#চন্দ্রপুকুর
||১৫তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
রজনীর সমাপ্তি হতে বেশ খাণেক সময় বাকি। স্বভাবগতই যামিনীর নিদ্রা ভঙ্গ হয় ফজরের পূর্বে। পাশে তাকালে নিদ্রারত মেহমাদ শাহকে দেখে অজান্তেই মুখমণ্ডলে চওড়া হাসি ফুটে উঠে। অধর ছোঁয়ায় তার ললাটে৷
“আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘায়ু দান করুক বাবু মশাই, তবে এই দীর্ঘায়ুতে যেন একমাত্র আমিই আপনার সঙ্গী থাকি অন্য কেউ নয়। নাহলে সেই নারীর হৃদস্পন্দন ছিনিয়ে নিতে আমার হস্ত খানা একবারও কম্পিত হবে না।”
যামিনী শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মাথা ও গায়ে রাজকীয় ওড়নাটি জড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়ে যায়। তাৎক্ষণাৎ চোখ জোড়া খোলে মেহমাদ শাহ। তার ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি।
“বাচ্চা হরিণী বনাম বাঘিনী এতো ক্রোধ, অনুভূতির জোয়ার সামলাতে পারবে তো? আবার কোনো ভুল না করে বসে।”
দরজায় করাঘাত করে তার সেবায় নিয়োজিত খাদিমরা। উচ্চ শব্দে উচ্চারণ করে,
“আসসালামু আলাইকুম, জমিদার নবাব শাহ। ফজর নামাজের ওয়াক্ত হয়েছে।”
আগমনের অনুমতি দেয় যুবক। নিজের ভাবনায় জলাঞ্জলি দিয়ে মসজিদে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে।
যামিনী কক্ষের দ্বারের সম্মুখে আসলে আঁখিতে ভেসে উঠে দিলরুবা সহ তার সেবায় নিয়োজিত দাসীদের মুখশ্রী।
“তোমরা হাম্মাম খানা প্রস্তুত করো আমার উদ্দেশ্যে। দিলরুবা তুমি আসো আমার সাথে উত্তরীয় চয়নের জন্য।”
আদেশ দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে যামিনী। দিলরুবা এক এক করে বস্ত্র দেখাতে শুরু করে।
“দিলরুবা, এই নীল রঙের সোনালী সুতো সজ্জিত পোশাকটি পরিধান করবো আমি আজ। আর সোনালী মসলিনের ওড়নাটি।”
“যথা আজ্ঞা, বেগম চন্দ্রমল্লিকা।”
অতঃপর হাম্মাম খানার দিকে অগ্রসর হয় যামিনী। দীর্ঘ সময় স্নান নিয়ে কক্ষে ফিরে সে। কক্ষের বাহিরে বের হতে নিলে দিলরুবা জিজ্ঞেস করে,
“বেগম, গহনা পরবেন না? চুলও তো শুকায়নি।”
“আজ অর্ধ সিক্ত কেশেই এই আবছা অন্ধকারে হাঁটতে হৃদয় টানছে। আর কোথায় আমি অলংকৃত নেই দিলরুবা? আমার ভূষণ বাবু মশাইয়ে ভালোবাসার চিহ্ন এই আংটি, আমাদের সম্পর্কের চিহ্ন এই নোলক, আমার আভিজাত্য ও মর্যাদার চিহ্ন এই গলার আমার দু’হাতে বিদ্যমান নবাব বংশের খানদানি চূড়।”
দিলরুবা নত দৃষ্টিতে মৃদু হাসে। মাথা ঝাঁকায় ধীরে ধীরে। যামিনী কক্ষ ত্যাগ করে। এই আবছা আলোতে মিষ্টি জুঁই ফুলের সুঘ্রাণে হেঁটে বেড়ানোর প্রবল ইচ্ছে তাকে ধেয়ে এনেছে বাগানে। দিলরুবার সাথে বাগানে হাঁটার সময় একজন অতি প্রিয় ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ।
যামিনী তাকে দেখে হৃদয় পোড়ানো হাসি দেয়।
“আসসালামু আলাইকুম শাহাজাদি। কী অপরূপ লাগছে আপনাকে দেখতে!”
“মাশাআল্লাহ বলো। নজর লেগে যাবে আঁধার ছায়ার।”
কিছুটা তাচ্ছিল্য করেই দুটো বাক্য উচ্চারণ করে শাহাজাদি মেহনূর। হয়তো কষ্ট দিয়েই নিজের ব্যথা উপশমের প্রচেষ্টা।
যামিনী বুঝতে পারে। তবুও মুখশ্রীতে এতো টুকু পরিমাণও তার ছাপ আনে না।
“দুঃখিত, মাশাআল্লাহ! সৌন্দর্যে অনেক গর্ব আপনার শাহাজাদি, থাকা উচিত। লানাত তো তার উপর যার মাঝে এই সৌন্দর্য নেই! আর আফসোস তার না কি সৌন্দর্যের জন্য যে এতো নন্দিত রূপের অধিকারী হয়েও নিজের ভালোবাসা পায়নি।”
মেহনূর অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রমণীর দিকে। তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
“সেসব কথা থাক শাহাজাদি। তবে আপনি উত্তর দিক থেকে আসছেন, বৈদ্যশালায় গিয়েছিলেন বুঝি? কিন্তু কী জন্য? আপনার আবার কীসের ব্যথা, কষ্ট?”
চিন্তিত হওয়ার ভঙ্গিমা কিশোরীর। অনেকটা কাছে এসে দাঁড়ায় নারীটি যামিনীর।
“সামান্য শরীর খারাপ ছিল তাই গিয়েছিলাম। অতিরিক্ত কিছু নয়। আর প্রথম বাজিতে জিতে আনন্দিত হওয়া আনাড়িপনার পরিচয়। আর অনভিজ্ঞ নাবিক ভাগ্যের জোরে খুব বেশি দিন টিকে না, একদিন অথৈ সাগরে ডুবেই।”
“আমি তো এভাবেই আনন্দিত নারী, নবাব মানে বাবু মশাইয়ের প্রেমে যে প্রতি রাতে সিক্ত হই। এজন্যই তো ভোরে ভেজা থাকে আমার চুল।”
মেহনূর কিছু বলবে তার পূর্বে তার নয়নযুগল আটক হয় যামিনীর হস্ত খানায় বিদ্যমান আংটিতে। মূল্যবান এই আংটি প্রথম দর্শনেই চিনে ফেলে সে, তাতে থাকা মহামূল্যবান রত্নটির জন্য।
যামিনী তার দৃষ্টি অনুসরণ করে হেসে শুধায়,
“এটাও আমার ভালোবাসার চিহ্ন। বাবু মশাইয়ের দেওয়া।”
মেহমাদ শাহ হাঁটার উদ্দেশ্যে বাগানে প্রবেশ করে। খেয়াল করে বাগানে দাঁড়ানো যামিনীকে। বুক ধ্বক করে উঠে তার। অলক্ষ্যেই হয়তো ওড়না পড়ে গিয়ে দেখা যাচ্ছে অর্ধ সিক্ত কেশ, একদম অল্প অলঙ্কারে সাজানো দেহ, সতেজ ও স্নিগ্ধ মুখশ্রী আরও ফুটে উঠে সাজ-সরঞ্জাম ত্যাগে।
“আমাকে বেগম চন্দ্রমল্লিকার সাথে একা ছেড়ে দেওয়া হোক। স্থান ত্যাগ করুক সকলে।”
বাগানের দিকটায় কোনো প্রহরী নেই, তাই জানান না দেওয়ায় টের পায়নি কেউ মেহমাদ শাহের আগমন। হুট করে তার কণ্ঠ শুনে অপ্রস্তুত হয়ে উপস্থিত সকলে। তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগ করে।
যুবক এগিয়ে যেয়ে শক্ত একখানা চুমু খায় তার বাচ্চা বাঘিনীর ললাটে ও কপোলে। সে নিজেও অতঃপর মসজিদের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যায়। একটু বাদেই আজানের শব্দ আলোড়িত হলে পরিবেশ যামিনীও নিজের কক্ষের দিকে অগ্রসর হয়।
___
বেগম নূর বাহার ও শাহাজাদি মেহনূর আঙিনায় তাদের আড্ডার স্থল তথা বৈঠক খানায় বসে আছেন। একজন ক্ষিপ্ত তো অপরজন রাগান্বিত ও দুঃখ জর্জরিত। নীরবে অবিরাম ধারায় আঁখিজলে কপোল ভাসাচ্ছে মেহনূর
একটু বাদেই বেগম লুৎফুন্নেসা এসে বসেন তার আসনে। তার আগমনে উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগতম জানায় তারা।
“আসসালামু আলাইকুম, বেগম।”
“হুম, বসো। তবে তোমাদের চেহারার এই হাল ক্যানো?”
“কাল যা হলো আম্মিজান তাতে এই দশা না হয়ে উপায় আছে? তবে আপনার স্বাভাবিক থাকা আশ্চর্যজনক বটে।”
“নূর বাহার, তোমার মুখ আজকাল একটু বেশিই চলছে আমার সম্মুখে। আমার কেমন থাকা স্বাভাবিক, আর কেমন থাকা অস্বাভাবিক তুমি আমায় বলবে? আদব ভুলে গেছো নারী!”
“দুঃখিত, আম্মিজান। গতকালের বিষয়টা নিয়ে এতোই চিন্তিত ছিলাম যে কী বলতে কী বলে ফেলেছি… মার্জনা করুন দয়াময়ী।”
“আমাদের জীবনে অনেক কিছু পরিকল্পনা মোতাবেক হয় না। কারণ আমাদের হাতে শুধু মাত্র পরিকল্পনা করারই ক্ষমতা আছে, বাস্তবায়ন করার নয়।
যা হয়েছে তা নিয়ে বসে থাকলে জীবন কাটবে না। সমস্যা বাড়বে বটে। তবে চন্দ্রমল্লিকার এ কাজ আমায় অভিভূত করেছে। মেয়েটা আনাড়ি হলেও সাহসী এবং বুদ্ধিমতীও নাহলে এই তথ্য এতো সুন্দর ভাবে সঠিক মুহূর্তে নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে পারতো না।”
শেষ বাক্যটি উচ্চারণ করতেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে শাহাজাদি মেহনূর। বেগম লুৎফুন্নেসার তার মাথায় হাত রাখেন।
“আমার চন্দ্রিমার আলো, চন্দ্রপ্রভা, সোনালীচুলো রাজকন্যা এতো টুকুতে এতো দুঃখিত হয় না। প্রথম বাজি জেতা মানেই খেলা জয় নয়, আবার হারা মানেও খেলা হারা নয়। তোমাকে তোমারটা জয় করে নিতে হবে। এখন কাঁদা বন্ধ করে, হেসে দেখাও আমার সোনা।”
যুবতী আলতো হাসে। বেগম লুৎফুন্নেসা আয়েশা খাতুনকে দাসীকে শরবত আনার আদেশ দিতে ইশারা করেন।
“তবে আম্মিজান, একটা বিষয় এখনও মাথায় ঢুকলো না যামিনী এই তথ্য পেলো কোথায়? যেই তথ্য আজ অবধি আমরা জানি না, তা তার একার পক্ষে জানাও সম্ভব নয়।”
“এই বিষয়টা আমিও বুঝতে পারছি না। আয়েশা খাতুন, তুমি কোনো খবর পেয়েছো?”
“না, বেগম। বেগম চন্দ্রমল্লিকার খাঁস বাঁদী বাদে তার সেবায় নিয়োজিত প্রতিটি দাসীই তো আমাদের গুপ্তচর রূপে কাজ করে। তারাও কিছু বলতে পারছে না।”
“দাসীদের বলো তার বিশ্বাস অর্জন করতে। এর জন্য যতো টুকু কর্ম করা লাগা করতে।”
“যথা আজ্ঞা, বেগম।”
বেগম লুৎফুন্নেসা নিজ হৃদয়েই বিচার-বিশ্লেষণ করতে শুরু করলেন। বেগম নূর বাহার এবং শাহাজাদি মেহনূরও তার সঙ্গি।
___
দাসী ও খাদিমদের অলক্ষ্যে একটি ছায়ামূর্তি প্রবেশ করে ধোপাখানায়। সেখানে অপেক্ষারত কেউ।
অপেক্ষারত মানুষটি জিজ্ঞেস করলেন,
“যা বলেছিলাম সেই অনুযায়ী কাজ হয়েছে? শুনেছি চন্দ্রমল্লিকার শাহের বিয়ে ভাঙা সম্পন্ন।”
“হ্যাঁ। আপনি যেভাবে বলেছিলেন সেভাবেই কাজ হয়েছে। তবে যে খেলায় আপনি মেতেছেন তা একবার লোকচক্ষুর সম্মুখে এলে ধ্বংস বয়ে আনবে।”
“তুমি চিন্তা কোরো না। আমাদের ঢাল চন্দ্রমল্লিকা, হাতের পুতুল হতে আর কিছুটা সময়। সবটা করবো আমরা তার আড়ালে থেকে, লোকচক্ষুতে ধরা পড়লেও সে পড়বে। আমাদের উপর একটা আঙুলও উঠবে না।”
হো হো করে হাসতে লাগলেন মানুষটি। সঙ্গ দিলেন ছায়ামূর্তিটিও।