শ্রাবন আধারে তুমি
লেখিকা:আফরিন ইসলাম
পার্ট:৬
সন্ধ্যা হয়ে গেছে আবরার ফোন ধরছে না ৷আফজাল খান গাড়ী নিয়ে বের হবেন এমন সময় তার মোবাইলে একটা কল আসলো ৷আফজাল খান ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো আবরার নাম্বার থেকে কল এসেছে ৷তিনি সাথে সাথে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন বললেন
আমি পুলিশ অফিসার শওকত বলছি ৷
আফজাল বললেন এটা আমার ছেলের নাম্বার ৷আপনার কাছে আমার ছেলের ফোন কেন ৷
আসলে ওনার গাড়ী ব্রেক ফেইল করে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৷আপনার ছেলে এখন হাসপাতালে ভর্তি ৷আপনারা তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হাসপাতালের ঠিকানায় চলে আসুন ৷
আফজাল খান আর দেরি করলেন না ৷আবরার গাড়ী দুর্ঘটনার কথা আনিলা বেগম শুনতেই ডুকরে কেদেঁ উঠলেন ৷ আবরার দুর্ঘটনায় রাইয়ে পায়ের নিচের মাটি যেন সরে গেছে ৷রাই আফজাল খানের কাছে কাদঁতে কাদঁতে বলল
বাবা উনি ঠিক আছেন তো ৷বাবা ওনার কিছু হয় নি তো ৷
আমি জানি না মা ৷কিন্তু তাড়াতাড়ি এখন আমাদের হাসপাতালে যেতে হবে ৷
আফজাল খান যত দ্রুত সম্ভব সবাইকে নিয়ে হাসপাতালে গেল ৷রাই দৌড়ে গাড়ী থেকে বের হয়ে গেল ৷রাই রিসিপশন থেকে আবরার কেবিন নাম্বার জেনে নিল ৷রাই দৌড়ে কেবিনের কাছে গেল ৷রাইয়ের মনে হচ্ছে কেউ তার কলিজা টেনে বের করে নিয়েছে ৷চোখের পানি যেন থামতে চাইছে না ৷ রাই কাচেঁর জানালা দিয়ে ভেতরে তাকালো ৷রাইয়ের হৃদয়টা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে ৷ কেবিনের ভেতর থেকে ডাক্তার বের হতেই রাই বলল আমার স্বামীর কি অবস্থা ডক্টর ৷
আপনার স্বামী ভালো আছেন৷মাথায় খুব একটা ব্যাথা না পেলেও হাতে আর পায়ে বেশ ক্ষত হয়েছে ৷ছয় মাসের আগে ঠিক মতো হাটতে পারবে বলে মনে হয় না ৷তবে সঠিক ভাবে সবা করলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে ৷ ওনাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে ৷জ্ঞান আসতে রাত হবে ৷চিন্তা করবেন না ডাক্তার কথা গুলো বলে চলে গেল ৷
রাত দুইটা বাজে ৷চারিদিকে নিরবতা বিরাজমান ৷রাই আবরার পাশেই একটা চেয়ারে বসে বসে ঘুমাচ্ছে ৷কিছুক্ষন আগেই রাই ঘুমিয়ে গেছে ৷আবরার আস্তে আস্তে চোখ খুলতেই নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করল ৷আবরার পাশে তাকাতেই রাইকে দেখতে পেল ৷মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে গেছে ৷আবরার ইচ্ছে হলো না রাইকে ডাকতে কিন্তু খুব পানির পিপাসায় তার গলা শুকিয়ে গেছে ৷আবরার রাইকে আস্তে করে ডাক দিয়ে বলল এই শুনছো রাই ৷
আবরার ডাক দিতেই রাই তার বিদ্ধস্ত চোখে তাকালো ৷রাই ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলো
আপনার কিছু লাগবে ৷আপনার কষ্ট হচ্ছে কোথাও ৷ডাক্তার ডাকবো আমি ৷
রাইকে থামিয়ে দিয়ে আবরার বলল আমি ঠিক আছি রাই ৷আমার খুব পানির পিপাসা পেয়েছে ৷একটু পানি দেবে আমাকে ৷
এই প্রথম আবরার রাইয়ের সাথে ভালো মতো কথা বলেছে ৷রাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছে ৷ ভালবাসার মানুষের একটু ভালো কথা অমৃতের থেকেও উত্তম প্রেমিকার কাছে ৷রাই অতি ব্যস্ত হয়ে আবরার কাছে পানি নিয়ে এলো ৷রাই আস্তে করে আবরার মাথার নিচে হাত দিল ৷আবরার মাথাটা একটু উচু করে পানি খাইয়ে দিল ৷
আবরার পানি খেয়ে শুয়ে রইল ৷তারপর বলল মা বাবা আসে নি ৷তুমি এখানে কেন ৷
রাইয়ের এখানে থাকাটা আবরার পছন্দ করছে না এটা রাই বুঝতে পারলো ৷রাই একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলল ওনারা এসেছেন ৷বাবা আর মিশকা বাইরে আছেন ৷মা আপনার এই অবস্থা দেখে অসুস্থ হয়ে গেছেন ৷তাই বাবা মাকে বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়েছে ৷
আবরার আর কিছু বলল না ৷প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেছে আবরার আর ঘুম আসছে না ৷রাই আবরার পাশেই বসে আছে ৷আবরার ঘুমাচ্ছে না তাই রাই বলল
আপনি ঘুমাচ্ছেন না কেন ৷
আবরার আস্তে করে বলল আমার মাথা ব্যাথা করছে ৷তাই ঘুম আসছে না ৷
রাই কোনো কথা না বলে আবরার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো ৷আবরার কঠিন চোখে রাইয়ের দিকে তাকালো ৷রাই কিছু না বলে মুচকি হাসি দিল ৷আবরার এবার বলল
তুমি কেন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছো ৷হাত সরাও ৷
আরো চার মাস আমি আপনার স্ত্রী ৷আপনার মাথায় আমি ছাড়া আর কে হাত বুলিয়ে দেবে শুনি ৷চার মাস পর না হয় আরেকটা বিয়ে করে নেবেন ৷
আবরার মুখ ভার করে শুয়ে রইলো ৷সে অসুস্থ বলেই রাই তাকে এই কথা গুলো বলছে এটা আবরার বুঝলো ৷একবার সুস্থ হোক তারপর বুঝাবে ৷
রাইয়ের নরম হাতের পরশে আবরার ঘুমিয়ে গেল ৷কিন্তু রাই আর ঘুমালো না ৷সারা রাত আবরারকে দেখেই পার করে দিয়েছে ৷
বেলা এগারো টায় আবরার ঘুম ভেঙ্গে গেল ৷পাশে তাকিয়ে দেখলো রাই নেই ৷এর মধ্যে কেবিনের ভেতর নার্স প্রবেশ করলো ৷নার্স আবরার কে সজাক দেখে বলল গুড মর্নিং মিঃ খান ৷
আবরার নার্সকে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলল গুড মর্নিং ৷
নার্স কাজ করতে করতে বলল আপনি কিন্তু খুব লাকি স্যার ৷আপনি লাখে একজন স্ত্রী পেয়েছেন ৷ কাল হাসপাতালে এসে তার কি কান্না আপনার জন্য ৷সারা রাত আপনার কাছে বসে ছিল ৷আমরা হাজার বলেও সরাতে পারি নি ৷উনি একটু আগে একঘন্টার জন্য একটু বাইরে গেছেন ৷আপনার খেয়াল আমাকে রাখতে বলে গেছেন ৷
