নিশুতি তিথি পর্ব ২

0
596

#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ২
____________

৩.
টিনের দোচালা ঘর। ঘরে আছে ছোট ছোট দু’টো রুম জরাজীর্ণ পরিবেশ। ঘরের সামনের খোলা বারান্দা দিয়েই ঘরে প্রবেশ করার পথ। রুম দু’টোতে বেশি কিছু নেই বলা চলে। একটাতে শুধু চৌকি, আর মাটিতে বিছানো মাদুর। থাকে শুধু তিনটি মানুষ তাই এটাই তাদের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু যেটা প্রয়োজন সেটাই নেই। একজন পিতা, যেটা মাথার উপর বট গাছের মতো ছায়া দিবে। ভরণপোষণের দায়িত্ব নিবে। লিপি, তার মা ও ছোট্ট ভাই লিমনকে নিয়ে তাদের পরিবার। লিপি ও লিমন লেখাপড়া করে না। তাদের পান্তা আনতে দিন ফুরায় আবার নাকি লেখাপড়া। বেশ হাস্যকর! লিপির মা মানুষের বাড়ি কাজ করে যা পারে তা দিয়ে খাবার জোগাড় করেন। লিপি-ও তার মায়ের সাথে মাঝে মাঝে অন্যের বাসায় কাজ করে। কিছু বাড়তি আয়ের আশায়। তবুও গরিবের কপাল ফুটোই থাকে। এক পয়সা জাদুবলে আর পাঁচ পয়সা হয় না।

লিপিদের বাসায় আঞ্জুমান বসে বসে কাঁচা আমের ভর্তা খাচ্ছে। আর তার দিকে তাকিয়ে তার খাওয়া দেখছে লিপি। এমন তাকিয়ে থাকা দেখে আঞ্জুমান কপট রাগ নিয়ে লিপিকে বলল,

‘তুই এমন কইরা আমার দিকে তাকাবি না।খাইলে খা, না খাইলে না খা। এমনে তাকায় থাকলে আমার পেট ব্যথা করব পরে।’

‘আইচ্ছা আঞ্জুমান আলী ভাইয়ে তোরে, আমারে তখন ছাইড়া দিলো কেন? আবার সাথে আমগুলা-ও আনতে দিলো।’

ভাবুক নয়নে ভাবনার প্রকাশ করে লিপি আঞ্জুমানের কাছে, অথচ আঞ্জুমান নিজের বেখেয়ালি চিন্তাভাবনা করেই শেষ করতে পারে না আবার লিপির করা মারপেঁচ প্রশ্নের উত্তর দিবে, যেখানে অন্যের মনে কী আছে তা নিয়ে।

‘এই এক পেঁচাল তুই কখন থেকে জিগাইতাছোস, হ্যাঁ? আমি কেমনে কমু কেন আমাদের ছাইড়া দিলো? সাথে আবার আম-ও দিয়া দিলো। আমি কি তার মনের ভিত্তে গিয়া দেখছি?’

আসলেই তো আঞ্জুমানের করা প্রশ্নগুলো একদমই ঠিক। সে তো জানে না অন্যের মনে কী চলে তাই সেগুলোর উত্তরই বা তার কাছে কীভাবে আশা করা যায়?

তখন আলীর করা রাগ আঞ্জুমানের দিকে তাকিয়েই প্রশমিত হয়ে গিয়েছিল। লিপি আর আঞ্জুমান খুবই ভয় পেয়েছিল। মনে হচ্ছিল এই না জানি আম চুরি করার কারণে তাদের নিয়ে বিচার বসায়। তখন তো আবার দু’জনের পরিবারের সবাই তাদের’কে উত্তম-মধ্যম দিবে। কিন্তু তার চিন্তা ভাবনার উর্ধ্বে গিয়ে আলী তাদের’কে বলে আমগুলো নিয়ে যেতে। তখন তারা হতবাক হয়ে একে-অপরের মুখে চাওয়াচাওয়ি করল আলীর কথা শুনে। তবুও বেশিক্ষণ সেটা টিকল না। তাড়াতাড়ি কেটে পড়ার চিন্তায় আমগুলো নিয়ে বিদায় হলো। তাও আবার মেইন গেইট দিয়ে, তখন আবার দারোয়ান আরেক কাহিনি ঘটাল। দারোয়ান তাদের’কে দেখে ভড়কে গেল। আর তাদের গেটের বাইরে যেতে দিতে চাইল না। বারবার আঞ্জুমানের হাত ধরতে চাইছিল। কিছুতেই তাদের’কে আম নিয়ে যেতে দিবে না। তাও আবার চুরি করা, তারই নাকের নিচ দিয়ে। যা দারোয়ানের গায়ে লাগল। কিন্তু শেষে দেখে বাড়ির কর্তাই তাদের’কে ছেড়ে দিতে বলছে। তাই সে-ও মুখটা কাচুমাচু করে আঞ্জুমান এবং লিপিকে ছেড়ে দিলো। কেন দিলো তাদেরকে ছেড়ে?

