ইচ্ছেপূরন
পর্ব-৭
আজ সকাল থেকেই ভীষণ ব্যস্ত বিভা। সকালের নাস্তা খেয়ে আতিককে বিদায় দেওয়ার সময় বার বার বলে দিলো, আজ যেন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে আতিক। আতিক যাওয়া মাত্রই ফ্রিজ থেকে মাছ, মুরগী আর গরুর মাংস ভিজিয়ে রেখে নিজের জন্য ঘন দুধ দিয়ে এককাপ চা বানালো। তারপর তা নিয়ে বেডরুমে ঢুকলো। আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিয়ে নিজের করনীয় কাজগুলো ঠিক করে নিলো মনেমনে। চা শেষ করে চট করে উঠে নিজের ব্যবহারের সুটকেসটা নামালো। আলমিরা খুলে সেটা থেকে নিজের প্রয়োজনীয় কাপড়গুলো নিয়ে সুটকেসে ভরলো। গহনাগুলোও নিয়ে নিলো, যদিও তা খুব একটা বেশি না! আতিক টুকটাক কিছু বানিয়ে দিয়েছিলো, কিছু শাশুড়ী দিয়েছে আর কিছু ওর বাবা মা দিয়েছে। কোনো কিছুই রাখলো না বিভা। সব খুব সন্তর্পনে সুটকেসে গুছিয়ে নিলো। নিজের ব্যাংক একাউন্ট এর চেকবই, কার্ড, নিজের সার্টিফিকেট সবকিছু সাবধানে গুছিয়ে নিলো। আতিক যদি একবার টের পেয়ে যেতো তাহলে সে কিছুতেই এসব কিছু নিয়ে বেরুতে পারতো না। একটা জিনিসও আতিক ওকে নিতে দিতো না। এর আগে দুইবার আতিক ওকে মেরে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলো। জাস্ট শুন্য হাতে বের করে দেওয়া যাকে বলে। কোথাও যেতে পারেনি বিভা। লজ্জায়, অপমানে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকতো নয়তো এই বাড়িরই অন্য কোন ভাড়াটিয়ার বাসায় যেয়ে বসে থাকতো। আতিকের রাগ কমার জন্য ওয়েট করতো। এসব স্মৃতি বিভার মনকে বড্ড কাতর করে দেয়। তখন ইচ্ছে হয় আতিককে কুটি কুটি করে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিতে। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিভা। এরপরের জীবনটা কেমন হবে সেটা জানেনা বিভা। জানতে চায়ও না। কি হবে এতো জেনে? এতো ভাবনা চিন্তা করে? জীবনে যতটুকু খারাপ হওয়ার তা মনেহয় হয়ে গেছে! এখন শুধু ভালোটাই ভাবতে চায়। আর যদি খারাপ কিছু হয়ও তবুও সেটা এই আতিকের সাথে জীবন কাটানোর চাইতে খারাপ হয়তো হবে না! ভাবতে ভাবতেই সুটকেসটা বন্ধ করে একবার শাশুড়ীর ঘরে উকি দিলো। নাহ! ঘুমাচ্ছে এখনো। বিভা একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। এখন তাড়াতাড়ি সুটকেসটা নিচে রেখে আসতে হবে। এদের কেউ যাতে টের না পায়। বিভা কোন আওয়াজ না করে খুব ধীর পায়ে একটা পেনড্রাইভ আর সুটকেসটা নিয়ে বেড়িয়ে এলো। তিনতলায় বাড়িওয়ালার বাসার কলিং বেল বাজালো। গতদিনের মেয়েটাই দরজা খুললো। বিভা তার কাছে পেনড্রাইভটা দিয়ে বললো-
“ভাবি, আমি যদি এই ব্যাগটা আপনাদের এখানে রাখি তাহলে কি প্রবলেম হবে? আমি সন্ধ্যার সময় এসে নিয়ে যাবো ব্যাগটা। আর যদি একটু কালকের ভিডিও ক্লিপটা এর মধ্যে দিতেন?”
