এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️পর্ব-২২

0
1872

এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️পর্ব-২২
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️

ভারিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। থেমে থেমে আকাশ কাঁপানো বজ্রপাতের শব্দে আলোড়িত হয়ে উঠছে চারিপাশ।পরমূহুর্তেই আবার ডুব দিচ্ছে অতল অন্ধকারে। গাড়ির ভেতরের পরিবেশ অতিব ঠান্ডা। ফুলস্পিডে এসি ছাড়া কাঁচবন্ধ গুমোট বাহনটাকে হিমাগারের থেকে কম মনে হচ্ছেনা। পাতলা সুতির শাড়ি ভেদ করে শীতল বাতাস শরীর ছুঁয়ে যেতেই গায়ের লোম ভয়ংকরভাবে কাঁটা দিয়ে উঠছে রাত্রির। ফর্সা চোখমুখ এতক্ষণ ভয়ে চুপসে গেছিলো আর এখন ঠান্ডায় শুকিয়ে কাঠ। তাপমাত্রাটা শরীর একদম মানিয়ে নিতে পারছেনা।
নিভ্রান কোল থেকে মাথা উঠিয়ে সোজা হয়ে বসলো। রাত্রি তৎক্ষণাৎ সিট থেকে পা নামালো। আচঁল কুঁচি সমস্ত বিগরে গেছে। এলোমেলো,হযবরল হয়ে কাপড় ঘুঁচে আছে। মাথার চুল অবিন্যস্ত সিঁথিতে কাঁধের এদিক ওদিকে ঝুলে পড়েছে। রাত্রি ঠোঁট দিয়ে অপছন্দসূচক শব্দ করলো। শাড়িতে পিন আটকায়নি একটাও।সুতির শাড়ি বলে সমস্যাও হয়নি। কিন্তু একটু আগের টানাহেচরায় সব ভেস্তে গেছে। দু’হাতে চুল মুঠ করে খোঁপা করার জন্য হাত উঠালো সে। আচঁল সরে অনাবৃত হয়ে গেলো মেদহীন ফর্সা উদর।
নিভ্রান তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেয়েটার রূপ মুখস্ত করে নিচ্ছিলো।হঠাৎ করে কিছু নিষিদ্ধ অংশ চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে উঠতেই ঘাবড়ে গেলো সে।রাত্রি মনোযোগ দিয়ে চুল পেঁচাতে ব্যস্ত।বেখেয়ালি প্রেমিকার চরম খেয়ালহীনতায় প্রেমিকের নাজেহাল চোখদুটো স্হির চেয়ে রইলো একসমুদ্র নিমগ্নতায় ডুবে।
রাত্রি খোঁপা শেষে হাত নামালো।নিভ্রান ক্ষনিকেই চোখ সড়ালো।চটপট জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলো।ঘাড়-গলা এসির মধ্যই ঘেমে উঠেছে।উত্তপ্ত অপরূপা পাশে আছে যে!
জানালা দিয়ে খরশান তালমাতাল হাওয়া এসে সময়টা থমকিয়ে দিলো যেন। রাত্রি আবার শিরশির করে উঠলো।দাঁতে দাঁত লেগে ঘর্ষণের শব্দ সৃষ্টি হলো। নিভ্রান তখন শক্ত চোখে বৃষ্টি দেখছে। ওদিকে তাকানো বারণ। তাকিয়ে ফেললে অপরাধ। বারণ শুনতে অপ্রসন্ন নির্লজ্জ মন।অপরাধেই ঝোঁক বেশি তার।
রাত্রি ঢিলে আচঁল টেনে একপলক নিভ্রানের দিকে চাইলো।লোকটার কি শীত করেনা?এই ঠান্ডা গায়ে জানালায় চেপে শার্ট ভেজাচ্ছে। কে জানে? এখন যদি ভিজতে বলে তবে তো অসম্ভব। এই আধখোলা কাপড় নিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা অকল্পনীয় ব্যাপার স্যাপার। স্যাঁতস্যাঁতে একরোখা কন্ঠে সে আগে ভাগেই বললো,
—“আমি কিন্তু ভিজতে পারবোনা।আপনি অযথা আবদার করবেন না।”

নিভ্রান ঘাড় ফিরালো। একচোট আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে বিরবির করলো,”তুমি ভিজলে আজ নির্ঘাত অঘটন ঘটে যাবে রাত।”

রাত্রি বুঝতে না পেরে বললো,”জি?”

