এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️পর্ব-৪২

0
2008

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️পর্ব-৪২
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️

নিকশকৃষ্ণ ঘরে একটু জ্যোতি নেই। কিরণ নেই। ঘটা করে রাত নামলো যেন সর্ব ধূলিকণায়। রুপালি চাঁদ ছুঁতে পারছেনা ভয়ংকর প্রেমিকের ঘুমন্ত মেঘরাণীকে। নিভ্রানের ফিরতে দেরি হলো বেশ। দেহভরা ক্লান্তি নিয়েই
ঘরে ঢুকলো সে। বিছানার দিকে চোখ পড়তে মনটাও ক্লান্ত হয়ে গেলো। রাত্রি ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটা অপেক্ষা করছিলো। প্রস্তুতি নিয়ে ঘুমায়নি। গায়ে ব্লাঙ্কেট নেই। শাড়ির আচঁল খসে পড়েছে এলোমেলো। হাতদুটো অগোছালো নিস্তেজ। মাথাটা হেলে পড়েছে ডানপাশে।
নিভ্রান নিশব্দে ঢুকলো। খুক খুক করে কাঁশতে যেয়েও থেমে গেলো। গলা ব্যাথা করছে খুব। আজ অফিসে এতো ধমকাধমকি করেছে সবাইকে। এখন মনে হচ্ছে কন্ঠনালি জ্বলে যাচ্ছে। নিশব্দেই হাঁটলো সে। গায়ের শার্ট ছাড়িয়ে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে এলো। পর্দা সরিয়ে দিতেই চাঁদের আলোয় পূর্ণ হলো ঘর। আঁধার কেটে গেলো। রাত্রি দেহভঙ্গি বদলেছে। কাত হওয়াতে অনাবৃত হয়েছে দেহ।
নারীময়ী আকর্ষণ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পরছে সর্বাঙ্গে। নিভ্রান হাসলো। শব্দ নেই সেই হাসিতে। আছে শুধু দূর্বার অনুভূতি। কাছে যেয়ে ঝুঁকে গেলো সে। এত অসুস্থতায়ও মেয়েটার সৌন্দর্য কমেনি বিন্দুপরিমানও। বক্ষ পিন্জিরায় ঝংকার তুলে প্রতিটি উষ্ণ প্রশ্বাস। লহু জমে যায় যেনো রুপের শীতলতায়। নিভ্রান গভীর দাগ বসালো গলদেশের নিম্নাংশে। ঘুমের মাঝেই হাল্কা হাল্কা কম্পিত হলো রাত্রি। কোমলাঙ্গ দেহ নেতিয়ে গেলো।
কাঙ্খিত স্পর্শ আরো প্রগাঢ় হতেই সজাগ হলো অপ্রকৃতিস্হ গা। অপ্রতিরোধ্য হাতদুটো দিয়ে অযথাই হাল্কা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলো রাত্রি। নিভ্রান মুখ তুলে উন্মত্ত শ্লেষ মাখানো স্বরে বললো,”কি হয়েছে?”
রাত্রি উওর দিলোনা। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট হলো তার সুপ্ত অভিমান। নিভ্রান কাতর স্হানে নাক ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,”রাগ করেছো রাত?”। তীক্ষ্ণ মাতাল গন্ধে ঘোর জাগলো। একটু ডুবে যেতেই রাত্রি শক্ত গলায় বললো,
—“দূরে যান। আমি ঘুমাবো। কাছে এসেছেন কেনো? আমিতো আপনার এত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নই।”
নিরবতা! নিষ্কম্প অভিমানিনী, নিষ্পাপ মুখশ্রীর দিকে চেয়ে চেয়ে নিভ্রান মোহকন্ঠে বললো,
—“আমার প্রাণনাশকারিনী, আমার নির্মোহ হৃদয়ের একমাত্র মোহ, আমার নির্মেঘ আকাশের শুভ্রতম মেঘ, আমার বৃষ্টিহীন বর্ষার এক পশলা বর্ষণ। যার পদ্মলোচন চোখে আমার দাম্ভিকতার মৃত্যু, কোমলতার আবির্ভাব। আমার নিশীথিনী, আমার বিভাবরী, আমার রাত তুমি।”
চোখের কোঁণে বিন্দুকণা জমা হয়েছে। মানের সিক্ত বহি:প্রকাশ। কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে অনবরত। নিভ্রান হতাশ চোখে চাইলো। রাত্রি শ্বাস চেপে বললো,
—“আপনি এসব বলে বেঁচে যেতে চাচ্ছেন?”

—“তোমার এই রুদ্ধ স্বরে কতবার মরছি জানো?”

রাত্রি চুপচাপ। নিভ্রানের ঠোঁট অঘোষিত বাঁরণ মানলোনা। আদরে আদরে অভিমান গলে পানি হলো কোমল নারীমনের। হার মানলো রুষ্ট হৃদয়। তুষ্ট হলো সব। রাত্রি ধীর গলায় প্রশ্ন করলো,
—“খেয়েছেন?”

