বিষাক্তফুলের আসক্তি ১৬

0
1412

#বিষাক্তফুলের_আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-১৬

রায়হান মৌয়ের বাবা-মায়ের মাথায় পি*স্ত*ল তাক করে রাখা ছেলেকে বললো, জুয়েল এ মনে হচ্ছে সোজা কথায় কাজ করবে না। তোর আঙ্গুলটা বাঁকা করতেই হবে।

তাজ মাথা নিচু করে হাসছে। রায়হান ভ্রু কুঁচকে তাকালো তাজের দিকে।

কী রে মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি ?

তাজ পেছনের টি-টেবিলে হেলান দিয়ে রায়হানের দিকে তাকালো, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা।ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ঠোঁটের কোণের রক্ত মুছে সেদিকে তাকালো।

একদিন নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে তোকে বাঁচিয়েছিলাম। ভালো প্রতিদান দিলি কিন্তু রায়হান। আচ্ছা একটা কথা বল তো রায়হান। আমার ভুলটা কোথায় ছিলো ? না তোকে বলেছি আমার জন্য কিছু ছাড় দিতে আর না মৌকে বলেছি তোকে রেখে আমাকে ভালোবাসতে। কিন্তু সবদিক থেকে ক্ষতি তুই আমিই করেছিস। ভালোবাসা শব্দটার উপর ঘৃণা ধরে গেছে আমার।

রায়হান শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাজের দিকে। না সে চোখে রাগ দেখা যাচ্ছে আর না অনুশোচনা।
তাজ রায়হানের পাশে সোফায় নিজের পা তুলে দিয়ে টি-টেবিলে হেলান দিয়ে বসলো।

থাক সেসব কথা, তোকে একটা শো দেখাই। আমার ফেবারিট শো।

রায়হান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তাজের দিকে। তাজ টি-টেবিল থেকে রিমোটটা নিয়ে টিভি অন করলো। টিভি স্কিনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো রায়হান। তাজ টিভির উল্টো দিকে মুখ করে রায়হানের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজ একটার পর একটা চ্যানেল চেঞ্জ করে লাগলো। প্রত্যেকটা চ্যানেলে লাইভ দেখা যাচ্ছে রায়হানকে। তাজ মনের সুখে শিস বাজাতে লাগলো। টিভিতে শোনা যাচ্ছে তাজের শিস বাজানোর শব্দ।

রায়হান রেগে তাজের কলার ধরে দাঁড় করিয়ে বললো, কী হচ্ছে এসব ?

তাজ নিজের কলার থেকে রায়হানের হাত ছাড়িয়ে বললো, সারাদেশের মানুষের সামনে যে দাগ আমার চরিত্রে লাগিয়েছিলি সেই দাগ সারাদেশের মানুষের সামনেই মুছে ফেললাম। তোর কী মনে হয়, তাজওয়ার খান তাজ ঘাসে মুখ দিয়ে চলে ? এতো কষ্ট করে কারাটে, বক্সিং শিখলাম তোর চুনোপুঁটি লোকের হাতে মার খেতে ? সত্যিটা সবার সামনে তোর নিজের মুখে স্বীকার করানোর জন্যই এই চুনোপুঁটি মেরে হাত গন্ধ করতে চাইনি।

রায়হান রেগে আবার কলার চেপে ধরলো তাজের আর তাজ হাহা করে হাসতে লাগলো।

রায়হান তাজকে মারার উদ্দেশ্যে হাত উঁচু করতেই পেছন থেকে আওয়াজ এলো, দ্যা গেইম ইজ ওভার মিস্টার রায়হান চৌধুরী ওরফে ডার্ক ডেভিল।

রায়হান বিস্ফোরিত চোখে ঘুরে তাকালো পেছনে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে র‌্যাবের একটা টিম। রায়হানের প্রত্যেকটা লোকের মাথায় গান তাক করে রেখেছে। চোখের পলকে সবাইকে হাতকড়া পরিয়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে গেলো।

রায়হান ঢোক গিলে বললো, ডার্ক ডেভিল মানে ?

