উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৫
পাড়ায় রহিম খন্দকারের খুব নাম ডাক। তিনি বাড়ি বাড়ি যেয়ে কিস্তি আদায় করেন। তিনি প্রথমে মানুষদের কিস্তি তোলার জন্য উৎসাহ দেন। সেই সময় টায় তিনি হয়ে যান কোমল, নমনীয় এক ভদ্রলোক। কিন্তু যখন কোন ব্যক্তি কিস্তি দিতে দেরী করে বা বাকী রাখে তখন আর তিনি ভদ্রতা বজায় রাখতে পারেন না। তখন হয়ে যান কঠোর ও নিষ্ঠুর এক ব্যক্তি। সেই সময়টায় তার মুখে শুধু বিশ্রী ভাষাই বিরাজ করে। যা শুনে লজ্জায় পরে যে-কেউ কিস্তির টাকা দিতে বাধ্য। আজ রহিম খন্দকার প্রচন্ড চটে আছে। লক্ষ্য তার আজ আবুল কালামের থেকে বকেয়া কিস্তিসহ বর্তমানের কিস্তি আদায় করা। পুরনো দোচালা ঘরটা ভেঙে চারচালা ঘর তোলার জন্য আবুল কালাম একদিন রহিম খন্দকারের শরনার্থী হয়েছিলেন। তবে আবুল কালাম কিস্তি তোলার উপদেশটা নিয়েছিলেন তার এক বন্ধুর থেকে। সেই বন্ধু তাকে রহিম খন্দকারের নিকট নিয়ে যান। এটা প্রায় বছর খানেক আগের কথা। কিস্তি প্রায় শেষের দিকে। ভালো মন্দ না খেয়ে এই পর্যন্ত কিস্তি টেনে আসছেন আবুল কালাম। নগদ দেড় লাখ টাকার কিস্তি তুলেছিলেন তিনি। সপ্তাহে তাকে পনেরোশত টাকা করে কিস্তি দিতে হয়। মাটি কেটে যা আয় করেন, তার তিন ভাগের দুই ভাগই চলে যায় কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে। বেশ ভালো ভাবেই কিস্তি গুলো শোধ দিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু গত তিন মাস যাবৎ ছেলে রুজনের একটার পর একটা অসুখ লেগেই আছে। ছেলের ঔষধ কিনতে গিয়েই কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে পারেনি সে। এইজন্য পরাপর চারটা কিস্তির বোঝা তার ঘাড়ে চেপে বসেছে। কদিন ঘরে একটা কাঁচা বাজারও করেনি সে। আজ কাজও হয়নি। আবুল কালামকে তার মালিক গত কদিনের কাজের টাকা আজ একসাথে দেবে বলেছিল। আবুল কালাম ভেবেছিল সেটা দিয়ে কিস্তিগুলো পরিশোধ করবে। কিন্তু আজ কাজ না হওয়ায় সেই সুযোগ টাও হারিয়ে ফেলল সে। রুপালি যে লোকের বাড়ি কাজ করে,সেখান থেকে রোজ কিছু না কিছু সবজি এনে উনুন জ্বালিয়ে সবার পেট বাঁচিয়েছে। নইলে সবাইকে না খেয়ে মরতে হতো। সব মিলিয়ে আবুল কালাম ও তার পরিবার খুব কষ্টে দিন অতিবাহিত করছে। রহিম খন্দকার দুজন জওয়ান মদ্দ লোক নিয়ে আবুল কালামের বাড়ি এলো। তারপর গলা ছেড়ে ডাকতে লাগল।
‘আবুল কালাম! আরে ওই আবুল কালামের বাচ্চা। বের হয়ে আয় ঘর থেকে।’
আবুল কালাম গুটিগুটি পায়ে রহিম খন্দকারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দৃষ্টি তার মাটির দিকে। রহিম খন্দকারের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না সে।
‘মাথা তুল। আমি বলছি মাথা তুল।’ হুংকার দিয়ে বলল রহিম খন্দকার।
‘রহিম ভাই,আমি আসলে….।’
‘টাকা বের কর। আগের তিনটে কিস্তির চার হাজার পাঁচশত টাকা আর আজকেরটা নিয়ে মোট ছয় হাজার টাকা বের করে ফেল জলদি।’
‘রহিম ভাই আমি টাহার জোগাড় করতে পারি নাই।’
‘পারিসনি মানে?’
