গোধূলিলগ্ন ২৫

0
347

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ২৫

“আমার দুচোখ ভরা স্বপ্ন,
হতে চাই তোমাতে বিভোর,তোমাতেই মগ্ন।
দিনের একটা সময়ে থাকতাম বড্ড উদ্বিগ্ন,
শুধুই তোমাকে পাওয়ার খোঁজে,
হাতছানি দিয়ে ডাকে আমায়, সেই না গোধূলিলগ্ন।

আর কি কখনো পাবো তোমায়,চেনা সেই সুরে?
তোমার হাসির মায়ায়,হারাবো কি বহুদূরে?
ডুব দিতে চাই তোমায় নিয়ে,মন গহীনের গাঙে,
স্বপ্ন সবই মিথ্যে হলো,চোখের পানি গলে।
আপন সুখে পাড়ি দিলে, সঙ্গী হলো অন্য,
তাইতো তুমি এতো দূরে,করে এ হৃদয় ছিন্নভিন্ন।
হাতছানি দিয়ে ডাকে আমায়, সেই না গোধূলিলগ্ন।

দিব্বি আছো ফেলে আমায়,বিষাদময় মরীচিকায়,
চাইলেও ভুলিতে পারি না আমি, কাটানো সেই সময়।
কাটার মতো বিঁধে রইল ভয়ংকর ওই প্রলয়,
সেই কাটা পারবে না কেউ তুলতে,
কারণ!আমার সবটা জুড়ে শুধুই তুমিময়।
হৃদয় আমার একলা নয়,যোগ হলো সাথে ভগ্ন,
হাতছানি দিয়ে ডাকে আমায়, সেই না গোধূলিলগ্ন।

সুযোগ কি আর পাবো না আমি?
পাবো কি নাগাল তোমার?
হাজারো ব্যথার ভীড়েও এ মন,নেভাতে চায় যন্ত্রণাময় এ হৃদয়ের দহন।
জানি সে দহন খুবই তীক্ষ্ণ। তবুও,
হাতছানি দিতে ডাকে আমায়, সেই না গোধূলিলগ্ন।

বেহায়া বলো,নির্লজ্জ বলো,কিংবা রাস্তার কাঙাল।
তবুও সেই একই সুরে বাজাবো বাঁশি,হয়ে তোমার রসিক রাখাল।
বেহায়া মন এখনো আগের পথেই,
হাঁটিনি পথে অন্য,
হাতছানি দিয়ে ডাকে আমায়,সেই না গোধূলিলগ্ন।”

মিনিট পাঁচেক হলো উপরোক্ত কবিতাটি কাব্য তার টাইমলাইনে পোস্ট দিয়েছে। পোস্ট হওয়ার সাথে সাথে রাত্রির আইডিতে নোটিফিকেশন আকারে চলে এলো সেই পোস্ট। একবার,দুইবার,তিনবার, না জানি কতবার কবিতাটি পড়ে ফেলেছে রাত্রি। প্রতিবার আলাদা আলাদা প্রশ্নের স্বাদ পেয়ে মাথা টনটন করে ওঠে। দুর্বোধ্য রহস্যের মায়াজালে চোখ কুঞ্চিত হয়ে আসে। এরই মধ্যে কাব্যকে চোখের সামনে আবিস্কার করে। কাব্য দুজন কলিগের সঙ্গে গভীর আলোচনায় মত্ত। রাত্রি দৃষ্টি কাব্যর দিকে স্থির রেখে অস্ফুটস্বরে বলল,
‘স্যার বোধয় অফিসে বসেই পোস্টটি করেছেন। কিন্তু কেন? আজ সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ছাড়বো কিছু প্রশ্ন। গম্ভীর থাকা, হাসলে মনে হয় কৃত্রিম হাসি, হুটহাট গুম হয়ে যাওয়া, গুমোট ভাব নিয়ে চলা- এসবের মানে কি? আজ আমার চাকরি গেলে যাক, তাও আমি জিজ্ঞেস করবোই। কিন্তু এখন একটা কমেন্ট করতে হবে। এটাকে সূত্র বানিয়ে বাকী কাজ করা যাবে।’

রাত্রি অনেক ভেবে একটা মন্তব্য খুঁজে পেল। সঙ্গে সঙ্গে টাইপ করে পাঠিয়েও দিল। তারপর অপেক্ষা করতে থাকল কাব্যর প্রতিত্তোরের।