ভয়ে রায়হানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের আনাগোনা দেখা দিলো। তার কোড নেইম এরা কীভাবে জানলো বুঝতে পারছে না রায়হান।

র‌্যাবের টিম ইনচার্জ এএসপি মাসুদ আহমেদ মুচকি হেসে বললো, সেটা তো আমাদের সাথে গেলেই বুঝতে পারবেন।

মাসুদ তার সাথের একজন অফিসারকে ইশারা করলো রায়হানকে হাতকড়া পড়াতে, সে তাই করলো।

রায়হান তাজের দিকে তাকিয়ে শাসিয়ে বললো, তোকে আমি ছাড়বো না তাজ। তবে যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাই তোকে।

রায়হান তাজের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, তিতির যাওয়ার আগে তোর জীবন থেকে আবারও কিছু কেড়ে নিয়ে গেছে। তুই ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাবি সেটা কী ? কিন্তু এর উত্তর তুই কোনদিন পাবি না আর না পাবি কোনোদিন তিতিরের দেখা।

রায়হানও যেতে যেতে শিস বাজিয়ে কোনো গানের সুর তুললো। কিন্তু তাজের চেনা চেনা লাগলেও বুঝতে পারলো না সেটা কোন গানের সুর। হয়তো সেই সুরে তাজ উত্তর পেয়ে যেত আবার কী কেঁড়ে নিয়েছে তিতির। রায়হান মৌয়ের দিকে একটা কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বের হয়ে গেলো র‌্যাবের সাথে। তাজ ধুপ করে বসে পড়লো সোফায়। রায়হানের সামনে নিজেকে কঠিন দেখালেও ভেতরে ভেতরে সে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। তিতির সাথে করা অন্যায় তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। মৌ দৌড়ে গিয়ে বাবা-মায়ের হাত মুখের বাঁধন খুলে দিলো। রেহেনা ছাড়া পেয়ে কাশতে লাগলো।

মৌ ব্যস্ত হয়ে বললো, বাবা তুমি মাকে নিয়ে ভেতরে যাও।

মহিবুল রেহেনাকে নিয়ে নিজেদের বেডরুমে চলে গেলো। মৌ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তাজের দিকে অনেক দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে কাছে দাঁড়ালো তাজের।

তাজ নিজের মাথার চুল খামচে ধরে ধীর গলায় বলছে, How could I do that ? I r*a*p*ed her.

তাজের কথা শুনে মৌ যেনো জমে গেলো। কী বলছে এসব তাজ ?

মৌ কাঁপা গলায় বললো, এসব কী বলছো ?

তাজে গর্জে উঠলো, শুনতে পাসনি কী বলছি ? আমি রে*প করেছিলাম ঐ মেয়েটাকে। যেখানে সকলে পরিস্থিতির স্বীকার সেখানে কেবল তাকেই শাস্তি দিয়েছি আমি। হিং*স্র জা*নো*য়ারের মতো আচরণ করেছিলাম সেই রাতে। রাগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি আর এই সবকিছুর জন্য দ্বায়ী তুই।

মৌ দু’কদম পিছিয়ে গেলো তাজের থেকে, আমি ?

তাজ রাগে থরথর করে কাঁপছে, হ্যাঁ হ্যাঁ তুই। তোর জন্য রায়হান এমন ডেস্পারেট হয়ে উঠেছে। তুই স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছিস ওকে।

মৌয়ের চোখে পানি টলমল করছে, আমি তো শুধু তোমাকে ভালোবেসে এসব করেছি।

তাজ দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বললো, কে চেয়েছে তোর এমন ভালোবাসা ? তুই ভালোবেসে এসব করে থাকলে রায়হানও তোকে ভালোবেসে এতো অন্যায় করেছে। ভালোবাসার শাস্তি যদি রায়হান পায় তাহলে তোরও পাওয়া উচিত। কারণ তুইও কম অন্যায় করিসনি রায়হানের সাথে।

মৌ কাঁপা গলায় বললো, কী শাস্তি ?