‘হামার মালিক আইজ টাহা দিবো কইছিলো।কিন্তু….।’
‘কিন্ত কি? থামলি কেন?’ হুংকার দিয়ে ওঠে রহিম।
‘কিন্ত আইজ কাজ নাই কইয়া সবাইরে বাইত্তে চইলা যাইতে কইছে। টাহা আর দেয় নাই।’
‘তোর এই খামখেয়ালি বানোয়াট কথা শোনার জন্য আসছি নাকি আমি? শালা ভালো ভাবে বলছি টাকা বের কর,নইলে আজ তোকে মেরে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দিতে আমার বেশি সময় লাগবে না। মজা করিস আমার সাথে? মজা?’
আবুল কালাম মিনতির সুরে বললেন, ‘এই শেষ বারের মতো হামারে মাফ কইরা দেন ভাই। সামনের বার যেমন কইরাই হোক আমি সব টাহা পরিশোধ কইরা দিমু।’
‘রাখ তোর সামনের বার। সামনের বার,সামনের বার করতে করতে তুই বছর পার করে দিবি।আমি কিছুই শুনতে চাইনা। তুই কিস্তির টাকা দে আমি চলে যাই। নইলে আমার মুখের ভাষা কতটা সুন্দর জানিস তো? আর সাথে করে কাদের নিয়ে এসেছি বুঝতেই তো পারছিস? আমার এক ইশারা শুধু তারপর….!’ রহিম খন্দকার কথা অসম্পূর্ণ রেখে একটা পৈশাচিক হাসি দিলেন। যার অর্থ আবুল কালাম ঠাউরে উঠেছে।
‘ভাই হামার অবস্থা ইকটু বুজার চেষ্টা করেন। ঘরে বাজার করি না মেলা দিন হইছে। পোলা মাইয়ারে একটা জিনিস কিন্না দিতেও পারি না।আপনিই কন আমি কিস্তির টাহা কেমনে দেই?’
‘সেটা আমার বোঝা বা ভাবার বিষয় না। তুই দেনাদার আর আমি পাওনাদার। এর বেশি কিছু জানা বা বলার দরকার নেই। তুই না খেয়ে মরলে কিস্তিওয়ালা লোকেদের কি? আমি আজকে টাকা না নিয়ে এখান থেকে এক পাও নড়ছি না। টাকা নেওয়ার সময় মনে ছিল না যে কিস্তি দিতে পারবি না?’ বলেই দুহাত দিয়ে আবুল কালামের বুক বরাবর ধাক্কা দিলেন।
আবুল কালাম দুই কদম পিছিয়ে গেলেন। কান্নাজড়িত গলায় বললেন,
‘ভাই আমি নিরুপায়। কিছুই করার নাই হামার।’
‘তুই এভাবে মানবি না বুঝেছি। ওই তোরা পিটিয়ে লাশ বানিয়ে দে আজ এই ফকিন্নির বাচ্চাকে।যতক্ষণ না টাকা বের করে দেয়,ততক্ষণ থামবি না তোরা।’
রহিম খন্দকারের থেকে আদেশ পেয়ে জওয়ান মদ্দ লোক দুটো আবুল কালামের নিকটে তেড়ে গেল মারার জন্য। কিন্তু মারতে পারলো না। মারার আগেই আবুল কালামের স্ত্রী রুপালি বাঁধা দিয়ে বলল, ‘আপনারা ওনারে মাইরেন না। আমি টাহা দিতাছি। এই নেন রহিম ভাই আপনার কিস্তির ছয় হাজার টাহা।’
রুপালি অনেক গুলো একশো টাকার নোট রহিম খন্দকারের হাতে তুলে দিলেন। রহিম খন্দকার গুনে দেখলেন পুরো ছয় হাজার টাকা আছে সেখানে। টাকা পেয়ে চোখের পলকেই রহিম খন্দকারের দানব রূপটা শান্ত হলো।
তিনি বললেন, ‘আগেই টাকা দিয়ে দিলে আমি এত গুলো কথা শোনাতাম না। এত ঝামেলা সৃষ্টি করতাম না। যাই হোক,সামনের বার যেন আর চিল্লাতে নাহয় আমাকে।’ এই বলে লোকজন নিয়ে চলে যায় রহিম খন্দকার।
তারা চলে গেলে আবুল কালাম অবাক করা কন্ঠে রুপালি কে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি এত গুলান টাহা কই পাইলা রুপালি?’
