলে
_ ঠিক আছিস তুই ?

নাক টেনে উত্তর দেয় ঝিল।
_ হুমম।

বাগানের ডান পাশে দাঁড়িয়ে প্রচন্ড রেগে কারো সাথে কথা বলছিলো সজল। হঠাৎ চোখ যায় ঝিলের দিকে। ফোন রেখে ছুটে আসে।
_ বোন !

_ ভাইয়া।

সজল কে জড়িয়ে ধরে ঝিল। কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটার শার্ট ভিজিয়ে ফেলে। সজল গলা উঁচিয়ে ডাকে
_ পাপা , মেঝো পাপা , ছোট পাপা রাফাত কোথায় তোমরা।
দেখো ঝিল ফিরে এসেছে।
আহনাফ ওর ফ্রেস হওয়ার ব্যবস্থা কর।

আহনাফ চলে যায়। সজল আদুরে গলায় ডাকে।
_ বোন ! আমরা খুব স্যরি। এভাবে পালিয়ে যাস কেন বল তো ?
বিয়ে টা করলে কি এমন হবে ?

_ আম স্যরি ভাইয়া।

_ থাক আর কোনো কথা নয়। এখন সব কিছু মাথা থেকে ঝেরে ফেল।

ঝিল নাক টেনে মাথা কাত করে। সজলের সাথে বাসার ভেতরে যেতেই পাপা দের দেখা মেলে। একে একে সবার সাথে কথা বলে। আশ্চর্যজনক ভাবে এবার ও কেউ রেগে নেই।
উল্টো সবাই সাফাই গাইছে। ঝিলের চোখ ভরে উঠে। কষ্টের অনুভূতি টুকু ভুলে যায়।

*

ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অভিনব। বুকের ভেতর শূন্যতা টা পোরাচ্ছে খুব। বাবা মা আজকে রাতের ফ্লাইটেই রওনা হবেন। অভিনবর বিশ্বাস মামা রা মা কে দেখলে মুখ ফেরাতে পারবেন না।
অভিনব ঠিক করেছে ভেজাল টা মিটে গেলেই ঝিলের বিষয় টা জানিয়ে দিবে। ঝিল কে ছাড়া সময় যেন কাঁটছেই না। পুকুর পাড়ে পা মেলে বসে পরলো। পাশে থাকা কংক্রিট গুলো পুকুরের পানি তে ছুড়তেই পেছন থেকে ডাক পরে ফুলের।
অভিনব পেছন ঘুরে তাকাতেই ফুল হাসি মুখে বলে
_ ইহান ভাইয়া তুমি এসে গেছো। বাসায় কেন যাও নি ?

_ যাবো তো ফুল ঝুঁটি । পুকুর পাড়ের হাওয়া নিচ্ছিলাম।

_ বনে বাঘ দেখেছো তুমি ?

_ দেখেছি। বাঘের সাথে বাঘিনী ওহ দেখেছি।

_ বাঘিনী !

_ হুমমম আমার পাশে বসো। আমি তোমাকে বাঘিনীর ছবি দেখাচ্ছি।

ফুল হাস্য উজ্জল মুখে অভিনবর পাশে বসে। ছবি তে বাঘ দেখলে ও বাঘিনী দেখা হয় নি। বাঘিনী বিষয় টা শুনে নি কখনো। ফোনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো অভিনব। ফুলের আড়ালে ছবি টা তে চুমু খেল।
ফুল বলল
_ বাঘিনী দেখাবে না ?

_ দেখাচ্ছি তো।

ফোন টা ফুলের হাতে তুলে দেয় অভিনব। ফুল ভ্রু কুঁচকে ছবি টা দেখে তাঁর ছোট্ট মস্তিষ্ক প্রশ্ন করে
_ এটা তো একটা আপি ,আপি টা কি করে বাঘিনী হয় ?

বিগলিত হাসে অভিনব। ফুলের হাত থেকে ফোন টা তুলে নিয়ে একটা ভিডিও অন করে। বিস্ময়ে ফুলের মুখ হা হয়ে যায়। অভিনব ফুলের চুল গুলো এলোমেলো করে বলে
_ বুঝেছো ?