তাজ নিজের চোখ মুছে গম্ভীর গলায় বললো, রায়হান যেমন ওর ভালোবাসা পায়নি ঠিক তেমনই তুই কোনোদিন পাবি না তোর ভালোবাসা। আজকের পর আর কোনোদিন তুই আমার সামনে আসবি না আর এটাই তোর শাস্তি।

তাজ হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো মৌদের বাসা থেকে। নিজেকে তার পাগল পাগল লাগছে। একবার হলেও তিতিরের দেখা পাওয়া দরকার। সেরাতের আচরণের জন্য সরি বলতে হলেও তিতিরের দেখা পাওয়া দরকার। এখানে নির্দোষ তো কেউ নেই, তবে শাস্তি কেনো একা তিতিরের ভাগ্যে লেখা। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে তাজের হৃদয়। চোখের সামনে ভাসছে তিতিরের সাথে করা জঘন্য সেই ব্যবহারগুলো।

“বুঝবে তুমি বুঝবে
যেদিন সব বুঝবে
হারিয়ে আমায় খুঁজবে
তবে দিনশেষে শূণ্য হাতে
নিজের নীড়ে ফিরবে
বিষাক্তফুল নেই আপন করতে
তার ঘ্রাণেও যে হবে প্রাণনাশ”

তিতিরের বলা ছন্দের মানে আজ বুঝতে পারছে তাজ। তবে কী আর কোনোদিন দেখা হবে না বিষাক্তফুলের সাথে তাজের ? জানা হবে না সে হয়ে উঠেছিলো আর জীবনের বিষাক্তফুলের আসক্তি। মেয়েটা আসক্ত হয়েছিলো তাজ নামক মানুষের।

১৯.
প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ

প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ
প্রেমে পড়া বারণ

তোমায় যত গল্প বলার ছিল…
তোমায় যত গল্প বলার ছিল
সব পাপড়ি হয়ে গাছের পাশে ছড়িয়ে রয়েছিল

দাওনি তুমি আমায় সেসব
কুড়িয়ে নেওয়ার কোনো কারণ

প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
ওই মায়া চোখে চোখ রাখলেও ফিরে তাকানো বারণ
প্রেমে পড়া বারণ

শূন্যে ভাসি রাত্রি এখনও গুনি
তোমার আমার নৌকা বাওয়ার শব্দ এখনও শুনি
শূন্যে ভাসি রাত্রি এখনও গুনি
তোমার আমার নৌকা বাওয়ার শব্দ এখনও শুনি

তাই মুখ লুকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে
বসন্তের এই স্মৃতিচারণ

প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
মনে পড়লেও আজকে তোমায় মনে করা বারণ
প্রেমে পড়া বারণ

প্রেমে পড়া বারণ

গানটা শেষ করতেই তিতিরের বন্ধ চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে গেলো নোনাজল। আহান তাকিয়ে আছে তার তুতুলের দিকে। এভাবে তো সে দেখতে চায়নি তার তুতুলকে। যুদ্ধে পরাজিত হওয়া সৈনিক হিসাবে দেখতে চায়নি তাকে। সে চেয়েছিলো ছোটবেলার মতো চঞ্চল আর প্রাণোবন্ত মেয়েটাকে ফিরে পেতো।

ছদ্মবেশে সিলেটের ছোট একটা কটেজে উঠেছে তারা, সকালে এসে সিলেট পৌঁছেছে। কিছু খেয়ে নেওয়ার জন্য তিতিরকে ডাকতে এসেছিল। তিতির কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে গানটি গাইছে দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে যায়।

মনে মনে বললো, কিছু বারণ মানতে ইচ্ছে করে না তুতুল। কিছু বারণ উপেক্ষা করে নিজেকে পোড়াতে ইচ্ছে করে কারো প্রেমের আগুনে। তাই তো মানুষ জেনে শুনে প্রেম নামক আগুনে ঝাঁপ দেয়।

গতরাতে তিতির যখন বলেছিলো সে প্রেগনেন্ট। আহান কিছু সময়ের জন্য পাথর হয়ে গিয়েছিলো যেনো। কোনমতে নিজেকে সামলে শুধু বলেছিলো ঘুমিয়ে নে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত তিতিরের সাথে আর কথা হয়নি। আহান অনেক ভেবে ঠিক করেছে বাচ্চাটাকে প্রয়োজনে নিজের পরিচয়ে বড় করবে তবু তিতিরকে আর একা ছাড়বে না।