“হুম দিচ্ছি। ব্যাগ রাখুন কোনো সমস্যা নেই। ”
মেয়েটা ঘর থেকে ল্যাপটপ নিয়ে এসে পেনড্রাইভে ভিডিও ক্লিপটা কপি করলো।
“এই যে আপনার ভিডিও ক্লিপ।”
“অনেক ধন্যবাদ, ভাবি। আপনি আমার যে উপকার করলেন তা আজীবন মনে রাখবো।”
“আরে এভাবে বলছেন কেন? আমরা একজন আরেকজনার উপকার না করলে কিভাবে হবে?”
“তারপরও, এই কথা আজকাল কে মানে বলেন? অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।”
বিভা খুশি মনে বেড়িয়ে আসে। যাক আজকে সবকিছু ভালোয় ভালোয় হচ্ছে। বাকী কাজটুকু ভালোয় ভালোয় শেষ হলে হয়। ঘরে ঢুকে আস্তে করে দরজা বন্ধ করলো বিভা। শাশুড়ীর রুমে উকি দিয়ে নিজের রুমে ঢুকলো। জেরিনকে একটা ফোন দিতে হবে, ভাবনাটা মাথায় আসতেই ফোনটা হাতে নিলো-
“হ্যালো, জেরিন আপু?”
“হুম,বিভা। কি খবর? এতোদিন পরে কি মনে করে?”
“তোমার কাছ থেকে একটা ফেভার চাই। দেবে?”
“আরে তুই আবার কবে থেকে এতো ফর্মালিটিস করা শুরু করলি? বলে ফেল।”
“আমি আজ রাতে তোমার বাসায় আসবো। দু চারদিন থাকবো তোমার ওখানে। তোমার কি কোন সমস্যা হবে?”
“কেন রে আবার ঝামেলা হয়েছে নাকি আতিকের সাথে? ”
“আরে না! তুমি আগে বলো তোমার চলবে কিনা? পরে দেখা হলে তোমাকে বিস্তারিত বলবো। আর একটা রিকোয়েস্ট করবো।”
“হুম, করে ফেল।”
“আমার জন্য একটা জব দেখবে? আমি আবার কোথাও জয়েন করতে চাই।”
“আরে, তার জন্য অন্য কোথাও কেন খুঁজবি? তোর জব ছাড়ার পর তোর পদে দুজন বদল হলো। কেউ টিকে না। স্যার একদিন তোর কথা বলেওছিলেন। আমার মনে হয় তুই যদি স্যারকে রিকোয়েস্ট করিস তাহলে মনেহয় স্যার আবার তোকে রেখে নেবে?”
“সত্যি বলছো? যাক, তুমি আমার নিশ্চিত করলে গো। আচ্ছা রাতে যখন আসবো তখন বাকি কথা বলবো, ঠিক আছে? রাখলাম। ”
বিভার এবার বিশ্বাসটা আরো পাকাপোক্ত হলো। আসলেও মনে হচ্ছে ভাগ্য এবার সহায় আছে। সবকিছু কেমন স্মুদলি হয়ে যাচ্ছে! মনে মনে আল্লাহ কে ধন্যবাদ জানালো বিভা। পেনড্রাইভটা সেফ জায়গায় রেখে খুশি মনে রান্নাঘরে ঢুকলো বিভা। আজ মনের আনন্দ নিয়ে শেষ বারের মতো এই বাড়িতে রান্না করবে বিভা। খেয়ে যেন সবাই আজ আঙ্গুল চাটতে থাকে!
