#অনুবদ্ধ_আয়াস ?
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৪
ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে গভীরতর হচ্ছে। রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে পড়ছে। শীতলতা ক্রমশ বাড়ছে। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করতে করতে চারটার ঘরে পৌঁছেছে। থেমে যায়নি। সে নিজের মতো চলছে। চায়ের দোকান বন্ধ করে চলে গেছে। ফজরের আযান পড়েছে। আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। রৌধিকের দেখা নেই। আমাকে একা রেখে কোথায় গেছে সে। এই শহরটা আমার শহর হলেও তেমন চেনা নেই। কখনো এদিকটায় এসেছি বলেও মনে পড়ছে না। আমার চোখের অশ্রু গড়াল। চায়ের কাপ দু’টো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে নির্ঘাত। ফোন সঙ্গে আনিনি যে, রৌধিককে ফোন করব। মাথা ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠছে ক্রমশ। টাকা নেই সাথে। আমি তো ভেবেছিলাম, না খেয়ে থাকলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি, এটা শোনার পর রৌধিক আমাকে কিছু খাওয়াতে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিলেন। আমাকে কথা বলতে বারণ করার পরে, কথা বলেছি বলে এভাবে ফেলে রেখে গেছে।
আমি আপনাকে জীবনেও ক্ষমা করব না রৌধিক। কখনো না।
ড্রাম থেকে পানি তুলে মুখে ছিটিয়ে নিলাম। জানা না, কোন দিকে যাবো। তবুও যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকেই পা বাড়ালাম।
আশেপাশে কেউ নেই। শুনশান রাস্তাঘাট। শাড়ির আঁচল চেপে সামনে দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। হাত পা ছুলে যাওয়ার ফলে জ্বলছে প্রচুর। টান করতে পারছি না। কিছুদূর এগুতেই কয়েকজন যুবকের দেখা পেলাম। তাদের সুবিধার মনে হলো না। কুচকুচে কালো গায়ের রং। চুলগুলো বড় বড়। কোঁকড়ানো চুলগুলো পাখির বাসার মতো। কাক দেখলেই যখন তখন ডিম পাড়তে চলে আসবে। ফিক করে হেসে ফেললাম আমি। অতঃপর আমার হাঁটা ধরলাম। পিচের রাস্তায় হাঁটার ফলে খ্যাচ খ্যাচ শব্দ হচ্ছে। পায়ের শব্দ বাড়তে লাগল। ছেলেগুলো স্থির রইল না। আমার পিছু পিছু আসছে। পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলাম। আমার পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে তারও হাঁটতে লাগল। আমার ছুঁই ছুঁই। উপায়ন্তন না পেয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ছুটলাম। তারাও ছুটল। দূর্বল শরীরটা বেশিক্ষণ দৌড়াতে পারল না। ভারসাম্য হারিয়ে রাস্তার মাঝে মুখ থুবড়ে পড়লাম। ততক্ষণে তারা আমাকে ঘিরে ফেলেছে। ভয়ে ক্রমশ শরীর কাঁপছে আমার। তৎক্ষণাৎ একটা বাইক এসে রাইণ্ড করে চারপাশে। আমি ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে সামনের দিকে তাকাতেই অপ্রত্যাশিত মানুষটিকে দেখতে পেলাম। ভয় ডর এক নিমিষেই মিলিয়ে গেল। রৌধিক বাইক থেকে না নেমে হেলমেট খুলল। হাতে রেখেই বললে,
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি উঠে এসো। ফিরতে হবে।”
অভিমানে নত হলাম আমি। এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো, এই মানুষটির সাথে যাওয়ার চেয়ে এদের সাথে থাকা অনেক ভালো। হয়তো কেউ আমাকে চায়। হোক সেটা দেহের প্রয়োজন। আমার ভাবনার মাঝেই ফোড়ন কেটে বলে উঠল একজন ছেলে,
“ও যাবে না, তুই যা। যদি তুই স্বইচ্ছায় যেতে না চাস সমস্যা নেই। আমরা পাঠানোর ব্যবস্থা করব। তবে বাড়িতে না সোজা হসপিটালে নয়তো কবরে।”
“দেখ তোদের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। তাই চুপচাপ মেয়েটাকে ছাড়। আমি ক্ষ্যাপলে থামাতে পারবি না।”
দু’টো ছেলে রৌধিককে ঘিরে ধরল। বাইকের উপর পা দিয়ে জোরে আঘাত করল। রৌধিক বাইক সমেত উল্টো হয়ে নিচে পড়লো। একপা বাইকের নিচে চাপা পড়ল। তা দেখে চোখজোড়া খিঁচে গ্ৰথণ করে নিলাম। আহ্ করে উঠলাম। রৌধিক রাস্তায় শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে। ছেলেগুলো রৌধিকের হাতে টা দিয়ে আঘাত করে বলে, “তুই না-কি ক্ষ্যাপে গেলে, থামানো যায় না। তাই ক্ষ্যাপার আগেই ফেলে দিলাম। এবার ফোট!”