নিভ্রান দূর্বোধ্য হাসলো।জানলার বাইরে দৃষ্টির স্হাপন করলো,”কেন ভিজতে পারবেনা?”

—“শাড়ি পড়েছি যে।ভিজলে খুব বাজে দেখাবে।”

নিভ্রান এবার সরাসরি চোখে চোখ রাখলো।রাত্রির আকস্মিক অপ্রস্তুত ভাবটাকে আরো একটু বাড়িয়ে দিতে এক ভ্রু উচিয়ে ব্যাঙ্গাত্বক কন্ঠে বললো,
—“তোমাকে ভেজা শরীরে আগে দেখিনি আমি?”

নিভ্রানের ঠোঁটের বাকালো হাসি,ধার ধার পুরুষালি চাহনী,লাজহীন সুপ্ত প্রশংসার দংশনে গোছানো কথা মুখেই আটকে গেলো রাত্রির। অস্বস্তিকর হয়ে উঠলো হাত-পা। লজ্জায় কানের লতি পর্যন্ত লাল।
নিভ্রান হো হো করে হেসে উঠলো।

—“ভয় নেই,ভিজতে বলবোনা।তুমি শাড়িটা গোছাও তারপর গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছি।”

রাত্রি একটা একটা করে কুঁচি সোজা করলো। নিচু গলায় বললো,
—“আপনি হঠাৎ আপনি থেকে তুমিতে চলে গেলেন যে?”

—“মানুষটা হঠাৎ আপন হয়ে উঠলো যে।”বলে একটু চুপ থেকে আবার বললো,”আবার আপনিতে চলে যাবো?”

—“না না সেটা বলিনি।”রাত্রির ধূমায়িত লাজুক স্বর। নিভ্রান উওর দিলোনা। রাত্রি শাড়ি গুছিয়ে নিতেই বৃষ্টি মাথায় বেরিয়ে পড়লো সে। আধভেজা গায়ে সামনের সিট থেকে ছাতা নিয়ে গাড়ি ঘুরে এপাশে এসে দাড়ালো।
দরজা খুলে ছাতা ধরে বললো,
—“আসো,সামনে যেয়ে বসো।”

রাত্রি বেরোলো।কি তেজি বর্ষন!সামনে দেখা যাচ্ছে না।রাস্তায় পানি জমে বিচ্ছিরি অবস্থা।পা গোড়ালির উপর অবধি ডুবে যাচ্ছে।নিভ্রান ব্যস্ত ভঙ্গিতে একহাতে রাত্রির মাথার উপর ছাতা ধরে অপরহাতে কুঁচি উপরের দিকে টেনে ধরলো।তাড়াহুড়ো গলায় বললো,

—“আস্তে,পিছলা খাবা কিন্তু।আমাকে ধরো।”

রাত্রি বাধ্যমতন আলতো করে নিভ্রানের কোমড়ের শার্ট শক্ত করে মুচরে ধরলো।ছপছপ আওয়াজ তুলে দু’কদম এগিয়ে ফ্রন্ট সিটে ঢুকে বসলো।নিভ্রান দরজা লক করে দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো।পিঠের শার্ট পুরো ভিজে গেছে।মাথাটা একটু ছাতার ভিতর ছিলো তবু চুলের ডগা থেকে পানি ঝরছে।ভেজা হাতেই চুল ঝাড়ার চেষ্টা করলো সে।
রাত্রি আচমকাই ঝুঁকে গেলো।শুকনো আচঁল দিয়ে চুল মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“আমি পেছনে বসলেই তো হতো।শুধু শুধু ভিজলেন।”

