#চন্দ্রপুকুর
||১২তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
তাৎক্ষণাৎ মেহমাদ শাহ নিজের বক্ষ হতে দূরে সরিয়ে দিল যামিনীকে। কানের নিকট নিজের মুখমণ্ডল এগিয়ে নিয়ে বিরস কণ্ঠে বলল,
“তোমার স্বভাব হয়ে গিয়েছে সুন্দর মুহূর্তগুলোকে নিজের অশ্রু নামক অগ্নিতে ভস্ম করে দেওয়ার। আমাকে নিজের অধীনস্থ বা অধিকারে ভাববার ভ্রান্তি ভাঙাও, নাহলে খুব কষ্ট পাবে। খুব!”
অশ্রুসিক্ত নয়নযুগল তুলে তাকায় রমণী নিজের প্রিয়তমের দিকে। যুবক তার চিবুক ধরে মুখশ্রী উঠিয়ে শক্ত, বিরস এক খানা চুমু খায় ললাটে। নিঃশব্দেই শয্যায় যেয়ে কপালে হাত রেখে চোখজোড়া বদ্ধ করে ফেলে।
যামিনী সেখানে দাঁড়িয়েই একদৃষ্টি দেখে পুরুষয়াটিকে। না, কোনো স্বপ্নময় সৌন্দর্যের অধিকারী নয় মেহমাদ শাহ। শুভ্র নয় কোমল হলদে উজ্জ্বল বর্ণের কায়া, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণই বলা কাম্য। লম্বাটে, কঠোর ও বুদ্ধিদীপ্ত মুখশ্রী, তীক্ষ্ম নাক, মৃদু গোলাপি অধরজোড়া, চাপ দাড়ি, লোম ও চুল কালো হলেও কিছুটা সোনালি আভা স্পষ্ট। তবে তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো তার মোহনীয় ব্যক্তিত্ব ও সসম্মোহনী চোখজোড়া।
আনমনেই যামিনী বিড়বিড়ায়,
“কী মায়াবী ও কোমলতম মুখশ্রী! অথচ, হৃদয় খানা আস্ত এক পাথর যামিনীর আগমনে।”
নিজের অশ্রুগুলো মুছে নিয়ে পরনের ভেজা পোশাক বদলে সাধারণ উত্তরীয় গায়ে জড়িয়ে নেয় নিদ্রা গমনের উদ্দেশ্যে। যদিও সে জ্ঞাত এই ক্ষণে তার নিদ্রা প্রাপ্তি হচ্ছে না।
___
শাহাজাদি মেহনূর ও বেগম নূর বাহার রঙ্গশালায় বসে আছেন। শুধু তারা ক্যানো? নবাববাড়ির অন্দরমহলে বসবাসকারী সকল খাদিম, দাসী ও সদস্যগণ উপস্থিত। বেগম লুৎফুন্নেসা এই রজনীতেই মেহমাদ শাহের আগমনের আনন্দ উদযাপনে আজ উৎসবের আয়োজন করেছে। তবে হাস্যকর বিষয় হলো বেগম লুৎফুন্নেসা ও মেহমাদ শাহ উভয়ই নেই।
মাঝখানে অন্দরমহলের কিছু মেয়েরা স্বতস্ফূর্তভাবে দফ ও খঞ্জনী বাজাচ্ছে, গানের সুর তুলছে, গাইছে, নৃত্য প্রদর্শন করছে। কাবাব, শরবত, বাদাম, খেজুর ও পাটিসাপটা পিঠা সহ বিভিন্ন পিঠার আয়োজন করা হয়েছে।
সবার হৃদয়ে উল্লাস, উৎসবের রঙ লেগেছে। গল্প-গুজব, মানবীদের কলরবে মেতে গিয়েছে গোটা রঙ্গশালা। অনেকদিন পর যে অন্দরমহলে উৎসব হচ্ছে।
“আমার ঘরে কোন এক পাখি
বসত করে যায়।
ধরতে গেলে দেয়না ধরা
করি কি উপায়?
আঁখির কোনে পাখির বাসা,
নীড়ে থাকে এই মোর আশা
পাখি ফিরে যেন চায়।
আশা ছিল মনে মনে
বাঁধবো বাসা ঘরের কোনে।
আমার আশার মুখে ছাই
আমায় ছেড়ে পাখি যেন
কখনো না যায়…”
গানটা যেন বড্ড বেশিই হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছে মেহনূরের। রমণীর বাল্যকাল হতেই একমাত্র স্বপ্ন মেহমাদ শাহ ও এই শেরপুরের জমিদারনির পদবী। সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চললে আজ মেহনূর বেগম হতো, কোনো মান-মর্যাদা ও যোগ্যতা হীনা যামিনী নয়। অজান্তেই এক ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে অধরের উপরে।
বিড়বিড়ায়,
“আপনি আমার স্বপ্ন নয়, জীবনের লক্ষ্য আপনি শাহ। আপনাকে আমার হননি তো কী হয়েছে? ভবিষ্যৎ কে জানে? ছলে, বলে, কৌশলে হোক আপনাকে মেহনূরের বক্ষেই ফিরতে বাধ্য করবো আমি।”
“মোর্শেদা খাতুন, এসব কী গান বাজাচ্ছে যুবতীরা? আনন্দোৎসব, একটু মন মাতানো গান গাক, সুর তুলুক। আমার পছন্দের গিতটা বাজাতে বলুন।”
“যথা আজ্ঞা, বেগম।”
“কোনো প্রয়োজন নেই। যা চলছে, চলতে দেও। আমার সিংহ এখনও আসেনি? মেহনূর, যাও। আমার সিংহকে ডেকে আনো।”
বলতে বলতেই শিমুল তুলার নরম ও নিচু গদিতে এসে বসেন দাদীজান। মোর্শেদা খাতুনও সায় জানিয়ে বসে পড়েন নিজ স্থানে।
ঘোর ভাঙে শাহাজাদির। সায় জানিয়ে উঠে রওনা হয় মেহমাদ শাহের কামরার উদ্দেশ্যে। বেশ পুলকিত ও তুষ্ট হয় সে। বহুদিন ধরে প্রিয় পুরুষটিকে হৃদয় ভরে দর্শন করতে পারে না। আজ করবে নিদ্রার সুযোগ নিয়ে।
পরিবারের সদস্য হওয়ায় খুব ভালো ভাবেই জ্ঞাত যুবক যাত্রা শেষে স্নান নিয়ে গভীর তন্দ্রায় তলিয়ে যায়। আজও নিশ্চয়ই এর বিপরীত কিছু হবে না।
কক্ষের দ্বারে এসে ভিতরে ঢুকতে নিলে প্রহরীরা বাধাদান করে। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহনূর।
“এই ভুল করার স্পর্ধা কী করে হয়?”
“দুঃখিত, শাহাজাদি মেহনূর। জমিদার নবাব শাহের আদেশ কেউ যেন কামরায় প্রবেশ না করে।”
“আমি কোনো ‘কেউ’ নয়। আমি শাহাজাদি মেহনূর, এই বংশের অংশ, শাহাজাদি। আমার বিরোধিতা করা মানে গোটা নবাব বংশের বিরোধিতা করে। এখন সরো আমার পথ থেকে! সরো!”
প্রহরীরা ভীতিগ্রস্ত হয়ে সরে যায়। উৎফুল্ল হৃদয়ে দরজা খুলে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। কিন্তু শয্যার দিকে দৃষ্টি ফেলতেই তার তিক্ততা ও বিতৃষ্ণাতে শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি হয়।
চক্ষুর সম্মুখে মেহমাদ শাহের বক্ষে সর্পের ন্যায় লেপ্টে আছে যামিনী। বিশাল ক্ষতে চিৎকার করে ক্রন্দন করতে চায় তার হৃদয়। নিজেকে সামলে বুকে পাথর ও মুখে আঁচল চেপে বেড়িয়ে যায়। প্রহরীদের বলে যায় তাদের জমিদার নবাব শাহকে উঠাতে।
রঙ্গশালায় যাওয়ার গোটা পথ যেন তার নিকট বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। অন্ধকারচ্ছন্নও ভীষণ। সে নিজের ভর সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলে তাকে ধরে ফেলে কেউ। চোখ উঠিয়ে তাকিয়ে দেখে আতঙ্কিত হয়ে দাঁড়ানো বেগম নূর বাহার। জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয় সে।
“কী হয়েছে আমার চাঁদের আলোর? কাঁদছো ক্যানো?”
“মামীজান আমি আর সহ্য করতে পারছি না এই যন্ত্রণা। আমি মরে যাব, মরে যাব মামীজান। আমার ধৈর্য্য ফুড়িয়ে যাচ্ছে ঐ নারীকে শাহের নিকট দেখতে দেখতে।”
বেগম নূর বাহার বুঝতে পারে কী ঘটেছে। মস্তিষ্কে এঁকে নেয় এক সামনের পদক্ষেপগুলো।
___
করাঘাতের শব্দে নিদ্রা ভঙ্গ হয় যামিনীর। তার পরনে শুধু ফিনফিনে পাতলা কাপড়ের উত্তরীয়বস্ত্র। তাই আর দরজা খুলার জন্য অগ্রসর না হয়ে নিজের কণ্ঠের ব্যবহার করাই উত্তম মনে করে।
“কে? কী জন্য ডাকা হচ্ছে?”
“আসসালামু আলাইকুম বেগম। বেগম লুৎফুন্নেসা সংবাদ পাঠিয়েছে জমিদার নবাব শাহকে রঙ্গশালায় যেতে। সেখানে জমিদারের আগমনে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।”
“ঠিক আছে। আমরা তৈরি হচ্ছি।”
এবার নিজের প্রিয়তমের পানে তাকায় যামিনী। শান্ত-শিষ্ট ও দিন-দুনিয়ার জ্ঞানহীন এক শিশুর ন্যায় তন্দ্রায় ডুবে সে। এই তন্দ্রা ভাঙানোর ইচ্ছে জাগছে না তার, তবুও উঠাতে তো হবেই।
“বাবু মশাই! বাবু মশাই! আর কতো ঘুমাবেন? উঠেন না কষ্ট করে। দাদীজান ডাকিয়েছো তো আপনাকে।”
জাগ্রত হয় মেহমাদ শাহ। শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ায় সে।
“দাসী বা খাদিমদের ডাকাও, মিনারকেও। আমি তৈরি হবো।”
মৃদু ক্রোধে ঠোঁট ফুলিয়ে যামিনী শুধায়,
“আমি তো এখানেই স্থির আছি। কৃষ্ণ দেহের রং বলে কি এই কামরা আলোতে হারিয়ে গিয়েছি না আপনার আঁখির দ্যুতিতে, যে আমাকে দেখেও দেখছেন না বাবু মশাই?”
“বাব্বাহ্! কী বিশাল ভৎসনা, তিরস্কার আমার উদ্দেশ্যে চন্দ্রমল্লিকা! আমার হরিণী যেন আজকাল আমাকেই সিংহী হয়ে আক্রমণ করতে প্রস্তুত। এতো না রাগ দেখিয়ে সোজাসুজিই তো বলতে পারো তুমিই আমায় তৈরি করতে চাও।”
লাজের লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে কৃষ্ণাঙ্গ মুখশ্রীতে, অদৃশ্য তা, শুভ্র হলে দৃশ্যমান হতো। তবুও যেন ধরা পড়ে যুবকের নয়নযুগলে। ভালোবাসা এমন এক জাদুকরী প্রদীপ যা বহু অদৃশ্য ক্ষেত্রও দৃশ্যমান করে দেয় অনায়াসেই।
মেহমাদ শাহকে নিজ হাতে তৈরি করে দিলো রমণী। যুবক নিজেকে আয়নায় পর্যবেক্ষণ করার মাঝে খেয়াল করে তার বাচ্চা হরিণী একদৃষ্টিতে তার পানে তাকিয়ে।
“তুমি তোমার কক্ষে যাচ্ছো না ক্যানো? তৈরি হবে না?”
“আসলে আপনাকে স্নান করাতে যেয়ে আমার পোশাক ভিজে গিয়েছিল পুরোপুরি। পরনের উত্তরীয়টি ব্যাতিত এই কামরা আমার পরিধান করার মতোন কিছু নেই। আপনি আদেশ করলে এভাবেই আমার কক্ষে যাবো?”
তড়িৎগতিতে ডান হস্তের তিন আঙুলে তার কপোল শক্ত করে চেপে ধরে মেহমাদ শাহ। কোঁকিয়ে উঠে রমণী।
হিসহিসিয়ে বলে উঠে,
“একদম প্রাণ নিয়ে নিব চন্দ্রমল্লিকা। এই রূপ, এই দেহ, এই এলোকেশ দর্শন করার ও ছোঁয়ার অধিকারী একমাত্র আমি। তুমি কি না বলছো এই রূপে প্রহরী ও দেহরক্ষীদের সামনে দিয়ে বের হবে তুমি!”
নির্বাক যামিনী। সে ভাবেওনি এমন কোনো প্রতিক্রিয়া পাবে, খুব সাধারণ ভাবেই বলেছিল সে। তবে চাপা আনন্দও জেগে উঠছে গোটা শেরপুরের শাসকের আঁখিতে ঈর্ষার সাক্ষাৎ পেয়ে, যার কারণ সে নিজেই।
চতুর ভাবনা আসে তার মস্তিষ্কে। আনন্দ টুকুতে পাথর চেপে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিমায় শুধায়,
“হ্যাঁ, আমি শুধু আপনার অধীনস্থ, আমার উপর পুরো আপনার অধিকার। আর আপনার উপর আমার কোনো অধিকার ভাবার অধিকার টুকু নেই। আপনাকে ছাড়া কেউ আমায় ভালোভাবে দেখবেও না। অথচ, আপনি অন্যকাউকে বিবাহ করে তার স্পর্শে সিক্তও হবেন। কী অদ্ভুৎ না সব নিয়মগুলো! কেমন একপাক্ষিক!”
“যামিনী…”
“হয়েছে, কিছু বলা লাগবে না। আমিই দুঃখিত নিজের দুঃসাহসিকতার জন্য। তবে কী করবে বলেন? আমি খুব বেশি নিস্তেজ, নিঃস্ব হয়ে পড়ছি ধীরে ধীরে। আপনি বিনা আমার এই গোটা মহল তো দূরে থাকুক দুনিয়াতে কেউ নেই, আপনিও অন্য কারো হয়ে গেলে…
আর কী যাবো এই উৎসবে? আমাকে তো ডাকায়নিও তারা। কেউ তো আমাকে আপনার স্ত্রী ভাবেই না। পদে পদে আঘাত করে শব্দের বাণে আমাকে। অবশ্য আমি তো আঘাত করার মতোই নারী। সামান্য এক দাসী, মনোরঞ্জিনী।”
যুবকের চরণের সম্মুখেই কাঁদতে কাঁদতে মেঝের বসে পড়ে সে। মেহমাদ শাহ সহ্য করতে পারে না প্রিয়তমার এতো অশ্রুর বর্ষণ। বাহু ধরে উঠায় তাকে। অশ্রু মুছিয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়।
“তুমি এই মেহমাদ শাহের সবচেয়ে প্রিয় ও মূল্যবান সম্পত্তি। তুমি বিনা আমি মেঘলা, ফ্যাঁকাসে আকাশ। উদাসীন, ব্যথিত, দুঃখিত। তুমি আমার সূর্য যাকে ব্যাতিত আমি অন্ধকারচ্ছন্ন। তাহলে ভাবো তুমি কতোটা দামী আমার জমিদারনী বেগম চন্দ্রমল্লিকা।
আর তুমি যাবে না ক্যানো? তুমি জমিদার মেহমাদ শাহের স্ত্রী, জমিদারনী। তুমি হীনা এই নবাববাড়িতে উৎসব সাজে না। আমি যেখানে তুমি তো সেখানে থাকবেই। আমি নিজ হাতে আজ তোমায় তৈরি করে দিব।”
নিজের বাবু মশাইয়ের বক্ষে মুখ লুকিয়ে কুটিল হাসি দেয় যামিনী। ধীরে ধীরে সেও রাজনীতি ও কূটনীতি আত্মস্থ করে ফেলছে।
___
“সাবধান! জমিদার নবাব মেহমাদ শাহ প্রবেশ করছেন!”
প্রহরীর সতর্কবার্তা শ্রবণগত হতেই সকলেই নিজ নিজ স্থান হতে উঠে দাঁড়ায়। সংগিত, বাজনা, নৃত্য বন্ধ হয়ে যায়। পাতলা পর্দা দিয়ে দেওয়া হয় জমিদারের আসনের সম্মুখে। যাতে নর্তকী ও মনোরঞ্জিনীদের দর্শন না পায় যুবক। এ বংশীয় নিয়ম বিরোধী।
প্রবেশ করে মেহমাদ শাহ যামিনীর হাত ধরে। ঈর্ষায় দগ্ধিত হয়ে যায় মেহনূরের অন্তর ও বাহির। তবুও সৌজন্যতা রক্ষার্থে হাসি ধরে রাখা আবশ্যক। বেগম নূর বাহার আঁচ করতে পারেন সব।
বেগম লুৎফুন্নেসাকে সালাম জানায় মেহমাদ শাহ ও যামিনী। দাদীজানও পৌত্রের হাতে মমতা সিক্ত চুম্বন করে।
“আমার সিংহ, যাও আসন গ্রহণ করো। তুমি ছিলে না বলে আমার মহলের চাকচিক্যই যেন হারিয়ে গিয়েছিল, তোমার আগমনে তা ফিরেছে।”
মেহমাদ শাহ যামিনীকে সাথে করে নিয়ে তার পাশেই স্থান দেয়। রমণীর মুখশ্রী এক চওড়া তেজস্বী হাসি।
উৎসব পুনরায় শুরু হয়। শুরু হয় গল্প-গুজব। হুট করেই বেগম নূর বাহার ঘোষণা করেন,
“হালুয়া ও জিলাপি বিলানো হোক সকলের মাঝে। আমার সিংহ ও শাহাজাদি মেহনূরের কাল কাবিন হবে।”
গুঞ্জন পড়ে যায় সকলের মাঝে। আরেকদফা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে পড়ে যামিনী। কোনোরকম “আসছি” উচ্চারণ করেই বেড়িয়ে পড়ে সে।
___
নিশুতি রাত্রি। গোটা নবাববাড়ি নিস্তব্ধ, যেন গোটা মহলটিই তন্দ্রায় ডুবে। যামিনী ছোট্ট এক ছুড়ি হস্তে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এই গভীর মানসিক আঘাত সহ্য করতে পারছে না সে, ইচ্ছে করছে নিজেকে সমাপ্ত করে দিতে৷
চোখ বন্ধ করতেই মস্তিষ্ক কল্পনায় এঁকে দিচ্ছে মেহনূর ও মেহনাদ শাহকে জুড়ে নানা দৃশ্য। ধৈর্য্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। আর সহ্য করতে না পেরে ছুড়ি শক্ত করে চেপে ধরলো, রক্ত টপটপ করে বেয়ে পড়ে।
দিলরুবা দেখেই চেঁচিয়ে উঠে,
“বেগম! দাসী, দাসী, এদিকে আসো! তাড়াতাড়ি আসো!”
সে হাত ধরতে গেলেই যামিনী হাতের ইশারায় থামতে আদেশ করে। তার অগ্নিমূর্তি দশা দেখে দিলরুবা আর সাহস করে না এগিয়ে যাওয়ার।
“চলে যাও, দূরে চলে যাও! আমি বাবু মশাইকে ছাড়া আর কারো চেহারা দেখতে চাই না আমার সম্মুখে। একা ছেড়ে দেও আমায়, একা!”
দাসীরা দ্রুতো বারান্দা ত্যাগ করে। দিলরুবা ছুটে যায় মেহমাদ শাহের কক্ষের দিকে। সে জ্ঞাত এই মুহূর্তে শুধু সে-ই এই রমণীকে বাধা দান করতে পারে।
মেহমাদ শাহ তার খাঁস ভৃত্য মিনার ও হিসাবরক্ষকের সঙ্গে হিসাবকিতাব নিয়ে বসেছে। এমন সময় দরজায় করাঘাত করে প্রবেশ করে প্রহরী। ভ্রু কুঞ্চিত হয় যুবকের।
“হুজুর, ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন। বেগম চন্দ্রমল্লিকার খাস বাঁদী এসেছে। খুব জোর করছে আপনার কক্ষে প্রবেশ করার৷ খুবই জরুরি বিষয় বলে আবেদন করছে।”
কিছু একটা ভেবেই এক বারের জন্য বায়ু শূন্যতা বোধ হয় যুবকের। সায় জানায় বিনা বিলম্বে। তার অনুমতি পেয়ে দিলরুবা ভিতরে প্রবেশ করে।
“কী জন্য এসেছো এভাবে? কোনো সমস্যা? বিনা দ্বিধায় ও ভয়ে খুলে বলো সকল কিছু।”
দ্বিধান্বিত হয়ে দিলরুবা এক দফা হিসাবরক্ষককে তো আরেক দফা মিনারের দিকে তাকাচ্ছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে মেহমাদ বলে উঠে,
“কক্ষ খালি করা হোক।”
দু’জন বেড়িয়ে গেলে জিজ্ঞেসু দৃষ্টি ফেলে দিলরুবার উপর। তড়িৎগতিতে সে ঘটনাটি প্রকাশ করে। মেহমাদ শাহ কিছু বুদ্ধি শূন্য হয়ে পড়ে, সম্মোহিতের ন্যায় কক্ষ থেকে বেড়িয়ে যায়।
মেহমাদ শাহকে কামরায় প্রবেশ করতে দেখে সেবায় নিয়োজিত সকল দাসী বিদায় জানিয়ে কক্ষ ত্যাগ করে। যুবক বারান্দায় যেয়ে যামিনীর পিঠে বক্ষ মিশিয়ে দাঁড়ায়, হাত থেকে ছুড়িটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়।
“চন্দ্রমল্লিকা, আমার বাচ্চা হরিণী, এসব কী ধরনের উন্মাদনা? উন্মাদ হয়ে গিয়েছো? একটা বারও ভাবোনি তোমায় ছাড়া, তোমার সুবাস হীন আমার কী দশা হবে?”
“হয়েছি আমি উন্মাদ। হবো নাই বা কেন? আপনি গতকাল হতে যাচ্ছেন আপনার অপরূপা মেহনূর তথা চন্দ্রপ্রভার। আমার স্বামী, আমার একমাত্র ভালোবাসা, প্রিয়তম বাবু মশাই অন্য কারো হয়ে যাবে, আমি জ্বলবো না তা কি সম্ভব? এতোই যখন ভালোবাসেন তো কেন আমাকে পোড়াচ্ছেন? বন্ধ করুন না এই বিয়ে।”
“যামিনী, এসব অনর্থক কথা বোলো না। আঁধার নেমেছে বেশ, ঘুমিয়ে পড়ো।”
“আপনার জন্য বলা খুব সহজ। আমার জন্য না, বিশ্বাস করুন দয়া করে। আমি মরে যাচ্ছি ভিতরে ভিতরে। মরে যাচ্ছি।”
তীব্র শব্দে কাঁদতে কাঁদতে যুবকের চরণে লুটিয়ে পড়ে সে। আকুতি করে শুধায়,
“বাবু মশাই, একটু অনুগ্রহ দেখায়৷ একটু! এই বিবাহ বন্ধ করেন দয়া করে। বন্ধ করুন!”
যামিনীকে বাহু ধরে উঠায় যুবক। শক্ত তার চাহনি ও মুখশ্রী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানায়,
“আমার হাতে নেই যামিনী। আমার কিছুই করার নেই। সত্যি কিছু করার নেই, ঘুমিয়ে পড়ো।”
সব দুঃখ, অপ্রাপ্তি ও হতাশা হুট করেই ক্রোধের অনলে পরিণত হয়৷ কপোল মুছে ফেলে সে।
“বাস্তবতা এটাই আপনি আমাকে কখনও ভালোই বাসেননি। আপনার মোহ, মনোরঞ্জিনী, প্রিয় বস্তু আমি। আপনার যোগ্য স্ত্রী তো আপনি আপনার চন্দ্রপ্রভাকে ভাবেন। তাই তো আজ আমার এতো আকুতি আপনার কর্ণগোচর হচ্ছে না। অতি উত্তম! তবে মনে রাখবেন এই বিবাহ আমি এই বেগম চন্দ্রমল্লিকা হতে দিচ্ছি না।”
তীব্র ক্রুব্ধ কণ্ঠ যামিনীর। প্রতিক্রিয়াহীন ভঙ্গিমা মেহমাদ শাহের। তাকে আতঙ্কিত করে বুকে লুকায়িত ছোট্ট কাচের শিশিটিতে অধর লাগিয়ে পান করে নেয়।
যুবকের আতঙ্কিত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে রমণী।
“ভয় পাবেন না বিষ খাইনি। মৃত্যুকে জড়িয়ে নিলে আপনার বিবাহ কী করে আটকাবো? অচেতন হওয়ার ঔষধি, এখন আমার জন্য অচেতন দশাই অধিক স্বস্তিকর।”
কয়েক মুহূর্তের মাঝেই মেঝেতে ঢলে পড়ে যামিনী। মেহমাদ শাহ কোলে তুলে নেয় তার প্রেয়সীকে। শয্যায় কাঁথা দিয়ে ঢেকে রেখে অনুভূতি মাখা এক চুম্বন করে। ত্যাগ করে কক্ষ। তার চাহনি ও ভঙ্গিমা নির্লিপ্ত, আল্লাহ ব্যাতিত কেউ জানে না তার মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের খবর।
___
দুপুর গড়িয়েছে, বিকেলেই অনুষ্ঠান মেহমাদ শাহ ও মেহনূরের। গতকাল রজনী হতে এক ফোঁটা জলও মুখে তুলেনি যামিনী৷ হাতে তসবিহ নিয়ে পরছে আর অশ্রু ঝরাচ্ছে।
“এভাবে আর কত ক্ষণ থাকবেন বেগম? কিছু তো মুখে দিন।”
দিলরুবার যত্নশীল বাণীতে চোখ তুলে তাকায় কিশোরী।
“আমি নিজের নিকট ওয়াদা করেছি দিলরুবা। যেই অবধি এই বিবাহ বন্ধ না করাবো, সেই অবধি অন্ন-জল আমি মুখে নিবো না।”
“কিন্তু কীভাবে আটকাবেন এই বিবাহ বেগম? কোনোই তো পথ দেখছি না। না আছে আপনার কোনো পরিকল্পনা।”
“সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী ঐ উপরওয়ালা, তাঁর নিকটই চাচ্ছি। তিনি নিশ্চয়ই আমায় শূন্য হস্তে ফিরাবেন না।”
তার কথাটি শেষ করতেই কেউ করাঘাত করে। আগমনের অনুমতি দিলে একজন দাসী প্রবেশ করে জানায়,
“আপনার উদ্দেশ্যে এই চিঠি পাঠিয়েছে কেউ। নবাববাড়ির ডাকবাক্সে পাওয়া গিয়েছে, আপনারই নাম লিখে।”
যামিনী এখন টুকটাক বাংলা পড়তে পারে, লিখাও শিখছে শিক্ষিকার নিকট প্রতিনিয়তই৷ তাই সে নির্লিপ্ত ভাবেই চিঠিটি হাতে নিয়ে দাসীকে বিদায় করে।
চিঠিটি পড়তেই তার মুখশ্রীতে ফুটে উঠে এক ক্রুর হাসি, সাথে ধূর্ত এক পরিকল্পনা।
চলবে…