ধূসর রঙের প্রজাপতি ৪১

0
470

#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_41

নির্জীব আকাশ। সারা দিনের কর্মব্যস্ততা কাটিয়ে আঁধার নামিয়েছে। ক্লান্ত সে , বোধ হয় একটু ঘুমাতে চায়। তাই তো চাঁদ টা ও মিলিয়ে গেছে । যাতে করে ক্লান্ত আকাশ টাকে কেউ দেখতে না পারে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। শীতের প্রকোপ টা ও বেড়েছে। যেন সারা বছরের শীত আজ ই নেমে এসেছে। ঝিল কাঁপছে, অভিনব লক্ষ্য করলো মেয়েটার শরীর কেমন কুকুরে যাচ্ছে। খানিকটা চিন্তা গস্ত হলো। তিন দিন বনের ভেতরে যেমন তেমন করে থেকেছে। না ছিলো শরীরের যত্ন আর না মেনেছে ঠান্ডার ধাঁচ ।
সমস্ত কিছু ছাপিয়ে শুধুই প্রকৃতির সাথে মিশেছে।
অভিনব রিসেপশনে কথা বলে কাঠ নিয়ে এসেছে। আগুন জ্বালিয়ে ছোট খাটো উত্তাপ পোহাবে। যদি ও হিটার রয়েছে তাঁতে ভ্রমন ভ্রমন মজা পাওয়া যাবে না। প্রকৃতি প্রেমি রা বোধ হয় এমনি হয়। সহজ জিনিস পছন্দ নয়। কষ্ট করবে তবু ও প্রকৃতির সাথে ই লেপ্টে থাকবে।
_ ঝিল একটু ব্যলকনিতে আসো। আগুন জ্বালিয়েছি , দেখবে ভালো লাগবে।

ঝিল যেন চাঁদ পেয়েছে। ছুটে আসলো ব্যলকনিতে। অভিনব খুব সুন্দর করে আগনু জ্বালিয়েছে । সচরাচর নিয়মে দু পাশে দুটো টুল থাকার কথা। কিন্তু তা না করে এক পাশেই দুটো ঢোল রেখেছে। অভিনব একটু করে হেসে বলল
_ বসো ।

অভিনবর কথাটা যেন মেয়েটার কর্ণপাত হলো না। অভিনব ফোঁস করে শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো । ঘুটঘুটে অন্ধকারে এক টুকুরো কাঠের মাঝে জ্বলন্ত আগুন। বিষয় টা পুরোই অদ্ভুত। আগুন বুঝি এমন ও সুন্দর হয় ?
আসলেই পরিস্থিতি অনুযায়ী সব কিছুই সুন্দর।

_ ঝিল !

আচমকা ধাক্কা লাগায় চমকে উঠে মেয়েটা। অভিনব একটু করে হাসে। পুরো পুতুলের মতো প্যাকেট হয়ে আছে। তাঁতে ও শরীর কাঁপছে। একে নিয়ে সাইবেরিয়া যেতে হলে মহা বিপদ হবে। অভিনব ভেবে নিলো আগে থেকেই ট্রেনিং দিবে । না হলে ঘুরতে যাওয়াই যাবে না। প্রকৃতির সাথে সখ্যতা যে একটু বেশিই প্রয়োজন।
প্রান ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য , কিংবা আল্লাহর সৃষ্টি কে দেখার জন্য হলে ও সখ্যতা বড্ড প্রয়োজন।
আর ঝিল কে ছাড়া কোথাও যাবে না। মেয়েটার হাতে হাত রেখেই তো আগাতে চায়।
থর থর করে কাঁপছে ঝিল । অভিনব এক হাতে জড়িয়ে বসলো। ছোট বিড়াল ছানার মতো লেপ্টে গেল। অভিনবর শরীরের উষ্ণতা যেন মেয়েটাকে শক্তি জুগিয়েছে। আসলেই মানুষের শরীরে উষ্ণনা অদ্ভুত ভাবে কাজ করে।
_ চাঁদ টা কি সুন্দর তাই না ?

_ চাঁদ !

_ হুমম। চাঁদ টা এতো সুন্দর কেন বলো তো ?

_ অদ্ভুত আমি কেন দেখতে পারছি না ?

