পিড়িয়ডের ছোপ ছোপ রক্তের দাগ পাজামা ভেদ করে জামায় লেগে আছে। জীবনের এক নতুন অধ্যায়ে পা রেখেছে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী মিতু। বয়স তার বারো কেবল। ভয়ে রীতিমতো কাঁপছে সে। পেটে মরণ যন্ত্রণা নিয়ে পেট দুহাত দ্বারা চেপে ঘাপটি মেরে মাঝারি সাইজের একটা বেঞ্চিতে বসে আছে। তার সুদীর্ঘ পল্লব জোড়ায় পানির ধারা ভর করে আছে। ওষ্ঠাধর কামড়ে ব্যথা সহ্য করার কতই না অবিরত প্রয়াস তার। সময়টা টিফিন টাইম। ছেলে মেয়ে মিশ্রিত বিদ্যালয়। কেউ টিফিন খাচ্ছে কেউ বা বন্ধুদের সাথে খেলায় মেতে আছে। এইতো খানিকক্ষণ আগে মিতুও তার সহপাঠীদের নিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি নামুক খেলায় মত্ত ছিলো। খেলার দরুন প্রচুর পেট ব্যথা উঠে তার। প্রথমে বুঝতে না পারলেও ব্যথা যখন ক্রমশ বেড়েই চলছিল,তখন গিয়ে মিতু তার পেটে তীব্র ব্যথার অস্তিত্ব অনুভব করল। এমতাবস্থায় আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। ছুটে নিজের শ্রেণিকক্ষে চলে এলো। তার সাথে তার প্রাণপ্রিয় মিতা নয়নাও ছুটে এলো।
মিতুকে কাতরাতে দেখে নয়না আতংক ধরে না রাখতে পেরে বলেই বসলো,
‘কিরে মিতু! তোর হইছে টা কি? তোর কি পেট ব্যথা করতাছে নাকি?’
মিতু একই অবস্থা ধরে রয়েছে। নয়নার প্রশ্নে কোনো প্রকার সাড়াশব্দ করল না সে। এবার যেন নয়নার কৌতুহল দ্বিগুণ আকার ধারণ করে ফেলেছে। সে মিতুকে কিঞ্চিৎ ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ক আমারে?’
মিতু ব্যথা সইতে না পেরে পেট চেপে সহসাই উঠে দাঁড়ালো। অনিচ্ছুক হওয়া সত্ত্বেও অধর নাড়লো।
‘আর পারতাছি নারে নয়না,পেট ব্যথায় মইরা যাইতাছি আমি।’
সহসা নয়না আতংকে চেঁচিয়ে বলল, ‘মিতু তোর পিছে রক্ত!’
নয়না বলতে দেড়ি মিতু পেছনে তাকাতে দেড়ি করল না। বিদ্যালয়ের কামিজে টাটকা রক্ত দেখে মিতুর চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। তৎক্ষনাৎ এক ঝাঁক ভয় ভর করলো মিতুর ছোট মনে। কিছুই যেন সে বুঝে উঠতে পারছে না। বুকটা থরথর করে কাঁপছে শুধু। শ্রেণিকক্ষে সকল ছাত্র/ছাত্রী ইতোমধ্যে ভীড় জমিয়েছে মিতু ও নয়নার চারিপাশ জুড়ে। নয়না এক মুহুর্ত দেড়ি না করে শ্রেণি শিক্ষিকার নিকট চলে গেল। পরিস্থিতি সামলাতে শ্রেণি শিক্ষিকা বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার জনাব তৌসিফ সাহেবের নিকট মিতুর হয়ে ছুটির আবেদনপত্র লিখে দিলেন। জানাব তৌসিফ সাহেব মিতুর সাথে নয়নারও ছুটিও মঞ্জুর করল। সাথে নয়নার কাঁধে দায়িত্ব সঁপে দিল মিতুকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার। মিতু সামনে হাঁটছে আর নয়না ওর পিছে কাঁঠালের আঠার মতো লেগে আছে। পুরো ঝিকাতুলি নামক অজপাড়া গাঁয়ে নিমিষেই রায়তা ছড়িয়ে গেল মিতুর পিরিয়ডের ব্যাপারটা নিয়ে।
