গল্প: #মেহেরিন
২য় পর্ব
ফটো অ্যালবাম হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হচ্ছি এমন সময় এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলাম। মনে হল ঘরের আয়নাতে একটা মেয়েকে দেখলাম। পেছনে ঘুরে আয়নার দিকে তাকাতেই আমি একদম স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কে এই মেয়েটা? এটা তো আমি নই। আশ্চর্য! আমি দেখতে এমন হয়ে গেলাম কীভাবে! এটা তো অসম্ভব। আমার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। এখন তো আমার পরিবারের মানুষেরাও আমাকে চিনবেনা। কী করবো আমি..!!
আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবছি এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব। এটা অবশ্যই বাস্তব। কিন্তু আমার চেহারা তাহলে এমন বদলে গেল কীভাবে! এই জন্যই তারা আমাকে ঐ বাড়ির বউ মনে করছে। আমি আলভীর বউ এর মত দেখতে হয়ে গেলাম কেন? আর আলভীর আসল বউ তাহলে এখন কোথায় আছে? উফফ্, এত টেনশন নিতে পারছিনা। আমিতো এখন এটাও প্রমাণ করতে পারবোনা যে আমি মেহেরিন না। আমাকে আবার এখন সেই বাড়িতে ফিরে যেতে হবে। তারপর কি যে হবে ভাবতেই পারছিনা। আর এতদূর নিয়ে এসে এখন আমি কি বলবো এদেরকে?
আমার দেরি হচ্ছে দেখে সবাই আমার রুমে চলে আসলো। মা বললো, “আরে তুমি কে? রুমের ভীতর চলে এসেছো আবার কীসব বলছো?” আলভীর মামা বললো, “তারা তো বলছে তুমি তাদের মেয়ে না। তাহলে আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছো কেন? আবার কী শয়তানি পরিকল্পনা করেছো বলতো।” আমার এখন কিছুই বলার নেই। আমাকে এবার জানতেই হবে ঐ বাড়িতে কি হয়েছে আর মেহেরিন নামের মেয়েটি এখন কোথায়। আমি যদি এখন প্রমাণ করতে যাই যে আমি এই বাড়ির মেয়ে তাহলে ঝামেলা আরো বাড়বে। মা-বাবাও আমাকে খোঁজাখুঁজি করে টেনশন করবে।
এমন পরিস্থিতির জন্য একদম প্রস্তুত ছিলাম না। কিছু একটা বলতে হবে। এমনিতেই তো সবাই আমার উপর অনেক রেগে আছে। এবার আরেকটু বেশি রাগলে কি আর হবে! আমি শুধু বললাম, “কিছু মনে করবেন না। ভুল হয়ে গেছে। একটু মজা করলাম।” এখন খেয়াল করে দেখলাম নিজের কন্ঠটাও অন্যরকম লাগছে। আমি আর কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠে চুপ করে বসে রইলাম। আনমনা হয়ে অনেক কিছু ভেবে যাচ্ছি। হঠাৎ কেউ আমার পাশে এসে বসলো। নিশ্চই শিপা এখন জানতে চাইবে আমি কেন কিছু প্রমাণ করতে পারিনি। সেই তো আমাকে এখানে আসতে সাহায্য করলো। যেহেতু কিছু প্রমাণ করতে পারিনি তাই এখন কথা না বলাই ভালো।
আমি শিপার দিকে না তাকিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছি। এবার যেন আরো বড় একটা ধাক্কা খেলাম। শিপা, আলভী আর আলভীর মামা মাত্র আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়ির দিকে আসছে। তাহলে আমার পাশে কে বসে আছে? আমি দ্রুত পাশে তাকাতেই দেখি আমার পাশে কেউ নেই। অথচ আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম কেউ আমার পাশে এসে বসেছে। কী হচ্ছে এসব! টেনশন এর সাথে এবার ভয়ও লাগছে। কাকে কী বলবো? সবাইতো ভাবছে শুধু আমি মিথ্যাই বলছি। হয়তো টেনশনে আমার সব এমন মনে হচ্ছে। তারা তিনজন এসে গাড়িতে উঠলো। কেউ বুঝতে পারছেনা আমাকে এখন কী বলবে। সবাই আমার উপর যেভাবে রেগে আছে তারমধ্যে এমন মজা করা কেউই মেনে নিবেনা।