_ চোখের ব্যামো হয়েছে তোমার ।

ঝিল ভ্রু কুঁচকে নিলো। সত্যি কি চোখের ব্যামো হলো তাঁর । এক হাতে চোখ ঢলে নিলো। বাকি সব তো ঠিক ঠাক ই আছে। তাহলে চাঁদ কে কেন দেখতে পাচ্ছে না ?
রাত কানা রোগ হয় , চাঁদ কানা রোগ ওহ কি আছে ?

_ শোনো চাঁদ কানা রোগ হয় ?

_ গাঁধা!

_ আজব তো। গাঁধার কি হলো ? তুমি ই তো বললে চোখের ব্যামো হয়েছে।

_ তো ?

_ তো মানে ? সব কিছু ই দেখছি, শুধু চাঁদ কেই দেখতে পাচ্ছি না।

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো। ঝিলের মাথায় সাধারন বিষয় কেন যে ক্যাচ করে না। নাকি অভিনব ই একটু বেশি চালাক ?

_এই কথা বলো না কেন ? তোমার আবার কথার ব্যামো হলো না তো ?

_ হুসস।

নিভে গেল ঝিল। অভিনবর মুখে দুষ্টুমির ছায়া। একটু আগাতে ই ছটফট করে উঠলো মেয়েটা। অভিনবর বুকে হাত দিয়ে বলল
_ দেখো আমার শীত করছে। উল্টো পাল্টা কোনো ভাবনা মাথায় ওহ এনো না।

অভিনব মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ঝিল কিছুই বললো না। পিন পতন নীরবতা দুজন দু দিকে তাকিয়ে।
_ আজব মানুষ দেখেছি , তবে গাঁধা মানুষ কখনোই দেখি নি। তবে সেটা ও আজকাল দেখতে পাচ্ছি।

_ আমাকেই বললে ?

_ তুমি ? কে তুমি ? তোমাকে কেন বলবো।

অভিনবর হেয়ালি পানায় বিরক্ত ঝিল। উঠে যেতে চাইলেই খপ করে হাত ধরে নিলো অভিনব । ঝিল অভিমানী গলায় বলল
_ বার বার গাঁধা বলো কেন আমায় ? আমি কি গাঁধা ?

_ উহহুহ আমার গাঁধী।

অভিমানের মাঝে ও হেসে ফেললো ঝিল। দুটো কিল মেরে অবভিনবর বুকে মাথা রাখলো।
পরম আবেশে চোখ বন্ধ করলো। অভিনব তাঁর শীতল হাতে ঝিলের চুলে গলিয়ে দিলো। ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল
_ চাঁদ কে বুকে নিলে এতো স্বস্তি পাওয়া যায় ?

_ চাঁদ ?

_হ্যাঁ আমার চাঁদ ই তো তুমি। আমার ব্যক্তি গত চাঁদ ।

ঝিলের ভেতর থেকে ভারী নিশ্বাস এলো। এতো ভালোবাসা কখনো ফিকে হয়ে যাবে না তো ?

*

প্রকান্ড শীতের মাঝে ভয়ঙ্কর ভাবে কাঁপছে ঝিল। অভিনবর দিকে রাগী চোখে তাকাচ্ছে। ফিচেল হাসি তে মত্ত সে। আগুনের কাছে হাত নিয়ে তাপ নিলো।শীত কমছে না। এই মাঝ রাতে সাওয়ার নিতে হয়েছে । সব দোষ অভিনবর। অভিনব ই তাঁর কাছাকাছি এসেছে। ছেলেটার চুল গুলো ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। কম্বল হাতে এগিয়ে এলো অভিনব । পেছন থেকে কম্বল নিয়ে পেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
রগরগা কন্ঠে খানিক টা সুর তুলে বলল
_ স্যরি।

_ এখন বলে কি হবে ? আগে মনে ছিলো না ?

_ সব দোষ কি আমার ?

_ অবশ্যই তোমার। তুমি ই তো আমাকে কাছে টেনে নিয়েছো।

_ তুমি বাঁধা দিয়েছিলে ?

