#মনের_মানুষ
#সুচন্দ্রা_চক্রবর্তী
#পঞ্চম_পর্ব
অস্মিতার কথা বলার মতো অবস্থাই ছিল না তখন আর।দাঁতে দাঁত চেপে সদ্য মন ভাঙার কষ্টটা প্রাণপণে গিলে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় গলা বুজে আসছিল তার।কোনোরকমে জলভরা চোখে ধরা গলায় বলল,’বিয়ের আগে কেন বললে না একটিবার?’
— ‘কারণ তুমি সবটা জানলে কিছুতেই বিয়েটা করতে না আমায়,মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের মন ভাঙতে না তুমি জেনেশুনে,এটা আমি জানি।আর তুমি বিয়ে না করতে চাইলে বাবার মতো বিচক্ষণ মানুষ ঠিক বুঝে নিতেন ব্যাপারটা,কিন্তু শেষ সময়টায় আর বাবাকে কষ্ট দিতে চাই না গো আমি,আর তাই…..’
— ‘আর তাই বিয়েটা করলে,তাই তো?’
— ‘অস্মি আমি জানি এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমাকে তোমার পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ,নিকৃষ্টতম মানুষ মনে হচ্ছে,আর সেটাই স্বাভাবিক,কিন্তু অস্মি বিশ্বাস করো আমি নিরুপায়!জীবনের শেষ দিনগুলোতে আমি বাবার মুখে হাসি দেখতে চেয়েছিলাম,চেয়েছিলাম তিনি দেখে যান তাঁর অস্মি সুখে আছে,ভালো আছে,নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে আছে!এমনিতেই বাবা তোমায় নিয়ে বড়োই চিন্তিত ছিলেন,তুমি সারাজীবন কষ্ট পেয়েছ,বাবা চেয়েছিলেন তোমায় একটু সুখী দেখতে,আর তাই….’
— ‘তুমি চিন্তা কোরোনা হেমন্তদা,আমি স্যারের সামনে কোনোদিনও নিজের সামান্যতম কষ্টও প্রকাশ করব না,তাঁকে কখনো বুঝতে দেব না আমি অসুখী।’ চোখের জল মুছে অস্মিতা বলল, ‘আমি এতটাও খারাপ মানুষ নই গো হেমন্তদা যে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা দেব!’
— ‘ছি ছি অস্মি,এরকম বোলো না।খারাপ মানুষ তুমি কেন হবে অস্মি,খারাপ মানুষ তো আমি,তাই তো চোখে হাজার স্বপ্ন নিয়ে আসা এক সদ্যবিবাহিতার মন ভাঙলাম আমি!’
— ‘না হেমন্তদা,তুমি ভুল বলছ।আজ যদি সত্যিটা তুমি স্বীকার না করতে,তাহলেই তুমি খারাপ মানুষ হতে।যে মানুষ সত্যিকে জোর গলায় বলতে জানে,তাকে আমি সবসময়ই সম্মান করি।’
— ‘জানো অস্মি,আমিও তোমায় সম্মান করি।হ্যাঁ আমি তোমায় কোনোদিন ভালোবাসতে পারব না ঠিকই,কিন্তু আমার মনে যে সম্মানের জায়গাটা আছে,সেখানে তুমি আছ অস্মি,চিরকাল থাকবে।’
— ‘তুমি চিন্তা কোরোনা হেমন্তদা,তোমার জীবনে বেশিদিন বোঝা হয়ে থাকব না আমি।স্যার যেকটা দিন আছেন,ততদিনই রুদ্ধদ্বারের বাইরে সকলের চোখে আমরা স্বামী-স্ত্রী,ওই মানুষটা যেদিন থাকবেন না আর,সেদিনই আমি তোমায় ডিভোর্স দিয়ে দেব,আর আন্টিকেও আমি রাজি করাব তোমার আর স্বরলিপির বিয়েটা দেওয়ার জন্য,আমি জানি আমার কথা আন্টি ফেলতে পারবেন না।’
— ‘তোমায় শুধু একটা রিকোয়েস্ট করব অস্মি?তুমি প্লিজ ডিভোর্সের পর এই বাড়িটা ছেড়ে চলে যেও না,তাহলে আমার নিজেকে অপরাধী বলে মনে হবে।মায়ের অবর্তমানে এই বাড়িতে তোমার আর আমার সমান অধিকার আছে,তেমনটাই উইল করেছেন বাবা।’
— ‘আমায় ক্ষমা করো হেমন্তদা,এই রিকোয়েস্টটা আমি রাখতে পারব না গো!আর আইনের কাগজে কোথায় কি লেখা আছে সেসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই গো আমার,আমি শুধু চাই এই বাড়ির মানুষগুলো ভালো থাক,সুখে থাক।হ্যাঁ আন্টিকে দেখতে আমি মাঝে মধ্যে অবশ্যই আসব,কিন্তু স্থায়ীভাবে থেকে যেতে পারব না হেমন্তদা,আমায় ক্ষমা করো তুমি!’
যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছিল অস্মিতার মনের ভেতরটা,ভাবছিল, ‘যে মানুষটাকে আমি ভালোবাসলাম এতদিন,সেই প্রাণের মানুষটা অন্য একজনের সাথে সংসার করছে,এই দৃশ্য সহ্য করা যে আমার পক্ষে অসম্ভব!’