আলভীর মামা আর শিপা রাগের মাথায় মুখে যা আসছে তাই আবোল তাবোল বলে যাচ্ছে। আমি কারো কথার কোনো উত্তর দিচ্ছিনা। আলভী চুপ করে বসে আছে। সে খুব গম্ভীর স্বভাবের ছেলে। রাগ জেদ নিজের মধ্যে চেপে রাখে, সহজে তা প্রকাশ করেনা। প্রকাশ না করলেও বুঝতে পারছি তার ভিতরে একটা ঝড় বইছে। আলভীর জন্য এখন আমার কি করা উচিৎ সেটাও বুঝতে পারছিনা। কি হচ্ছে তা ভেবে টেনশন এ মাথা ব্যাথা করছে। নাহ্, আর টেনশন করা যাবেনা। এবার ঠান্ডা মাথায় সবকিছু বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আমি কে সেটা সবাইকে বোঝানোর চেয়ে আমার সাথে কেন এমনটা ঘটছে তা খুঁজে বের করা এখন বেশি গুরুত্বপুর্ন। পৃথিবীটা রহস্যময় জগত। এখানে অলৌকিকভাবে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। আর আমার সাথেও এখন অলৌকিক কিছু ঘটছে। কিন্তু এরপর ভালো কিছু ঘটবে নাকি আমার কোনো বড় বিপদ হবে সেটাই জানিনা। এসব ভাবতে ভাবতে আলভীর বাসায় পৌঁছে গেলাম।
প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আলভীর আত্মীয়রা সবাই এখানেই আছে। আলভী তার রুমে চলে গেল। আমি ডিভোর্স না দেওয়ার জন্য এত সময় নষ্ট করেছি ভেবে সবাই বিরক্ত হলো। কেউ আর নতুন করে আমাকে কিছু বলেনি। শুধু নিজেদের মধ্যেই একটু বিরক্ত প্রকাশ করলো আর কালকের দিনের অপেক্ষায় আছে সবাই। আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। কালকে কী হবে তা ভাবছি। কার কাছে কি জানতে চাইবো কিছুই বুঝতে পারছিনা। হঠাৎ বাড়ির কাজের লোক এসে বললো, “ম্যাডাম, বড় আপা বলছে আপনি আজকে ঐ কোনার রুমে থাকবেন। চলেন আপনারে ঘর খুলে দেই।” এটা বলেই সে হাটা শুরু করলো যেন তারও আমার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই।
আমি আমার ব্যাগ নিয়ে তার সাথে যাচ্ছি। রুমের ভিতর ঢুকে লোকটি লাইট জ্বালাতে জ্বালাতে বললো, “আলভী স্যার আপনারে খুব ভালোবাসে। তারে এত কষ্ট না দিলেও পারতেন।” এই প্রথম কেউ আমার সাথে ভালোকরে কথা বললো। এর কাছেই জানতে হবে মেহেরিন আলভীর সাথে কি অন্যায় করেছে। আমি তাকে বললাম, “আলভী এত কষ্ট পাচ্ছে কেন?” লোকটি একটু চুপ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “নিজে স্বার্থপর হইছেন তো, তাই এহন অন্যের কষ্ট বুঝেন না। আপনি চাইলে আলভী স্যার এমনিতেই আপনারে সবকিছু দিয়ে দিত। কিন্তু আপনি মিথ্যা বইলা সব সম্পত্তি নিজের কইরা নিয়া অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক কইরা পালাইতে চাইছেন। ঐ ছেলে কী আপনারে আলভী স্যার এর মত ভালোবাসা দিতে পারবো? জীবনেও না। ভালোবাসার দাম দিলেন না। কত বড় ভুল করছেন একদিন বুঝবেন। সারাদিন তো কিছু খান নাই। আপনার জন্য খাবার নিয়া আসি।” এটা বলেই লোকটি আমার রুম থেকে চলে যাচ্ছে।
