#চন্দ্রপুকুর
||১৬তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
যামিনী নিয়মমাফিক শিক্ষিকার সাথে পড়া-লেখার পাঠ চুকিয়ে কক্ষের দিকে ফিরে। কক্ষের দ্বার খুলে অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই অবাক সে।
সম্মুখে তার সেবায় নিয়োজিত এক দাসী তার চিঠির বাক্স হাতে অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে। কিছুটা মুহূর্ত পেড়িয়ে গেলে মেয়েটি তাকে ঝুঁকে সালাম জানায়।
“আসসালামু আলাইকুম, বেগম চন্দ্রমল্লিকা।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমি এখানে কী করছিলে?”
“আমি? আমি তো আপনার জিনিসপত্র গুছিয়ে দিচ্ছিলাম বেগম।”
নত মুখে সে বাক্য সমাপ্ত করতেই তাকে চেপে ধরে দিলরুবা। যামিনী তার কোমর হতে ছুড়িটি বের করে চেপে ধরে তার গলায়।
“সত্যি করে বলো দাসী। কী করছিলে তুমি এখানে? আমাকে তোমায় আঘাত করতে বাধ্য কোরো না।”
“আমি সত্যি বলছি বেগম। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন।”
রাগ হয় কিশোরীর বিপুল পরিমাণে। তার হস্ত খানা ধরে আঁচড় কাটে ছুড়ির সহায়তা। গলায় আরও শক্তভাবে চেপে ধরে ছুড়িটি, কিছুটা চামড়া ভেদ হয়ে রক্তের দর্শন পাওয়া যায়। তীব্র বেদনায় কোঁকিয়ে উঠে মেয়েটি, ফিনকি দিয়ে ছুটে।
“আমি বলছি, বেগম। বলছি। বেগম লুৎফুন্নেসা এই আদেশ দিয়েছিলেন আমায়। আমার কোনো দোষ নেই। একটু অনুগ্রহ দেখন বেগম। আমাকে ছেড়ে দিন দয়া করে।”
“এই মেয়েকে কোনো দাসীর সাথে বৈদ্যশালায় পাঠাও। হাতে কাপড় প্যাঁচিয়ে নিয়ো। আর তুমি দ্রুতো কক্ষে ফিরো দিলরুবা।”
দিলরুবা সায় জানিয়ে তার মনিবের আদেশ পালন করে। কক্ষে ফিরলে যামিনীকে চিন্তিত ভঙ্গিমায় জানালার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য তাকেও চিন্তিত করে।
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন। আমার মনে হয় দাসীকে তাও আবার বেগম লুৎফুন্নেসার শরণাপন্ন দাসীকে আঘাত করা সঠিক হয়নি। অন্দরমহলের নিয়ম বহির্ভূত…”
“রাখো সেসব দিলরুবা। আমি বেগম চন্দ্রমল্লিকা, নবাবের প্রিয়, বিশেষ এবং একমাত্র নারী। আমাকে আবার কে কী বলবে? চিন্তার বিষয় হলো এই দাসী যদি দাদীজানের গুপ্তচর হয়, তবে বাকি দাসীগুলো ক্যানো হবে না? কারণ সব দাসী তো উনাদেরই চয়ন করা।”
দিলরুবা নত করে ফেলে চোখ। তার কথায় মাথা ঝাঁকায়।
“আমার নতুন দাসী নেওয়া লাগবে। এমন দাসী যারা হবে আমার পক্ষে, আমার প্রতি অনুগত এবং আমার বিশ্বস্ত। যারা গুপ্তচরও হবে আমার জন্য।”
“কিন্তু বেগম এমন দাসী কোথায় খুঁজবেন আপনি? যারা আছে তা তো অন্দরমহলের মধ্যেই।”