বিকেল বেলা মিতু ঘরের এক কোণে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। মিতুর মা রুপালি, কোনো মতে মেয়ের মনের ভয়টা কাটিয়ে চুলায় ভাত বসাতে গেলেন। মিতুর বাবা আবুল কালাম দিনমজুরির কাজ করে সংসার চালান। আর মিতুর মা পরের বাড়ির কাজ করে কখনো দুমুঠো চাল, ডাল, রসুন,পেয়াজ ইত্যাদি এনে ওয়াক্ত পূরণ করেন।টানাপোড়ার এই পরিবারে মিতুরা বাবা-মা সহ তিন ভাইবোন। মিতু মেঝো। মিতুর বড়ো বোন সেতু। তার বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক হবে। বিয়ের পাঁচ বছরেও সেতু সন্তানের মুখ দেখতে পারেনি এখনো অবধি। সংসারে শান্তি নেই তার। দুদিন পর পর দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে বরের সাথে। আবুল কালাম ও রুপালি জীবন ভর কষ্টই করে গেলেন। সুখের মুখ দেখার আশায় মরিয়া হয়ে আছেন তারা। ছেলে রুজন সবে ৫ বছরে পা রেখেছে। ওকে নিয়েই আবুল কালাম ও তার স্ত্রীর যত আশা। একদিন রুজন বড়ো হয়ে তাদের সব কষ্ট দূর করে দেবে। এই ভেবে হাওয়াতে দীর্ঘশ্বাস উড়িয়ে দিন পার করে দেন তারা।
একে একে দল বেঁধে গাঁয়ের সকল মহিলারা মিতুদের বাড়ি ভীড় জমাচ্ছে। সাথে মিতুকে নিয়ে একেকজন একেক ধরনের অশ্লীল মন্তব্য পরিবেশন করে যাচ্ছে। মিতু এসব সইতে না পেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের চেনা জায়গাটার পানে ছুট লাগালো অতিষ্ঠ মনে।
বিরাট এক গাঙ। সেখানে গাঙচিলের খেলা চলছে অবলীলায়। কিনারার ধারে সবুজ কচুরিপানা ও শ্যাওলার সমাহার। মিতুর নিষ্পাপ সরল মনটি ভাবছে নদীর পানি, শ্যাওলারা যেন তার দুঃখ ও অভিযোগ শুনতে দল বেঁধে সমাবেশে যোগ হয়েছে।
নৌকা দিয়ে অনেকেই জাল ফেলে মাছ ধরছে গাঙে। মিতু তার নিষ্পল চোখ জোড়া দিয়ে তাই দেখে চলেছে। সেই সঙ্গে গাঙের বুকে নিরন্তর ঢিল ছুড়ে চলেছে মনের দুঃখে। আচমকা কেউ একজন তার হাত দিয়ে মিতুর চোখ জোড়া আবদ্ধ করে ফেলল। তবুও যেন মিতু স্বাভাবিক। হেলদোল নেই যেন। এমনকি কোনরকম পরিবর্তন অবধি আসেনি তার ভাবভঙ্গিতে।
মিতু একরাশ হতাশা ভরা গলায় বলল, ‘ছাড়ো কাব্য ভাই, আইজ আর দুষ্টামি করার মন নাই আমার।’
কাব্য মিতুর পাশে গিয়ে বসল। তারপর পকেট থেকে এক মুঠো চানামুঠ বের করে মিতুর সামনে ধরে বলল, ‘তাহলে আজ চানামুঠগুলো আমি একা একাই খাই নাহয়।’
অন্যদিন হলে মিতু জোর করে কাব্যর থেকে সব চানামুঠ কেড়ে নিত। কিন্তু আজ ওর সব চঞ্চলতা নিস্তব্ধতার আড়ালে ঢেকে গেছে। কাব্য বড়ো এক নিশ্বাস ত্যাগ করল। তারপর বলল, ‘মেয়েদের জীবনে এই দিনটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে সৃষ্টির নিয়ম মানতে তো হবেই। সব মেয়ের জীবনেই এই দিনটা আসে। প্রথমে লজ্জাবোধ হলেও পরে ঠিক মানিয়ে নেয়। মেয়েরা হচ্ছে মায়ের জাত। এই একটা কারণে আমি তাদের পুরুষদের তুলনায় বেশি শক্তিশালী বলে মনে করি।’
মিতু পিটপিট করে চাইল কাব্যর দিকে। তা দেখে কাব্য আলতো করে মিতুর নাক টেনে দিল।
‘এভাবে কি দেখছিস মিতুবুড়ি?’
