উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৩
প্রতিরাতে চাপা কন্না করাটা সেতুর নিত্যনতুন অভ্যাসে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। বুকে তার প্রচুর ব্যথা। পাঁচ বছরের সংসার জীবনে এখনো মা ডাক শোনার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি তার। অনেক কবিরাজ ফকিরের শরনাপন্ন হয়েও কোনো ফলাফল পায়নি। সেতুর স্বামী নাহিদ দেওয়ান খুব মেয়েভক্ত এক নোংরা মানুষ। পতিতালয়ে যাওয়া আসা লেগেই আছে তার। নাহিদ ব্যবসায়ী লোক। টাকা পয়সার কোনো কমতি নেই। এই জন্যই সেতুর বাবা-মা মরিয়া হয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন নাহিদের সাথে। নাহিদের বাবা রাসেল দেওয়ান প্রচুর অর্থসম্পদ দু ছেলে ও স্ত্রী মছিদা বেগমের নামে রেকর্ড করে পরলোক গমন করেছিলেন। মছিদা বেগম এখনো জীবিত। নাহিদরা দু ভাই এক বোন। নাহিদের বড়ো ভাই নুরুল দেওয়ান দীর্ঘ ১৫ বছর যাবৎ প্রবাসে। এখনো বিয়ে করেনি সে। ১-২ মাসের মধ্যে দেশে ফিরছেন তিনি। নুরুল প্রবাসে থেকে প্রচুর অর্থসম্পদ কামিয়েছে। নাহিদের থেকেও তার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো। নাহিদ তার প্রাপ্য জায়গা টুকোয় চারিদিকে দেয়াল গেঁথে উপরে টিন দিয়ে ঘর তুলেছে। যাকে বলে হাফ ওয়ালের ভবন। নুরুল বৈদেশিক মুদ্রার জোরে চারতলা ফাউন্ডেশনের একটা বিশাল বিল্ডিং দিয়েছে। দেশে এসে বিয়ে করার পরিকল্পনা তার। বয়স চল্লিশ এর এদিক সেদিক হবে। সব মিলিয়ে বেশ স্বচ্ছল নাহিদদের পারিবারিক অবস্থা। নাহিদ পরিবারে ছোট সন্তান। নুরুলের থেকে পাঁচ বছরের ছোট রাবেয়া। রাবেয়ার কয়েক বছর আগে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। তিনি বিবাহবিচ্ছেদের পর থেকে তার মায়ের কাছেই রয়েছেন। আর বিয়ে করেননি। মছিদা বেগম স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়িটায় বর্তমানে মেয়েকে নিয়ে থাকছেন।
সেতু বিয়ের পর থেকে কখনো কাপড়-চোপড়,খাওয়া দাওয়ার অভাব পায়নি। কিন্তু এসব যে সকল সুখের মূল নয়! আসল সুখ যে মনের শান্তি। সেটাই তো তার ললাটে নেই। তার আক্ষেপ, সে এ জীবনে বিন্দুমাত্র সার্থকতা অর্জন করতে পারলো না। তার অভিযোগের শেষ নেই। অভাব অভিযোগ শোনার লোকের। এ সংসারে সবার চক্ষুশূল সে। সব সময় সবার মুখে লেগে থাকে। তার কাছে জীবন মানে শুধুই ব্যর্থতা। অনেক বড়ো ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। স্বপ্ন তার স্বপ্নই রয়ে গেল। যখন মনকে শক্ত করে সব ইচ্ছাকে মাটিচাপা দিয়ে গৃহকর্মে নিজেকে নিয়োজিত করতে শুরু করে,তখন একটা বাচ্চা নেওয়ার খুব শখ জাগে তার মনে। সেটাও যেন তার কপালে নেই। কথায় আছে না, কপালে না থাকিলে কাঁন্দিয়া হবে কি? সেতুর অবস্থা ঠিক তেমনই। স্বামীর সুখও নেই, তার নসিবে জোটেনি। নাহিদ যেন স্বামী নয়, জঘন্য এক পুরুষ। পান আনতে চুন খসলেই মারধর করে আধমরা বানিয়ে ফেলে সেতুকে। প্রথম প্রথম শ্বাশুড়ি ও ননদের কাছে বিচার দিতো সেতু। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হতো না। উল্টে তাদের কাছেও দু তিন ঘা খেতে হতো সেতুকে। প্রতিদিনের মতো আজও নাহিদ ভোর ৫টার সময় বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফিরেই তার হেঁড়ে গলা ছেড়ে সেতুর দিকে আঙুল উঁচিয়ে রাগান্বিত মেজাজে বলে,
‘সারা দিন-রাত পরে পরে ঘুমাবি। আর স্বামী গোল্লায় গেলেও তোর চিন্তা হয়না! বউ নামের কলঙ্ক, ছেঁছ!’
সেতু খুব সাহসী একটা মেয়ে। অন্যায় মোটেও সহ্য করতে পারেনা। তাতে যদি সে আঘাতপ্রাপ্ত হয়,তবুও মনে মনে সে অশেষ শান্তি পায়। এই ভেবে যে, সে একটু হলেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে।
সেতু জবাব দিল, ‘স্বামী যদি দিনে-রাইতে অন্য মাইয়া মানুষে মত্ত থাকে,তাইলে বাড়ির বউয়ের কি দোষ? আর কারে তুমি বউ নামের কলঙ্ক কইলা? তুমি নিজেই স্বামী নামের কলঙ্ক।’
সেতুর উগ্র কন্ঠে বলা বাক্যগুলো বেশ ভালো করে নাহিদকে চটিয়ে দেয়। সে এগিয়ে বলে,
‘কি! যত বড়ো মুখ নয়,ততো বড়ো কথা। আমার খেয়ে আমার পরে আমার মুখে মুখেই তর্ক করা!আজ তোর হচ্ছে।’
এই বলে সেতুকে বরাবর যে লাঠি দিয়ে পেটায় সেটা বের করল। তারপর একের পর এক আঘাত করতে লাগলো সেতুর শরীরে। সেতু কোনো টু শব্দটিও করল না। কারণ সে জানে কেউ নেই যে তাকে বাঁচাবে। প্রতিবারের মতে এবারও দাঁত কামড়ে সবটা সহ্য করে নিল সে। নাহিদ ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। ডাস্টবিনে যেভাবে ময়লা আবর্জনা পড়ে থাকে, ঠিক সেভাবে সেতুও মাটিতে পড়ে রইল উবু হয়ে। ব্যথায় ছটফট করছে। চোখ দিয়ে তার হাজারো কষ্টের ধারা বহিতেছে। তার ফর্সা গায়ে চোখের পলকে একের পর এক মর্মান্তিক রূপ ভেসে উঠছে। সেতু তার ব্যথা প্রাপ্ত স্থানে হাত দিয়ে ডলে উপশম ঘটনানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে অবিরাম প্রচেষ্টার সঙ্গে।
**
কেটে গেল তিনটে দিন। আজ চারদিন হলো মিতু বিদ্যালয়ে যায়নি। তার প্রধান কারণ লজ্জা আর পেট ব্যথা। তবে আগের থেকে অনেকটাই ব্যথার উপশম ঘটেছে। প্রথম প্রথম বলে লজ্জা কাটাতে সাথে পরিস্থিতি বুঝতে একটু সময় লাগছে মিতুর। এটাই তো স্বাভাবিক। মিতু ছোটো হলেও ততটাও অবুঝ নয়। ও খুব বুঝতে পারছে স্কুলে গেলে সেদিনের মতো আবারও সবাই তাকে নিয়ে হাসি তামাশা করবে। মনটা তার খুব কোমল। কারো হাসি ঠাট্টা সহজে নিতে পারেনা। ছোটো থেকে কারো সাথে মেশেনি সেভাবে। তার খেলার সাথী বলতে কাব্য আর নয়নাই। ওরা মিতুর হৃদয়ের প্রতি স্পন্দনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে। জীবনে তেমন কিছুই চোখে দেখেনি মিতু। ওর মনে নেই কোন অভিলাষ,সাধ, বাসনা। শুধু বোঝে দিন রাত পার করা। দু মুঠো খেয়ে সকাল বেলা নয়না আর বিকেল বেলা কাব্যর সঙ্গ পেলেই সে গুপ্তধনের খোঁজ পেয়ে যায়। তার দুনিয়াটাই সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। ওদিকে ছোটো ভাইটা কেঁদে খুন হলেও মিতুর তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। মিতু জানে মা তার ছেলেভক্ত। যতই কাজ থাকুক না কেন, ক্ষণিকের জন্য হলেও ছেলেকে চোখের আড়াল করতে চান না। এই ভেবে নিশ্চিন্ত মিতু। তবে ভাইকে ভালবাসেনা, তা