ফুল উত্তর দেয় না। অভিনব ঝুঁকে ফুলের হাত মুঠো বন্দী করে আশে পাশে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলে
_ কাউকে বলবে না তো ?

_ আচ্ছা।

_ এই যে দেখলে আপি টা আমাকে বাঁচাতে কিভাবে ছুটেছিলো। বাঘিনী না হলে এতো সাহস কারে থাকে ?

ফুল মাথা দোলায় অর্থাৎ না। অভিনব ফুলের গাল টেনে দেয়। লুকিয়ে রাখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে
_ এই আপি টা আমার বাঘিনী বুঝেছো। আমার জন্য দুনিয়া এফোর ওফোর করতে পারে। খুব ভালোবাসে আমায়।

_ ভালোবাসে ?

_ হুমমম। আমি ও খুব ভালোবাসি ।

ফুল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় ফুল। একটু ভেবে খিল খিল করে হাসে। অভিনবর দৃষ্টি দেখে বলে
_ আমার ভাবি হবে তাহলে ?

_ হুমম। ভাবি হবে না অলরেডি তোমার ভাবি ।

_ সে কি করে হয় ? তুমি তো বিয়েই করো নি।

অভিনব উত্তর দিতে গিয়ে ও দেয় না। ফুলের ছোট মস্তিষ্ক এতো কিছু বুঝবে না। ফুল কে কোলে তুলে নেয়। একটা চকলেট হাতে দিয়ে বলে
_ বাসায় যাই আগে , কাল কে গেস্ট আসবে।

_ গেস্ট আসবে ?

_ হুমমম তোমার ফুপি মা আসবে।

_ সত্যি ?

_ হুমমম।

ফুল কে কোলে নিয়েই হাঁটে অভিনব। ফুলের মিষ্টি চেহারা ঝিল কে মনে করিয়ে দেয়। ঝিলের চেহারার আদল টা খানিকটা ফুলের মতো।

বাসায় যেতেই সবাই কে দেখতে পায়। মামাদি সাথে কথা বলে নেয়। তবে মামা দের দেখতে পেয়ে অবাক হয়। এতো আগে তো আসার কথা ছিলো না। ইববান শিকদার প্রশস্ত হেসে অভিনবর সাথে আলিঙ্গন করে।
_ কেমন আছিস ইহান ?

_ ভালো মামা। তোমরা এতো আগে ফিরে এলে যে ? কাজ কমপ্লিট হয়ে গেছে ?

_ হুমম।

অভিনবর যেন বিশ্বাস হলো না। তবু ও কিছু বলল না। আরফানের সাথে আলিঙ্গন করতেই আরফান পিঠ চাপরে বলল
_ কেমন গেল ট্যুর টা ?

_বেশ ভালো। তোমাদের কাজ কেমন হলো ?

_ হুম ঠিক ঠাক। বাঘ মামার সাথে দেখা হয়েছে ?

_ হুমমম।

_ ভাইয়ার সাথে তো বাঘিনীর ওহ দেখা হয়েছে।

ফুলের কথা অনুসারে সবাই তাকায়। অভিনব হতচকিয়ে যায়। ফুলের দিকে ইশারা করে যাতে কিছু না বলে। ছোট্ট ফুল বিগলিত হাসে।

_ ফ্রেস হয়ে আয়। এক সাথে লাঞ্চ করি।

_ তোমরা এখনো লাঞ্চ করো নি ?

_ না একটু কাজে ছিলাম। বাই দ্যা ওয়ে সুন্দরবনে তো ঘোরা হলো আমার জন্য কি এনেছিস ?

_ এনেছি তো , সবার জন্য গিফ্ট আছে। আগে ফ্রেস হয়ে আসি ?

_ আচ্ছা যাহহ।

অভিনব সবার সাথে আরেকটু কথা বলে চলে যায়। ঝিল এখনো ফোন করে নি। তাই নিজেই নাম্বার ডায়াল করে ফোন করলো। দু বার রিং হয়ে ফোন টা কেঁটে গেল। অভিনব বুঝতে পারলো ঝিলের পাশে কেউ আছে।
তাই আর ফোন করলো না। দ্রুত বাথরুমে গিয়ে সাওয়ার ছেড়ে দিলো।

**কনফিউশন থাকলে জানাবেন। সবার মন্তব্য আশা করছি ।

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here