রৌধিক কর্ণপাত করল না। বাইক ঠেলে উঠে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা করল। হাঁটতে পারছে না। তবুও খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে। বাইক তুলে দাঁড় করাল। বাইকের ভেতর থেকে চেইন বের করল। একের পর এক ঘা দিয়ে যাচ্ছে সে। রক্তে জামা কাপড় ভেসে যাচ্ছে।
এক সময় সবাই আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। রৌধিক আমার দিকে না তাকিয়ে সোজাসুজি বললেন,
“এসো। সময় নেই আমার। তোমাকে তোমাদের বাড়িতে দিয়ে আসবো। আমাকে আবার ফিরতে হবে।”
আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। তিনি আমাকে আমাদের বাড়িতে রেখে আসবেন। তারজন্য নিতে এসেছেন, না-কি দায়মুক্ত হতে এসেছেন? আমি উল্টো পথে হাঁটা ধরলাম। রৌধিক বাইক নিয়ে সামনে এসে পথ আঁটকে দাঁড়ালেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“উঠবে না-কি উঠবে না। না উঠলে সমস্যা নেই। এখানেই ফেলে চলে যাবো। এরা নিজেদের প্রয়োজন মেটাবে তোমাকে দিয়ে।”
অশ্রুসিক্ত হলো নয়ন। মানুষের প্রতি একটু সহানুভূতি নেই। আমি তার স্ত্রী, সেটা না-হয় বাদ দিলাম। পরিচিতা তো। কিভাবে তিনি এইসব বলছেন?
“আমার চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। আগে যখন চিন্তা করতে আসেন নি। এখনো প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক চলে যেত পারব।”
ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। বাইক থেকে নেমে এলো। ফট করে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। বাইকে বসিয়ে দিলেন। ছাড়লেন না। বরং পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রইলেন। সেভাবেই বাইক স্টার্ট দিয়েন। আমি ছাড়ার চেষ্টা করলে দৃঢ় করে নিচ্ছে হাতের বন্ধন। পাত্তা না দেওয়ার ভাব। বিনিময়ে হাত এবং পায়ের ব্যাথা বাড়ছে। তাই চুপ করে রইলাম। কোনো কথা বলি নি। না নড়াচড়া করেছি।
আমাদের বাড়ির সামনে এনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে চলে গেল। যেন রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। একবার ভালো করে তাকায় অব্দি নি। আমি শূন্য পথের দিকে আশাহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। এটাই কী আমার নিয়তি। আমি এলোমেলো পা জোড়া দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। দরজা নক করার বেশ কিয়ৎক্ষণ পর জয়া এসে দরজা খুলে দিল। ঘুমু ঘুমু তার মুখ। আমাকে দেখে ভূত দেওয়ার মতো চিৎকার করে উঠল। এক দৌড়ে বাবার ঘরে। তৎক্ষণাৎ বাবা এসে হাজির হলো। আমাকে এই অবস্থায় দেখে বিচলিত হয়ে উঠল। কোনো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ার আগেই মিনমিনে স্বরে বললাম, ” বাবা আমি একটু ক্লান্ত। রেস্ট নিতে চাই।”
