শ্রাবন আধারে তুমি ১৫

0
2434

শ্রাবন আধারে তুমি
লেখিকা:আফরিন ইসলাম
পার্ট:১৫

রাই কোনো রকম দৌড়ে গেটের কাছে আসার আগেই আবরার গেট লাগিয়ে দিল ৷রাই লোহার গেটে একের পর এক আঘাত করতে লাগলো ৷রাই কাদঁতে কাদঁতে বলল

আবরার একটু দয়া করুন আমার উপর ৷আপনি দয়া করে এমন করবেন না ৷আমাকে আর কয়েকটা দিন এখানে থাকতে দিন ৷তারপর এমনিতেই সব জানতে পারবেন ৷আমার মুখ থেকে আর কোনো কিছু শুনতে হবে না আপনাকে ৷একটু দয়া করুন আবরার ৷আবরার দরজা খুলুন ৷

আবরার গেট খুলল না ৷ গেটের এপাশে দাড়িয়ে রইলো ৷হাতের তালু দিয়ে চোখের পানি মুছে নিল ৷তারপর হাটা দিল বাড়ির দিকে ৷কারো সাথে কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেল আবরার ৷তারপর ঘরের দরজা আটকে দিল ৷

অপর দিকে রাই আবরার কে ডেকেই চলেছে ৷আবরার নিজের জানালার পর্দা সামান্য ফাকা করলো ৷আবরার জানালা থেকে গেট স্পষ্ট দেখা যায় ৷রাই যে গেটে হাত দিয়ে আঘাত করছে তা দেখতে পারছে আবরার ৷না আবরার গলবে না কোনো মতেই এই ছলনার মায়ায় ৷ অনেক ছাড় দিয়েছে কিন্তু আর না ৷

অন্যদিকে রাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে গেটে আঘাত করতে করতে ৷চিৎকার করে ডাকতেও কষ্ট হচ্ছে ৷কান্না করার কারনে মাথা ব্যাথা করছে ৷রাই কাদতে কাদঁতে বসে পড়লো ৷

হে আল্লাহ তুমি কি দেখ না ৷ এতই যদি কষ্ট দেবে তাহলে কেন এই জীবন আমাকে দিয়েছো ৷এভাবে আস্তে আস্তে না মেরে একেবারে নিয়ে যাও ৷ তিলে তিলে আর মরতে পারছি না ৷না কাউকে বলতে পারছি আর না কাউকে নিয়ে বাচঁতে পারছি ৷ আমি আর পারছি না ৷আমাকে তুমি মুক্তি দাও খোদা ৷ রাই হাউমাউ করে কাদঁতে লাগলো ৷

অপর দিকে সাদি আবরার বাড়ীর দিকে যাচ্ছে ৷রাই ভুল করে ওর মেডিকেলের কাগজ গুলোই নেয় নি ৷ সাদি ঐ গুলো দিতেই আবার আসছে ৷কিছু দুর যেতেই কাগজ গুলো সাদির চোখে পড়ে ৷সাদির গাড়ী আবরার বাড়ীর কাছেই অনেকটা চলে এসেছে ৷ সাদি দূর থেকেই রাইকে গেটের কাছে এলোমেলো ভাবে বসে থাকতে দেখে চমকে গেল ৷গাড়ী চালিয়ে গেটের কাছে আসতেই সে সত্যিই চমকে গেল ৷রাই এই ভাবে কেন কাদঁছে তা সাদি বুঝলো না ৷ দ্রুত গাড়ী থেকে নেমে আসলো ৷

আবরার জানালা দিয়ে সবই দেখছে ৷এতক্ষন চোখ থেকে নোনা জল বের হলেও এখন তার রং বদলে গেছে ৷আবরার শরীর কাপঁছে রাগে ৷ সাদিকে এখনই মাটিতে পুতে ফেলতে ইচ্ছে করছে ৷

সাদি দৌড়ে রাইয়ের কাছে এসে বলল রাই বোন তোর কি হয়েছে ৷এভাবে কাদঁছিস কেন এখানে ৷বাড়ীর সবাই কোথায় ৷