কিন্তু নয়। ভাই যে তার চোখের মণি। সে যেটুকু সময় বাড়িতে থাকে ভাইকে নিয়ে কতই না আহ্লাদে মেতে থাকে। তখন তার পুরো দুনিয়া জুড়ে শুধু ভাই আর ভাই-ই রাজত্ব করে। আজ চারদিন স্কুলে না যাওয়ায় ভাইকে নিয়ে বিশ্বজগতের গপ্পো সারা। ভাই যে তার কিছুই বোঝেনা। আপন কাজে মগ্ন থাকে সে। মিতুর মোটা কথা বড়োরাই বোঝে না,সেখানে রুজন তো কেবল পাঁচ বছরের বাচ্চা শিশু। মিতু আজ বসেছে খেজুরের গুটি নিয়ে। মাটিতে কিসব আঁকিবুঁকি দাগ কেটে গুটি সাজিয়ে খেলছে সে। চার চারটে দিন সে স্কুলের গন্ডি পাড়ায়নি। অবশ্য সেজন্য তার বিন্দুমাত্র খারাপ লাগা কাজ করছে না। এর আরেকটি প্রধান কারণ অলসতা। রোজকার কাজের ধরণ একটু পাল্টে গেলেই বা একটু অবসর নিলেই মানুষ অলসতার সাগরে ডুব লাগায়। সে ডুবের ছায়াতলে একবার কেউ পরলে, তার জন্য অলসতার সাগর থেকে বের হওয়া খুবই দুষ্কর হয়ে পরে। তখন ফেরার রাস্তা যেন ভুলভুলাইয়ায় পরিণত হয়ে যায়। স্কুল কামাই দিতে কখনোই পছন্দ করে না মিতু। কিন্তু এবার যেন বেশ ভালোই লাগছে তার। কোন মতে পিতা-মাতাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে চারটে দিন কামাই করল। আজ যাব,কাল যাব বলে এই দূর ঠেকলো। অবশ্য মিতুর পিতা-মাতা মেয়ের দিকটা বুঝতে পেরেছে বলেই তাকে বাঁধা দেয়নি। মিতু গভীর আগ্রহে খেলছে। এদিকে মিতুর মা রুপালি চেঁচিয়ে মরছে।
‘মিতুনি! আরে কইরে তুই? এইদিকে আয় আমার সাতে ইকটু হাত লাগানা মা।’
রুপালি শত চেঁচিয়েও মিতুর থেকে কোন প্রকার প্রতুত্তর পাচ্ছে না। বারবার ডেকেও সাড়া না পেয়ে এবার রুপালি বেশ রেগে মেগে একটা পাটখড়ি তুলে নিয়ে মিতুর দিকে তেড়ে গেলেন। গিয়েই ঠাস ঠাস দুটো বারি বসিয়ে দিল মিতুর পিঠ বরাবর।
মিতু ব্যথাতুর স্বরে শব্দ করল, ‘আউউউউউউ গো।’
সঙ্গে সঙ্গে রূপালির রাগের ছটা গিয়ে পরে মিতুর উপর।
‘বলি কান কি তোর ফুফুগো কাছে ধার দিয়া আইছোস নাকি? নাকি জাত গুষ্টিরে বিলাইছোস?’
‘মারলা ক্যান আমারে? আমি তো তোমার পোলারে নিয়াই খেলতাছিলাম।’
মিতুর চোখ মুখ লাল হয়ে এসেছে। কান্না কান্না ভাব। আর দু একটা খেলে ভ্যা করে কেঁদেই দিত মনে হচ্ছে।
‘আপনে যে কত আমার পোলারে নিয়া খেলতাছেন,হেইডা আমি খুব ভালো কইরাই দেখতাছি। রুজন কি তোর ধারে কাছে আছে? আশেপাশে চাইয়া দেখতো একবার।’
মিতু আশেপাশে চোখ বুলাল। কিন্তু রুজনকে কোথাও দেখতে পেল না।
‘মা আমি সত্যি ওরে নিয়া খেলতাছিলাম।’
‘আমি জানি খেলতাছিলি। কিন্তু তুইযে খেলার মইধ্যে মশগুল হইয়া চৌদ্দ গুষ্টির নাম ভুইল্যা গেছস! আশেপাশে আগুন লাইগ্যা যাক, পুইড়া ছারখার হইয়া যাক, তাতে আপনের কি? আপনের তো কোনো কিছু খেয়াল করার দরকার নাই।
‘তুমি চেঁচাইতাছো ক্যান রুপালি? মাইয়াডায় আবার কি করলো?