মিতু বলল, ‘তুমি আমার মার মতো কথা কইতাছো ক্যান? আইজকে মাও আমারে এই কথাখানই কইল। তুমি কি তাইলে আমার ঘটনাখান জানো কাব্য ভাই?’
কাব্য ঈষৎ হাসল। বলল, ‘আমি কেন,গাঁয়ের প্রায় সব লোকই জানে। জানিস, যে এই কথাটা পুরো গাঁয়ে ছড়িয়েছে তাকে দু হাতের মধ্যে নিয়ে পিষে ফেলতে মন চাচ্ছে আমার। এটা কি বিজয় দিবসের স্লোগান নাকি যে ঢাকঢোল পিটিয়ে লোক জানাতে হবে!’
মুহুর্তেই কাব্যর চোখ মুখ আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হানার ন্যায় জ্বলে উঠল তীব্র ভাবে।
‘কাব্য ভাই!’ শান্ত স্বরে ডাকল মিতু।
‘কি?’
‘আমারে নিয়া মানুষ হাসি মজা করতাছে ক্যান?আমার এই রোগখান চাইনা। আমি কি মইরা যামু কাব্য ভাই?’
‘পাগলীর কথা শোনো! তুই কোন চিন্তা করিস না। তোর কিছুই হবে না। তুই শুধু তোর মায়ের কথা শুনে চলবি। আর এই সময় টায় বিশেষ খেয়াল রাখবি নিজের। কারণ এর সাথে স্বাস্থ্যহীনতা জড়িত থাকে।’
‘আমি কিছুই হুনতে চাইনা। তুমি খালি কও এইডা ক্যান হইলো আমার সাথে? কি হইবো এহন আমার?’
‘শুধু তুই না, প্রতিটি মেয়েই প্রথম প্রথম ভয় পায়। এটাই স্বাভাবিক। আর এটা শুধু তোর সাথেই হয়নি। তোর বয়সী প্রায় অনেক মেয়েরই হয়েছে। আর এটাই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম।’
‘তাই যদি হয় তাইলে নয়নার ক্যান হয়নাই কাব্য ভাই?’
‘আজ হয়নি কাল হবে। আর কাল না হলে কিছুদিন পর হবে। প্রকৃতির নিয়ম বলে কথা। আর এই মেন্সট্রুয়েশন প্রক্রিয়াটি সব মেয়েদের একই সময়ে হবে তা কিন্তু নয়। এটি মেয়েদের শরীরের চাহিদা অনুযায়ী শুরু হয়। তাই কারো আগে হয়, তো কারো পরে।’
‘কিন্ত এইডা হয় ক্যান কাব্য ভাই?’
‘তুই এতো সব বুঝতে পারবি না এখন। সময় হলে ঠিকই বুঝবি। আর রইল গ্রামের লোকেরা, তারা দু একদিন এটা নিয়ে মাতামাতি করবে ঠিকই কিন্তু তারপর দেখবি সবাই ভুলে যাবে। আর তুইও স্বাভাবিক হয়ে যাবি। সেই আগের মতো কাব্য ভাই,কাব্য ভাই করে আমার মাথা খাবি।’
‘কি কইতাছো! আমি তোমার মাথা খাই?’ মুহুর্তেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল মিতু।
‘হুম তাতো খাস’ই। এই তুই আবারও অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলছিস কেন? তোকে না বলেছি সুন্দর মার্জিত ভাষায় কথা বলতে?’
