এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️পর্ব-২৬
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
ঘটা করে সন্ধ্যা নেমেছে। পৃথিবীর চরণে মাথা ঠেকিয়েছে সূর্য। ঘনালি অন্ধকার শূণ্য গগনে। পাখিরা নীড়ে ফিরে গেছে। স্তব্দ পৃথিবীর নিস্তব্ধ আড়ালে কেউ হয়তো মত্ত হয়ে প্রহর গুনছে তোমাকে কাছে পাওয়ার।
ঘরটা অন্ধকার। বাতি নিভানো। হাসপাতালের চিরচেনা স্যাভলনের গন্ধ ছাপিয়ে কৃত্রিম এয়ার কন্ডিশনারের মিষ্টি ফুলেল ঘ্রান। রাত্রি আবছা অল্প চোখ মেললো। পিটপিট করলো। ঘন গুমোট ছাড়া কিছুই কালো কর্ণিয়ায় দৃষ্টিগোচর হলোনা। অতিদীর্ঘ ঘুমের রেশটা কাটতে বেশ সময় লাগলো। নড়চড়হীন পার হলো দু-তিনমিনিট। একটু সজাগ হয়ে উঠতেই টনক নড়লো। থতমত খেয়ে গেলো সে। অনুভব করতে পারছে। তার কাঁধের পাশের বালিশে মুখ গুঁজে তার উপরই উপুর হয়ে শুয়ে আছে একজন। মানুষটার হাতের গাঢ় চাপেই নরম বিছানার সাথে লেপ্টানো বামহাতটা। আর ডানহাতটা এতক্ষণ ঘুমের মধ্যেও মানুষটার বিশাল পিঠের মাঝখানটায় খুব যত্নে আঁকড়ে ধরেছে রয়েছে। কয়েকসেকেন্ড অতিবাহিত হলো একান্ত ঘনিষ্ঠ অনুভূতিতে। রাত্রি মাথা কাত করার চেষ্টা করলো। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে লেগে জ্বলে উঠলো তুলতুলে গাল। মুখ দিয়ে বের হলো চাপা আর্তনাদ,”উহ্।”
নিভ্রান দ্রুত মুখ তুললো। নামমাত্র দুরত্ব। দু’নাকের ডগা ছুঁইছুঁই। চোখে চোখ পড়েছে কিনা স্পষ্ট নয়। স্তুপাকার তীব্র অন্ধকারে একটা ফোঁটা বিন্দুও দৃশ্যমান না।
নিভ্রান আবারো মুখ ডুবালো কাঁধে। দেহ নি:সাড়।
পিঠের হাতটা সরিয়ে ঘাড়ের ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলের উপর রাখলো রাত্রি। যত্নমেখে বললো,
—“কি হয়েছে?”
নিভ্রান মুখ তুললোনা। কথা যেন কানে যায়নি। রাত্রি চিন্তিত ভঙ্গিতে চুলে হাত বুলাল,”কি হলো?”
নিভ্রান বিছানার চেপে রাখা হাতের জোর বাড়িতে দিলো। রাত্রি হকচকালো। কি হলো লোকটার? রেগে আছে নাকি?
নিভ্রান মুখ গুঁজেই ধীরকন্ঠে বললো,
—“মেন্টাল স্ট্রেস, খাওয়া দাওয়ায় চরম অনিয়ম, বিপি হাই ..এসবের মানে কি?”
রাত্রি গাল ঘুরালো। এবার দাড়িতে খোঁচা খেলেও শব্দ করেনি। মিনমিনে গলার স্বর,”জি?”
নিভ্রান মুখ তুললো। সরাসরি চোখে চোখ রাখলো বোধহয়। রাত্রি বুঝতে পারছে। একজোড়া নিমগ্ন চোখ হয়তো আকন্ঠ তৃষ্ণায় ডুবে স্হির চেয়ে রয়েছে। খুব খুব গভীর সেই দৃষ্টি, সেই গভীরতায় হয়তো ডুবা সম্ভব না। না তা পরিমাপ করা সম্ভব তার ছোট্ট মনের অপরিপক্ক স্কেলে।
নিভ্রান হঠাৎই কপালে কপাল ঠেকালো। অন্যরকম টানটান কন্ঠে বললো,
—“আমি যদি তোমাকে আজকেই বিয়ে করি তবে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে রাত?”
