অনুবদ্ধ আয়াস ৩২

0
445

#অনুবদ্ধ_আয়াস ?
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩২

আমার স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ মেঝেতে। ফোনটা হাত ফস্কে আঁচড়ে পড়েছে ইতোমধ্যে। বাঁধ ভেঙেছে নেত্রযুগলের। বর্ষণ হচ্ছে অবিরাম। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। নিঃশ্বাস থমকাল। কথনগুলো গলায় দলা পাকিয়ে থেমে রইল। বাড়িতে কেউ নেই, সবাই শপিং মলে গেছে। মস্তিষ্ক শূন্য। আমি মেঝে থেকে দ্রুত ফোন তুললাম। কয়েক খণ্ডে বিভক্ত হয়েছে। বালিশের পাশ থেকে ওড়না তুলে গায়ে জড়ালাম কোনোমতে। কাবার্ড থেকে পার্স বের করে ছুটলাম। ভুলে গেলাম আমার ছোট বেবীর কথাটা।

আকাশ মেঘের ঘন আঁধারে আবৃত হয়েছে। ইতোমধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। রাস্তা ঘাট জনশূন্য। কোন হসপিটালে রৌধিক আছেন, সেটাও জানি না। ফোন বের করে দ্রুত কল করলাম। রিসিভ হচ্ছে না। পরপর কয়েকবার ফোন করেও রেসপন্স পেলাম না‌। দেহটা ক্রমশ বরফাচ্ছন্ন হয়ে আসছে। কি মনে করে লোকেশন চ্যাক করলাম।
হসপিটালটা আমাদের বাড়ির থেকে ঘণ্টাখানেকের পথ। আকাশ অন্ধকারে আচ্ছন্ন আছে বিধায় রাস্তায় গাড়ি নেই। কিছুদূর অগ্রসর হতেই রিক্সা পেলাম। আগ পিছু না ভেবে রিক্সায় চড়ে বসলাম। ডাবল ভাড়ার লোভে রাজি হলেন।
ভিজে জবুথবু হয়ে গেছি আমি। শীতল হাওয়াতে ক্রমাগত কাঁপছি। যত সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বৃষ্টির ধাঁচ যথারীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কম্পনের মাত্রা বেড়ে গেল। ঘণ্টাখানেকের পথ দুই ঘণ্টায় এলাম। দ্রুত ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। সবাই আমার দিকে অবাক চোখে চেয়ে আছে। হয়ত এমন অবস্থায় কাউকে হসপিটালে দেখে না। আমি ওড়না পেঁচিয়ে রিসেপশন দিকে এগিয়ে গেলাম। মেয়েটা আমার দিকে অবাক চোখে চেয়ে থেকে থেমে থেমে বলেন,

“ম্যাম আপনি ভিজে গেছেন‌ তো। জামা কাপড় সাথে থাকলে চেঞ্জ করে নিন।”

“আ আমি ঠিক আছি। আগে বলুন, একটু আগে কেউ আমাকে এই হসপিটাল থেকে ফোন করেছিল। বলেছিল, আমার হাসব্যান্ড এই হসপিটালে ভর্তি আছে।”

অতিশয় যাতনায় কথাগুলো বলি আমি। বলার সময় প্রচণ্ড কাঁপছিলাম আমার। তিনি লিস্ট বের করে নাম জিজ্ঞেস করলাম। রৌধিক নামটা উচ্চারিত করতেই বুকটা কেঁপে উঠল। তিনি লিস্ট চ্যাক করে বলেন,

“রৌধিকের ডেডবডি তো কালকে নিয়ে গেছে।”

ব্যাগটা হাত ফস্কে নিচে পড়ল। ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে বলি,
“মানে? কীসব যাতা বলছেন? একটু আগে আমাকে‌‌ ফোন করে বলে, রৌধিক হসপিটালে।”

“স্যরি ম্যাম রৌধিক নামের কেউ নেই হসপিটালে। যিনি ছিলেন, গতকাল তিনি মারা গেছেন। ও হ্যাঁ। তার জিনিস পত্র পড়ে আছে, নেয়নি। দাঁড়ান, আমি আনিয়ে দিচ্ছি।”