— ‘এভাবে বোলো না অস্মি,তুমি না থাকতে চাইলে আমি কোনোদিন জোর করব না তোমায়।আর অস্মি,তুমি অবশ্যই তোমার পড়াটা শেষ কোরো,তারপর সুপাত্রের হাতে তোমায় তুলে দেওয়া আমার দায়িত্ব রইল।’
অস্মিতা কিছু বলল না,শ্লেষের হাসি হাসল।তারপর ফুলের তোড়াটা হেমন্তকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,’এ আমার প্রাপ্য নয় হেমন্তদা,তুমি এটা স্বরলিপিকেই দিও।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্মিতা বলল,’শুধু এটা নয়,আমার এই বাড়ি থেকে পাওয়া বিয়ের সমস্ত উপহার,শাড়ি,গয়না কোনোকিছুর ওপরেই আমার কোনো অধিকার নেই,এই সবকিছু স্বরলিপির প্রাপ্য।তোমার এই ঘরের ওপরও আমার অধিকার নেই,শুধু স্যার যে কটা দিন….’
— ‘অস্মি প্লিজ!শাড়ি,গয়না,উপহার গুলো মা বাবা তাঁদের একমাত্র মেয়ে অস্মিতাকে দিয়েছেন,পুত্রবধূকে নয়,তাই ওগুলো প্লিজ ফিরিয়ে দিও না!প্লিজ অস্মি!’
সে রাত্রে অস্মিতা বিছানায় শুল,আর হেমন্ত সোফায়।অস্মিতা বারবার অনুরোধ করেছিল হেমন্তকে যাতে তাকেই সোফায় শুতে দেওয়া হয়,আর হেমন্ত শোয় বিছানায়,কিন্তু হেমন্ত রাজি হয়নি একদমই।অগত্যা কনে একাই ফুলের সাজে সাজানো শয্যায় শুয়ে পড়ল।অবশ্য এই রাত ফুলশয্যা নয়,শরশয্যা বলে মনে হচ্ছিল তার।অগুনতি শর যেন বিঁধছিল তার বুকে,আর সেই আঘাতে রক্তাক্ত হচ্ছিল তার মন।বারবার মনে পড়ছিল হেমন্তর কথাটা, ‘আমি তোমায় সম্মান করি ভীষণ অস্মি!’ শ্লেষের হাসি হেসে অস্মিতা ভাবছিল, ‘জ্বরের রাতে,মনখারাপি বিকেলে,আনন্দের মুহূর্তে ভালোবাসার মানুষের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে ইচ্ছে করে,কিন্তু সম্মানে সেই অধিকার কই?’
সকাল হল।গোটা রাতটা একপ্রকার না ঘুমিয়েই কেটেছে অস্মিতার।ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে,হঠাৎ সুমিত্রার ডাকে ঘুম ভাঙল তার।ঘুম ভেঙে অস্মিতা দেখে,গোটা ঘর সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে,আর সুমিত্রাদেবী তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন,’প্রথম রাত কেমন কাটল রে মা?’
মুখে জোর করে হাসি এনে অস্মিতা বলল,’দারুণ আন্টি।’
— ‘দুর বোকা,আন্টি কি রে!আমায় মা বলে ডাক!’
অস্মিতা মনে মনে হেসে ভাবে, ‘তোমায় মা ডাকার অধিকার যে নেই আমার!’
সেদিন সন্ধ্যেবেলায় সুমিত্রা অস্মিতাকে নিজের ঘরে ডাকলেন।তারপর অস্মিতাকে বিছানায় বসতে বলে আলমারি খুলে একটা কাঠের বাক্স বের করলেন,তারপর বললেন,’বল তো অস্মি,এতে কি আছে?’
— ‘কি আছে গো মা!’ প্রতীকবাবুর জন্য অস্মিতা তাঁদের মা-বাবা বলেই ডাকে।
— ‘বলতে পারলি না তো?এই দেখ!’ বলেই বাক্সটা খুললেন তিনি।বাক্সের ভেতর জ্বলজ্বল করছে একটা সাতনরি হার।হারটা বাক্স থেকে বের করে অস্মিতার গলায় পরিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘এ হারটা বংশ পরম্পরায় এ বাড়ির বড়ো বৌরা পায়।আমার তো ওই একটিই ছেলে,তাই এই গয়নার ওপর এখন থেকে তোরই অধিকার।একবার আয়নার সামনে গিয়ে দেখ,কেমন লক্ষ্মীর মতো লাগছে তোকে।’
অস্মিতা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।আয়নার প্রতিচ্ছবিটাও যেন ব্যঙ্গ করছে তাকে, ‘কি রে অস্মিতা,যে জিনিস তোর নয় সেটা হাত পেতে নিতে লজ্জা করে না তোর?’
অস্মিতা নিজের মনেই বলল, ‘চিন্তা কোরোনা হেমন্তদা,এ গয়না একদিন নিজের হাতেই আন্টি স্বরলিপির গলায় পরিয়ে দেবেন।যা কিছু আমি ডিসার্ভ করিনা,তা কক্ষনো জোর করে আটকে রাখব না নিজের কাছে।’
(ক্রমশ)