“আমার জানামতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে দাস বা দাসী নিয়োগ দেওয়া হয় বা আনা হয় নবাববাড়ির উদ্দেশ্যে। আমাদের গ্রামেই তো যেয়ে প্রচার করা হতো এই চাকুরীর বিজ্ঞাপন। সেই দিন কবে তা খোঁজ করো।”
“যথা আজ্ঞা বেগম চন্দ্রমল্লিকা।”
___
শাহাজাদি মেহনূর বেগম লুৎফুন্নেসার কক্ষে বসে তাঁর উদ্দেশ্যে অপেক্ষা করছে। ক্রোধে ফোঁস ফোঁস করছে রীতিমতো। বারবার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠছে মেহমাদ শাহ ও যামিনীর অন্তরঙ্গ দৃশ্য।
কয়েক মুহূর্ত বাদেই কক্ষে প্রবেশ করেন বেগম লুৎফুন্নেসা ও আয়েশা খাতুন।
রত্না ও শাহাজাদি মেহনূর দাঁড়িয়ে তাদের স্বাগতম জানায়।
“আসসালামু আলাইকুম, নানীজান।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম আমার চাঁদের কিরণ। মুখটা আজও মলিন। কতো বার বললাম নিজেকে সামলে নেও, এসব তো হবেই।”
“নানীজান, আমি আর পারছি না। আমার হৃদয় পুড়ছে। সব তো মেনে নিয়ে কাটাচ্ছি এই প্রাসাদে দিন। তবে এখন কি চন্দ্রমল্লিকার তিরস্কার ও ভৎসনাও সহন করতে হবে? আমার পরীক্ষার সময়ও ঘনিয়ে আসছে, শহরে ফিরতে হবে। তুমি কিছু করো না নানীজান, ফিরিয়ে দাও আমায় আমার শাহকে।”
বেগম লুৎফুন্নেসা বিচলিত হন। নাতনির এমন আবদার গ্রহণ বা পূরণ করার কোনো পরিকল্পনা নেই তার, আবার এমন মলিন চেহারাও সহ্যকর নয়।
“শান্ত হও। চন্দ্রমল্লিকা আবার কী বলেছে তোমায়?”
যুবতী নিজের বচন অভ্যন্তরে চাপা রেখে যামিনীর বাণীগুলো সত্য-মিথ্যে মাখিয়ে বললো। বেগম লুৎফুন্নেসার তা শ্রবণগত হতেই সে ক্ষিপ্ত।
“এতো স্পর্ধা ঐ মেয়ের! এজন্য আমার এসব ছোটো ঘরের আনাড়ি নারী পছন্দ নয়। সামান্য জয় করেই ভাবে বিশাল সাগর পাড়ি দিয়েছে, সামান্য ক্ষমতাতেই সঠিক-বেঠিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।”
দরজার করাঘাতের শব্দে ধ্যান ভঙ্গ হয় সকলের। বৃদ্ধা নারীটি বিরক্তির ভঙ্গিমায় জিজ্ঞেস করেন,
“কী হয়েছে? কে এসেছে?”
“মালিহা খাতুন, বেগম। বলছে জরুরি প্রয়োজন।”
“ভিতরে আসতে বলো।”
মনিশা খাতুনের সাথে যামিনীর আঘাতে আহত দাসীটিও প্রবেশ করে। হাতে ও গলায় ক্ষত দেখেই ভ্রু কুঞ্চিত হয় বেগম লুৎফুন্নেসার।
“এই কন্যার এমন দশা হলো কী করে? অন্দরমহলে দাসীদের মাঝে ঝগড়া-বিবাদ হয়েছিল না কি আমার অগোচরে? আমার কানে তো কোনো খবর আসলো না।”
“দুঃখিত, বেগম লুৎফুন্নেসা। আপনি ভুল বুঝছেন। ঘটনাটি তা না আপনি যা ভাবছেন।”
মালিহা খাতুন দাসীকে ইশারা করলো গোটা ঘটনা প্রকাশ করতে। তার ইশারায় দাসীটিও তোতাপাখির ন্যায় এক এক করে খুলে দেয় ঘটনার প্রতিটি পাতা। সবটা কর্ণগোচর হতেই বেগম লুৎফুন্নেসার সে কী ক্রোধ!