—“উহুম।”

—“খেয়ে আসেন, যান।”

—“কাজ ছিলো রাত।”

রাত্রি মৃদু স্বরে বললো,
—“ঠিকাছে।”

নিভ্রান উঠে গেলো। উঠার আগে একবার উঁচু পেটে কান পেতে কি যেনো শুনলো। বিরবির করে বললো,”তুমি খেয়েছো আম্মু?”

—“ও আম্মু না আব্বু আপনি কিভাবে জানলেন?”

—“জানি। খেয়েছো তুমি?”

—“হু।”

চাঁদের আলো তখন তেরছাভাবে পড়ছিলো নিভ্রানের মুখের অর্ধাংশে। একপাশ উজ্জ্বল, একপাশ অন্ধকার।
কি নরম সেই চাহনী! কি কোমল সে অর্ধাঙ্গিনীর প্রতি!
_____________

নাহিদা ভাত বেড়ে দিলেন প্লেটে। নিভ্রান চেয়ারে বসতে বসতে বলল,”ওকে তো আজ ভালোই দেখলাম।”

—“আর ভালো! দুপুরে সব বমি করে দিয়েছে। রাতে জোর করে একটু খাইয়েছি। এভাবে না খেলে হয় বল?” ওইটুকু বলে থামলো নাহিদা। পরমূহুর্তেই ভ্রু ভাঁজ করে বললো,”ভালো দেখলি মানে? ঘুমিয়েছিলো না? উঠিয়েছিস কেনো?”

নিভ্রান নামানো কন্ঠে উওর দিলো,
—“উঠে গিয়েছে।”
নাহিদা কথা বাড়ালেন না। পাশে বসতে বসতে বললেন,
—“আগামী সপ্তাহ থেকে পরীক্ষা। শরীরের যা অবস্থা। মেয়েটা কিভাবে লিখবে, পড়বে?”
নিভ্রান চোখে একসমুদ্র আশঙ্কা, চিন্তায় কাবু অস্থিরতা নিয়েই বললো,
—“পারবে মা। চিন্তা করোনা।”

—“পরের বছর দেয়া যায়না?”

—“ওর এতদিনের প্রিপারেশন বৃথা যাবে মা। শুধু শুধু একটা বছর গ্যাপ পড়বে। পড়াশোনা নিয়ে অনেক সপ্ন ওর। আমি কি করে মানা করবো বলো?”

নাহিদা উওর দিলেননা। নিভ্রানের কথাও ঠি ক। আবার মেয়েটার জন্য দুশ্চিন্তা হয় খুব।
_____________
দীর্ঘ রজনীর মধ্যপ্রহর!
শক্ত নিরপদ্রব বুকটা থেকে মাথা তুলে উঠে বসলো রাত্রি। ব্যাকসাইডে কোথায় একটা ব্যাথা হচ্ছে।
ভেতরটা কেমন যেনো লাগছে। নিভ্রান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। খুব ক্লান্ত মানুষটা। রাত্রি একা একাই বসে রইলো কিছুক্ষণ। চোখ বুজে নিভ্রানের হাত ধরে রইলো। ব্যাথার সাথে বাড়লো নখের গাঁথুনির ধার। হাতে শাণিত চাপ লাগতেই নিভ্রানের তন্দ্রা কেটে গেলো। ঘুমে মোড়ানো নিভু নিভু কন্ঠে সে বললো,
—“কি হয়েছে রাত?”

রাত্রি একবার তাকালো। নিরুত্তর ব্যাথাযুক্ত চাহনী দেখে সঙ্গে সঙ্গেই উঠে বসলো নিভ্রান। একহাতে অপরপাশের বাহু জড়িয়ে কাছে টেনে বললো,”কি হলো? খারাপ লাগছে?”
রাত্রি আবারো অসহায় চোখে চাইলো। মাথা ঝুঁকিয়ে চাপা স্বরে বললো,”কোমড় ব্যাথা করছে খুব।”
শরীর ঘেমে উঠেছে তার। নিভ্রান কপাল ছুঁয়ে দেখলো গা হাল্কা গরম। সাইড টেবিল থেকে পানি নিয়ে পুরো একগ্লাস খাইয়ে দিলো। অস্থির ভঙ্গিতে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,”কমে যাবে, কমে যাবে। ভয় পেয়োনা।”
সময় কাটলো আধঘন্টার মতো। ঘড়ির কাঁটা তখন চারটায়। রাত্রি আস্তে করে বললো,
—“ব্যাথা আমার হচ্ছে, আপনি কাঁপছেন কেনো?”

—“কই কাঁপছি?”

—“এইযে আপনার হাত…যতবার বুলাচ্ছেন। আমি বুঝতে পারছি তো।”

—“সে তো এসিতে.. ঠান্ডা লাগছে বলে। ব্যাথা কমেছে একটু?”