রুপালি চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে,
‘হাঁস,মুরগীর ডিম আর ছাগলের দুধ বেইচ্যা, মাইনষের বাইত্তে কাজ কইরা যা টাহা পাইতাম,তার থেইক্যা কিছু টাহা জমাইয়া রাখতাম। ভাবছিলাম মিতুনির লাইগ্যা একজোড়া সোনার কানের দুল বানামু। মাইয়াডা বড়ো হইতাছে। কিন্তু হেইডা আর পারলাম না। বড়ো মাইয়ার মতো এইডারেও খালি হাতে বিদায় দিতে হইবো মনে হইতাছে। আইজ গরীব বইল্যা পোলা মাইয়াগো কোনো সাধ-আহ্লাদ পূরণ করতে পারি না।’
রুপালির চোখ আবারও জলে ভরে এলো। গলা ভাড়। তিল তিল করে জমানো আশায় পানি ঢেলে পরলে, মানুষ আর নিজের মধ্যে থাকে না। বুক ফেটে কান্না আসে শুধু। মিতু রুজনকে বুকের সাথে জড়িয়ে দরজার আড়াল থেকে সব কিছু শুনছে। সে বাবা মার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছে। বড়ো হচ্ছে সব না বুঝলেও এখন অনেকটাই বোঝে সে। তাইতো বাবা-মার কষ্ট দেখে আড়াল থেকে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে অঝোরে।
***
মিতু গত তিন দিন ঘর থেকে বের হয়নি। সে প্রতিদিনের অভ্যাসে একটু পরিবর্তন ঘটিয়েছে। প্রত্যহ বিকেলে সে নদীর ঘাটে আসে কখনো দুঃখের অবসান ঘটাতে, আবার কখনো আসে সুখ গুলোকে নদীর ঢেউ তোলা কচুরিপানার সাথে ভাগ করে নিতে। নিত্যদিনের এই অপরিহার্য কাজটিতে মিতুর সঙ্গী হয় কাব্য। এই সময় টায় নয়না প্রাইভেট পড়ে। তাছাড়া নয়নার ভাই নয়নাকে বিকেলে বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করেছে। ফলে নয়নার সাথে সকাল,দুপুর কাটালেও, বিকেলটা মিতু ওর কাব্য ভাইকেই দিয়েছে। কাব্যর সাথে মিতুর বন্ধুত্ব মাত্র কয়েক মাসের। এই গাঙেই কোনো এক গোধূলি বেলায় বন্ধুত্ব হয়েছিল দুজনের। মিতুর বাচ্চা স্বভাবই মূলত কাব্যকে মিতুর প্রতি দুর্বল হওয়ার জন্য বাধ্য করেছিল। ঠিক এই জের ধরেই সে একদিন মিতুর দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেদিন কাব্যর হাতে অবশ্য গুটিকয়েক চানামুঠও ছিল। যা মিতুর সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য তালিকার মধ্যে শীর্ষে বলা চলে। মিতু প্রথম প্রথম কাব্যর সাথে অতটা মিশতে না পারলেও, কিছু সময়ের ব্যবধানে ঠিকই মিশে গেল। মাত্র অল্প কয় মাসেই কাব্য মিতুর মনের অতলগভীরে জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্য ও কম নয়। তার কাছে মিতু কেবল ভালো বন্ধু নয়,তার থেকেও বেশি কিছু। মিতু তার প্রথম আবেগ। ভাললাগার প্রথম ছোঁয়া। প্রাণবন্তকর এক সম্মোহন। যা চোখের পলকে কাব্যর পাহাড় সমান বেদনাকে গলিয়ে আনন্দের অনুভূতি এনে