কিছু খেয়ে নিবি চল। এই অবস্থায় বেশি সময় না খেয়ে থাকা ঠিক না।

তিতির চমকে উঠে পেছনে ফিরে তাকালো, খেতে ইচ্ছে করছে না।

নিজের জন্য না হলেও ভিতরে বেড়ে উঠা প্রাণটার জন্য খেতে হবে।

পাখি কোথায় ?

তোর জন্য অপেক্ষা করছে। আজ সে আপুনির হাতে ছাড়া খাবে না।

তিতির কথা না বাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। আহান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে তিতিরের পিছনে গেলো। তিতির যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে বোনুকে। তিতির নিজে খাচ্ছে না দেখে আহান একটু খাবার নিয়ে তিতিরের মুখের সামনে ধরলো। তিতির তাকালো আহানের দিকে তবে কিছু বললো না। চুপচাপ খাবারটা মুখে নিলো।

আহান নিজের মুখেও খাবার তুললো, ভাইয়াকে র‌্যাব ধরে নিয়ে গেছে।

তিতিরের হাত থেমে গেলো তাকালো আহানের দিকে, তবে আমরা এবার স্বাধীন।

আহান ছোট করে বললো, হুম।

তিতির আবার পাখিকে খাওয়ানোতে মনোযোগ দিলো, তোকে গতকাল একটা প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তরটা এখনো দিসনি। আমার বোনুকে দেখে রাখবি বিনিময়ে সব প্রোপার্টি আমি তোর নামে করে দিবো আহু।

আহানের হাত থেকে গেলো। চামচটা প্লেটে রেখে দিলো একটু শব্দ করে, তুই কী আমাকেও রায়হান চৌধুরীর মতো মনে করিস তুতুল ?

সেটা হতে যাবো কেনো ? তোকে রায়হান চৌধুরীর মতো মনে করলে তার সাথে আসতাম না বরং তোর থেকে পালানোর চেষ্টা করতাম।

তবে কেনো মনে করছিস, প্রোপার্টির স্বার্থে আমি পুতুলের খেয়াল রাখবো।

তিতির দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, রাখতে না চাইলে থাক। আমি অন্য ব্যবস্থা করে নিলো।

আহান তিতিরের এক হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বললো, তুই চাইলে আমি নিজের জীবনটাও দিতে রাজি তুতুল।

তিতির প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালো আহানের দিকে আহান বললো, আজ থেকে পুতুল আর তোর সব দ্বায়িত্ব আমার। তোর এই বন্ধুকে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত পাশে পাবি। একবার হারিয়ে গিয়েছিলি আর হারাতে দিবো না।

তিতিরের চোখে টলটল করছে নোনাজল। নুরুল মারা যাওয়ার পর যেনো অথৈ সাগরে পড়েছিলো বোনুকে নিয়ে৷ পাশে পায়নি কাউকে তারপর জবটা হলো। সেখানেই হয়তো সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলো জীবনের, জবটা নিয়ে।

আহু রে আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। আমি চাইনা আমার বোনুর জীবনটা এলোমেলো হোক। বড্ড বেশি ভালোবাসি ওকে।

আহান চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করলো তিতিরকে, আগামীকাল ওসমানী বিমানবন্দর থেকে লন্ডন যাচ্ছি আমরা।

তিতির ভয় পেয়ে বললো, রায়হান চৌধুরী যদি আবার কিছু করে।

আহান বললো, ভয় পাস না রায়হান চৌধুরী জেলে, সে কিছুই করতে পারবে না আর লন্ডনে আমি নিজের ঠিকানা পরিবর্তন করে ফেলেছি। সেখানে আমাদের এতো সহজে খোঁজে পাবে না ভাইয়া বা অন্য কেউ।

আর তোর বাবা ?

আহান তাকালো তিতিরের দিকে। মেয়েটার চোখমুখে এখনো আতংক।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here