—“কমেছে।”

নিভ্রান যেনো এতক্ষণে ঠি ক ঠাক শ্বাস নিলো। চোখের পাতা শান্ত হলো। রাত্রি ঝিঁমাতে ঝিঁমাতে বুকেই ঘুমিয়ে পড়লো। নিভ্রান বাকিরাত আর ঘুমোতে পারলোনা। রাত্রির স্লান চেহারা দেখতে দেখতেই নির্ঘুমতায় জর্জরিত হলো আঁখিপল্লব।
______________

পরের দিনটা স্বাভাবিকই কাটলো। সন্ধ্যার দিকে নিশাদ এলো দেখতে। রাত্রি তখন উবু হয়ে নোটস লিখছে।
রুমের দরজা খোলা। নিশাদ ড্রইংরুম থেকেই চেঁচিয়ে উঠলো,
—“ভাবি, সোজা হন। আপনিতো বাচ্চাটাকে চ্যাপ্টা বানিয়ে ফেলবেন।”

রাত্রি দ্রুত মাথা তুললো। বিমূঢ় চোখে যেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বামহাতটা আপনাআপনিই চলে গেলো পেটে। বাচ্চা আসলেই চ্যাপ্টা হয়ে যায়? নিশাদ কাছে এগিয়ে এসেছে। রাত্রি পেটে হাত রেখেই নির্বোধের মতো প্রশ্ন করলো,”উবু হলে সত্যি চ্যাপ্টা হয়ে যায় ভাইয়া?”

নিশাদ ফিচেল হেসে উওর দিলো,”হয়তো, আমার এক বন্ধুর হয়েছিলো।”

রাত্রি একমূহুর্তের জন্য বিশ্বাসও করে ফেললো কথাটা। ভয়ার্ত চাহনীতে পেট অনুভব করার চেষ্টা করলো। পরমূহুর্তেই বিশ্রিভাবে মুখ কুঁচকে বললো,
—“আপনার বন্ধু? আপনার বন্ধু কিভাবে মা হবে?”

নিশাদ কথার প্রেক্ষিতে উওর দিলোনা। পাশ থেকে মাথার বালিশ তুলে নিয়ে কোলের উপর দিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“এখানে বালিশ রেখে লিখতে পারেন না? দেখি, কি লিখেন এতো। সারাদিন পড়াশোনা। বাচ্চাকেতো পেটেই আলবার্ট আইনস্টাইন বানিয়ে ফেলছেন। আপনি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী না। এইতো খাপে খাপ।”

—“ধুর, চুপ করেনতো ভাইয়া।”

নিশাদ জোর গলায় বললো,
—“কি লিখছেন? আহা! দেখি না। আমি লিখে দেই, দেন।”

—“উহু! লাগবেনা। আমি পারবো, শেষই প্রায়।”

—“আপনি আমার ভাতিজিকে খেতে দেননা কেনো? ও জন্ম হয়ে তো সোজা আমাকে চড় লাগাবে। ভাববে চাচ্চু কিপ্টামি করে খেতে দেয়নি।”

রাত্রি একঝাঁক বিস্ময় নিয়ে বললো,”আপনারা দু’ভাই জানলেন কিভাবে ও মেয়ে হবে? উনি আম্মু, আম্মু ডেকে অস্থির, আবার আপনি ভাতিজি ভাতিজি করছেন?”

নিশাদ মুচকি হেসে বললো,”জানি জানি।”

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটলো। রাত্রি লিখছে তখনো। নিশাদ একধ্যানে চেয়ে রইলো খাতার দিকে। কি মনোযোগ মেয়েটার। একটু বিরতি নেই লিখার মাঝে। লেখা শেষ হলো নাকি না জানেনা তবে মাঝপথে হঠাৎই কলম থামালো রাত্রি। নিশ্চল বসে রইলো কতক্ষণ। নিশাদ হাল্কা গলায় বললো,”কি হয়েছে? শেষ লেখা। কই? আরো বাকি আছেতো। নিচেরটুকু লিখবেন না।”

রাত্রি প্রত্যুওর করলোনা। আচমকাই নিশাদের কব্জি খামছে ধরলো। অদ্ভুত কন্ঠে বললো,”আপনার ভাইয়াকে একটু ফোন করেন প্লিজ।”
—“ভাইয়াকে? কেনো? নিশাদ বলতে বলতেই শরীরের ভারটা পিছের দিকে ছেড়ে দিলো রাত্রি। নিশাদ দ্রুত ধরলো। বুকের পাশে আগলে নিয়ে অধৈর্য কন্ঠে বললো,”ভাবি? ভাবি কি হলো?…মা, আই মা এদিকে আসো। ভাবির খারাপ লাগছে মনেহয়।”
রাত্রি বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে তখনো বলেই যাচ্ছে,”আপনার ভাইয়াকে আসতে বলেন। উনাকে আসতে বলেন প্লিজ।”
নিশাদ অবিন্যস্ত কন্ঠে বললো,
—“আসবে আসবে, আপনি শান্ত হন। কিছু হবেনা। কি হয়েছে বলবেন তো। কোথায় খারাপ লাগছে? পেটে ব্যাথা?”
রাত্রি ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
—“উনাকে ফোন দিননা।”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here