কিন্তু আঞ্জুমানের যে বোকা মগজ, বেশি কিছু আর সে চিন্তা করতে পারল না। সামনে থাকা কাঁচা আমের ভর্তায় মশগুল হয়ে পড়ল। লিপি যাও কিছুটা চিন্তিত ছিল, তবে ওই যে কথায় আছে না— ‘সবই এক গোয়ালের গরু’ কথাটি একদমই তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সে-ও খালি মস্তিষ্কের ব্যক্তি ঠিক আঞ্জুমানের মতো। তাই সে-ও আর বেশি চিন্তা ভাবনা করল না। ভর্তা খাওয়ায় ধ্যান দিলো আনন্দের সহিত। ভর্তা খাওয়া শেষ হলে দু’জন মিলে বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে, নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল হয়ে পড়ল। কিন্তু আসন্ন বিপদের আভাস আর টের পেল না । যদি টের পেত তাহলে এতো চিন্তা শূন্য থাকত না। এখন শুধু আসন্ন বিপদের অপেক্ষা। না জানি সেই বিপদ তাদের কতো দূরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়?

৪.
রাতে আলী আকবর শুয়ে আছে, আর তার চোখে ভাসছে সকালের দৃশ্যগুলো। ভুলানো যাচ্ছে না মেয়েটির চেহারা, মনের ভেতর বোধহয় গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছে। মনে হচ্ছে, ডাগর ডাগর চোখ দু’টো যেন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এখনো চেয়ে আছে তার দিকে। লম্বা উন্মুক্ত চুল তার মনকে উন্মাদ করে তুলছে ক্ষণে ক্ষণে। কী করবে সে এখন? কীভাবেই বা সামাল দিবে এই উত্তাল হওয়া বেসামাল মনটা’কে? তার যে ওই ডাগর আঁখির মেয়েটিকে চাই। হঠাৎ করে নিচের তলা থেকে বাড়ির কাজের লোক করিম মিয়ার ডাকে ভাবনা জগৎ থেকে ফিরে আসে আলী। বাবা-মা নামক ছায়া ব্যতিত সে বাড়িতে একাই থাকে। সে যখন বাইশ বছর বয়স তখন ঢাকা যাওয়ার পথে বাবা-মা দুজনেই এক্সিডেন্টে মারা যায়। সে আবার তার বাবা-মা’য়ের একমাত্র সন্তান। আবার তার বাবা ছিল তার দাদার একমাত্র সন্তান। যেন সেই যোগসূত্র ধরেই সে বাবা-মায়ের একমাত্র হওয়া সন্তান। কাজের লোক করিম মিয়া বেশির ভাগ সময় বাড়িটা দেখাশোনা করে। আলী নিচে গেল করিম মিয়ার ডাকে, গিয়ে দেখা গেল তার স্ত্রী রিমা এসেছে। সে বেশির ভাগ সময় নিজের বাবার বাসায় থাকে ঢাকাতে, মফস্বল এলাকা আবার তার বেশি একটা পছন্দ না। স্বাভাবিকই মেয়েটার জন্ম, বেড়ে ওঠার স্থান এত সহজে ভুলে গ্রামীণ এলাকায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে না। বাবা-মা, তিন ভাই ও ভাবিদের নিয়ে তাদের পরিবার। রিমা সেখানে অতি আদরের একমাত্র মেয়ে। যাকে কি না তাঁরা সবাই চোখের মনি করে রাখে। তার সব স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ করে। সেজন্যই তো আলীর মতো গ্রামের ছেলেকে মেয়ে দিতে বেশি ঝামেলা করল না। কারণ তাদের ভালোবাসার বিয়ে। ভালোবাসাটা আসলে রিমার দিক থেকেই। আলী তো কেবল তাদের টাকা’কে ভালোবেসেছে। সাথে যদি ফ্রি মেয়ে শরীর পায় তাতে মন্দ কীসের? আর আলী-ও থাকে সেখানে, যেটাকে একপ্রকার ঘরজামাই বলে। গ্রামে আসা মাঝেমধ্যে তাও চেয়ারম্যান পদটার কারণে। রিমির আচমকা আগমনে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ল আলী। সে ভ্রু কুঁচকে রিমাকে দেখে বলল,

‘কী ব্যাপার হঠাৎ এখানে এলে যে? ফোন-ও তো দিলে না। একা কীভাবে আসলে?’