_ তো। এতে আমার দোষ। আমি তো

_ ইসসস বললেই হলো। শোনো মেয়ে আবার শাওয়ার না নিতে চাইলে কাছে আসো।

_ দূরে যাও। একদম কাছে আসবে না।

অভিনব ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মেয়েটাকে টেনে বুকে নিয়ে নিলো। ভারী নিশ্বাস ফেলে বলল
_ এবার ঘুমাও।

ঝিল কথা বাড়ালো না , ঘুমিয়ে পরলো।

সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো না। কলিং বেল বাজতেই অভিনব পিট পিট করে তাকালো। বিরক্ত হলো খুব। তবু ও উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
সকালের নাস্তা এসেছে। এই নাস্তা গুলোই ওর জীবন কে এক ধাপ পিছিয়ে দিলো। বউ এর সাথে ঘুমিয়েছিলো সেটা ও সহ্য হলো না এই নাস্তার। আবার রোম্যান্স করবে তখন ও নাস্তার কল আসে। আজব দুনিয়া ।

দু ঘন্টা ঘুমিয়ে তারপর উঠে পরলো। ঝিলের ঘুম তখনো কাটে নি। অভিনবর ফ্যাচ ফ্যাচানি তে উঠে পরলো। মনে মনে এক গাঁদা গালি মেরে দিলো।
অভিনব নাক মুখ কুঁচকে বলল
_ এতো ঘুমালে মটু হয়ে যাবে। এমনি তেই তো আটার বস্তা।

_ দেখো অভিনব তুমি কিন্তু অনেক বেশি মজা করছো।

_ তো ? আমি ই তো মজা করবো। মাঝে মাঝে রোম্যান্স ওহ করবো। তুমি কি ভেবেছো খুব ভদ্র আমি ?

_ আসলেই একটা অসভ্য। কার ঘাড়ে এসে পরলাম।

বালিশ টা ছুঁড়ে অভিনবর গাঁয়ে ফেললো। অভিনব পেট চেপে হাসছে । অন্য দিকে রাগে গজগজ করতে করতে ফ্রেস হতে গেল ঝিল ।

রিসোর্ট টা কাল ঘোরা হয় নি। তাই আজ ঘুরতে বের হলো। সকালে নাস্তা করে আবার ঘুমিয়েছিলো। দুপুরে উঠে সাওয়ার নিয়ে লাঞ্চ করতেই বেজে গেল চারটা।
তাই এখনি বের হলো দুজনে। রিসোর্ট এ দোলনা সহ নানান খেলনা বসানো। রয়েছে সাইকেলিং এর ব্যবস্থা। ঝিলের চোখ চকচক করে উঠলো। সাইকেলিং করবে সে। অভিনব বাঁধা দিলে ও শুনলো না। অভিনব হাত চেপে বলল
_ কাপল সাইকেলিং করি ?

_ রিয়েলি ?

_ হ্যাঁ ।

প্রচন্ড খুশিতে লাফিয়ে উঠলো ঝিল । একটা সাইকেল নিয়ে দুজনেই বসলো। ছোট থেকেই সাইকেল চালাতে বেশ পারদর্শী ঝিল । তাই একটু ওহ ভয় হলো না। গোল গোল পাক খেতে লাগলো দুজনে । অভিনব কখনো কাপল সাইকেলিং করে নি। বার বার ব্রেক কষসে।
_ তুমি কাপল সাইকেলিং পারোই না।

_তো। আমার কি আরো বউ ছিলো যে আমি পারবো ?

_ থাকা দরকার ছিলো।

_ হোয়াট।

_ কিছু না। এমনিতেই বললাম । অন্য দিকে নজর দিলে চোখ গেলে দিবো । আমি আমার স্বামী কে ভাগ দিবো না।

অভিনব হেসে ফেললো। ঝিলের গাল টেনে দিয়ে লো স্প্রিটে সাইকেলিং করলো।

*

_ ব্যাগ গুছিয়েছো ঝিল ?

_ আমার ঘুম পাচ্ছে।

_ আচ্ছা তাহলে ঘুমাও । শোনো একটা ঘন্টা পরেই কিন্তু বের হবো আমরা।

_ বাস কখন ছাড়বে ?

_ রাত এগারোটায়।

_ ডিনার এখানেই করবো ?

_ অবশ্যই।

_ আচ্ছা রিসোর্ট এর বাইরে কোথাও গেলে হয় না ?

অভিনব টাইম দেখে নিলো। সন্ধ্যা সাত টা বাজে। অনেক টাইম আছে এখনো। ঝিলের দিকে তাকিয়ে বলল
_ তোমার না ঘুম পাচ্ছে ?