রিসেপশনের মেয়েটা কাউকে ফোন করলেন। মিনিট পাঁচেক পর একটা ওয়ার্ডবয় এলেন ব্যাগপত্র নিয়ে। কিৎকর্তব্যবিমূঢ় আমি। এটা তো রৌধিকের লাকেজ। চটজলদি লাকেজের চেইন খুললাম। রৌধিকের জামা কাপড়গুলো ভাঁজে ভাঁজে রাখা। নিঃশ্বাস ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসছে। মাথা ঘুড়ছে। ভারসাম্যহীন হয়ে বসে পড়লাম আমি। ভিড় জমে গেছে। বাকরুদ্ধ হলাম। কী করা উচিত ভুলে গেলাম সবকিছু। ঘণ্টাখানেক নিশ্চুপ হয়ে অবশেষে মস্তিষ্ক হার মেনে নিল। জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। ধীরে ধীরে সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে এলো। মৃত্যু কামনা করলাম তীব্রভাবে। কিন্তু আদৌও কী সম্ভব তা।
.
জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে সিলিং ফ্যানের নিচে উপলব্ধি করলাম। মাথার উপরে ভনভন শব্দে ফ্যান ঘুরছে। বাম হাতে স্যালাইনের ক্যানেল লাগান। হুট করেই আমার বেবীর কথাটা মস্তিষ্কে হানা দিল। ধরফরিয়ে উঠে বসলাম। পেটে হাত রেখে ফুঁপিয়ে উঠলাম। রৌধিক জানতেই পারল না, তার পুঁচকুর কথা। পাশের টেবিলে আমার পার্স আর ভেজা জামা কাপড় রাখা। জামা কাপড় শুকিয়ে গেছে। ফোনটাও পড়ে আছে।আমি দ্রুত ফোন নিয়ে আদ্রিতা আপু ফোনে কল করার প্রয়াস করলাম। ইতঃপূর্বে আদ্রিতা আপু বেশ কয়েকবার ফোন করেছেন। ফোনের স্ক্রিনে অবলোকন করতেই নজরে এলো পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ। চমকে উঠলাম আমি। ভিশন চমকালাম। বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিল তখন সময় ছিল দশটা নাগাদ। এতক্ষণ আমি জ্ঞানহীন, অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলাম।

আদ্রিতা আপুর নাম্বারে ফোন করতেই রিসিভ করলেন। কিছু বলার উদ্যেগ নিতেই আমি ধীরে ধীরে শুধালাম,

“আদ্রুপু।”

আর বলতে পারলাম না। ঢুকরে কেঁদে উঠলাম। ওপাশ থেকে বিচলিত হলেন আদ্রিতা আপু। পরপর বললেন,

“ওয়াট হ্যাপেণ্ড জোনাকি? কাঁদছিস কেন? কোথায় তুই? না বলে কোথায় গেছিস? কতবার ফোন করেছি, ধারণা আছে তোর? একবারও ফোন ধরলি না।”

এতগুলো প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেলাম আমি। বারবার ঝাঁপসা দেখছি। কীভাবে ওনার কথা বলব। পুনরায় কেঁদে উঠলাম,

“আদ্রুপু।”

“জোনাকি, বোন আমার। কাঁদছিস কেন? ভয় পেয়েছিস? বাবু ঠিক আছে? কিছু বল?”

ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ ব্যবধান করে কিছু বলতেই প্রয়াস করলেই ফোনটা হাতছাড়া হয়ে গেছে। মানুষটিকে দেখার উদ্বেগ প্রকাশ করলাম। পাশ ফিরতেই রৌধিকের আঘাতপ্রাপ্ত মুখশ্রীতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। আমি নিঃপলক। মানুষটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার হাত থেকে ফোন নিয়েছে। আদৌও কী সম্ভব? ফোনে আদ্রিতা আপুকে বলছে,

” ও আমার সাথে আছে। তুই ফোন রাখ। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা আসছি।”

“ভাই। তুই কোথায়। জোনাকি তোর কাছে কীভাবে? তুই দেশে ফিরে এসেছিস?”