রাই শুধু কেদেঁই যাচ্ছে ৷ কোনো কথা বলছে না ৷

সাদি বলল ঠিক আছে আমি ভেতরে যাচ্ছি ৷ আমি ভেতরে যেয়ে কথা বলছি ৷

রাই সাদির হাত ধরে আটকালো তারপর বলল ওখানে যেয়ে লাভ নেই ভাইয়া ৷

কেন কি হয়েছে ৷ আর হাতেই এই অবস্থা কেন রাই ৷ হাত ফেটে রক্ত বের হচ্ছে ৷কিভাবে হলো এমন ৷কেউ কিছু বলছে ৷আমাকে বল তাড়াতাড়ি কি হয়েছে ৷

রাই কাদঁতে কাদঁতে সব বলল সাদিকে ৷

সাদির শরীর এখন রাগে কাপঁছে ৷সাদি বাড়ীর ভেতরে ডুকবে বলে পা বাড়াতে রাই বলল

আমাকে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন তোমার বাড়ীতে থাকতে দেবে সাদি ভাই ৷তুমি যেখানে থাকতে বলবে আমি সেখানেই থাকবো ৷তোমার বাড়ীর সব কাজ করে দেব আমি ৷ প্লিজ সাদি ভাই শুধু দু বেলা খেতে দিলেই হবে ৷তুমি আমাকে সবার মতো ছুড়ে ফেলনা ৷ একটু দয়া করো আমার ওপর ৷

সাদি নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না ৷রাইকে জরিয়ে ধরলো ৷তারপর নিজেও কেদেঁ দিল শব্দ করে ৷ এই রকম একটা মেয়ে কেউ কিভাবে কষ্ট দিতে পারে তা সাদি বুঝে উঠতে পারে না ৷

সাদি কাদঁতে কাদঁতে বলল আমি যত দিন বেচেঁ আছি তত দিন তোর কোনো চিন্তা নেই ৷আমি তোর চিকিৎসা করাবো ৷তোর কিছু হবে না ৷এখানে আর এক মুহূর্ত না ৷চল আমার সাথে ৷সাদি রাইকে গাড়ীতে বসিয়ে দিল ৷

অন্য দিকে সাদিকে দেখে আবরার খুব রাগ হলেও যখন দেখল সাদি রাইকে জরিয়ে ধরেছে ৷তখন তার রাগ পাহাড় সমান কষ্টে রূপ নিল ৷চোখ বেয়ে আবারো নোনাজল গড়িয়ে পড়ল ৷বাইরের রূপ সবাই দেখলেও ভেতরের কষ্ট কেউ দেখে না ৷

আনিলা বেগম আর মিশকাও এই দৃশ্য দেখেছে ৷ সাদি যে রাই কে জরিয়ে ধরেছে ৷আর রাই যে সাদির হাত ধরেছে ৷আবরার ফুপু আনিলা বেগমের কাছে এসে বলল

দেখলে তো আনিলা কি থেকে কি হয়ে গেল ৷আগে কতবার সাবধান করেছি ৷কিন্তু তুমি আমার কোনো কথাই কানে নিলে না ৷ মিশকার দিকে তাকিয়ে বলল দেখলি তো মিশকা তলে তলে রাইয়ের সাথে কত কি করছে সাদি ৷আহারে তোরা কিছু বুঝতেও পারলি না ৷মিশকা নিজেকে আর আটকাতে না পেরে নিজের ঘরের দিকে দৌড়ে গেল ৷আনিলা বেগম মিশকার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল ৷মিশকা যে সাদিকে পছন্দ করে এটা সে ভালো করেই বুঝতে পারে ৷কিন্তু তারা যে একে ওপর কে ভালোবাসে তা জানে না ৷

রাত গভীর হচ্ছে ৷ঘড়ির কাটায় দুইটা বাজে ৷ আবরার ঘরের ফ্লোরে শুয়ে আছে ৷সারা ঘর জুড়ে সিগারেটের গন্ধ ৷মদের বোতল গুলো মেঝেতে পড়ে আছে ৷ রাইয়ের একটা ছবি সামনে নিয়ে আবরার বলল