_ সমস্যা নেই এতে। আমি ম্যানেজ করে নিবো তো।

_ আচ্ছা তাহলে চলো। বাই দ্যা ওয়ে নিজের ব্যাগ নিজেই গোছাও।

_ প্লিজ গুছিয়ে দাও না।

_ অলসতা ভঙ্গুর মানসিকতার সৃষ্টি করে। গুছিয়ে নাও।

ঝিল আলসেমি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো । রাগ দেখিয়ে অভিনবর ব্যাগের সব কাপড় বের করে নিলো। হতবাক অভিনব , কিছু না বলে গোছাতে গেলেই ঝিল বাঁধা দিয়ে বলল
_ দুটোই আমি গোছাবো।

অভিনবর সরে গেল । ঝিল যত্ন নিয়ে দুটো ব্যাগ ই গোছালো।

খুলনার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে দুজনে । খানিক টা অপরিচিত ভাব নিয়েই হাঁটছে । সেই প্রথম দিন গুলো ফিরে পেতে চায়। যখন ওদের বিয়ে হয়েছিলো। সেই দিন গুলো সত্যি ই খুব মনোমুগ্ধকর। শুধু অনুভূতি গুলো আলাদা। তখন চাইতো মুক্তি আর এখন দুজন দুজনার শক্তি । ভালোবাসা গুলো এমনি হয়। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয় তবে ভালোবাসার ক্ষেত্রে সম্পূর্ন ভিন্ন। ব্যতিক্রম আছে তবে তাঁতে কি যায় আসে ?
ভালো খারাপ মিলিয়েই তো মানুষ ? যদি কেউ 51% ভালো হয় তাহলেই সে যোগ্য। কারন মানুষের ভালো দিক গুলোই বেঁচে থাকার অবলম্বন।

দুজনে একটা রেসট্রন এ চলে আসলো । রেসট্রন টা মূলত কাবাব নিয়ে। নানা রকমের কাবাব রয়েছে এতে। অভিনব মেনু কার্ড টা এগিয়ে দিলো। ঝিল বেশ ভেবে চিন্তে অর্ডার করলো। কোরাল মাছের কাবাব , জালি কাবাব , চিকেন পকোড়া আর রায়তা।
সাথে দুটো ধোঁয়া উঠা কফি ও নিয়ে নিলো। অভিনব এক গাল হেসে বলল
_ কাবাব কি শুধু শুধু খাবে ?

জ্বিভ কাটলো ঝিল । কথা কাটাতে বলল
_ আসলে আমি অতো টা ও খারাপ নই যে একাই অর্ডার করবো। তাই তোমার জন্য বাকি মেনু রেখে দিয়েছি।

_ কথায় হারাতে পারবো না তোমায়।

ঝিল বেশ ভাব নিয়ে হাসলো। অভিনব কাবাবের সাথে খাওয়ার জন্য বাটার নান আর লুচি নিয়ে নিলো।

মিনিট পনের পর খাবার দিয়ে গেল। দুজনে পেট পুরে খেলো। অভিনব বেশ অবাক হলো। কারন ঝিল আজ অনেক টা খেয়েছে।

বিল পে করে উঠে দাঁড়ালো। ঝিলের মন খারাপ। অভিনব সে দিকে পাত্তা দিলো না। কারন বাসে উঠতে হবে। ভাগ্য ক্রমে আজ ও বাসের লাস্ট সিট পেল । অবশ্য ভালো ই হয়েছে এতে। দম ফেলে ব্যাগ গুলো রেখে দিলো।
_ মন খারাপ কেন ঝিল ?

_আমরা আলাদা হয়ে যাচ্ছি অভিনব। সে দিকে খেয়াল আছে ?

_ এমন কেন বলছো ? আমরা মাস খানেক এর মধ্যে ই সম্পূর্ন এক হয়ে যাবো। মামা বাড়ির ভেজাল টা মিটিয়েই আমি তোমাকে নিয়ে যাবো।
দেড় বছর দূরে রেখেছি বলে ভেবো না এখন ছেড়ে দিবো।
একদম নিজের কাছে লুকিয়ে রাখবো তোমায়।

হাসি কান্নায় ভেঙে পরলো ঝিল । অভিনবর পেটে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। কষ্ট হচ্ছে খুব । অভিনবর থেকে দূরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বড্ড মায়ায় জড়িয়ে গেছে।
বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে গেছে। সারাক্ষণ ভয় হচ্ছে হারিয়ে ফেলার ভয়।

** আমার পরবর্তী গল্প অব্যক্ত প্রিয়তমা ।

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here