“হ্যাঁ। এসেছি। রাখছি,‌ বাড়ি এসে বাকিটা বলছি।”

তিনি ফোন কেটে আমার পাশে বসলেন। আমিও এখনো ঘোরের মাঝে বিরাজমান। কাঁপা কাঁপা হাতজোড়া দ্বারা রৌধিককে স্পর্শ করলাম। এটা আমার হ্যালোসেলুশন নয়ত! না-কি স্বপ্ন। যদি স্বপ্ন হয়, তাহলে জনম জনম এটা স্বপ্ন হিসেবে থাকুক।

পরক্ষণেই আস্টে পিস্টে জড়িয়ে নিলাম রৌধিককে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। রৌধিক আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আমার কান্নার গতি তুলনামূলক বেড়ে গেল। আশ্বাসের স্বরে বললেন,

“জোনাকি কেঁদো না, দেখ এইত আমি। এমনভাবে কাঁদছ যেন, মরে গেছি আমি।”

দৃঢ় করে মুড়িয়ে নিলাম। অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠে বললাম,

“কী বলছেন এইসব? আপনার কিচ্ছু হবে না।”

“কিন্তু তুমি এমনভাবে কাঁদছ, মনে তো হচ্ছে আমি নেই।”

মুখ তুলে চাইলাম। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলাম তাকে। রৌধিক শুধু চেয়ে রইলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

“আপনি না-কি অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন?”

“আমাকে দেখে তোমার কি মনে হচ্ছে?”

রৌধিকের মাথায়, হাতে- পায়ে মোটা ব্যাণ্ডেজ। এমনকি ললাটের পাশ ঘেঁষেও মোটা ব্যাণ্ডেজ। আমি হাত ছুঁয়ে দিলাম। বললাম,

“ওরা বলছিল, আপনি, আপনি নাকি..

“মরে গেলে বুঝি খুশি হতে?”

আঙুলের সাহায্যে ওষ্ঠদ্বয় ঠেকিয়ে থামিয়ে দিলাম তাকে। মাথা নাড়িয়ে না-বোধক বোঝালাম। তৎক্ষণাৎ প্রবেশ করলেন নার্স এবং রিসেপশনিস্ট। হাসির আধো আধো রেখে টেনে বিনয়ী সুরে বলেন,

“স্যরি মিসেস জোনাকি। আপনাকে ভুল ইনফ্রম দেওয়ার জন্য। আসলে আপনার হাসব্যান্ড ভর্তিই হয়নি। অন্য রৌধিকের নাম ছিল। তিনি অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি ভুলবশত তার নাম বলেছিলাম। দুঃখিত। আমি অনেক অনুতপ্ত। তবে আপনাদের স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা দেখলাম। বেঁচে থাকুক এমন ভালোবাসা।”

আমি প্রত্যুত্তরহীন। তিনি প্রস্থান করলেন। আমি নির্বাক হয়ে রৌধিকের বুকে মুখ গুঁজে দিলাম। আঁকড়ে ধরে রইলাম। অনুভব করলাম, পূর্ণ আমি পূর্ণ। আমার ন্যায় সুখী বর্তমানে কেউ নেই পৃথিবীতে, কেউ নেই।

“সামান্য একটুতেই এই অবস্থা মিসেস রৌধিক। বলি সত্যিই যদি মরে যেতাম, তাহলে হয়তো একবিন্দুও শান্তি পেতাম না।”

“না। শান্তি দিতাম না। প্রয়োজনে আমি আগে চলে যাবো।”

“এভাবে বলো না, বুকে লাগে জোনাকি। অনেক কষ্টে তোমাকে ফিরে পেয়েছি আর হারাতে দিচ্ছে না।”
________
পাশাপাশি শুয়ে আছি আমি আর রৌধিক। ইভু ভাইয়াকে ফোন করেছেন তিনি। এলেই বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবো। বাড়ির কেউ রৌধিকের অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারে জানেন না। রৌধিক কড়া নিষেধাজ্ঞা। সবাই চিন্তা করবে। ইভু ভাইয়াকেও বারণ করে দিয়েছেন। রৌধিক আর আমার একার পক্ষে এই অবস্থায় বাড়িতে যাওয়া অসম্ভব। নাহলে ইভুকেও জানাতেন না।

ইভু ভাইয়া উপস্থিত হলেন। কীভাবে এক্সিডেন্ট করেছেন জানতে চাইলেন।
বাড়িতে ফেরার পথে উল্টোদিক থেকে গাড়ি এসে ধাক্কা দিয়েছে। অতঃপর ইভু ভাইয়া রিসেপশনে গেলেন। টাকা প্রে করে এলেন। অতঃপর আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য এলেন। রৌধিককে ধরে ধরে নিচ অব্দি নিয়ে গেলেন। আমিও ধরেছি একটু।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here