*******
সন্ধ্যার দিকে পুরো বাড়ি লোকজনে ভরে গেলো। আজকে তিন আপুই এসেছে একসাথে। সাথে দুলাভাই আর বাচ্চাগুলোও আছে। বেশ একটা খুশির মহল। বিভা রান্না শেষ করে শাওয়ার নিয়ে উঠতেই সবাই এলো। কিছুক্ষণের মধ্যে আতিকও চলে এলো। সবাই মিলে বসে বেশ কিছুক্ষণ গল্প আর আড্ডা হলো। বিভার শাশুড়ীও আজ বেজায় খুশি। সবাইকে পেয়ে তার খুশি যেন ধরছে না। আটটার দিকেই বিভা সবাইকে তাড়া দিলো খেয়ে নেওয়ার জন্য। সবাই খেয়ে উঠলেই না বিভা নিজের বাকি কাজটুকু শেষ করতে পারবে?
খাওয়া শেষে আসলেও সবাই আগুল চাটছিলো। প্রশংসার বন্যায় ভেসে যাচ্ছিলো বিভা। বহুদিন নাকি এতো মজার রান্না খায়নি। বিভা উত্তরে শুধু মুচকি হাসি উপহার দিয়েছে। আতিকও আজ না পারতে প্রশংসা করলো বিভার রান্নার। সে আজ যেন বিভাকে চিনতে চাচ্ছে? অদ্ভুত দৃষ্টিতে বিভাকে দেখছে। হয়তো আতিক কিছু অস্বাভাবিকতা টের পাচ্ছে। বিভা সেসব পাত্তা দিলো না। সে কোনোদিকে না তাকিয়ে নিজের মনে কাজ করতে থাকলো। সবার খাওয়া দাওয়ার পাট চুকে গেলে বিভা ল্যাপটপ নিয়ে ওদের বেডরুমে ঢুকলো। সবাই আজ এই ঘরেই বসেছে। বিভার খুব নার্ভাস লাগছে, বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হাতে একটা ছোটো বোতল নিয়ে ঘুরছে বিভা। কিছুক্ষণ পর পর বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি খাচ্ছে। মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এতো সাহসিকতার কাজ কখনো করেনিতো? সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে করতে পারবে তো? মনের সব কথাগুলো ঠিকঠাক গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারবে তো? বিভা সবার দৃষ্টি আকর্ষন করলো-
“আপুরা, আজ কি আমরা একটা ছবি দেখতে পারি?”
কথাটা শোনামাত্রই সবাই হইহই করে উঠলো। কনাপু বললো-
“হ্যা,দেখবো তো। চালাও চালাও!”
“আপু, বাবুদের জন্য টিভিতে কার্টুন চালিয়ে দেই?”
বিভার কথায় কেউ আপত্তি করলো না। কিন্তু বাচ্চারা কেউ যেতে চাইছিলো না। শেষে শাশুড়ী মাকে দিয়ে বাচ্চাদের পাশের রুমে পাঠিয়ে দিয়ে বিভা পেনড্রাইভে নেওয়া ভিডিও ক্লিপটা ওপেন করলো। বিভা একবার আতিকের দিকে তাকালো। আতিক মনেহয় কিছু একটা বুঝতে পারছে। ওর মুখটা রংহীন লাগছে কিনা বিভা এতোদূর থেকে টের পেলো না। ও একটু গলা খাক রানী দিয়ে বলতে শুরু করলো-
“আপু,ভাইয়ারা,আপনারা এখন যেটা দেখবেন সেটা একটা বাস্তব ছবি। কয়েকদিন আগে এরকম আরো একটা ঘটনা ঘটেছিলো যেটা আপনাদের কে জানাইনি, শুধুমাত্র কনাপু জানে ঘটনাটা। ভেবেছিলাম সেটাই বুঝি শেষ ঘটনা! তাই আর কারুকে বিরক্ত করিনি। কিন্তু না, সেটা শেষ না বরং শুরু বলা যায়।তাই বাধ্য হয়ে আমাকে আজ ঘটনাগুলো বলতে হচ্ছে। এরকম একটা ঘটনা আমার জন্য শুধু সারপ্রাইজই না একটা লজ্জাজনক ঘটনা বটে। যাইহোক, আপনারা আগে দেখুন তারপর ঘটনাটা খুলে বলবো।”