রাত্রি যেনো আচানক কথাটা সামলে উঠতে পারলোনা। কেমন চিনচিনে একটা অনুভূতি শিরায়- উপশিরায় ছিঁটকে পড়লো। মাথার ভোঁতা যন্ত্রনাটা চড়ে উঠলো। তবু কোথায় যেনো একটা খুব শান্তি। কোথায় যেনো এক আকাশ প্রশান্তি। হাতছানি দিয়ে ডাকছে আদরকন্যা। নিভ্রান চোখ বন্ধ করলো। আবার বললো,
—“আপত্তি আছে?” কন্ঠের টানটান ভাবটা এবার একটু মৃত। বুক চিড়ে আসা যন্ত্রনাটা বিদ্রুপ করলো হয়তোবা।
রাত্রি হাসলো। শব্দহীন। সব ছাপিয়ে আলতো করে হাত রাখলো নিভ্রানের দু’গালে। কপালে কপালের ঠেকানোটা আরো একটু দৃঢ় করে বললো,
—“আজই?”
—“এক্ষুণি।”
—“এক্ষুণি?”
—“হু।”
—“মা?”
—“জানে।”
—“বাকি সবাই?”
—“জানে।”
—“সবাই জানে?”
—“সবাই।”
রাত্রি হেসে ফেললো। হাসিতে কেমন যেনো ছন্নছাড়া ভাব। পিছুটান নেই। মুক্ত পাখির মতো ডানা ঝাপটানোর আভাস। জীবনে তো কতো কিছুই হুটহাট হয়ে যায়। এবার নাহয় একটু স্বার্থপর হয়ে গেলো। অন্যসব চিন্তাভাবনা ক্ষণিকের জন্য ভুলিয়ে দিলো। নামহীন অনুভূতিকে নাম দিয়ে দিলো। কি হবে বড়জোড়? কি ই-বা হবে?
নিভ্রান অন্ধকারেই যেনো সেই হাসি ছুঁয়ে ফেললো। অনুভব করে নিলো। মনে মনে তাল মিলিয়ে হেসেও নিলো খুবক্ষণ। তবে মুখে বললো,”আছে আপত্তি?”
রাত্রি হাসি থামালো,”থাকলে?”
—“জোর করবোনা।”
—“কেন করবেননা?”
—“হু?”
রাত্রি চুপ থাকলো অনেকক্ষণ। তম্রসারা কি যেনো করে গেলো। খুব নিরিবিলিতে কি যেনো একটা ঘটে গেলো হঠাৎই, খুব আকস্মিক। রাত্রি আদুরে গলায় উওর দিলো,
—“নেই।”
—“নেই?”
—“নেইতো।”
চেপে রাখা হাত ছেড়ে দিলো নিভ্রান। উঠে গেলো উপর থেকে। পাশের সুইচ টিপে লাইট জ্বেলে দিলো। রাত্রি সইতে না পেরে চোখ খিঁচে ফেললো। হাত দিয়ে দৃষ্টি আড়াল করলো। উঠে বসার শক্তি নেই শরীরে। কেমন কমজোর লাগছে। একহাতে চুল খামছে ধরলো সে,
—“আমাকে কি ইনজেকশন টি নজেকশন দিয়েছেন নাকি? এমন লাগছে কেনো? মাথা ধরে আছে। উফ!”
—“ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে ডক্টর। কতো দূর্বল তুমি জানো? খেয়াল তে থাকেনা কোনোদিকে।”বলতে বলতে তাকে দু’হাতে ধরে উঠিয়ে বেডসাইডে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো নিভ্রান। পাশের টেবিল থেকে ঘোলাটে স্যালাইন পানি তুলে নিলো হাতে। ঠোঁটের সাথে ঠেকিয়ে বললো,”হা।”
—“আমি অসুস্থ না তো। এসব কেনো?”
—“অসুস্থ না তুমি? ডাক্তার তাহলে কাকে গাদা গাদা ওষুধ প্রেসক্রাইব করলো? আমাকে?”
—“ডাক্তাররা তো ওসব করেই। সব টাকার ধান্দা। আপনাকে দেখেছে বড়লোক মানুষ। চেহারা সুরতে আভিজাত্য,ব্যস ধরিয়ে দিয়েছে ওষুধপত্র।”
—“চুপ, হা করতে বলেছি।”
স্যালাইনটুকো একনিশ্বাসে শেষ করিয়ে গ্লাস নামালো নিভ্রান। ঠোঁট মুছিয়ে দিতেই রাত্রি বললো,
—“মা কোথায়?”