দিতে সক্ষম। মিতু আবেগ বোঝেনা। বোঝে শুধু মায়া,মমতা ও ভালবাসা। কাব্যর থেকে মিতু সর্বদাই নিঃস্বার্থ ভালবাসা পেয়ে এসেছে। এই একটা কারণেই সে কাব্যর সাথে এত বেশি ঘনিষ্ঠ। যার কাছেই ভালবাসা পায়, মিতু তার সাথেই মিশে যায়। হৃদয় তার খুবই কোমল,স্বচ্ছল ও সোজা। প্যাঁচগোচ বোঝে না। মিতুর এই গুণের কারণেই কাব্য মিতুকে তার হৃদয়ের সর্বোচ্চ স্তরে স্থান দিয়েছে। এই তিনটে দিন কাব্য অসহ্যকর মরণ যন্ত্রণা সহ্য করেছে। কারণটা মিতু। তার মিতুবুড়িকে একদিন না দেখলে রাতের ঘুম তার মরীচিকার পেছনে ছোটে। রাত তার নির্ঘুমে কাটে। কোনকিছুতেই মন বসে না। তার নির্ঘুম নামক মহামারি থেকে পরিত্রাণের একটাই উপায়। আর সেটা হলো তার মিতুবুড়ির এক চিলতে হাসি। কাব্য আজও নদীর ঘাটে অপেক্ষা করছে তার মিতুবুড়ির জন্য। মনে তার ভয়ের সমাহার। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে তার মিতুবুড়িকে এক ঝলক দেখে আসবে। কিন্তু কোন এক অদেখা সুর কাব্যকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। সেই অদেখা সুর যেন কাব্যর কানের কাছে সতর্কের বাঁশি বাজিয়ে বলছে, ‘যাসনে কাব্য! তোর মিতুবুড়িকে বিপদে ফেলিসনে।’
আবুল কালাম মিতুর সাথে কাব্যর সম্পর্কটা মেনে নিতে পারেনা। আবুল কালামের মনে কাব্যকে নিয়ে অশ্লীল উক্তি পোষণ করা। যা তাকে জঙ্গলের হিংস্র প্রাণীর ন্যায় নির্দয় করে তোলে। সেই নির্দয়তার ভুক্তভোগী হতে হয় নিষ্পাপ বালিকা মিতুকে। যতবার আবুল কালাম মিতুকে কাব্যর সাথে দেখেছে, ঠিক ততবারই আঘাত হেনেছে মিতুর কোমল শরীরে। কাব্য মনে মনে সেই ভয় টাই পাচ্ছে। কাব্যর এই কাল্পনিক ভয়ের অস্তিত্বের অবসান ঘটে মিতুর মিষ্টি কন্ঠ শুনে।
‘আমারে ছাড়া একা একা কি করো কাব্য ভাই?’
কাব্য মিতুকে দেখে যতটা না খুশি হয়েছে,তার থেকেও অধিক পরিমাণে অভিমান হয়েছে। তাইতো মুখটা আড়াল করে ফেলল মিতুর থেকে।
তা দেখে মিতু বলল,
‘আমি জানি কাব্য ভাই, তুমি আমার উপর অভিমান করছো। আমি যে গত তিনদিন গাঙ কূলে আহিনাই তার লাইগ্যা।’
‘তুই আমাকে কষ্ট দিতে বড্ড ভালবাসিস তাইনা রে মিতুবুড়ি?’
মিতু দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দিল।
তা দেখে কাব্য আবারও জিজ্ঞেস করল,
‘তাহলে কেন আসিস নি নদীর ঘাটে? সত্যি করে বলবি, তোর বাজান নিষেধ করেছে, তাইনা?
‘না, বাজানে নিষেধ করে নাই। আমি নিজের ইচ্ছাতেই গত তিনদিন ঘরের বাইরে এক পাও ফালাই নাই।’
‘কেন? আমাকে জ্বালাতে?’
‘না,লজ্জায়।’ মিতু বলল।
কাব্য ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘লজ্জা কিসের?’