বিভা ক্লিপটি চালু করতেই আতিক বুঝে গেলো। ও উঠে আসতে লাগলেই বিভা ওকে হাত দিয়ে থামালো-
“তুমি ওখানেই থাকো আতিক। উঠে এসে কোনো সিনক্রিয়েট করার চেষ্টা করবে না।”
বিভার গলায় কিছু একটা ছিলো। আতিক থেমে গেলো। ওর বোন জামাই গুলো একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে ইশারা করছিলো। কেউই কিছু জানে না। এদিকে কনার মুখচোখ লাল হয়ে
গেছে। আজ বুঝি স্বামীর কাছে সব মানসম্মান গেলো! বিভা আবার চালু করলো ভিডিও ক্লিপ।
সবাই পিনপতন নিরবতায় দেখলো পুরো ভিডিও। আর আতিক? আতিক মাথা নিচু করে বসে আছে চুপচাপ। ওর থুতনি মিলে গেছে গলার সাথে। ওর এতোদিনের ভালোমানুষি ইমেজ যে আজ ভেসে গেলো! আতিক এভাবে ধরা খেয়ে যাবে এটা কখনো ভাবেনি। ওর মাথাতেই ছিলো না সিসিটিভির ব্যাপারটা।
ভিডিও শেষ হওয়ার বেশ অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বললো না। সবাই একবার আতিকের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার বিভার দিকে। ঠিক কি বলবে বুঝে পাচ্ছে না। বিভাই কথা বললো-
“আপনারা কি কিছু বুঝতে পারছেন? যদি বুঝেও থাকেন তবুও আমি নিজের মুখে আর একবার বলতে চাই। এই ভিডিও ক্লিপটি হলো আম্মাকে সাথে নিয়ে যেদিন চাপাই গেলাম তার পরদিন রাতের। আতিক সে রাতে মেয়েছেলে নিয়ে এসে আমারই বেডরুমে আমারই বিছানায় সারারাত….। কি করেছে সেটা আমার উচ্চারণ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। আপনারা সবাই সেটা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই। এর আগেও আতিক এই মহিলার সাথেই অপ্রিতিকর অবস্থায় ধরা পরেছিলো মোহাম্মদপূরে। প্রচুর মারও খেয়েছিলো। পরে আমি ছাড়িয়ে এনেছিলাম। ভেবেছিলাম এতো কিছুর পর ও নিশ্চয়ই সোজা হয়ে যাবে! কিন্তু না! ও তো কুকুরের লেজ! কুকুরের লেজ কি কখনো সোজা হয়? ওর সাহস এতোই বেড়ে গেছে যে নিজের বাড়িতে বাজে মেয়েমানুষ নিয়ে এসেছে? এখন আপনারাই বলুন, এটা কি আমার সহ্য করা বা মেনে নেওয়া উচিত? কোনো মেয়ে কি তা মেনে নেবে? আপুরা, আপনাদের জিজ্ঞেস করি, সহ্য করতে পারতেন? আপনাদের বিছানায় যদি দুলাভাইরা অন্য কোন মেয়েকে নিয়ে থাকতো?”
“বিভা, খুব বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু? ভালো হবে না বললাম? তোমাকে অনেকদিন ধরে মার দেই না তো এইজন্য বেশি বার বেড়েছো, তাই না?”
আতিক বিভাকে মারতে উঠে এলো। ওর দুলাভাইরা ঠেকালো ওকে। কনার বর বললো-
“আতিক, সাহস একটু বেশি দেখিয়ে ফেলছো। আর দেখায়ো না। সেটা তোমার জন্য মোটেও ভালো হবে না। এতো কিছু ঘটে গেছে, আর এই মেয়েটা একা একা সব সহ্য করে গেছে? আমাদের টের পর্যন্ত পেতে দেয়নি। তুমি কি মানুষ নাকি রে ভাই? আবার আমাদের সামনেই ওকে মারতে যাচ্ছো?”