—“আছে।”
—“একা তো। ওখানে যাই।”
নিভ্রান কিছু বলবে তার আগেই দরজায় খটখট। রাত্রি চমকে উঠলো। তাকালো দরজার দিকে। দরজা হাল্কা ফাঁক করে নিশাদ উঁকি দিলো। একপলক রাত্রিকে দেখেই সালাম দেয়ার ভঙ্গি করলো। রাত্রি হতভম্ব। চোখে হাজারখানেক প্রশ্ন। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি। নিশাদ ফিচেল গলায় হাসলো। নিভ্রানের দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করে ব্যাঙ্গ করে বললো,
—“তোর আজও আপুকে মানানো হবে নাকি আমি কাজি সাহেবকে নিয়ে চললাম।”
নিভ্রান আজ আর ধমকালোনা। বরং হাসি হাসি কন্ঠে বললো,
—“মেনে গেছে তোর আপু। আসছি যা।”
সে বিনাবাক্য চাপা হেসে দরজা ভিড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। রাত্রি হতবাকে কিৎকর্তব্যবিমূঢ়।
—“আপনি কি পাগল? ভাইয়া কোথা থেকে এলো? হসপিটালে কাজি,বিয়ে…কিভাবে?”
নিভ্রান হাসলো শুধু। রাত্রির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,”দাড়াতে পারবে? হাতটা ধরো।”
মায়ের কেবিনে যেতেই আরো একদফা অবাক হলো রাত্রি। একদফা বললে ভুল হবে বরং কয়েকদফা অবাক হলো এবং হতেই থাকলো অবিশ্রাম। নিশাদ, নাহিদা, নওশাদ সাহেব সবাই আছেন এই কেবিনে। কাজি সাহেব বসে আছেন প্রস্তুত হয়ে। মামা- মামিকে আশেপাশে দেখা গেলোনা। সবাইকে সালাম দিয়ে মায়ের কাছে যেয়ে বসলো সে। চোখের থমকানো ভাবটা কাটেনি এখন অবধি। নিভ্রান সজোরে চাঁটি মারলো নিশাদের মাথায়,
—“এই গাধাটাতে বলেছিলাম আমার কাবার্ডে রাখা বিয়ের শাড়িটা মনে করে নিয়ে আসতে। গাধাটা ভুলে বসে আছে।”
নিশাদ মাথা ডললো। তবে মুখে মিটিমিটি হাসি নিয়ে বললো,”কথা দিচ্ছি আপু, আপনাকে আমি নিজে গুনে গুনে দশটা বিয়ের শাড়ি কিনে একেবারে সাজিয়ে গুছিয়ে নিজদায়িত্বে দশবার বিয়ে দিবো। মানে ভাইয়ার সাথেই আরকি। এবার শুধু একটু এভাবেই ম্যানেজ করে নিন।”
রাত্রি ঠোঁট কোঁণ প্রসারিত করে হাসলো। মায়ের দিকে একবার তাকাতেই সে চোখের পাতা নামিয়ে সম্মতিসূচক বার্তা দিয়েছে। আর কোনো বাঁধা নেই বিধায় আপত্তি করার মতো কিছু পেলোনা। নাহিদার মুখে বিস্তর হাসি। যাক অবশেষে!
নওশাদ সাহেব গলা ঝেড়ে বললেন,”শুরু করুক তাহলে। ডাক্তাররা এসে আবার কখন ঝামেলা করে।”
নিভ্রান চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,”করবেনা। ম্যানেজ করা আছে সবাইকে।”
রাত্রি তখন মাথা নিচু করে সবটা হজম করার চেষ্টায় অব্যাহত। গালে অজান্তেই লালাভ আভা। তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? সত্যি সত্যি?
বিয়েটা পড়ানো হয়ে গেলো কিছুক্ষণের মধ্যই। আচমকা, হুট করেই। কবুল বলার সময়েও রাত্রির মনে হচ্ছিলো এখনই বুঝি ঘুমটা ভেঙে যাবে। উঠে দেখবে চিরচেনা বিষাক্ত পৃথিবীর ছোবলে তার মধুর সপ্নটা রক্তাত্ব হয়ে গেছে। কিন্তু এরকম কিছুই হলোনা। সপ্নটা ভাঙলো না বরং জন্ম দিলো আরো হাজারখানেক নতুন সপ্নের।
আকাশে মেঘ ডাকছে তখন। গুড়ুম গুড়ুম। সাদা মেঘের গুচ্ছ হাততালি দিচ্ছে যেনো। প্রাণ উজার করে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে সদ্য বিবাহিত দম্পতিকে। নিভ্রান খুব গোপনে রাত্রির কানের কাছে ফিসফিস করলো,
—“দেখো রাত, আজ বৃষ্টি নামবে।”
~চলবে~
[বিশেষ দিনে বিশেষ মন্তব্য করে যাবেন সবাই❤️]