#গজপ্রিয়া-7
#Chhamina Begam
রানিরা যখন নানুবাড়ি পৌছালো তখন ঘড়ির কাটা আটটা ছুইছুই ।দুর থেকেই বিয়েবাড়ির কোলাহলের আওয়াজ ভেসে আসছে । সোডিয়াম আলোর রোশনাইয়ে পুরোবাড়ি আলোকিত হয়ে উঠেছে। ছোটো ছোটো বাচ্চারা সেই আলোতে রাস্তায় হইহল্লা করছে। একটা খুশির আমেজ ছড়িয়ে আছে ছোট বড়ো সবার মধ্যে । গাড়ি থেকে নেমেই বাণি, বিলকিস দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেছে ।
   রানি আর ওর মা উঠোনে পা দিতেই রানির মেজ খালা সাহানাজ হাসি মুখে এগিয়ে এল বোনের দিকে ।
-” কেমন আছিস ছোট ?”
-“ভালো আছি আপা । তুমি কেমন আছ ?”
-“এই তো আছি ভালোই । রানি, তুই কেমন আছিস মা ?”
-“ভালো আছি খালামা । তুমি কখন এসেছ ? আর মিলি আপা আর মৌনি, সাহিন ভাইয়ারা কোথায় ?  ”
-” এই তো আমরা বিকেলে আসছি ।  মৌনি তো  এখানেই ছিল । ওই তো বিলকিসের সাথে আছে । আর মিলি মুস্তাফিনার সাথে  গল্প করছে  ।  সাহিন, ও   এখানেই আছে হয়তো কোথাও ।  আসার পর থেকেই দেখছি না ওকে । হয়তো তামিমের সাথে বেরিয়েছে । ”
-” আপা, দুলাভাই আসেনি ?” জিজ্ঞেস করল জাহানারা  ।
-“নারে , ও তো কাজ পাগল মানুষ । কাল আসবে হয়তো বিকেল নাগাদ । ” বলল সাহানাজ ।
-“আরে ছোট ফুপি, এখানেই দাড়িয়ে থাকবে নাকি ।  ভেতরে চলো , আম্মা ডাকছে ?”…কাছে এসে দাড়াল মৌসুমী ।
-“বৌমা, ভালো আছ তো ? তোমার মেয়ে কোথায় ?”
-” ভালো আছি ফুপি । তান্নু মুসুর সাথে আছে ।   চলো তোমরা । এসো । ”
–” হ্যাঁ যাই । আপা চলো । ”
-” আম্মু , তোমরা যাও । আমি  রুমে গেলাম । ”
-“আরে রানি ?” ডাকল মৌসুমী ।
-“হ্যাঁ ভাবি । বলো ..”
-“শোন , জামা কাপড়  পাল্টে তাড়াতাড়ি আসিস তো আমার কাছে । আমি রান্নাঘরে আছি ”
-“আচ্ছা ”
    ঘরে গিয়ে রানি দেখল তান্নু মোস্তাফিনার কোলে খেলছে আর মিলি মোস্তাফিনার সাথে গল্প করছে । দরজা খৈলার শব্দ হতেই দুজনেই তাকায় রানির দিকে ।
 -“হ্যালো লেডি , কেমন আছেন  আপনি ?”  হাসি মুখে রানি এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মিলিকে ।
-“হেই মাই কুইন  ,  আ’ম ফাইন । তুই কেমন আছিস ?”
-”  খুব ভালো … আচ্ছা আপু , তোমরা কথা বলো  আমি চেঞ্জ করি । ভাবি এখুনি যেতে বলল আমাকে । ”
-“আচ্ছা যা ”
–
   -” এখন সময় হল দুই বোনের আসার । মেয়েটা শুধু একার আমার ?  বিয়ে লাগছে একমাত্র ভাসতির ।  আর তার  ফুপিদের পাত্তা নেই ।   আত্মীয়ের মতো ঢুলে ঢুলে আসছ !”  সাহানাজ , জাহানারা যেতেই  কপট ঝাড়ি দেয় মনিরা ।
-“আরে ভাবি ,   বললেই কি আসা যায় বলো তো । পুরো সংসারের কাজ গুছিয়ে তারপর বেরতে পারছি । মহাসেনার আব্বু তো ছুটিও পায়নি । তাও আমাদের তিন মা মেয়েকে পাঠিয়ে দিল । ” বলল জাহানারা ।
-“আমার কথা তো জানোই ভাবি । সাহিনের আব্বু যা কাজ পাগল লোক ।   কত করে বলার পর   সাহিন সব কাজ ওর বাবাকে বুঝিয়ে দিয়ে  তারপর আমাদের নিয়ে এল । ”
  মনিরা দুজনের কথা শুনে হেসে ফেলল । বলল,
–” হয়েছে । এত এত কথা বলতে হবে না । আমি জানি তো । এমনিতেই মজা করলাম একটু । বসো । আমি চা বানাই । ”
-“ভাবি , আম্মার শরীর এখন কেমন ?” প্রশ্ন করল  জাহানারা ।
-” আগের মতোই । কোনো উন্নতি নেই । তাই তো মুসুর বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি   দিতে হচ্ছে । নাত জামাই দেখতে চায় আম্মা । ”
-“ওহ…. । ভাবি ,তুমি চা বানাও । আমি ততক্ষণে  আম্মার সাথে দেখা করে আসি । ”
-“হুম যাও ” 
 -” ভাবি,  কেন ডাকলে বলো ?”