‘কেন আসতে পারি না, নাকি? তোমাকে সারপ্রাইজ দিব বলে গ্রামে আসা। গাড়ি দিয়ে ড্রাইভার সাথে পাঠিয়েছে বাবা। তাছাড়া কতোদিন হয়ে এলো তোমাকে কাছেও তো পাই না একটু।’

শেষের কথাটা আলীর গলা জড়িয়ে ধরে বলল রিমা। বস্তুতই বাড়িতে কেউ একটা থাকে না। খাবার রান্না, ঘর গুছানো সকালে একবার কাজের মহিলা এসে করে যায়। আর করিম মিয়া নিচের তলার কোণার রুমে থাকে, যেখান থেকে সহজে বাহিরটা দেখা যায় না। গলা জড়িয়ে থাকা অবস্থায় রিমাকে কোলে তুলে নিলো আলী। রিমা-ও বেশ আবেশে আলীর গলা জড়িয়ে ধরে তার বুকে নাক ঘষতে লাগল। দু’জনই দু’জনকে কাছে পাওয়ার আশায় এগিয়ে যেতে লাগল নিজেদের শয়নকক্ষে। হায়! কোথায় গেল কিছুক্ষণ আগের নিষ্পাপ মেয়েকে চাওয়া? এক দমকা হাওয়ায় উড়ে গেল সেটা।

নিশাচর মধ্য রাত হবে হয় তো! বাগানের দিকের বারান্দাটা আলীর’ই পছন্দ করা তৈরি, যেটা রুমের সাথে অ্যাডজাস্ট করা। উন্মুক্ত বক্ষ নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে একমনে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াচ্ছে আলী। চারিদিকে কেমন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে! কিন্তু তার মনে কেবল প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের বাতাস বইছে।এতেই বুঝা যাচ্ছে কেউ একজন এই ঝড়ের কবলে পড়ে নিঃস্ব হবে। সে কেউ-টা কে? আলীর ধ্যানমন সেই কেউ-টা বলতে সকালের সেই মেয়েটিকে বুঝাচ্ছে। হৃদয়টা যে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারছে আলী। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়ায় সম্বিত ফিরে পেল। পিছনে তাকিয়ে দেখে তার স্ত্রী রিমা। শ্যামলা বর্ণের মেয়েটিকে দেখতে অতটাও খারাপ লাগে না। কিন্তু তাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য তো শুধু তার বাবার সম্পত্তি পাওয়া। রিমা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,

‘কী হয়েছে? ঘুমাচ্ছ না যে?’

‘ঘুম আসছে না।’

‘ঘুম আসছে না কেন? জানতে পারি।’

পেছন থেকে রিমাকে সামনে নিয়ে এসে ঘুরিয়ে তার কাঁধে থুতনি রেখে বলল,

‘মনটা সারাক্ষণই তোমায় কাছে পেতে চায় তাই।’

বলেই রিমার কাঁধে কামড় বসিয়ে দিলো আলী। ব্যথায় মুখ কুঁচকে রিমা জবাব কপট রাগের ভান করে বলল,

‘ইস কী ব্যথা পেলাম! আমাকে নাকি সে আবার কাছে পেতে চায়। আর আসবে না আমার সামনে, ব্যথা দিয়েছ। হুহ্!’

মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে নিলো রিমা কিন্তু তার আগেই শক্ত দু’টো বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া পেলো। খেয়াল করে দেখল বলিষ্ঠ হাতের লোকটি তাকে কোলে করে অন্ধকার ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। রিমা ভাবল, এই মানুষটিকে সে অনেক ভালোবাসে। তার জন্য সে অন্ধকার গহ্বরেও তলিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু সে কি বুঝতে পারল, তার মানুষটার মনে এখন কী চলছে? আলী কি তাকে কাছে পেতে চাচ্ছে নাকি সে শুধু তার মনের ঝড়ের খোরাক মিটাতে চাচ্ছে। কিন্তু সে চাওয়া-পাওয়ার পার্থক্যটা কেবলই হারিয়ে গেল দুজনের উষ্ণ নিশ্বাসে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here