বিভা হাসলো-
“ভাইয়া, আপনিও না কি যে বলেন? আমাকে মারা তো ওর শখ! এই শখ ওর যখন তখন ওঠে।আমাকে না মারলে ওর খাবার হজম হয় না। যাই হোক, এই তিনবছরের বিবাহিত জীবনে আমি ওর কাছ থেকে কিছুই পাইনি। যা পেয়েছি তা হলো, কথায় কথায় ওর হাতের মার, লোকজনের কাছে ওর জন্য অপমানিত হওয়া আর ওর বাড়ির ফ্রি চাকরানী হওয়ার সম্মান। কি আমি ভুল বললাম?”
আতিকের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় বিভা। আজ আতিকের মুখে কোনো কথা নেই। ও যেন বোবা। না চাইতেও চুপ করে থাকতে হচ্ছে।
বিভা আবার বলতে শুরু করলো –
“আজ তোমাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হচ্ছে, আতিক। তুমি যদি এই কাজটুকু না করতে তাহলে হয়তো আমি আজীবন বসে বসে তোমার মার খেয়ে যেতাম। কখনো প্রতিবাদ করার কথা মনেও আসতো না। কিন্তু, এবার যখন ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখলাম, শুনলাম, নিজের প্রতিই কেমন যেন ঘৃনা জন্মে গেলো। মনে হলো যে, কি করছি এসব আমি? এতো নিচ হয়ে গেছি যে তোমার এরকম লেইম আচরন আমি মেনে নিচ্ছি? নিজের আত্মসম্মান, মর্যাদা সবই বিকিয়ে দিচ্ছি। কিসের জন্য, কার জন্য? যার জন্য এসব করছি সে তো আমাকে একটুও মুল্য দেয়না? তখনই মনে হলো আর না? এভাবে আর থাকবো না, থাকা সম্ভব না? যদি থাকি তাহলে নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যাবো। এভাবে তো বেঁচে থাকাও যা না থাকাও তা! তাই ভাবলাম, যাদের কাছে তুমি ভালো, মার্জিত, ভদ্র তাদের কাছে তোমার মুখোশটা উন্মোচন করে দেই। ওহ, আর একটা ইচ্ছে আছে আমার! তুমি যখন আমায় মারতে তখন আমারও খুব ইচ্ছে করতো তোমাকেও খুব করে মারি, এতো মারি যে, মার খেয়ে যেভাবে আমার মুখ চোখ ফুলে থাকতো ঠিক সেভাবে তোমারও ফুলে থাকুক। ব্যাথা অনুভব করো তুমিও, অপমানের জ্বালাটা তুমিও কিছু বোঝো! কিছুটা হলেও ফিল করো আমার কষ্টটা।”
বিভা এগিয়ে যায় আতিকের দিকে। একেবারে আতিকের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো আতিক। বিভার জামা দেখে উপরে তাকাতেই বিভা নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আতিককে চড় মারলো। আতিক বুঝে উঠতে উঠতে আরো কয়েকটা মারলো। বিভার তখন হিতাহিত জ্ঞান নেই। মেরেই যাচ্ছে আতিককে। এতোদিনের জমানো রাগ, অসহায়তা,কষ্ট, অপমান এর শোধ তুলছে যেন! যখন থামলো তখন দেখলো কনার বর ধরে রেখেছে আতিককে। বিভা হাঁপাতে হাঁপাতে এবার একটু দূরে যেয়ে দাঁড়ালো, সবার দিকে একনজর তাকিয়ে নিলো। সবাই ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কেউ কিছু বলবে এই বোধটুকুও বোধহয় কারো নেই! বিভা একটু হাসার চেষ্টা করলো-