 -”  ওহ  রানি ,  শোন এই প্লেটটা আমাদের ঘরে নিয়ে যা তো ।  তোর ভাইয়ার কোন এক বন্ধু এসেছে বলল।  আমি একটু এদিকে ব্যস্ত আছি । তুই দিয়ে  আয় না নাস্তার প্লেট টা ।  ”
-”  ঠিক আছে।  দাও । ”
 -“ভাইয়া,  দরজাটা খোলো । ভাবি নাস্তা  পাঠিয়েছে”
-“ভেজানো আছে । চলে আয় “.. ঘরের ভিতর থেকে লাবিবের আওয়াজ ভেসে আসে।
    ঘরে ঢুকেই রানী  যেন চারশো চল্লিশ  ভোল্টের ঝটকা খেল । এ কাকে  দেখছে সামনে ?  আশিক ভাইয়া ।  ওহ আল্লাহ ,কেমন দেখা যাচ্ছে আমাকে ? চুল গুলো ঠিক আছে তো ? মুখ ধুয়ে ক্রিম ও  তো লাগাইনি আজ  ! নিজের পোশাকের দিকে তাকিয়ে আর একবার আফসোস হয় রানির  । ইস , আজকের দিনেই এই নেতানো কুর্তি টা পড়তে হলো । ইস্ত্রিটা একদম নষ্ট হয়ে গেছে । সামনে যেটা পেয়েছে সেটা পড়ে চলে এসেছে রানী । অত খেয়াল ছিল না ।  ফুরফুরে মনটা এক নিমিষেই জন্য কালো মেঘে ঢেকে গেল  । আরষ্ঠ  হয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে দাড়িয়ে রইল  ।
-” রাণী  ,দাড়িয়ে আছিস কেন ? আয়  ভেতরে …” লাবিবের কথায় সচেতন  হয় ।  গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় ঘরের ভিতরে ।  সোফায় বসে গল্প করছে লাবিব আর আশিক । তাদের সামনে টি টেবিলের ওপর নাস্তার প্লেট  রাখে রানি  । একটা প্লেট তুলে আশিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
 -” ভাইয়া নাস্তা নিন । ”
   আশিক মিষ্টি করে হেসে নাস্তার প্লেট হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে ,
-“কেমন আছ রানি ?
-“ভালো আছি ভাইয়া । আপনি কেমন আছেন ? ”
-“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি । ”
   বলেই আশিক তার বিখ্যাত  মুচকি হাসিটা হাসে ।   ওই হাসি দেখে রানী থমকে যায় ।    ফিরে যায়   সাত বছর আগে অতীতের সেই দিনগুলোতে । তখন ইলেভেনে পড়তো রানী।  ইংলিশ পড়ার জন্য আশিকের কাছে টিউশন নিত ।  আশিক তখন পঁচিশের টগবগে যুবক  ।  শ্যাম বর্ণের প্রায়  ছয় ফুট উচ্চতার  মাঝারি স্বাস্থ্যের  আশিক তখন  সদ্য মাস্টার্স কমপ্লিট করে পি.এইচ.ডির প্রিপারেশন নিচ্ছিল ।  ঘন চুল গুলো সবসময় ব্যাকব্রাশ করা থাকত ।  চওড়া কপাল  ,উন্নত নাক ,  চাপদাড়ি যুক্ত   মুখখানিতে সবসময় মুচকি হাসি লেগেই থাকত ।  বলতে গেলে সেই সময়ের ওদের পুরো ব্যাচের মেয়েদের ক্রাশ ছিল আশিক । রানিদের পাড়ার প্রায় সব মেয়েই আশিক বলতে একবাক্যে চিনত ।  রানি নিজেও আশিককে ইমপ্রেস করার জন্য কম চেষ্টা করেনি ।  রোজকার পড়া কমপ্লিট করে যেত ।  আশিককে ইমপ্রেস করার চক্করে ইংলিশ পরীক্ষায় সেবার 94 পেয়েছিল রানি ।  আর প্রতিবার রানি  টিউশনে   ক্লাস টেস্ট গুলোতে ভালো  করলেই  আশিক মিষ্টি করে হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত । আর তাতেই একসপ্তাহ পর্যন্ত চুল ধুতে চাইত না রানি । চুলে জট লেগে ময়লা হয়ে কি  যে বিশ্রী  হয়ে যেত  । ছোট থেকে মোস্তাফিনা আর ও একি রুমে ঘুমায় ।  মোস্তাফিনা কত বকাবকি করেছে  ওকে ।   কিন্তু তবুও রানি চুল ধুবে না । একপ্রকার জোর জবরদস্তি  করেই মোস্তাফিনা তখন   চুল ধুয়ে দিত রানির । ইস , এখন এসব মনে পড়লেই ভীষণ লজ্জা পায় রানি ।   