কাব্য কিছুক্ষণ আগে কলিগদের সঙ্গে লাঞ্চ করেছে। সবেমাত্র তার ক্যাবিনে এসে বসল। এরপর ফোন হাতে নিয়ে কাউকে বলল একটা কোল্ড কফি দিয়ে যেতে। চোখের চশমাটা খুলে চুল গুলোয় হাত চালিয়ে ঠিক করে নিল। তারপর পুনরায় ফোন হাতে নিয়ে ডাটা অন করতেই কিছু সংকেত ধ্বনি বার্তা ফেসবুক বিজ্ঞপ্তি আকারে ভেসে ওঠে। সবকিছু সাধারণের মধ্যে পড়লেও তন্মধ্যে রাত্রির পক্ষ থেকে আসা মন্তব্যটি কাব্যর ভাবনায় নাড়া দিল। মন্তব্যটি ছিল এমন ”ডিপ্রেশন ইস দা হরিবল টর্চার।” কাব্য ভেবে পেল রাত্রির মন্তব্যের উদ্দেশ্য। পরক্ষণেই তা উপেক্ষা করে অন্য কাজে মন দিল। আজ তেমন কাজের চাপ নেই। কাব্য ছুটির পর রোজ জিমে যায় শুধু শুক্রবার ব্যতীত। যদিও আজ বুধবার, তবুও আজ জিমে যাবে না বলে মনস্থির করল। একটু সতেজ নির্মল পরিবেশে ঘুরাঘুরি করার ইচ্ছে আছে। বেরোবার আগ মুহুর্তে কাব্যর ক্যাবিনে গেল রাত্রি। কাব্যই প্রথমে বলল, ‘বাড়ি চলে যাননি এখনও? কিছু দরকার?’

রাত্রি হাতের নখ খুটতে খুটতে বলল, ‘স্যার আমার অনেক প্রশ্ন আছে। জানি আপনি রাগ করবেন, কিন্তু প্রশ্নগুলো আমাকে ঘুমোতে দেয়না। খুব ভাবায়। আমি, আপনি আর সাজিদ একটা টিম বলা যায়। আমরা অনেক জায়গায় একসঙ্গে গিয়েছি। অনেক পরিস্থিতি একসঙ্গে সামাল দিয়েছি। একে অপরের পরিপূরক হয়েছি।’

‘তো?’ বলল কাব্য।

‘তো একসঙ্গে চলাফেরা করলে কার মনে কি চলে তা একটু হলেও আন্দাজ করা যায়। যেমন সাজিদ চটপটে টাইপের৷ কথা বেশি বলে। মনে যা থাকে সব প্রকাশ করে ফেলে। এমনকি পার্সোনাল বিষয়গুলোও। আর আমি পার্সোনাল ছাড়া প্রায় সবই বলে থাকি। কিন্তু আপনি কোনটাই বলেন না। কিছু কথার পরিপ্রেক্ষিতে মুচকি হাসেন নইলে তা কৌশলে ইগ্নোর করেন। এটা কেন করেন স্যার? আমাদের মতো খোলা মনে কথা কেন বলেন না? আপনার গাম্ভীর্যের কারণ কি? আপনি কি কোন কারণে ডেস্পারেট? ডিপ্রেশনে ভুগছেন কি?’

কাব্যর মুখশ্রী জুড়ে স্বাভাবিকতা। আজ ভালো খারাপ কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বরং বলল, ‘আপনি শুনে কি করবেন? আমার ব্যর্থতার হৃদয় বিদারক গল্প নাহয় অজানাই থাক।’

