শ্রাবন আধারে তুমি
লেখিকা:আফরিন ইসলাম
পার্ট:১১
আয়নাতে আবরার রাইয়ের প্রতিবিম্ব দেখছে ৷ সোনালী পারের সাদা শাড়ী , দুই হাতে সাদা চুড়ি ,খোপা করা চুলে রজনীগন্ধার মালা ,মায়াবী চোখে গাঢ় কাজলের ছোয়ায় তার বিয়ে করা বউকে হুর পরীর মতো লাগছে ৷কোনো মেয়ে কি সত্যি এত সুন্দর হয় ৷ সত্যি বলতে ভালোবাসার মানুষ গুলো সর্বদাই সুন্দর ৷সাধারন জিনিসেও তারা প্রেমিকের দেখা শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হয়ে ওঠে ৷প্রেমিকার একটু স্পর্শ প্রেমিকদের মনে মাতাল হাওয়া সঞ্চারন করতে সক্ষম ৷তাই প্রেমিকাদের থেকে সাবধান ৷নয়তো যে কেউ ঘায়েল হতে পারেন প্রতি মুহূর্তে তাদের চোখের অতল গভীরে ৷
আবরার রাইকে নিয়ে বাড়ী থেকে বের হয়ে গেল দুপুরের একটু পরেই ৷বাড়ীর কেউ এই নিয়ে কোনো কথাই বলে নি ৷বিয়ের পর দুজনে এই প্রথম কোথাও যাচ্ছে ৷আবরার মা বাবাও বেশ খুশিই হয়েছে ৷
আবরার গাড়ি চালাচ্ছে ৷খোলা জানালা দিয়ে বাতাস গাড়ীতে প্রবেশ করছে ৷ চারিদিকে বসন্তে ছোয়া লেগেছে ৷ প্রকৃতি নিজের মতো সেজে উঠছে ৷ রাই বার বার তার জীবনের বসন্তকে দেখে চলেছে ৷আবরার রাইয়ের জীবনে বসন্তের মতো ৷যাকে ছোয়া যায় না চাইলেই ৷ কিন্তু তার আগমনে জীবন সেজে ওঠে প্রকৃতির মতোই ৷আবরার দিকে একবার তাকালো রাই ৷তারপর মুখ ঘুড়িয়ে নিল ৷জানালার কাছে মুখ নিয়ে চোখ বন্ধ করে দিল রাই ৷প্রকৃতিকে খুব সুন্দর করে উপভোগ করছে রাই ৷ বাতাসের মাঝে অক্সিজেনের অভাব নেই ৷কিন্তু এখানে তার জন্য সামান্যই আছে ৷হঠাৎ একদিন তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে ৷ চাইলেই আর প্রকৃতিকে উপভোগ করা যাবে না ৷চাইলেই আর নিজেকে নানা রং এ রাঙ্গিয়ে তোলা যাবে না ৷নিঃশ্বাস বন্ধ হলে ঐ সাদা কাপড়টাই সবাই পড়িয়ে দেবে ৷মুসলিম হলে মাটির ঘরে রেখে আসবে প্রিয়জনেরা ৷আর হিন্দু হলে আম কাঠের চিতায় দাহ করা হবে ৷ আর খ্রিষ্টান হলে কফিনে করে মাটি চাপা দেবে ৷জীবনটা বড়ই অদ্ভুত ৷ যেখানে সেকেন্ডের ভরসা নেই ৷অথচ আমরা সবাই আজ রূপ , টাকা,পয়সার মোহে পড়ে আছি ৷দুনিয়ার চাকচিক্য দেখে ভুলেই গেছি যে একদিন ওপারে চলে যেতে হবে ৷একদিন সবাইকে ছেড়ে আপন ঠিকানায় চলে যেতে হবে ৷হয়তো দুই দিন আগে নয়তো দুই দিন পরে ৷
গাড়ী থেমে গেছে ৷রাইয়ের বলা মতো তুরাগ নদীর পাড়েই আবরার গাড়ী থামিয়েছে ৷ নদীর পাড়ে গাঢ় সবুজ ঘাস ৷নদীর পানির কলকল আওয়াজ আসছে ৷নদীর পাড়েই একটা শুকনা গাছ ৷গাছটার একটা ডালে দুইটা চড়ূই পাখি বসে আছে ৷ রাই সেই দিকে তাকিয়ে হাসলো ৷ রাই নিজের পায়ের জুতো খুলে ফেলল ৷আবরার রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল
জুতো কেন খুললে তুমি ৷
রাই বলল এই কোমল ঘাসে একবার নিজের পা ছুইয়ে দেখুন ৷দেখবেন একরাশ সিদ্ধতা আপনার মনকে ছুইয়ে দেবে ৷
আবরার নিজের পায়ের জুতো খুলে ফেলল ৷তারপর রাইয়ের একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিল ৷কোমল ঘাসে একটা একটা পা ফেলে চলতে লাগলো ৷বাতাস এসে রাইয়ের আচঁল উড়িয়ে নিতে চায় ৷আবরার ঘন চুল গুলো এলোমেলো হয়ে গেছে ৷পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে নিয়েছে আবরার ৷ হঠাৎ রাই আবরার হাত ছেড়ে দিল ৷তারপর একটু সামনে হেটে গেল ৷রাই কিছু বন্য ফুল তুলে নিল ৷আবরার রাইকে দেখেই চলেছে ৷মেয়েটা কখন কি করে আবরার বুঝতেই পারে না ৷ আবরার যেই পাঞ্জাবীটা পরে আছে সেটাও রাইয়ের দেওয়া ৷ আবরার দেখলো রাই তার দিকে আসছে ৷রাই আবরার কাছে এসে দাড়ালো ৷তারপর একমুঠো বন্য ফুল আবরারকে দিয়ে বলল