একই টিউশনে পড়ার সুবাদে সম্রাট কিছু কিছু জানত । এ নিয়ে কম জ্বালাতন করেনি রানিকে ।  দুজনেই কোনোকিছু দিয়ে ঝগড়া লাগলেই সম্রাট আশিকের কথা বলে ক্ষেপাত রানিকে ।  তার পর  আশিক চাকরি পেয়ে চলে গেল এলাকা ছেড়ে । আর রানিও  চলে গেল শান্তিনিকেতন  । এত বছর পর আজ দেখা হল সামনাসামনি ।   স্বাভাবিক ভাবেই এতদিন পরে  আশিককে দেখে   রানি চমকে গিয়েছিল  । ছোটবেলার কথা গুলো মনে পড়তেই কোথা থেকে যেন  একঝাঁক লজ্জা এসে জড়ো হল মুখখানিতে । 
   -” পড়াশোনা কেমন চলছে রানি ?”
  আশিকের ভারী স্বর শুনে  রানি ভাবনার জাল ছিড়ে বাস্তবে ফেরে । বলে ,
-” ভালোই । …..আচ্ছা , তোমরা গল্প কর ।  আমি আসি তাহলে ..  ” কোনো রকমে কথা গুলো বলেই  রানি দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে ঘর ছেড়ে । উঠোনে  দাড়িয়ে একটা লম্বা নিশ্বাস নেয় । তখনি ঘাড়ের কাছে কারো গরম নিশ্বাসের সাথে  পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে আর এক দফা  চমকে ওঠে রানি ।
-” কি হয়েছে রে তোর ? এভাবে হাপানি রোগির মতো করে শ্বাস নিচ্ছিস কেন ?”
     নিজেকে সামলে ঘাড় ঘুরিয়ে   সম্রাটকে দেখে বেজায় ক্ষেপে যায় রানি ।  বলে,
-” আমাকে তোর হাপানি রোগি  মনে হচ্ছে ? ”
-” হুম , সেরকমই লাগছে । এই দেখ ,এখনো তুই জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস ফেলছিস। ”
   সম্রাটের কথায় রানি নিজের নিশ্বাসের গতি খেয়াল করে । সত্যি তো । এখনো বুকটা ধরপর করছে । এর কারণ  কি ?   ও হো । ছোট বেলায়  কারো ওপর ক্রাশ খেয়ে এই  বয়েসে তাকে সামনে দেখলে তো লজ্জা লাগবেই । আর হ্যাঁ , এই সাদা বান্দরকে এই কথাটা কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না  যে আশিক ভাইয়ার সাথে এখন কথা হয়েছে আমার ।  নাহলে  এর খোঁচায় জীবন থেকে শান্তি জিনিসটা পারমানেন্টলি উড়ে যাবে ।  নিজেকেই বুঝ দেয় রানি । তারপর চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নেয় । সময় নিয়ে  ছেরেও দেয় । তারপর লাবিবের ঘরের দিকে আঙ্গুল ইশারা করে বলে,
-“আসলে ওই খানে   দরজার কাছে…  একটা  সাপ দেখলাম । তাই ভয় পেয়ে গেছি । ”   চট করে কিছু খুঁজে না পেয়ে সাপের কথাই বলে রানি ।
-“সাপ ? কোথায় ? এখানে সাপ আসবে কেন ? যে কোলাহল চারিদিকে ….”  লাবিবের ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্যের সুরে বলে সম্রাট ।
-“ছিল । এখন নেই । চলে গেছে । ঢোরা সাপ ছিল  মনে হয় । ”
-” আচ্ছা যাক ।  শোন ডিনারের পর ছাদে পার্টি হবে । আপুকে নিয়ে আসবি । ”
-” পার্টি ?”
-“হুম আপুর  জন্য ব্যাচেলর পার্টি । হ্যাঁ তবে কোনো মেনু নেই । শুকনা পার্টি হবে । ” বলে রানির মাথায় একটা চাটা মেরে বাকা হেসে চলে যায় সম্রাট ।  মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে তাকায় রানি সম্রাটের দিকে । বিরবির করে বলে ,
-“বান্দার , সাদা বক একটা ।   দু মিনিট ভালো করে কথা বললেই তিন মিনিটে নিজের আসল স্বভাব দেখিয়ে দেয় ।   ”
To be continue…