রাত্রির বুক মোচড় দিয়ে ওঠে কাব্যর শেষ কথায়। কিছুটা আন্দাজ করে ফেললেও ভাবভঙ্গিতে কোনরূপ প্রভাব ফেলেনা। রাত্রি গলায় কৌতূহল ঢেলে বলল, ‘আমাকে বলবেন স্যার? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। আপনাকে খুব বেশি শ্রদ্ধা করি বিধায় আপনার চাপা কষ্টগুলো নিয়ে একটু ভাবি। একটু বেশিই ভাবি বলতে পারেন। বলুন না স্যার, কি নিয়ে এত দুঃখ আপনার। মনে রাখবেন, দুঃখ ভাগ করলে মন হালকা হয়৷ আজ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েন না। প্লিজ স্যার!’
***
রোজকার তুলনায় রোদের উত্তাপ কিছুটা হলেও কম। দূর থেকে ভেসে আসা নাম না জানা পাখির ডাকে নিস্তব্ধ দুপুর প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। মায়া বিদ্যালয় থেকে ফেরেনি, তবে ফেরার সময় ঘনিয়ে। মিতু গোসল সেরে ভেজা কাপড় হাতে এগিয়ে আসছে কলপাড় হতে। উঠোনে কাপড় নাড়ার জন্য লম্বা একটা দড়ি টানিয়ে রাখা। কাপড় নেড়ে পাশে ঘুরতেই চোখের সামনে অচেনা দুটো লোকের প্রতিচ্ছবির দেখা মেলে। হঠাৎ দেখে আঁতকে উঠল মিতু। দ্রুত হাতে মাথায় আঁচল টেনে বলল, ‘কে আপনারা?’

বাদশা হাসি মুখে দু কদম এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘আপনার নাম মিতু তাইনা?’

মিতু বলল, ‘জ্বি, কিন্তু আপনি আমারে চেনেন কি কইরা? আমি তো আপনারে কোনদিন দেহি নাই।’

‘সেকি! সেদিন আমার চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেন, আর বলছেন আমাকে কোনদিন দেখেননি!’

‘কোনদিন দেখছি?’

‘এইতো গত পরশু। পুকুর পাড় থেকে কলসি ভরে পানি নিয়ে আসছিলেন, আর আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। মনে পড়েছে কি?’

মিতু সময় নিয়ে ভাবল। ভেবে বলল, ‘আমি ব্যাটা মানুষগো দিকে তাকাই না রাস্তা দিয়া হাঁটলে। দেখলেও আমার মনে নাই।’

‘আচ্ছা সমস্যা নেই। আমি হচ্ছি শিমুলতলী গ্রামের চেয়ারম্যানের বড়ো ছেলে বাদশা শেখ। গ্রামে থাকিনা তাই খুব একটা কেউ চেনে না আমাকে।’

মিতুর মনে পড়ল গতকালের ঘটনা। আনিসুলের মুখ থেকে সে বাদশা সম্পর্কে শুনেছিল। রাগে মিতুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ফেটে পড়ছে। সে চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘আপনি যেই হন, এইহানে আপনার কাম কি? আমার স্বামী বাইত্তে থাহে না। হেরে রাইত ছাড়া পাওন যায়না বেশি একটা। আমার ধারে কেউ আইবেন না কোন কিছু লইয়া। কি পাইছেন আপনারা আমারে?’

বাদশা মিতুর কঠিন কথার পৃষ্ঠে হেসে ফেলল। বলল, ‘এত রাগ মেয়েদের শোভা পায়না। শান্তশিষ্ট ভাবে যদি কথা বলতেন একটুখানি।’

‘কোন কথা হুনতে চাইনা আমি। আপনার বাপের সম্মান নষ্ট হওয়ার আগে চইল্যা যান কইতাছি। আমি কিন্তু খারাপ একজন মানুষ। কাউরে ছাড় দেইনা। আপনাগো মতো বদের হাড্ডিগো তো পারিনা পিষ্যা ফেলতে। পারলে সময় নিতাম না।’

মুহুর্তেই বাদশার কপালের রগ ফুলে উঠল৷ তিনি বাজখাঁই কন্ঠে বললেন, ‘এত দেমাগ কিসের হুম? রক্ত সবসময়ই গরম থাকে নাকি! রুপের অহংকার করিস? তোদের মতো মেয়েদের দিকে টাকা ছুড়লে আমার পা চেটে কূল, দিশা পায়না। আর তুই কিনা চোখ রাঙাস! আরেকবার বলছি আমার কথা শোন, নইলে ফলাফল ভালো হবে না।’