“ধন্যবাদ, ভাইয়া। আমার ইচ্ছেটুকু পূরন করার জন্য। তা না হলে ও তো এতক্ষণে আমাকে মেরে আধমরা করে ফেলতো। আমি জানতাম যে, বোনেরা ভাইয়ের জন্য একটু সফট কর্নার হলেও, আপনারা ঠিকই আমাকে সাপোর্ট করবেন। সেজন্যই সবাইকে একসাথে ডাকা। অবশ্য আজ ভাগ্যও আমার সাথ দিয়েছে। তা না হলে সবাই একসাথে আসতেন নাকি? যাই হোক, আমি আজই চলে যাচ্ছি এ বাসা ছেড়ে। আমার পক্ষে আর আতিকের সাথে ঘর করা সম্ভব না। বরং যাকে ওর ভালো লাগে ও তার সাথেই সংসার করুক। আমার তরফ থেকে মুক্তি দিয়ে গেলাম ওকে। আর হ্যা তোমার কাছে আমার কোন দাবি নাই, আতিক। ডিভোর্স লেটার পাঠায়ে দিবা আমি সাইন দিয়ে দিবো। আর মাকে তো অনেক ভালোবাসো? এবার নিজের হাতে মায়ের সেবা কইরো। আপুরা, ভালো থাকেন। আমার দ্বারা যদি কোন ভুল হয়ে থাকে তাহলে আমাকে মাফ করে দিয়েন। আর ভাইয়া, আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আমাকে বোঝার জন্য। আমাকে সাহায্য করার জন্য। আশাকরি কেউ আমার কাছে অন্যায় কোনো আবদার করবেন না। আমি কোন আবদার রাখতে পারবো না। শুধু শুধু আপনাদের অসম্মান করতে চাই না তাই আগেই বলে দিলাম। সবাই ভালো থাকবেন, আমার জন্য দোয়া করবেন।”
বিভা কাউকে কোনো সুযোগ না দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো। হাতের মোবাইলে দেখলো সাড়ে নয়টার মতো বাজে। বাড়িওয়ালার বাসা থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিচে নেমে এলো। দারোয়ান ছেলেটাকে একটা সিএনজি ডেকে আনতে বললো। লক্ষ জেরিনের বাসা। জেরিন মিরপুরে থাকে। দারোয়ান সিএনজি আনতেই তার দিকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে ধন্যবাদ জানালো বিভা।
প্রথমে একটু গাইগুই করলেও লোকটা খুশি মনে নিয়ে নিলো টাকাটা। সিএনজি যখন মিরপুরের দিকে যাচ্ছে তখন বিভার মনটা শান্ত দীঘির মতো হয়ে আছে। আজ আতিককে মেরে নিজের ইচ্ছেপূরন করতে পেরে খুব শান্তি লাগছে বিভার। তিন বছরের জমানো ঘৃনা,ক্লেদ সব যেন দূর হয়ে গেছে। মনেহচ্ছে এতোদিনে আতিকের সাথে হিসাব বরাবর হলো। এখন জীবন অনিশ্চিত হলেও কেন যেন চিন্তা হচ্ছে না খুব একটা। বরং মনেহচ্ছে, আল্লাহ নিশ্চয়ই কারুকে অসহায় অবস্থায় ফেলেন না! কোনো না কোনো ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করবেন বিভার জন্য! বিভার মুখে চোখে অদ্ভুত এক বিশ্বাস যেন নাড়া দিয়ে যায়! বিভা মনে আনন্দ নিয়ে অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা করে। কারন, ও এখন জেনে গেছে মন যখন লড়াই করার জন্য প্রস্তুত থাকে তখন জীবনে আর কাউকে প্রয়োজন হয় না! কাউকে না!
সমাপ্ত।
©Farhana_Yesmin