‘আমার অসুস্থ হওয়া নিয়া। ইশকুলের সবাই আমারে নিয়া যে সেইদিন কি হাসাহাসি করতাছিল, তুমি সেইডা জানো না কাব্য ভাই! আমার সেইডা একদমই ভালো লাগে নাই। তার লাইগ্যাই বাইত থেইক্যা বাইর হইনাই।’
‘তুই স্কুলেও যাসনি তাহলে?’
‘হ ইশকুলেও যাই নাই।’
‘উহ! তোকে কতবার বলবো ওটা ইশকুল নয়। ওটা স্কুল। বল স্কুল।’
‘স্কুল।’ বাঁধা হীন বলে ফেলল মিতু।
‘এইতো কত সুন্দর করে বললি। এভাবেই বলবি।’
‘আমার ইশকুল কইতেই ভালো লাগে কাব্য ভাই। স্যার কইছে মাতৃভাষারে সম্মান করতে। তাই আমি আমার মায়ের মুখের ভাষাতেই কথা কমু।’
‘তুই যে কি? উল্টো বুঝিস সবসময়। আচ্ছা বাদ দে। তুই স্কুল কামাই দিবি না আর। স্কুল কামাই দিলে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ কমে যায়। বাজে ইফেক্ট পড়ে। আগ্রহ হ্রাস পায়। পড়ায় অনীহা আসে।’
‘ঠিক কইছো কাব্য ভাই। আমি কাইল থেইক্যা আবারও ইশকুলে যামু। বিনা কারণে আর একদিনও ইশকুল কামাই দিমু না।’
কাব্য মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, ‘এইতো আমার লক্ষী মিতুবুড়ি।’
‘কাব্য ভাই, একটা কথা জিগাই?’
‘হুম অবশ্যই, জিজ্ঞেস করে ফেল।’
‘আমি নাপাক মানুষ। সবাই আমারে দূরছাই করতাছে। তুমি করতাছো না ক্যান? আমার লাইগ্যা সবার ক্ষতি হইলে, তোমার হইবো না? মিতুর মুখ মলিন হয়ে এলো। ফর্সা মুখটায় যেন নিকষকালো অন্ধকার ভর করল।
কাব্য মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘তুই এভাবে বলছিস কেন? কে, কি বলেছে তোকে?’
মিতু উদাস মুখে জবাব দেয়,
‘কেউ কিছুই কয় নায় কাব্য ভাই।’
‘কেউ কিছু না বললে তুই ওভাবে মন খারাপ করে কেন বললি কথাটা? নিশ্চয়ই কেউ কিছু না কিছু বলেছে তোকে।’
‘তোমারে কিছু কওন ও যায়না বাবা! সব কথায় প্যাঁচ ধরো খালি। এমনি কি কিছু কইতে পারি না আমি?’ মিতু রাগের মাধ্যমে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করল।
কাব্য ডান সাইডের কানের লতি স্পর্শ করে বলল,
‘আচ্ছা স্যরি। তুই বল, তিন দিন পর আজ কোন মনে আসলি এখানে? না আসলেও পারতি।’
‘এ্যাহ! না আসলেও পারতি! কইলেই হইলো নাকি? আমার মনখান যে তোমারে দেহার লাইগ্যা লবণ দেওয়া শিং মাছের মতোন লাফাইতাছিলো। সেইডা তো তুমি বুঝবা না। তার লাইগ্যাই তো না আইয়া আর থাকতে পারলাম না।’
‘তাই বুঝি?’
‘হুম, আমি তোমারে আর নয়নারে না দেখলে মনে হয়, বুকের মইধ্যেখান থেইক্যা পরাণ পাখি দূর আকাশে পালায় গেছে। আর কোনদিন দেখতে পারুম না তোমাগো। আমি তোমারে ভালো কইরা কইতে পারতাছি না আমার ঠিক কতখানি কষ্ট লাগে তোমাগো না দেখলে।’
‘থাক তোর এই ছোট মাথায় এত চাপ নিস না। আচ্ছা বলতো,তুই আমাকে আর নয়নাকে কি একই রকম ভালবাসিস?’