তুমি আমাকে এত দিন দয়া করেছো তাই না ৷ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে সবাইকে ধোকা দিতে পারলেও আমাকে পারবেন না ৷কি ভেবেছো বিদেশে বসে তোমার কোনো খোজঁ আমি নেই নি ৷তোমার সব খোজ আমি ফুপুর কাছ থেকে নিয়েছি ৷আমি তো তোমাকে প্রথম দেখেই ভালোবেসে ছিলাম ৷কিন্তু তুমি আমায় বুঝলে না ৷তুমি জানো আমি কেন বিদেশে গিয়ে ছিলাম ৷তুমি তখন অনেক ছোট ছিলে রাই ৷তাই আলগা রাগ দেখিয়ে চলে গিয়ে ছিলাম ৷জানো ওখানে তোমাকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হতো ৷আর ফুপু যখন তোমার আর সাদির ক্লোজ ছবি গুলো পাঠাতো তখন হৃদয়টা বারবার ভেঙ্গে যেত আমার ৷তুমি বুঝ নি রাই ৷তোমাকে সংসার নামক বেড়া জালে আটাতে চাই নি আমি ৷তোমাকে চিন্তে চেয়ে ছিলাম আস্তে আস্তে ৷ জানতে চেয়ে ছিলাম আমি ৷ সংসার মানেই তো আর এক বিছানায় শোয়া না ৷সংসার মানে ভালোবাসা ৷যেখানে হৃদয়ের বন্ধন থাকবে ৷ কিন্তু তুমি তো মুখোশের আড়ালে থাকা এক নারি ৷ তাই আমি বুঝাতে পারি নি তোমাকে ৷

ওপর দিকে মিশকা সাদিকে ভুল বুঝে যা নয় তাই মেসেজে লিখে দিয়েছে ৷তারপর সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিল ৷অপর দিকে সাদি মিশকার সাথে যোগাযোগ করতে যেয়েও বারবার ব্যর্থ হলো ৷

রাইয়ের গা কাপিঁয়ে জ্বর এসেছে ৷সাদির মা বাবা অনেক ভালো ৷সাদির মা রাইকে ধরে কেদেঁই দিয়ে ছিল সব শুনে ৷ রাইকে ভালো একটা ঘরে থাকতে দিয়েছে ৷আনিলা বেগম যেমন রাইকে খাইয়ে দিত ৷ঠিক তেমনি সাদির মা রাইকে খাইয়ে দিয়ে গেছে ৷রাত বারোটার দিকে রাইয়ের জ্বর এসেছে ৷রাই মাথার ব্যাথায় ছটফট করছে ৷এত রাতে কাউকে বিরক্ত করতে সে চায় না ৷রাই খুব কষ্টে বিছানা থেকে উঠে বসলো ৷ তারপর দেয়াল ধরে কোনো রকম ওয়াসরুমে গেল ৷বেসিন থেকে পানি নিয়ে মাথায় দিতে লাগলো ৷রাই হাপাচ্ছে ৷রাই নিজের নাকে ও কানে আবারো প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলো ৷রাই আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলো আবারো সেই রক্ত আসছে ৷গলগল করে রক্ত আসছে ৷ রাই নিজের মাথা চেপে ধরলো আর পারছে না সে ৷রাইয়ের হঠাৎ কেন জানি মনে হলো তার চুল গুলো গোড়া থেকে উঠে গেছে তার হাতের চাপে ৷রাই নিজের একটা হাত সামনে আনতেই চমকে গেল ৷রাইয়ের হাতে তার আস্ত চুলের গোছা ৷রাই হাত দিয়ে নিজের চুল গুলো আবারো আলগা করে টান দিল ৷দেখতে পেল তার রেশমি চুল গুলো উঠে আসছে ৷চোখ দুটো জলে ভরে এলো তার ৷তার প্রিয় কোনো জিনিস তার কাছে কেন যেন থাকতে চায় না ৷রাই শুধু তাকিয়ে রইলো নিজের প্রতিবিম্বর দিকে ৷কতটা অসহায় সে ৷নিজের প্রতিবিম্বটা যেন তাকে দেখে হাসছে ৷ এটা এক ভয়ংকর হাসি ৷রাইয়ের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ৷দুর্বল শরীরটা ঢলে পড়লো ওয়াসরুমের চকচকে মেঝেতে ৷কিছুক্ষনের মধ্যেই মুখ থেকে গলগল করে বেড়িয়ে এলো রক্ত স্রোত ৷ ঝাপসা চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো ৷

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here