“স্পর্ধা কী করে হয় ঐ মেয়ের আমার অন্দরমহলে রক্তপাত করার! এর শাস্তি তো ওকে পেতেই হবে। আয়েশা খাতুন ডাকাও…”
আর কিছু বলার পূর্বেই হাত ধরে তাকে থামায় মেহনূর। তার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি।
___
মেহমাদ শাহ মিনার ও হিসাবরক্ষক সহ অন্যান্য কর্মচারী ও উপদেষ্টার সাথে তার ব্যবসায়ক পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছে। নবাববাড়ির নবাবের বৈঠক ঘরে বসে।
“জমিদার বাবু, এবার পেয়াজের উৎপাদন ভালো হয়েছে। শেরপুর ব্যতীত শোনা যাচ্ছে অন্যান্য স্থানে এবার পেয়াজের উৎপাদন ভালো হয়নি। আমার মনে হয় পেয়াজটা কিছুটা সময় আটক করে রাখলে গুদামে আরও চড়া দাম পাওয়া যাবে।”
“ঠাকুর সাহেব ঠিক বলছেন হুজুর। আমারও তাই মনে হয়। তাছাড়া এবার গোলাপ ফুলের উৎপাদন কম হয়েছে, লোকসান হতে পারে। এখান থেকে উর্ধ্ব মূল্য পেলে লোকসানটা ঘুচাবে।”
একটু ভাবে মেহমাদ শাহ। তারপর প্রশ্ন করে,
“আখ চাষের কী অবস্থা? আমাদের চিনির ফ্যাক্টরিতে পাঠিয়ে দিন দ্রুতো। আর পুকুর ও নদীর মাছের তো কোনো খোঁজ-খবরই নেই। দু’বছর ধরে এই ব্যবসার জন্য শেরপুর থেকে কোনো মাছই পাচ্ছি না বলতে গেলে।”
“হুজুর গত দু’বছর ধরে পুকুর ও নদীতে মাছের পোনা তো দেখা যায়, কিন্তু তোলার সময় মাছ পাওয়া যায় না তেমন। আমরা সন্দেহ পোষণ করছি গ্রামবাসীরা আমাদের তোলার পূর্বেই মাছ ধরে খেয়ে ফেলে।”
“এ কী করে সম্ভব! নদী ও নির্দিষ্ট পুকুর বাদে আমরা তো সকল পুকুর ও বিল উন্মুক্ত রেখেছি তাদের জন্য। এটা নিয়ে তদন্ত করা হোক। ফলাফল বের হলেই কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মেহমাদ শাহের কথা শেষ হতে বৈঠক ঘরে পা রাখে একজন খাদিম। জিজ্ঞেসু দৃষ্টি যুবকের।
“আসসালামু আলাইকুম জমিদার বাবু। আপনাকে বেগম লুৎফুন্নেসা অন্দরমহলের বৈঠকখানায় উপস্থিত হতে বলেছেন।”
জমিদারির কার্য নিয়ে বোঝা পড়ার মাঝে অন্দরমহলের চিন্তা মাথায় দেওয়ায় বিরক্ত ও ক্ষিপ্ত হয় মেহমাদ শাহ। ধমক দিয়ে খাদিমকে স্থান ত্যাগ করতে বলে।
___
বৈঠকখানায় বসে আছে বেগম লুৎফুন্নেসা, বেগম নূর বাহার, শাহাজাদি মেহনূর। আছেন মোর্শেদা খাতুন, আয়েশা খাতুন এবং মালিহা খাতুনও। কাঠের দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে দাসীরা। যামিনীও উপস্থিত। সে নিশ্চিন্তভাবে বসে আছে, তার জলকণা পরিমাণও ধারণা নেই কী হতে চলেছে তার সাথে কয়েক মুহূর্ত বাদেই।
চলবে…