‘হুম। একটু কমও না,একটু বেশিও না। দুইজনরেই একরকম ভালবাসি।’
‘মানে? তুই আমার জন্য যেমন ফিল করিস,মানে আমার জন্য তোর মনে যেমন অনুভূতি, নয়নার জন্যও কি একই অনুভূতি?’
‘হুম। ক্যান তুমি কি নয়নারে হিংসা করতাছো নাকি? তুমি চাইতাছো আমি নয়নার থেইক্যা তোমারে বেশি ভালবাসি?’
‘সেটা না। আমি অনুভূতির কথা বলছি। তোর মনে নয়নার জন্য যেমন অনুভূতি, আমার জন্যও একই অনুভূতি কিনা সেটা জানতে চাইলাম।’
‘আমি তো দুইজনরে এক চোখেই দেহি। তুমি কি কইতে চাইতাছো কাব্য ভাই?’
‘আরে তুই বুঝতে পারছিস না কেন? আমি জানতে চেয়েছি, আমাকে ভালবাসা আর নয়নাকে ভালবাসার মধ্যে পার্থক্য কি। অর্থাৎ দুজনের ভালবাসা কি সেইম?’
‘দুইজনেই খুব ভালো। আমার স্যার কইছে ভালো বন্ধুদের মইধ্যে পার্থক্য করতে হয়না। বন্ধুত্বে উনিশ বিশ মাপতে নাই। তাইলে একদিন কোনো বন্ধুই পাশে থাকে না। সবাই চইল্যা যায়।’
‘তোর কোন স্যার বলেছে রে এই কথা?’
‘ইশকুলের হেডমাস্টার কইছে। তোমার বাজানে।’
কাব্য বিষম খেল। হতভম্ব হয়ে বলল, ‘তোকে কোনো উপদেশ বোঝানোর সাধ্যি এই দুনিয়ায় কারো নেই। বোঝাবে এক,তুই বুঝবি আরেক। সাধে বলিনা তুই বাচ্চা মেয়ে। একেবারে নির্বোধ শিশুর মতো তোর মস্তিষ্ক।’
‘তুমি না ওইদিন কইলা আমি বড়ো হইছি! এহন আবার ছোডো হইয়া গেলাম? তুমি আগে সিদ্ধান্ত নেও আমি বড়ো নাকি ছোডো। তারপর যেই কোনো একটা কথাই কইবা।’
‘তুই শারীরিক দিক দিয়ে বড় হচ্ছিস ঠিকই কিন্তু মানসিক দিক দিয়ে দিন দিন ছোটই হচ্ছিস। বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে তোর। আমি জানতে চাইনি তুই নয়নার তুলনায় আমাকে বেশি ভালবাসিস কিনা। বরং আমি জানতে চেয়েছি আমাদের দুজনকে যে ভালবাসিস,সেই ভালবাসার পার্থক্য টা কি। মানে কোন হিসেবে ভালবাসিস আমাদের?’
‘আমিও তো সেইডাই কইলাম। আমি তোমাগো দুইজনরেই অনেক ভালবাসি। ভেদাভেদ করা খারাপ কাজ। আমি এইগুলা পছন্দ করি না। একরকম হিসাবেই ভালবাসি তোমাগো।”
কাব্য কপাল থাপড়ায়। আফসোস নিয়ে বলে,
‘হায় আল্লাহ্! আমি পাগল হয়ে যাব তোকে বোঝাতে বোঝাতে, তাও তোকে বোঝাতে পারবো না।’
‘তুমি যে কি বুঝাইতে চাইতাছো আমারে? আমি কিছুই বুঝতে পারতাছি না কাব্য ভাই।’
‘থাক বাদ দে এই বিষয়। আমার অল্প বয়সে পাগল হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। তুই একটা কবিতা শোন। আমি গতকাল ঠিক এই সময় টায় এখানে বসে বসে একটা কবিতা বানিয়েছিলাম তোকে নিয়ে।’
‘কবিতা? তুমি যে কিসব কবিতা কও আমি কিছুই বুঝিনা। আমি বইয়ের কবিতা বুইঝ্যাই দিশা পাইনা, তোমার টা আর কি বুঝুম? কিন্তু তুমি যেহেতু কষ্ট কইরা কবিতা বানাইছো, সেহেতু শুনি৷ আর কি করার?’