আবরার রাইয়ের প্রতি রাগ হলো ৷সে অসুস্থ এটা জেনেও মেয়েটা তাকে রেখে চলে গেছে ৷মেয়েটা ভালো নাটক করতে পারে ৷সবাইকে বেঝাচ্ছে সে আমাকে ভালবাসে ৷কিন্তু তাকে তো আমার থেকে ভালো কেউ চেনে না ৷
আবরার শুয়ে আছে ৷এর মধ্যে রাই ভেতরে প্রবেশ করলো ৷আবরার আড়চোখে রাইয়ের দিকে তাকালো ৷রাইয়ের মুখটা মলিন হয়ে আছে ৷মুখটা বড্ড বেশি শুকনা লাগছে ৷রাই অনেক কষ্টে একটু হাসলো তারপর বলল
কেমন আছেন ৷শরীরটা এখন ভালো লাগছে ৷আসতে একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে তাই না ৷
আবরার শক্ত কন্ঠে বলল অভিনয়টা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না ৷সবার সাথে এমন একটা ভাব করছো যে আমাকে কত ভালবাসো ৷কিন্তু আমি মরে গেলেও তো তোমার কিছু যায় আসে না ৷
রাই টলমল চোখে আবরার দিকে তাকিয়ে বলল আপনি সত্যি বড্ড অবুঝ আবরার ৷আমার সব আয়ু আপনাকে দিতেও আমার আপত্তি নেই ৷ কিন্তু কি করবো বলুন ঐ টাও নেই আমার কাছে খুব বেশি ৷ আপনি আমাকে সত্যি বুঝলেন না ৷রাই একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো তারপর কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেল চোখের পানি মুছতে মুছতে ৷
এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে ৷আবরারকে বাড়ীতে নিয়ে আসা হয়েছে ৷আবরার ঘরে শুয়ে আছে ৷ রাই স্যুপ নিয়ে ঘরে আসলো ৷আবরার পাশে বসে রাই বলল এখন ঔষুধ খেতে হবে ৷আমি স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছি ৷আপনার কোনো কথা শুনবো না আমি ৷তাড়াতাড়ি খেয়ে নিবেন ৷
আমার উপর হুকুম জারি করছো তুমি ৷তুমি কি ভেবেছো আমি অসুস্থ বলে কিছু করতে পারবো না ৷
রাই স্যুপে ফু দিতে দিতে বলল আপনার উপর আমি হুকুম জারি করতে চাই না ৷ তবুও যদি আপনার মনে হয় আমি আপনাকে হুকুম করছি ৷তাহলে হ্যা আমি হুকুম করছি ৷ যত দিন বেচেঁ আছি তত দিন না হয় হুকুম করে গেলাম ক্ষতি কি ৷মরে গেলে তো আর পারবো না ৷হঠাৎ হয়তো এক দিন দেখবেন আমি আর নেই ৷ঐ দিন হাজার চাইলেও আর হুকুম করতে পারবো না ৷তাই যত দিন বেচেঁ আছি তত দিন না হয় আমার মতো করেই থাকুন ৷ক্ষতি কি তাতে ৷ আর তো কয়েকটা দিন মাত্র ৷
আবরার এবার রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল এই মেয়ে তোমার বয়স কতো হ্যা ৷এখনই মরার কথা বলো কিভাবে ৷তোমার থেকে বয়স্ক লোক পরে আছে এখনো ৷আর তুমি মরার কথা বলছো ৷
রাই হাসলো তারপর আস্তে করে বলল ওপারের যাওয়ার চিঠি যে কোনো সময় চলে আসে ৷আমার চিঠিও চলে এসেছে ৷যে কোনো সময় আমাকেও হয়তো চলে যেতে হবে ৷আমার যাওয়ার সময় যে ঘনিয়ে আসছে আবরার ৷আপনার অজানাতেই হয়তো একদিন হারিয়ে যাব কোনো এক কুয়াশা ঢাকা ভোরে ৷
(কাল আপুকে নিয়ে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত হাসপাতালে ছিলাম ৷বাসায় আসার পর খুবই ক্লান্ত ছিলাম তাই গল্প দেই নি ৷)
চলবে…..