আবুল কালাম ঘাড়ে কোদাল ঝুলিয়ে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বললেন কথাটি।
রুপালি সাথে সাথে উত্তর দিলেন,
‘কি করে নাই তোমার মাইয়া? মেলা কাম আমার। কইছি ইকটু হাত লাগা। তোমার মাইয়া খেলতাছে তো খেলতাছেই। রুজন হেই কবেই আমার কাছে আইয়া পড়ছিল, আর তোমার মাইয়া কয় ওরে নিয়া নাকি খেলতাছিল। পাটখড়ি দিয়া ভালমতোন দিছি দুইখান বারি।’
‘থাক আর চেঁচাইয়ো না। রুজন কই এহন?’ জিজ্ঞেস করল আবুল কালাম।
রুপালি হাতের পাটখড়ি ফেলে হাতে দুই এক ঝাড়া দিয়ে বলল, ‘ঘুমাইতাছে ঘরে।’
মিতু ওর বাবার কাছে চলে গেল। কৌতূহল চোখে শুধাল,
‘বাজান, তুমি আইজ এত তাড়াতাড়ি আইলা যে?’
আবুল কালামের মুখে নিমিষেই দুশ্চিন্তার ছাপ পরে গেল মিতুর প্রশ্নে। সে বিষাদগ্রস্ত গলায় বলল,
‘আইজ কাম নাইরে মা।’
‘ও আইচ্ছা। তাইলে আমি গিয়া নয়নার থেইক্যা আইজকের পড়া গুলা দেইখ্যা আহি। ইশকুল তো ছুটি হইয়া গেছে এতক্ষণে।’
এই বলে আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে এক দৌঁড়ে বাড়ির বাহিরে চলে গেল মিতু। পেছন থেকে রুপালি আবারও চেঁচিয়ে ওঠেন,
‘আরে ওই মাইয়া! থাম,থাম কইতাছি। দেখলা তোমার মাইয়াডা কেমনে চইল্যা গেল? বাপের কাম নাই ইকটু ভয় ডরও নাই ওর মনে। কি! তোমার কাম নাই আইজ!’ ব্যাপার টা বুঝে উঠে খানিক আঁতকে উঠল রুপালি।
আবুল কালাম কোদালটা মাটিতে ফেলে বললেন,
‘না, আইজ নাকি মালিক কাম বন্ধ রাখতে কইছে।’
‘তাইলে কিস্তি নেওয়ার লাইগ্যা যে ব্যাডায় আইবো আইজ। তারে কি দিবা?’
আবুল কালাম হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘এই সপ্তাহেও কিস্তি দিতে পারুম না মনে হইছাছে।’
‘তুমি কি বুইঝ্যা কতা কইতাছো সেতুর বাজান? আইজ কিস্তি না দিলে ব্যাডা অনেক রাইগ্যা যাইবো। আগের বাকী ৩ডা কিস্তি লইয়া আইজ ৪ডার টাহা এক লগে দেওনের কতা আছিলো।’
আবুল কালাম সেই একই স্বরে বললেন,
‘আমি ভাবছিলাম আগের দুই দিনের টাহাসহ আইজকের কামের টাহা একসাথে মিলাইয়া কিস্তিওয়ালারে দিমু। পরে যা থাকবো, তা দিয়া একটা বড়ো মাছ কিনুম। পোলা মাইয়া হামার কতদিন ধইরা বড়ো মাছ খাইতে চাইতাছিল। কিন্তু হামার যে কপালডাই পোড়া। দ্যাহো! কামই নাই আইজ। হামার হগল পরিকল্পনায় পানি পইরা গেল!’
‘এহন কি হইবো? কিস্তিওয়ালা ব্যাডায় তো ছাড়বো না আইজ। হেইদিন রাইগ্যা যাইয়া তোমারে মারতে নিছিলো। আইজ যদি সত্যি সত্যি মাইরা দেয়!’ শেষের কথা বলতে গিয়ে রুপালির মুখে ভয়ানক আতংক ফুটে উঠল।
‘মাইর খামু। আর কি? গরীব মাইনষেগো তো মান সম্মান নাইগা। ইকটু মাইর খাইলাম নাইলে!’
আবুল কালাম খুব কষ্টে,দুঃখে কথাগুলো বলতে বাধ্য হলো যেন।
চলবে ইনশাআল্লাহ…….