এতক্ষনে আমি বুঝলাম আমার দোষটা কি। একটা মেয়ে এতটা খারাপ হয়? আর সেই খারাপ মেয়েটির জায়গায় আমাকে কেন আসতে হলো! কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমাকে এমন বাজে একটা মেয়ের চেহারা নিয়েই থাকতে হবে? এখন তো সেই মেয়েটার উপর আমারো রাগ হচ্ছে। ভালোবাসা যত গভীর হয়, কষ্টের অনুভূতিটাও তত গভীর হয়। সেইজন্যই আলভী এত কষ্ট পাচ্ছে। আমি লোকটাকে ডেকে বললাম, “আলভী খেয়েছে?” সে পেছনে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “খায় নাই। খাবার দিয়া আসছি। আর একটা কথা। আপনি এহনো আলভী স্যার রে ভালোবাসেন। নাইলে তার খাওয়ার কথা জিজ্ঞাস করতেন না। এত সুন্দর একটা সম্পর্ক ভুইলা কেন যে স্বার্থপর হইলেন! এহন আমি যাই। বড় আপা আপনার সাথে কাউরে বেশি কথা কইতে না করছে।”
লোকটা চলে গেল। কিন্তু তার বলা কথাটা এখনো মাথায় ঘুরছে। আমি ঐ গম্ভীর ছেলেটাকে ভালোবাসি? অসম্ভব। হতেই পারেনা। কিন্তু, তাহলে তার খাওয়ার কথা জিজ্ঞাস করলাম কেন? তার দিকে তাকালেই আমার এত মায়া লাগে কেন? এটা শুধু মায়া নাকি অন্যকিছু? ধুর! এসব কেন ভাবছি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি! লোকটা তো মেহেরিন আর আলভীর ভালোবাসার কথা বললো। আমিতো শুধু মেহেরিন হয়ে এখানে ঝামেলায় আটকে গেছি। কিন্তু মেহেরিন এখন কোথায় আছে? সবাই জানে আমি মেহেরিন। কিন্তু আমিতো মেহেরিন না। আর তার ফোন আমার ব্যাগে আসলো কীভাবে? অনেক জটিল লাগছে সবকিছু। যদি কেউ আমাকে বলে দিত এখন আমি কী করবো তাহলে হয়তো একটু শান্তি পেতাম।
আমি ব্যাগ থেকে ফোনটা নিতে গেলাম। হয়তো ফোনের মাধ্যমে কোনো উপায় খুঁজে পেতে পারি। কিন্তু একি! ব্যাগের ভিতর কোথাও ফোন টা নেই। কেউ আমার ব্যাগ ধরেনি। তাহলে ফোনটা উধাও হয়ে গেল কীভাবে! সবকিছুই অদ্ভুতভাবে ঘটছে। কে ঘটাচ্ছে এতকিছু? উফফ, এসব ভাবলেই মাথায় খুব চাপ পরে। আবার কিছুটা ভয়ও লাগছে। অন্যকিছু ভাবতে হবে। একটু রিলেক্স দরকার। ভাবছি লুকিয়ে আলভীর সাথে দেখা করতে যাব। আলভীতো মেহেরিনকে অনেক ভালোবাসে, আবার কষ্ট পেয়ে এখন তাকে ঘৃনাও করে। আমি যদি এখন মেহেরিন হয়ে আলভীর কাছে গিয়ে তার সাথে মজা করি, তাকে বিরক্ত করি তাহলে তার রিয়েকশন কেমন হবে? সেই মেয়েকে তো ভালো করতে পারবোনা। কিন্তু কিছু সময়ের জন্য মেহেরিন হয়ে আলভীর সাথে ভালো ব্যাবহার তো করতে পারবো। এতে যদি আলভীর কষ্টটা একটু কমে তাহলে তো ভালোই হবে। কিন্তু আলভী আমাকে ভিতরে ঢুকতে দিবে কিনা সেটাই তো জানিনা।
আমি রুম থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে আলভীর রুমের সামনে গেলাম। দরজায় নক করতে গিয়ে দেখি দরজা খোলাই আছে। ভিতরে গিয়ে দেখি। আলভী চেয়ারে বসে আছে। তার চোখ ভেজা। আমাকে দেখেই সে চিৎকার করে বলছে, “তুমি এখানে…” সাথে সাথেই আমি তার মুখ চেপে ধরলাম আর বললাম, “প্লিজ, চিৎকার করবেন না। কেউ যদি দেখে আমি এখানে এসেছি তাহলে বাসার সবাই আমাকে খুব বকবে।” হঠাৎ খেয়াল করলাম আমি তার মুখ চেপে ধরে আছি। টেনশনে মাথা একদম ঠিক নেই। আমি দ্রুত হাত সড়িয়ে নিলাম। আলভী বললো, “কেন এসেছো এখানে?” আমি বুঝতে পারছিনা কী বলবো। কেন এসেছি সেটা নিজেই ভুলে গেছি। টেবিলে রাখা খাবারগুলো দেখে বললাম, “আপনি খেয়েছেন কিনা দেখতে এসেছি। এখনো খাননি কেন?”
