#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️পর্ব-৪৩
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
ল্যাম্পপোস্ট ঘিরে আলোর পোকা ঝাঁক বেঁধেছে। হলুদ আভার নিচে অনবরত উড়ে যাচ্ছে বিশৃঙ্খলভাবে। অতিশয় জটিল, বিদঘুটে, কুৎসিত লাগছে দৃশ্যটা। নিভ্রান চোখ সরিয়ে নিলো। বাহুতে কপাল মুছে শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুললো। ঘেমে গেছে। বুকের শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। রাস্তায় জ্যাম। চৌরাস্তার মোড়ে প্রাইভেট কারের জটলা। এসি ছেড়েও জানলা খুলে বসে আছে সে। অসহনীয় গরম পড়েছে আজ।
পাশের সিটে হলুদ রংয়ের প্যাকেট। ভিতরে আল্ট্রার রিপোর্ট। আসার সময় নিয়ে এসেছে হসপিটাল থেকে। জ্যাম থাকায় গাড়ি আগে বাড়ছেনা। হাত বাড়িয়ে কাগজটা বের করলো সে। সাদা কাগজের উপরের দিকে স্ট্যাপলার দিয়ে পিন করা ছোট্ট কালো রংয়ের কাগজটা। স্পষ্ট একটা অবয়ব। আবছা আকৃতি। তার রাজকন্যার। তার ছোট্ট পরীর।
নিভ্রান রিপোর্টের উপরেই চুমু খেলো। খুব আদরে ভরা চুমু। মেয়েটা জন্মানোর পরে কপালে প্রথম চুমুটা সে-ই খাবে।
ফোন বাজলো। নিভ্রান ধরলোনা প্রথমবারে। লাইট কেটে গেলো। সেকেন্ড বাদেই আবার বাজতে শুরু করলো।
রিপোর্টটা যত্ন করে ঢুকিয়ে রাখলো সে। একটু ভাঁজ পরলে অনর্থ ঘটে যাবে যেনো। নিশাদ ফোন করেছে।
ভ্রু কুচকে ফোন ধরলো সে। ওপাশ থেকে ঠাট্টাপূর্ণ কথা আশা করলেও শোনা গেলো তার বিপরীত। অভিসঙ্কিত কন্ঠস্বর,
—“হ্যালো? হ্যালো ভাইয়া? কোথায় তুই? কতক্ষণ লাগবে আসতে?”
নিভ্রান বাঁকানো গলায় বললো,”তুই বাসায়? কিছু হয়েছে? রাত? রাত ঠি ক আছেতো?”
নিশাদ রুদ্ধ স্বরেই বললো,”ভাবির খারাপ লাগছে খুব। আমরা বসে আছি কাছে তবু তোকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝেনা মেয়ে। জলদি আয় প্লিজ। ড.নিকিতাকে বাসায় আসতে বলেছি। হসপিটাল তো দূর হয়ে যায়। তাছাড়া ভাবি এতো নড়াচড়া করতে পারবেনা। গুটিশুটি হয়ে বসে আছে আমার সাথে।”
নিভ্রান খেই হারানো বেগতিক গলায় বললো,
—“হসপিটাল? কেনো? ওর কি বেশি খারাপ লাগছে? মাথায় হাত বুলিয়ে দে। ভয় পেয়ে যায়তো তাই ওমন করে।”
নিশাদ নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,”উনার তোকে লাগবে ভাই।”
নিভ্রান আস্তে করে উওর দিলো,
—“আসছি, আসছি।”
নিশাদ ফোন কাটতে কাটতেই খেয়াল করলো রাত্রির নাকের পাশ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। নি:শব্দে কাঁদছে ।
অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে পকেট থেকে রুমাল বের করলো সে। পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,”ভাবি? কাঁদছেন কেনো? ভাইয়া আসছে তো। একটু পরেই চলে আসবে।”
ঘরে ঢোকা মাত্রই নিভ্রান খেয়াল করলো সোফায় বাবা বসে আছে। নওশাদ সাহেব। একটু আগেই এসেছেন তিনি। খবর পেয়ে বাসায় থাকতে পারেননি আর। মুখে প্রখর দুশ্চিন্তার ছাপ। চোখাচোখি হলো। নওশাদ সাহেব অষ্পষ্ট স্বরে বললেন,”এসেছো তবে।”
রাত্রি তখনো নিশাদের কাছেই। চোখ বন্ধ বিধায় সে এসেছে বুঝতে পারেনি। স্নেহপূর্ণ হাতে তাকে আগলে রেখেছে নিশাদ। রক্তের সম্পর্ক না হলেও দায়িত্বশীল বড়ভাই যেনো। নিভ্রান হাসলো। কাছে যেতেই উঠে দাড়াতে গেলো নিশাদ। নিভ্রান থামালো। রাত্রির মাথায় হাত রেখে নরম গলায় ডাকলো,”রাত?”