বাবা পথে ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন। আমি ভেতরে ঢুকে অন্যরুমে চলে গেলাম। কাবার্ড থেকে পুরোনো জামা নিয়ে শাওয়ার ঢুকে গেলাম। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত ঠেকছে। মিনিট দশেক পর রুমে ফিরে গা হেলিয়ে দিলাম বেডে।
তারপরে কেটে গেছে দু’দিন। রৌধিক নামক মানুষটা আমার কোনোরুপ খবর নেয়নি। একবারও ফোন করে বলেনি, খেয়েছ? ঘুম হয়েছে? কিচ্ছু বলেনি। কেন এমন করছেন তিনি। কেন বুঝতে পারেন না, আমার মনের অবস্থায়? তার দেওয়া আঘাতে জর্জরিত আমার বিক্ষিপ্ত মন। খাওয়া দাওয়া এখন অফশনার সাবজেক্টের মতো। ইচ্ছে হলে করলাম নতুবা করলাম না। বেশ কয়েক জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছি। কোনো কাজ হয়নি।
.
আজকে ভার্সিটিতে এসেছি। মন ভালো রাখার ছোট একটা উপায়। আমি বসে আছি বড় আমগাছটার নিচে। আমার পাশে বসে আছে অহি। তার মনে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু আমার জবাব নেই। চোখজোড়া বইয়ের মাঝে নিবদ্ধ করে লোকদেখানো পড়ছি। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। আমার এরুপ অবস্থা দেখে ফোড়ন কেটে বলে অহি,
“এমন ভাবে পড়ছিহ, যেন সবকিছুই মুখস্থ হয়ে গেছে। অথচ কিছুই হয়নি। আমাকে দেখাতে হবে না। আমি জানি, একটা শব্দও মুখস্থ হয়নি তোর।”
“চেষ্টা তো করছি। মুখস্থ না হলে আমি কী করতে পারি। আশ্চর্য!” আমার ঝাঁঝালো জবাব।
“সামান্য একটা ব্যাপারে তুই সর্বদা হাইপার হয়ে যাস। অন্যের উপর রাগ আমার উপরে দেখাস। যা থাকবই না।”
মাথায় চপল মা’র’লা’ম আমি। রৌধিকের জন্য এই মেয়েটাকে সবসময় কথা শুনিয়ে দেই। তার সাথে পারার মুরোদ নেই।
অহির হাত ধরে থামিয়ে দিলাম। টেনে টেনে বললাম, “স্যরিরে!”
তবুও মেয়েটা গম্ভীর হয়ে রইল। ফিক করে হেসে দিলাম আমি। আমার সাথে অহিও হাসল। কেউ হাসলে অহি রাগ করে থাকতেই পারে না। বড্ড সহজ-সরল।
আমরা উঠে ক্লাসের দিকে পা বাড়ানোর আগে সেই মেয়েগুলো ঘিরে ধরল আমাদের। সেদিনের মেয়েগুলো। সিনিয়র বলে হয়তো আজকে সেদিনের কথা গুলোর প্রতিশো’ধ নিবে। আমি সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সেদিক থেকেও ঘিরে ধরল। আমাকে বাঁধা দিয়ে তারাই বলতে শুরু করল,
“স্যরি আপু। আমরা সত্যিই দুঃখিত। মেয়ে হয়েছে আমাদের এমন ভাবে বলা উচিত হয়নি। আমাদের ভাবা উচিত ছিল, শত হোক আমরাও তো মেয়ে।”
“হ্যাঁ আপু। আমরা আপনাকে অনেক খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি। প্লীজ আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন।
আর কখনো এই ভুল হবে না।”
[চলবে.. ইনশাআল্লাহ]