#চন্দ্রপুকুর
||১০ম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
তখনই নজর স্থির হয় তার কানের নিকটে বিদ্যমান যন্ত্রটির দিকে। বিস্মিত নয়তে তাকিয়ে থাকে শুধু। যামিনী চিনে এই যন্ত্রটিকে, টেলিফোন। যা গোটা শেরপুরে শুধুমাত্র ডাকঘর ও থানাতেই বিদ্যমান। ঐ গ্রামের মোটামোটি অবস্থাপন্ন ঠাকুর মশাই কতো চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় টেলিফোন রাখার অনুমতি পেতে। ডাকঘরে কী চড়া খরচই না হয় একটি মাত্র কল করতেই! তবে টেলিফোন এখানে কী করে?
জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকাতেই দিলরুবা মুচকি হাসির সহিত উত্তর দেয়,
“জমিদার বাবু বিশেষভাবে আপনার জন্য এই নবাববাড়ির বৈদ্যশালায় টেলিফোন ও তা সংযোগ করার ব্যবস্থা করেছেন।”
এই বচন শুনে যামিনীর যেমন অন্তরাত্মা শীতল হয়ে পড়ে তেমনই অতীতের কিছু বিষাক্ত স্মৃতি দ্বারা দংশিতও হয়। সে সবার খুব অপ্রিয় থাকলেও নানুর অত্যন্ত আদুরে ছিল, মামাতো বোনদের তুলনায় অধিক বটে।
তখন কিশোরী বড়োজোর চার-পাঁচ বছরের হবে, নানু কাজের খোঁজে রহমতপুর গ্রাম ত্যাগ করে গেলেন শেরপুরের আরেক গ্রাম পিরোজপুর। একদিন পাড় হয়, দু’দিন পাড় হয়, তাঁর সে কী অস্থিরতা! মামা-মামীর নিকট নানুর খবর জানতে চাইলে পাত্তা পায় না।
অবশেষে পাশের বাড়ির শুভ্রা কাকীমা জানান পাশের গ্রামে আছেন নানু। কারো মুখ থেকে তখন জ্ঞাত হয় ডাকঘরের এই জাদুকরী যন্ত্রটির বিষয়ে। অনেক কষ্টে চার আনা জোগাড় করে ডাকঘরের কাকুর নিকট যায়। এই অল্প পয়সায় দরুন টেলিফোনের ব্যবহার তো করতে পারেইনি, বরং তাচ্ছিল্য করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল বটে।
“কী হলো চন্দ্রমল্লিকা কথা বলছো না ক্যানো? খারাপ লাগছে? চন্দ্রমল্লিকা! চন্দ্রমল্লিকা!”
ঘোর ভঙ্গ হয় যামিনীর। মেহমাদ শাহ একাধারে ডেকেই যাচ্ছে তাকে। চোখের কোণে পুঞ্জিভূত অশ্রুটি মুছে নেয়।
“আমার মন্দ থাকাতে বুঝি আপনারও কিছু আসে যায় বাবু মশাই? এও সম্ভব? আমি হলাম কি না সামান্য এক মনোরঞ্জনকারী, স্ত্রীর তকমা লাগানো মাত্র।”
রমণীর মনে হলো মেহমাদ শাহ টেলিফোনের ওপারেই যেন হাসলো। সেই পরিচিত নিস্তব্ধ, স্নিগ্ধ হাসি এঁটে গেল তার মুখশ্রীতে।
“আপনি হাসছেন? আমার বেদনা, দুঃখ, আক্ষেপ আপনাকে আনন্দ দেয় বুঝি?”
“আমার প্রিয় বাচ্চা হরিণীটির অভিমানী কণ্ঠ এতোটাই হৃদয় শীতলকারক যে হাসি ফুটেই উঠে। তুমি আমার স্ত্রী, শুধু স্ত্রীই না চন্দ্রমল্লিকা, আমার জমিদারনী ও বেগম তুমি। তুমি আমার প্রিয় সেই ফুলটি, যার সুবাসে আমার প্রাণের বাস, আমার বাস।”
যুবকের প্রেমময় বাণীতে মুহূর্তেই গলিত অভিমানের হয় যামিনীর অভিমানের বরফ। মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ যেভাবে একটু একটু করে স্ফুরিত হয়, তেমন ভাবেই দীপ্তিময় হতে শুরু করে তার মুখশ্রী।
“ভালোবাসি বাবু মশাই। অনেক ভালোবাসি। তাড়াতাড়ি এসে পড়ুন না আমার নিকটে। আগলে রাখবো বাবু মশাই আপনাকে, আমার বক্ষে, আমার অনুরাগে।”
“অতি শীঘ্রই ফিরবো চন্দ্রমল্লিকা। ততোদিন নিজেত যত্ন নেও। আমি তোমার চেহারায় চিনির একটি দানা পরিমাণও মলিনতা দেখতে চাই না।”
কথা শেষ হয় তাদের। কল কেটে দিয়ে বুকে জড়িয়ে রাখা টেলিফোনের কথা শোনাও বলার অংশ তথা হ্যান্ডসেটটি।
___
শাহাজাদি মেহনূর আয়নার সম্মুখে বসে নিজের গোছালো সোনালি আভাযুক্ত কালো কেশকে আরও সুন্দর ভাবে গুছিয়ে নিচ্ছে। তার খাস বাঁদী রত্না আড়চোখে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে।
“কিছু বলবে রত্না?”
হুট করেই তার দিকে মুখ ঘুরায় মেহনূর। রমণীর আচমকা বাণীতে চমকিত হয় রত্না। যতো দ্রুতো সম্ভন নজর ঝুঁকিয়ে ফেলে।
ইতস্ততভাবে শুধায়
“আসলে শাহাজাদি আপনার বেগম চন্দ্রমল্লিকাকে নিয়ে চিন্তিত হওয়ার অর্থ বুঝলাম না। তিনি তো আপনার প্রতিপক্ষ, শত্রু।”
কেদারা থেকে উঠে দাঁড়ায় শাহাজাদি। আভিজাত্যের ভঙ্গিমায় এগিয়ে আসে রত্নার দিকে। শান্ত ও কুটিল চাহনি তার।
“এতো চিন্তাশক্তি, বিচক্ষণতা, কুটিলতা যদি তোমার মাঝে থাকতো, তবে তুমিই না শাহাজাদি হতে। অথবা, তা না হলেও নিজের জায়গা করে নিতে এই মহলে।
এই গোটা নবাববাড়ি জানে চন্দ্রমল্লিকার প্রতিপক্ষ আমি। নানীজান কখনোই নিজের নীতির বিরুদ্ধে যেয়ে নির্দোষ এক নারীকে আঘাত করবেন না। তাঁকে এবং আমাকে ছাড়া এই কার্য সম্পাদনের ক্ষমতা ও উদ্দেশ্য কারো নেই।
আরও একটা কথা হলো জমিদারী ও জমিদারের হৃদয় চাইলে প্রজা ও জমিদারের চোখে শ্রেষ্ঠ থাকা অতি আবশ্যকীয়। আমি নিজের এই সামান্যতম সময় ও পদক্ষেপের দ্বারা তা-ই করেছি।”
“বাহ্! বাহ্! এই নাহলে আমার পুত্রের যোগ্য বধূ! কী বুদ্ধি, কী তেজ, কী রূপ! মাশাআল্লাহ, নজর যেন না লাগে কারো।”
কথাগুলো উচ্চারণ করতে করতেই কক্ষে প্রবেশ করেন বেগম নূর বাহার। তিনি মূলত শাহাজাদি মেহনূরের সঙ্গে যামিনীর বিষয়ে আলোচনা করতে এসেছিলেন। এখানে এসে কক্ষের দরজার কাছাকাছি আসতে মেহনূরের কণ্ঠস্বর শ্রবণগত হয়। নিঃশ্চুপ হয়ে সবটা জানতে স্থির হন তিনি।
“মামীজান আপনি? কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকাতেন, আপনার সেবায় তো আমি সর্বক্ষণ নিয়োজিত।”
“কী আদব আর শিক্ষা আমার চন্দ্রিমার নূরের! আমি তো কী না কী ভেবে বসেছিলাম। এই নবাববাড়িতে নিজের জায়গা রাখতে হলে জাহান্নামের ন্যায় নির্দয় আর সরিষার দানা পরিমাণ দয়া থাকতে হবে। আমার চাঁদনি কন্যা তো আমার চেয়েও বুঝদার। একদম নিজের নানীজান বেগম লুৎফুন্নেসার ন্যায় হয়েছো বুদ্ধি, কুটিলতা, সৌন্দর্যে।”
“জাজাকাল্লাহ খাইরান মামীজান। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। সব আপনাদেরই দোয়া।”
এর মাঝেই দরজায় কড়াঘাত করে প্রহরী। অনুমতি প্রবেশের অনুমতি দেয়।
একজন দাসী প্রবেশ করে ঝুঁকে সালাম জানায়।
“আসসালামু আলাইকুম শাহাজাদি মেহনূর ও বেগম নূর বাহার। আপনাদের বেগম চন্দ্রমল্লিকার কামরা উপস্থিত হওয়ার হুকুম জারি করেছেন বেগম লুৎফুন্নেসা।”
উভয় সম্ভ্রান্ত নারীর চেহারায় কেমন একটা অদ্ভুৎ চাহনি ফুটে উঠে। হাতের ইশারায় দাসীকে কক্ষ ত্যাগ করতে বলে।
___
যামিনীকে ঘণ্টা খাণেক পূর্বেই তার কক্ষে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সে কপালে হাত রেখে বিচার-বিবেচনায় ব্যস্ত। বৈদ্যশালা থেকে সাথে আসা দাসী তার দিকে ছোট্ট বাটিতে বিদ্যমান ঔষধিটি এগিয়ে দেয়৷
“বেগম, আপনার ঔষধ সেবনের সময় হয়েছে। কষ্ট করে পান করে নিন।”
ক্রুব্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিশোরী।
“মারতে চাও আমাকে কন্যা? হত্যা করতে বিষ সেবনের প্রচেষ্টা করছো?”
“তওবা, তওবা, বেগম। আমি কল্পনাতেও এই চিন্তা করতে পারি না। এই মিছে কালিমা আমার ললাটে লেপন করবেন না বেগম। আমার আল্লাহ জানে আমার সত্য।”
“এতোই সত্য তুমি পান করো ঔষধি তবে তুমি প্রথমে।”
দাসীটি নীরব। তা দেখে আরও ক্রোধান্বিত হয় যামিনী।
“কী হলো? পান করো!”
কেঁপে উঠে নারী। তড়িৎগতিতে এক চামচ ঔষধি পান করে নেয় সে। তাকে অক্ষত দেখে, নিরাপদ বুঝে শান্ত হয়ে পান করে নেয় পানীয়টি।
তিক্ত স্বাদ পেতেই মুখখানা কুঁচকে যায়। ঠিক তখনই দ্বার খুলে দেয় প্রহরীরা। অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন বেগম নূর বাহার ও বেগম লুৎফুন্নেসা। সবার শেষে শাহাজাদি মেহনূরের আগমনও হয়।
“আসসালামু আলাইকুম, দাদীজান।”
তাঁদের দেখে উঠে দাঁড়াতে চায় যামিনী। তবে ক্ষতের জন্য সক্ষম তো হয়-ই না, যন্ত্রণায় কোকিয়ে উঠে বটে।
বেগম লুৎফুন্নেসা তা দেখে গম্ভীর গলায় বলে উঠেন,
“উঠার প্রয়োজন নেই, তুমি শান্ত হয়ে বসো। ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই।”
“জী, দাদীজান।”
“তা শরীরের অবস্থা কেমন এখন? সুস্থ বোধ করছো?”
“পূর্বের তুলনায় ভালোই বোধ করছি দাদীজান।”
“দাসী, কন্যার মুখ এমন শুকনো, ফ্যাকাসে ক্যানো? ফল-ফলাদি, শাক-সবজি কি পেটে দিচ্ছো না? আমার শাহের মলিন বস্ত্র, বস্তু সবকিছুই অপছন্দ। খেয়াল রেখো চন্দ্রমল্লিকার। প্রয়োজন পড়লে বৈদ্যকে খবর দিয়ো। আমি দ্রুতো সুস্থতা চাই।”
“যথাসাধ্য চেষ্টা করবো, বেগম লুৎফুন্নেসা। আপনি চিন্তা করবেন না।”
বেগম নূর বাহার হুট করেই শুধান,
“আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল আম্মিজান। যেহেতু এখানে সকলেই উপস্থিত তাই এখানেই বলছি। মেহনূর মামনি বিবাহযোগ্য হয়ে গিয়েছে, অনেকদিন নিজের বাড়ি থেকে ও পড়ালেখা থেকে দূরে বিবাহের উদ্দেশ্যে। আমি চাচ্ছিলাম দু’দিন বাদে আমার সিংহ বাড়ি ফিরলে তাদের আঙটি পরানোর ক্রিয়া বা কাবিনটা করিয়ে রাখতে। আনুষ্ঠানিকতা পরে করা যাবে।”
পৈশাচিক হাসি মাখা মুখে আড়চোখে তাকান যামিনীর পানে। মেহনূরের মুখশ্রীতে চাপা হাসি।
শয্যায় বসে থাকা কিশোরী স্তম্ভিত, আহত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এতো কম সময়ে কী করে সে তার বাবু মশাইয়ের বিয়ে রোধ করার ব্যবস্থা করবে?
চলবে…
লাস্ট পোস্ট দিয়ে অনেকটা সময় অপেক্ষ করলাম। কেউ তেমন কিছু বললো না, তবুও এমন হওয়ার কারণ বুঝত পারছি না। পর্বটি পোস্ট করে দিলাম তাই।