আলভী বললো, “তুমি চলে যাও। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা।” বুঝলাম, আলভী মেহেরিন কে ঘৃনা করলেও ভালোবাসা এখনো কমেনি। নয়তো অন্য সবার মত আমাকে দশটা কথা শুনিয়ে এখন ঘর থেকে বের করে দিতো। হয়তো চোখের সামনে মেহেরিন কে অন্যভাবে দেখে তার ঘৃনা কিছুটা কমছে। কিন্তু ক্ষমা পাওয়ার মত কাজ মেহেরিন করেনি তা আমি জানি। আমিতো মেহেরিন না। আমি এখন কিছুক্ষন আমার মত থাকবো। আলভীকে খাবার খেতে বলছি। কিন্তু সে খাবেই না। আমি টেবিল থেকে খাবার নিয়ে বললাম, “চলে তো যাবই। কিন্তু যাওয়ার আগে আমার একটা শেষ ইচ্ছা থাকবেনা? আমি আজ আপনাকে খাইয়ে দিব।”
আলভী খেতে রাজি হচ্ছেনা। আমি এবার জোর করে আলভীকে খাবার খেতে বাধ্য করলাম। এমনভাবে রেগে গেলাম যে আলভী বাধ্য হয়ে চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা ছোট বাচ্চার রাগ ভাঙ্গিয়ে তাকে খাইয়ে দিচ্ছি। এর আগে আমি কখনো কাউকে এভাবে খাইয়ে দেইনি। এখানে যতক্ষন আছি আর কি কি করতে হবে কে জানে। হঠাৎ মনে পরলো ঐ কাজের লোকটা আমার জন্য খাবার আনতে গেছে। যদি এসে আমাকে রুমে না পায় তাহলে ঝামেলা হয়ে যেতে পারে। আমি আলভীকে বিদায় বলে দ্রুত আমার রুমে চলে আসলাম। আলভী চুপ করে দাঁড়িয়েই ছিলো। যে আলভীকে এত কষ্ট দিয়েছে হঠাৎ তার এমন ব্যবহার দেখে আলভীর মুখের অবস্থার কথা ভেবে আমার হাসি পাচ্ছে। রাগি চোখে চুপ করে কিছুক্ষন আমার দিকে কীভাবে তাকিয়ে ছিল। এসব ভেবে হাসতে হাসতে ঘরের দরজা বন্ধ করে এসে বিছানার উপর বসলাম।
আমার হাসি থেমে গেছে। কিন্তু এখনো কানে হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। আমি চমকে গেলাম। আশ্চর্য! আমিতো হাসছিনা। তাহলে কে হাসছে? মুহুর্তেই ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। ঘরের ঝাপসা আলোয় আয়নার দিকে তাকাতেই ভয়ে আমার মাথার ভিতর সহ পুরো শরীর কাঁপছে..!
লেখা: #Jasmine_Diya
সমস্যার সমাধান করতে সাথেই থাকুন..