‘তোমার মতো যেইদিন ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলাইয়া টইটই কইরা কলেজ যামু,ওইদিন শুদ্ধ ভাষাতেই কথা কমু। হিহিহিহি।’
‘ওরে পাঁকা বুড়ি! তোকেও আমি কাল একটা ব্যাগ কিনে দেব। তারপর তুইও টইটই করে ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যাবি।’
মিতু ওর দু হাত নাচিয়ে বলল,
‘না বাবা আমি হাতে কইরাই বই খাতা নিতে পারি। আগের বার তুমি একটা জামা কিন্না দিছিলা আমারে। ওই জামা বাজান আমারে একদিনও পরতে দেয় নাই। পুড়ায় ফেলাইছিল জামাডা। বাজান যদি জানতে পারে তুমি আমারে ব্যাগ কিন্না দিছো,তাইলে এইবার আমারে আগের বারের থেইক্যাও আরও অনেক বেশি মারবো। তাই আমার ব্যাগ লাগবো না।’
‘তোর বাজান এত পঁচা কেন বলতো? আমি তো তোকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না। তাও কেন দেখতে পারেনা আমাকে? আমি তোকে কিছু দিলেই তোকে মারে। আমার সাথে দেখলেই তোকে বকাঝকা করে। আমার কিন্তু এটা মোটেও ভালো লাগে না।’
‘উহু,বাজান আমার অনেক ভালো। কিন্তু এমন ক্যান করে আমি জানি না কাব্য ভাই।’
‘আমি তোকে এত এত আদর করি বলে তোর বাজানের হিংসা হয় তাইনা রে? তাই বলি কি, এখন থেকে তুই আর আমার কাছে আসিস না। আমার জন্য তুই মার খাস, আমি চাইনা।’
কথাটা বলা মাত্র কাব্যর কপালে হতাশার ভাজ পড়ল। সেই হতাশা লুকাতে সে মুখ ফিরিয়ে অন্যত্র স্থির করে নেয়।
মিতু মাথা দুই দিকে নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দিল। তারপর বলল,
‘আমি তো আসমু তোমার কাছে। আমার কাব্য ভাইয়ের লাইগ্যা আমি একবার না, হাজারবার মাইর খাইতে রাজি আছি। এইবার আমার চানামুঠ গুলা দেও কাব্য ভাই। আমি সব বুঝতাছি, তুমি আমারে সাত পাঁচ কথায় ডুবায় রাইখ্যা আমার চানামুঠ গুলান আত্মসাৎ করতে চাইতাছো!’
কাব্য ভ্রু সামান্য কোঁচকালো। তারপর বলল,
‘আত্মসাৎ! তুই আত্মসাৎ মানেও বুঝিস নাকি?’
‘বুঝমু না ক্যান? আমি তো আর মূর্খ না। ইকটু আঞ্চলিক ভাষায় কথা কই এইটুকুনই।’
‘হুম, বেশ বুঝলাম আমার মিতুবুড়ি অত্যন্ত জ্ঞানী একজন ব্যক্তি। কিন্তু একটু আগে না বললি তুই চানামুঠ খাবি না!’
‘সেই কথা আমি একবারও কই নাই কাব্য ভাই!তহন আমার মন ভালো আছিলো না বইল্যা খপ কইরা চানামুঠ গুলান কাইড়া লই নাই তোমার হাত থেইক্যা।’
‘এখন বুঝি তোর মন ভালো হয়ে গেছে?’
‘তোমার সাথে থাকলে আমার মন কেমনে কেমনে যে ভালো হয়, তা আমি নিজেই জানি না।’
‘ওলে বাবা! আচ্ছা এই নে তোর চানামুঠ।’
চানামুঠ পেয়ে মিতু তো মহা খুশি। খুশিতে কাব্যকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুমি অনেক ভালো কাব্য ভাই।’
কাব্য তৎক্ষনাৎ মিতুকে তার বুক থেকে আলগা করে বলল,
‘এখন তুই আর আগের সেই ছোট মিতুবুড়ি নেই।অসামাজিক কিছু দেখলে লোকে মন্দ বলবে। বড়ো হচ্ছিস। স্বভাবটা একটু বদলা। এখন আর আমাকে কথায় কথায় জড়িয়ে ধরবি না বুঝলি?’
‘এ্যাহ! কইলেই হইলো? আমার কাব্য ভাইরে আমি একশো বার জড়ায় ধরমু কোটি কোটি বার জড়ায় ধরমু।’ এই বলে আবারও জড়িয়ে ধরল কাব্যকে।
চলবে ইনশাআল্লাহ…
উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ১