গোধূলিলগ্ন ১৪

0
471

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ১৪

পরবর্তী ছয় দিনেও শুকালো না মিতুর চোখের পানি। কোমায় চলে যাওয়া মানুষদের ন্যায় শান্ত হয়ে গেছে মিতু। গাছপালা, লতাপাতা, আকাশ-বাতাস,আলো-অন্ধকার সবকিছুই মিতুর অসহ্য লাগছে। তেল বিহীন উষ্কখুষ্ক চুল। মুখ ফ্যাকাসে। কাব্য মিতুর থেকে সামান্য কয়েক হাত দূরে বসে দেখছে চেয়ে মিতুর মলিন মুখটি। নয়নার মৃত্যুর পর থেকে মিতু কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। ঘরে বসে থাকলে দম বন্ধ লাগে তার। বুক ফেটে কান্না আসে। যা সকলের সামনে প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই সে সবসময় সকলের থেকে আড়াল করার চেষ্টা করে নিজেকে। কাব্য প্রতিদিন একা একাই বকবক করে মিতুকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। কিন্তু সফল হয়না। তবুও কাব্য হার মানে না।

‘আর কতদিন এভাবে নিষ্প্রাণ ও নিষ্প্রভ লোকেদের মতো চুপ করে থাকবি শুনি? কথা বল না মিতুবুড়ি। একটু কথা বল। হঠাৎ কার মৃত্যু কখন, কিভাবে হয়ে যায় তা বলা অসম্ভব। প্রকৃতির খেলাই হচ্ছে জন্ম ও মৃত্যু। প্রতিটি মানুষ এই দিন দুনিয়ার সংসার নামক মায়া ত্যাগ করে এবং করবেই। একদিন তুইও করবি,আমিও করবো। কারো মৃত্যুতে কেউ থেমে থাকে না। থাকতে পারে না। জীবন যুদ্ধ কাউকে থেমে থাকতে দেয়না। আজ নয়না যদি থাকতো, তাহলে তোকে এভাবে দেখতে পারতো না। ইভেন এখনো পারছে না। নয়নার জন্য হলেও কথা বল। মন খুলে কথা বল। দেখবি মন হালকা হয়ে যাবে।’

মিতু ধীরে ধীরে ওষ্ঠদ্বয় গুলো নেড়ে ভাঙ্গা গলায় বলল, ‘নয়না যদি বাঁইচ্যা থাকতো, তাইলে আমার এই হাল হইতো কি কাব্য ভাই?’

‘তোকে আমি কিভাবে বোঝালে তুই বুঝবি বল? নয়নার মৃত্যুতে আমিও খুব ব্যথিত। মানছি তোর মতো নয়। কিন্তু তবুও আমি যতটা অনুভব করছি তার জের ধরে বলতে পারবো যে আমি সত্যিই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে খুবই ব্যথিত। তবে বাস্তবতা মেনে নিতে হবে আমাদের। এভাবে দিন যাবে না। বুঝলি?’

‘আমার যে কিছুই বুঝতে মন চায়না কাব্য ভাই। তুমি জানো না আমার কি হারায় গেছে। আমার সব থেইক্যা বড়ো ভরসা হারায় গেছে। আমারে কেউ কিছু কইলে আমার পাশে দাঁড়ানোর মতো সেই মাইয়াডা আর রইলো না। আমার হইয়া প্রতিবাদ করার মতো সেই নয়না নামের মাইয়াডা আর নাই আমাগো মাইধ্যে। আমি যে এই কথাডাই মানতে পারতাছি না। কি করলে যে আমি শান্তি পামু জানি না সেইডা। আমি যে আমার মনরে বুঝাইতে পারতাছি না কাব্য ভাই।’

কাব্য নিস্তেজ গলায় বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি তোর মনের অবস্থা।’

‘কিছুই বুঝতে পারতাছো না তুমি। কিছুই না। আমার কষ্টখান আমি নিজেই বুঝতে পারতাছি না, তাইলে তুমি কেমনে বুঝবা কাব্য ভাই?’

‘তুই এখন কি চাস বলবি আমাকে? কি করলে তোর মন ভালো হবে বলতে পারিস? আমি তাই করার চেষ্টা করবো।’

‘আমি যেইডা চাই, সেইডা কাইন্দা মইরা গেলেও আর পামু না। কিন্তু একটা জিনিস পাওয়ার আশা আছে আমার।’

‘কি সেটা? বল আমায়। আমি চেষ্টা করবো দেওয়ার।’

‘শাস্তি! আমি শাস্তি চাই সেই কুত্তার মতো নিকৃষ্ট মানুষের। যে আমার কাছ থেইক্যা আমার নয়নারে কাইড়া নিয়া গেল। তারে আমি ছাড়মু না। তার শইল্লের প্রতিডা অঙ্গ কাঁচি দিয়া টুকরা টুকরা কইরা কাটতে পারলে আমার শান্তি লাগতো। তার শইল্লের রক্ত দিয়া নাইতে পারলে আমার শইল্লের জ্বালা মিটতো।’

মিতুর চোখের সাদা অংশটুকু লাল বর্ণ ধারণ করে নিয়েছে। সেই লাল বর্ণের উপর থেকে পানি টলমল করছে। নাক মুখ দিয়ে প্রতিশোধের আগুন ছুটছে যেন। এবার কাব্যও জ্বলে ওঠে মিতুর কথার তালে।

‘ঠিক বলেছিস। ওই মানুষরূপী নরপশুকে সামনে পেলে জ্যান্ত মাটি দিয়ে দিতাম। তারপর আমার যা হয় হতো। এসব লোকের বাঁচার কোনো অধিকার নেই।’

মিতু বিচলিত হয়ে বলল, ‘তুমি তারে আমার কাছে আইন্যা দিতে পারবা কাব্য ভাই?’

কাব্য মাথা নুইয়ে ক্ষীণ গলায় বলল,
‘আমি যে এখন কিছুই করতে পারবো না রে মিতুবুড়ি। সত্যি বলছি, আমি কিছু করতে পারলে এভাবে বসে থাকতাম না। আমার যে এখন কোনো ক্ষমতা নেই রে। তবে একদিন পারবো। একদিন মস্ত বড়ো এক সাংবাদিক হয়ে এসব শয়তানদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করবো। পৌঁছে যাব সমস্ত নিপীড়িত জনগণের কাছে। তাদের সকল খবরাখবর তুলে ধরবো জনসম্মুখে। তাদের হয়ে লড়াই করবো। গ্রামীণ অজপাড়াগাঁয়ের নকশা পাল্টে দেব। সাহায্য চাইবো সরকারের কাছে। এটাই যে আমার বাবার সবচেয়ে বড়ো স্বপ্ন। সাথে আমারও।’

‘এহন কি এমন কেউ নাই কাব্য ভাই? তুমি যেমন সাংবাদিক হইতে চাও, তেমন সাংবাদিক কি এহন একটাও নাই দুনিয়াতে?’

‘জানি না। তবে যদি থাকতো, তাহলে আজ পুলিশ এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতো না। কোনো না কোনো মিডিয়ার লোক এসে পাশে দাঁড়াতে পারতো। কিন্তু কেউ আসলো না। টাকা ছুড়লে অবশ্যই হাজারো সাংবাদিক এসে হুড়মুড়িয়ে পড়তো। আর নয়নার ঘটনাটি টিভিতে সম্প্রচার করা হতো। সেটা দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়তো। ফলে নয়না ন্যায় বিচারও পেতো আশা করা যায়। কিন্তু দেখ, টাকার অভাবে তা আর হলো না। সেই সামর্থ্য যে অজপাড়া গাঁয়ের মানুষদের নেই। আফসোস! মুখে বললেও পুরোপুরি ভাবে আমাদের দেশটা এখনো স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি। পারলে সেবার নামে এভাবে নিরীহ মানুষের কাছ থেকে টাকা নিতো না ক্ষমতাসীন লোকেরা। আমি যদি একদিন সাংবাদিক হতে পারি, তাহলে অবশ্যই প্রথমে সেইসব পুলিশ দারোগাদের আসল রুপ তুলে ধরবো। যারা চেনে শুধুই টাকা।’

‘ঠিক কইছো কাব্য ভাই। দেখলা না কেমনে নয়নার লাশ লইয়া পুলিশ ব্যবসা শুরু করছিল? খুনিরে বাইর না কইরা তারা লাশ লইয়া পইড়া ছিল। টাকা না দিলে লাশ দিব না। টাকার লাইগ্যা নয়নার খুনির তল্লাশিও করলো না। হেরা মুহের উপর কইয়া দিছে ৫ লাখ টাকা ছাড়া খুনের তদন্ত করবো না। এতগুলান টাকা আমাগো মতো গরীবরা কই পাইবো কওতো?’

কাব্য চকিত ভঙ্গিতে বলল,’কি বলছিস! এসব বলেছে? তদন্ত কেন করবে না? এভাবে একটা ক্রাইমকে মাথায় চড়ালে, দেখা যাবে পরবর্তীতে অন্য কাউকে এই নির্মম পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয়েছে। যেমনটা নিষ্পাপ, নাবালিকা নয়না হলো।’

‘এত টাকার জুগাড় করতে পারে নাই বইল্যাই আইজ আমার নয়নার খুনিরে পুলিশে খুঁইজ্যা বাইর করতাছে না।’

‘আসল কথা হচ্ছে তারা এই কেসটাকে ধামাচাপা দিতে চাচ্ছে। তাইতো এরকম একটা শর্ত ছুড়ে দিয়েছে। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো এক রহস্য লুকিয়ে আছে। আমার শুধু একটাই খেদ, আজ সঠিক সুশাসনের অভাবে আমাদের মতো অজপাড়া গাঁয়ের লোকেরা ন্যায্য বিচার পাচ্ছে না। এই গ্রামে নেই একজন ভালো চেয়ারম্যান, নেই সৎ পুলিশ কর্মকর্তা, নেই কোনো দায়িত্বশীল সাংবাদিক। যার ফলে হতদরিদ্র পরিবারের লোকজন এতো ভোগান্তি সহ্য করছে, তাও আবার দিনের পর দিন। সভ্যতার বিকাশ কিভাবে হবে? এভাবে ক্রাইমকে উসকানি দিয়ে! নাকি হতদরিদ্রদের দমিয়ে রেখে? আমরা কবে পাবো ন্যায্য বিচার? কবে প্রকৃত স্বাধীনতার মুখ দেখবো আমরা? কবে,কবে?’

‘তুমি ঠিক কইতাছো কাব্য ভাই। কিন্তু কইয়া আর কি হইবো? মানুষ তো আর বদলাইবো না। ওগোরে শাস্তি না দিলে কহনোই স্বাধীন দেশের মুখ দেখতে পারুম না আমরা।’

‘হুম ঠিক। যেদিন মানুষের মনের বিকাশ হবে, ওইদিনই সম্ভব এটা। তাছাড়া নয়। তুই এখন সব দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যা। আমি যে তোকে এই অবস্থায় দেখতে পারছি না। দয়া করে আর মনমরা হয়ে থাকিস না।’

মিতু বিষন্ন গলায় বলল, ‘সবাই এই এক কথাই কও খালি। বাইত্তে বুবু আর এইহানে তুমি। বুবুও কম বুঝায় না আমারে। বুবু কয় কয়ডা দিন তার শ্বশুরবাড়ি যাইয়া বেড়ায় আইতে। তাইলে নাকি আমার মন ভালো হইবো। কিন্তু আমি জানি আমার মন আর কোনদিনও ভালো হইবো না।’

‘একদম ঠিক বলেছে সেতু। তুই তাই কর। কটা দিন ঘুরে আসলে মন হালকা হবে তোর। নতুন কিছু দেখলে মন মানসিকতায় পরিবর্তন আসে।’

‘আমার যে নয়নার কাছে যাওনের লাইগ্যা মন কান্তাছে। আমি যে বাঁচতে চাইনা আর।’
বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে মিতু। কাব্য মিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর বলল,
‘আমরা জীবন নায়ের মাঝি। যে মাঝি বইঠা দিয়ে দিক পরিবর্তন করতে পারে ঠিকই। কিন্তু সাগর-নদীর সাথে যুদ্ধ করতে পারে না। পারে না ঢেউকে বশে আনতে। ঠিক সেভাবে আমরা যতই নিজ খেয়াল মতো চলি না কেন, মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে পারবো না। মৃত্যু সময়ের দাস। সময় তাকে টেনে আনবে,আমরা নই। তাই এটা মুখে বলাও গুনাহ। মৃত্যুকে মেনে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। তবে মৃত্যু কামনা করে হেরে যাওয়া মানে সরাসরি নির্বোধের খাতায় নাম লেখানো। আমদের উচিত আপন লক্ষ্যে স্থির থেকে সামনে এগিয়ে যাওয়া। কবে,কখন মৃত্যু ঘনিয়ে আসবে সেটা নিয়ে পরে থাকা নয়। সত্য কখনো চাপা থাকে না। দেখবি, একদিন না একদিন নয়নার খুনি সামনে আসবেই আসবে। তুই কি নয়নার খুনির শাস্তি না দেখেই মরতে চাস?’

মিতু কান্না থামিয়ে মাথা তুলে তাকালো। সহসা মিতুর চোখে মুখে অদম্য মনোবল ফুটে ওঠে। মিতু দাঁতে দাঁত চেপে ধরে বলল, ‘তুমি ঠিক কইছো কাব্য ভাই। আমারে বাঁইচ্যা থাকতে হইবো। নয়নার খুনির শাস্তি দেহার লাইগ্যা হইলেও আমারে বাঁইচ্যা থাকতে হইবো। শেষ নিশ্বাস তরি আমার এই আশাডা থাকবো। আমি এর শেষ না দেইখ্যা মরার আশা করমু না আর।’

কাব্য কিঞ্চিৎ হেসে বলে, ‘এইতো সঠিক লাইন ধরতে পেরেছিস। এভাবেই সাহস রেখে মনোবল দৃঢ় রাখার চেষ্টা করবি।’

‘তুমি সবসময় আমার পাশে থাকবা তো কাব্য ভাই? তুমিও নয়নার মতো আমারে একা কইরা চইল্যা যাইবা না তো?’

‘ইচ্ছে নেই রে। আমি সবসময় তোর সাথে থাকবো ইনশাআল্লাহ। একেবারে ছায়া হয়ে। আর যদি কখনো কোনো সমস্যায় পড়ে তোর পাশে থাকতে না পারি, তবুও তুই থেমে যাবি না। হার মানবি না। ভেঙে পড়বি না। সবসময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানটি মাথায় রাখবি।’

মিতু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শুধাল, ‘কি গান কাব্য ভাই?’

কাব্য কন্ঠে সুর মিশিয়ে বলল, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে। একলা চলো,একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’
চলবে ইনশাআল্লাহ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here