রাত্রি নিভন্ত চোখে তাকালো। প্রাণহীন নয়ন। ফ্যাকাশে চেহারা। হৃদযন্ত্রে কেও যেনো পাথর দিয়ে আঘাত করলো নিভ্রানের। যন্ত্রনায় থেতলে গেলো প্রেমপূর্ণ অভ্যন্তর। এতোক্ষণ পর ভরসার মানুষটার দেখা পেয়ে নরম হাতদুটো সামনে বাড়িয়ে দিলো রাত্রি। নিরুপদ্রব বুকে টেনে নেয়ার আদুরে আঁকুতি। নিভ্রান আশেপাশে তাকালো। নিশাদ উঠে দাড়ালো তাড়াতাড়িই।
নিভ্রান চোখেমুখে আংশিক লজ্জা নিয়েই বুকে টেনে নিলো স্ত্রীকে। গোপনে ছোট্ট একটা চুমুও খেয়ে নিলো চুলের ভাঁজে। রাত্রি আধো আধো কন্ঠে বুলি ছাড়লো,”আপনি কোথাও যাবেননা আর।”
নিভ্রান তর্কে গেলোনা। কোমল কন্ঠে সম্মতি দিলো,”আচ্ছা, ঠি কাছে।”
নওশাদ সাহেব ধীরগলায় বললেন,”অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি আসবা। মেয়েটা থাকতে পারেনা। দেখোইতো।”
নিভ্রান গলা ঝেড়ে বললো,”ও একটু ভয় পায় আসলে।”
—“কই এখন তো পাচ্ছেনা। এতক্ষণ কেমন করছিলো জানো? উনি উনি করে পাগল হয়ে গেছিলো। এখন দেখো, চুপ হয়ে বসে আছে।”
নিভ্রান লজ্জা পেলো। মৃদু গতিতে মাথা নাড়ালো শুধু। তার সাথে থাকতে থাকতে মেয়েটাও পাগল হয়ে গেছে।
______________
রিপোর্ট দেখে, রাত্রিকে দেখে মিস.নিকিতা হেসে বললেন,”ইটস্ ভেরি নরমাল। মাশআল্লাহ, বাচ্চা হেলদিভাবে বড় হচ্ছে। আকৃতি বৃদ্ধির সাথে সাথে জরায়ুতে প্রভাব পড়ে। তখন ব্যাথা হয়। তাছাড়া উনার ব্লিডিংও হয়নি। হলে তবে হয়তো মিসক্যারেজের সম্ভাবনা ছিলো। আসলে প্রথমবার তো। সেজন্ইয পেইনটা সহ্য করতে কষ্ট হয়।”
নিভ্রান মুচকি হেসে বললো,”বুঝেছো? বাচ্চার কিছু হয়নি।”
রাত্রি হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁটের উপরে জমে যাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে ঘাম মুছলো। ব্যাথায় কেমন লাগে শুধু সে আর তার আল্লাহ জানে। খালি মনে হয় এই বুঝি সময় শেষ। সে বুঝি তার মানুষটার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাবে। আর দেখতে পাবেনা সুদর্শন মুখটা। এত ব্যাকুল লাগে। একটু দেখার জন্য ছটফট করে প্রাণপাখি।
নিভ্রান আলতো করে কপালের চুল কানের পিছে গুঁজতে গুঁজতে বললো,”এতো ভয় পাও কেনো রাত?”
রাত্রি না তাকিয়েই বিরবির করলো,”আপনি সাথে থাকেন না যে।”
মিস.নিকিতা মুখোমুখি বসলেন। রাত্রির একহাত মুঠোয় টেনে বললেন,”আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান একটা মেয়ে। তবে ব্যাথা উঠলে এতো ঘাবড়ে যান কেনো? ভয়ের তো কিছু নেই। ব্যাথা হলে উঠে দাড়াবেন। আস্তে আস্তে হাঁটবেন। না পারলে শুয়ে পড়বেন। রেস্ট করবেন। বাচ্চা আরো বড় হবে। মুভমেন্ট করবে। আপনি বুঝতে পারবেন। সে নড়ছে। হ্যাঁ, ব্যাথা করবে। কিন্তু এটাই তো মাতৃত্ব। এটাই মাতৃত্বের স্বাদ। শত রাতের কষ্টের পর যখন বাচ্চাকে কোলে নিবেন মনে হবে এসব কিছুই ছিলোনা। একেবারেই কিছু ছিলো না। কিসের কষ্ট? এতেই তো সব সুখ।”
নিভ্রান হাসলো। রাত্রি হা করে তার কথা গিলছে। চোখে জমেছে অশ্রু। নিভ্রান চোখ মুছিয়ে ম্লান গলায় বললো,
—“খালি কেঁদে দেয়। আমি কই যাবো ওকে নিয়ে, বলেন?”
মিস.নিকিতা হেসে বললেন,”আপনি আপাতত উনার সাথে থাকেন। কোথাও গেলেই বিপদ।”
______________
অসুস্থ শরীর নিয়েই পরীক্ষা দিলো রাত্রি। এক পরীক্ষায় তো লিখতে লিখতে হলেই ঘুমিয়ে পরেছিলো। নিভ্রান প্রিন্সিপালকে বলে তার নির্ধারিত সময় বাড়িয়েছিলো। তার অসুস্থতা দেখে অনুমতিও দিয়েছিলেন প্রিন্সিপাল।
ছোটখাটো ঝড়- ঝাপটা সাথে নিয়েই পরীক্ষা শেষ হলো। রাত্রি কে আনা-নেয়া, দেখে রাখা সবই নিভ্রানের উপর দিয়ে। মেয়েটা যে তাকে ছাড়া কিছুই বুঝেনা। পরীক্ষার সময়টুকু সে ভার্সিটির ওয়েটিং রুমেই কাটাতো। যদি কিছু হয়ে যায়? হয়নি অবশ্য।
তারপরের দিনগুলো পেরোলো ঘরে বসে বসেই। কতশত মধ্যরাতে রাত্রি চোখ মেলে দেখতো নিভ্রান আগে থেকেই উঠে বসে আছে। মগ্ন চোখে কি যেনো দেখছে তার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। জিজ্ঞেস করলেই শুধু বলতো,”তুমি ভীষণ সুন্দর রাত। এতো সুন্দর রাত গোটা পৃথিবীতেও নামে না।”
~চলবে~
[পর্ব ছোট হয়েছে। কেনো যেন লিখায় মন বসছিলো না। যখন বসলো তখন দেরি হয়ে গেছে। যতটুকু লিখতে পেরেছি ততটুকুই দিলাম]