রাত্রির কাছ থেকে হঠাৎই এই অপ্রত্যাশিত ভালবাসা পেয়ে খুশিতে ঝলমল করে উঠলো নিভ্রানের চোখজোড়া।
তবে তা প্রকাশ পেলোনা।মনের গহীন কোণেই চাপা পড়ে রইলো খুব যতনে।

গাড়ি চলছে।সামনের কাঁচটা বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে। তা মুছে দেয়ার কাজে নিয়োজিত কাঠি দুটো অবিশ্রাম দৌড়ঝাপ করেও ব্যর্থ হচ্ছে জল সামলাতে। নিভ্রান খুব সাবধানে ড্রাইভ করছে। রাস্তায় এমনেই পানি তারউপর এমন ঘোলাটে কাঁচে নির্বিঘ্নে গাড়ি চালানো বড়ই দুষ্কর।
সামনে বসায় এসির বাতাসটা আরো ভালোকরে জাপটে ধরছে।রাত্রি উষখুষ করলো,
—“এসিটা বন্ধ করে দিননা।শীত করছেতো।”

নিভ্রান মনে মনে বললো,”আমাকে উষ্ণতার সাগরে ডুবিয়ে তোমার শীত করছে তপ্তময়ী?সিরিয়াসলি?”
তবে মুখে বললো,
—“আমার গরম লাগছে।এসি বন্ধ করলে নিশ্চিত হিটস্ট্রোক করবো।”

রাত্রি অবাকচোখে চাইলো। তবে কথা সত্য,নিভ্রানের গলার কাছে বাস্তবিকই ঘাম জমেছে।

—“এটা বন্ধ করে দু’পাশের কাঁচ নামিয়ে দিন।তাহলেইতো হয়।”

—“কাঁচ নামালে ভিজে যাবা।”

—“ভিজবোনা,আমার সত্যি শীত করছে। দেখুন গায়ের লোম পর্যন্ত খাঁড়া হয়ে গেছে।দেখুন।”বলে হাত বাড়িয়ে দেখালো সে। নিভ্রান হাসলো। ঠোঁটে হাসি বজায় রেখেই বিনাবাক্য এসি বন্ধ করে দিলো। জানালার কাঁচ নামালো। রাত্রি হাত বাড়িয়ে পানি ধরলো। কোমড় বাকিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে জানালায় দু’হাত রেখে বৃষ্টি দেখায় মনোযোগী তরুনী হয়ে উঠলো। নিভ্রান একপলক তাকালো। বেশ কিছু সময় তাকিয়েই থাকলো একাধারে। মেয়েটাকে কে বলেছিলো এই সর্বনাশা শাড়ি গায়ে জড়াতে?কে বলেছিলো এতো খামখেয়ালিপনা করে বৃষ্টি দেখতে?দৃষ্টি সংযত করতে অক্ষম নিভ্রান উপায়ন্তর না পেয়ে শেষমেষ গাড়ির ইনার লাইটটা নিভিয়ে দিলো।
হঠাৎই আলো নিভে যাওয়ায় সচকিত ভঙ্গিমায় ঘাড় ফিরালো রাত্রি।ভ্রু কুচকে বললো,
—“কি হলো?এটা নষ্ট হয়ে গেলো?”

—“আমি নিভিয়ে দিয়েছি।”

—“কেনো?”

—“আর সম্ভব হচ্ছেনা রাত।”

কপালের ভাঁজ আরো গাঢ় হলো,”কি সম্ভব হচ্ছেনা?”

—“তোমাকে দেখা।”

রাত্রি অস্ফুট স্বরে আওয়াজ করলো।কিছু বলার আগেই নিভ্রান থামিয়ে দিলো,”এখন চুপ।আর কথা না।”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here