অনুমতি পেয়ে কাব্য নদীর পানে চেয়ে বলতে শুরু করল,
হৃদয় আমার ছুটে মরীচিকার পিছে।
বন্ধু আমার বোঝেনা মন,
দেয়না ধরা আমার কাছে।
সকাল নয়,দুপুর নয়,রাত্রিতেও নাহি পাই তারে।
তবুও সে তার গোধূলি বেলা-
দিয়েছে শুধুই আমারে।
আশায় আছি স্বপ্ন পূরণের।
তাকি অতি দূরে?
মন মালিকের অট্টালিকায়,
তারে রাখবো আপন করে।
পরিবেশ টা মনোমুগ্ধকর।
পাশে তুমি নাই,
মন গহিনের ফুল বাগিচা,
তোমাকে ভেবেই সাজাই।
অক্ষি তাহার মায়াবী তারা।
হৃদয় কাড়ে হাজার।
জোর খাটিয়ে বলবো একদিন,
শেষ বিকেলে তুমি আমার।
কবিতা শেষে কাব্য বলল,
‘তুই তো বুঝবি না। তাও জিজ্ঞেস করলাম, কেমন হলো রে মিতুবুড়ি?’
মিতু ঠোঁট উল্টে বলল, ‘কি জানি? আমার ঘুম আইয়া পড়ছে তোমার কবিতাখান হুইন্যা।’
‘তুই আজ বুঝবি নারে মিতুবুড়ি।’
‘আইজ না বুঝলে কবে বুঝুম? কাইল?’
‘সন্ধ্যা নেমে এসেছে, বাড়ি যা। নাহলে তোর মা তোকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে আসবে। তখন বকবে তোকে।’
‘এক্কারে হাচা কথা কইছো কাব্য ভাই। আমি বাইত্তে গেলাম। বাজান মনে হয় রাইগ্যা আছে। আইজকে বাইত্তে আছে বাজান।’
‘কেন? কাজে যায়নি আজ?’ কাব্য জিজ্ঞাসুক ভঙ্গিতে শুধায়।
মিতু নিষ্প্রভ কন্ঠে জবায় দেয়,
‘আইজ কাজ নাই বাজানের। জানো! কিস্তি নেওয়ার ব্যাডায় অনেক চিল্লাচিল্লি কইরা গেছিলো টাকার লাইগ্যা।’
‘সেকি! তারপর?’
‘বাজানের মালিক টাকা দেয়নায় আইজ। তাই কিস্তিওয়ালার টাকাও দিতে পারে নাই। তার লাইগ্যা বাজানরে মারতে নিছিলো। হেই ব্যাডায় তাজা মোডা দুইডা লোক আনছিলো বাজানরে মারার লাইগ্যা!’
কাব্য এক ঝাঁক আতংক নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘সাংঘাতিক লোক তো! তারপর কি তোর বাজানকে মেরেছিল তারা?’
‘না মারতে পারে নাই। মায় টাকা জমাইয়া রাখছিল, সেইহান থেইক্যা কিস্তির টাকা পরিশোধ করছে। তারপর বাজানরে ছাইড়া দিছে তারা।’
কাব্য হাঁফ ছাড়ল। আর বলল,
‘যাক বাবা ভালো হয়েছে। তুই জলদি বাড়ি যা নইলে তোর কপালে দুঃখ আছে আজ। আজ না আসলেও পারতি। আগামীকাল আমাকে সবটা বুঝিয়ে বললেই হয়ে যেত। এখন আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে তোকে নিয়ে। তুই বাড়ি গেলে যদি তোর বাজান তোকে মারে! আমার সেই নিয়ে ভয় লাগছে খুব।’
মিতু এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল,
‘অনেক দেরী হইয়া গেছে কাব্য ভাই। আমি তাইলে এহন যাই।’
চলবে ইনশাআল্লাহ….