আপনার জন্য এগুলো ৷এর দাম হয়তো খুবই কম ৷কিন্তু বিশ্বাস করুন এর সৌন্দর্য এতটাই প্রখর যে কবিও ভাষা হারিয়ে ফেলবে ৷
আবরার ফুল গুলো হাতে নিল ৷তারপর একটা গভীর শ্বাস নিয়ে তার গ্রান নিল ৷
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে ৷সূর্য বিদায় নেবে ৷নদীর স্বচ্ছ পানিতে পা দুলিয়ে বসে আছে আবরার আর রাই ৷রাই আবরার কাধে মাথা দিয়ে রেখেছে ৷দুজনেই গোধূলী বেলা দেখছে ৷সূর্য ডুবে যাচ্ছে ৷কিন্তু তার কিরন প্রেমিক আর প্রেমিকার মনে ভালবাসার এক সুন্দর সন্ধ্যি তৈরি করছে ৷আবরার রাইয়ের দিকে তাকালো ৷রাইয়ের মুখটা বড্ড মায়াবী লাগছে তার কাছে ৷রাই নিজেও চোখ তুলে আবরার দিকে তাকালো ৷তারপর বলল
এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন ৷
আবরার হাসলো ৷তারপর মাথা নেড়ে বলল কিছু না ৷
রাই মুচকি হেসে বলল সময়টা সুন্দর না ৷
হুমমম ৷এভাবে সারা জীবনও থাকা যায় ৷
রাই কবি কন্ঠে বলতে লাগলো
সময় থামিয়া যাক
প্রকৃতি শান্ত থাক
তোমার আমার প্রেম গাথা
এমনই রহিয়া যাক
জানি তাহা শুধুই স্বপন আমার
মিথ্যা মোহের সঙ্গে তুমি
থাকিবে আর কতদিন
দুদিন পরেই ছুটি নেব
জীবন সংসারের আমি
কিছুটা সময় তোমার আমার
এটাই যেন অনেক
তবুও বলিব সময় পেলে
আবার আসিব ফিরে
রাই থেমে গেল ৷আবরার ঘাড় ঘুড়িয়ে রাইয়ের দিকে তাকালো ৷তারপর বলল বেশ ভালো কবিটা বলো তুমি ৷ কিন্তু কয়েকটা লাইনের পরে আর বুঝতে পারি নি ৷না মানে অর্থ যেটা আসে তার সাথে তো তোমার কোনো সম্পর্ক নেই ৷
রাই হাসলো ৷তারপর বলল সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে ৷এবার উঠুন ৷বাড়ী যেতে হবে ৷আবরার আর রাই উঠে দাড়ালো ৷তারপর আবারো হাতে জুতো নিয়ে হাটা দিল ৷
আবরার কিছুদূর যেয়ে থেমে গেল ৷আবরারকে থাকতে দেখে রাই বলল কি হলো থামলেন যে ৷চলুন ৷
রাইয়ের কথায় আবরার পাত্তা দিল না ৷নরম ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লো ৷আবরার নিজের মাথার নিচে একটা হাত দিল ৷আরেকটা হাত ঘাসের ওপর রেখে বলল
শুয়ে পড় রাই ৷
রাই কথা বাড়ালো না ৷জীবনের শেষ সময়ে যদি ভালবাসার মানুষের একটু কাছে থাকা যায় তাহলে ক্ষতি কি ৷রাই আবরার হাতে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো ৷রাইয়ের খোপার ফুলের ঘ্রান আর নিরব পরিবেশ আবরার সহ্য করতে পারছে না ৷ নিষিদ্ধ চাহিদা হানা দিচ্ছে প্রেমিক হৃদয়ে ৷আবরার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো ৷রাই আবরার দৃষ্টি অনুসরন করে বলল কি দেখছেন আপনি ৷
হাজার তারার ভিড়ে একটা উজ্জল তারার খোজঁ করছি ৷কিন্তু পাচ্ছি না ৷
রাই মলিন কন্ঠে জবাব দিল ৷
যেই ক্ষনে আমার আখি বন্ধ হবে
সেই নিশিতে আকাশে তাকিও
হাজার তারার ভিড়ে
তোমার তারাটা খুজে নিও
যেই তারাটা তোমার জন্য হাসিবে
তাহারে দেখিয়া তুমি কাদিবে
আবরার রাইয়ের অপরে আধশোয়া হয়ে বলল এত কঠিন করে কেন কথা বলো ৷সোজা করে বলতে পারো না ৷
রাই বলল এবার বাড়ী চলুন মশাই ৷
চলবে