মিতু হঠাৎ নরম কন্ঠে বলল, ‘এত রাগেন ক্যান ভাইসাব? আচ্ছা, আপনি দাঁড়ান আমি দুইখান চেয়ার আনি। বইয়া কথা কইয়েন। এমন বড়ো মাপের মানুষ দাঁড়াইয়া কথা কইলে কেমন যেন ঠেকে। আইতাছি আমি।’
এক নিশ্বাসে বলে চলে গেল মিতু। বাদশা রাজকীয় ভাব নিয়ে গোঁফে হাত চালায়। কিছুক্ষণ পর মিতু চলে আসে। তবে সঙ্গে চেয়ার ছিল না। একহাত মুষ্টিবদ্ধ করে পেছনে ঠেকানো। আরেকহাত শাড়ির একপাশ খামচে ধরা। বাদশার সিকিউরিটি লোকমান বাদশার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘বস, এনার হাতে চেয়ার কোথায়? আমার মনে হয় কোন মতলবে আসছে। আক্রমণ হওয়ার আগে চলুন পালাই।’

বাদশা বেশ ভাব নিয়ে বলল, ‘কি করবে এই সহজ-সরল গ্রামের বধূ। কিছু করলেও একে আমি ছেড়ে দেব নাকি? কড়ায়-গণ্ডায় হিসেব নিয়ে তবেই ছাড়ব। যদিও এটাকে ছাড়ার ইচ্ছে নেই। এটা তো আমার সোনার ডিম পাড়া হাঁস হবে।’

মিতুর কান অবধি সেই ফিসফিসানি ঢোকেনি বোধয়। তবে কান খাড়া করে শোনার প্রচেষ্টা জারি আছে। সহসাই বাদশা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘কোথায় চেয়ার? চেয়ার আনার কথা ছিল আপনার।’

মিতু বলল, ‘চেয়ার আনুম, আর তোগো লাইগ্যা! তোগো জন্য অন্য জিনিস আনছি।’ কথাটা বলে লুকিয়ে রাখা হাতটি সামনে আনলো৷ এরপর হাতে থাকা লাল টকটকে শুকনো মরিচ গুঁড়ো ছিটিয়ে দিল বাদশা ও লোকমানের মুখের দিকে। চোখে প্রবেশ করায় ঝালে জ্বলতে শুরু করে দিল তাদের চোখ। বাদশা ও লোকমানের চিৎকারে মিতুর ঠোঁটের আলিজে হাসি ফুটল। তারা পারছে না মাটিতে গড়াগড়ি করতে। পানি, পানি করে তাদের যায় যায় অবস্থা হলো। মিতু তখনও তৃপ্তির হাসি দিয়ে চলেছে। একটা সময় বলল, ‘পানি আনি দাঁড়ান আপনারা।’ মিতুর এইটুকু কথায় বাদশা ও লোকমান উভয়ই নাক-মুখ বুজে এলোপাথাড়ি পা চালিয়ে পালালো। যাবার সময় বাদশা বলতে বলতে গেল, ‘তোর খবর আছে বলে রাখলাম। এর শোধ আমি নেবই নেব।’

মিতু তা উপেক্ষা করে হাত ঝাড়ল৷ বলল,
‘কাউরে ছাড়ুম না এহন থেইক্যা। এই মিতু কাউরে ভয় পায়না এক আল্লাহ ছাড়া। আজরাইলরেও না। সম্মান বাঁচাইয়া চলছি দেইখ্যা আমারে বলদ পাইছে বেবাকে। মাইয়া মানুষ দেইখ্যা আমি কি মানুষ না? স্বামীরেও ছাইড়া দিমু এহন থেইক্যা। স্বামী না থাকলে কি হইব? কিছুই না। আমার স্বামী সংসারের নাম ডুবাইছে দেইখ্যা অনেক মানুষ সুযোগ পাইছে। লাগবো না স্বামী টামি। খেতায় আগুন ওইরহম স্বামীর। মিতু তার মাইয়ারে লইয়াই বাঁচতে পারব। আহুক নুরুল। আমার মাইয়ারে আর আমারে মাইরা ফাঁসিতে ঝুলব হেয় না! ওরে ঝুলামু বেশি কইরা। গরু জবাই দেওয়া চাপাতি ধার দিয়া রাখছি। আইজ আহুক খালি বাইত্তে। ওর মাথাখান ওর কূটনী মার হাতে ধরায় দিতে পারলে আমার শান্তি লাগতো, শান্তি!’
চলবে ইনশাআল্লাহ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here