ভ্রমণ পর্বঃ১৭

0
365

#ভ্রমণ
#পর্বঃ১৭
লেখাঃসামিয়া খান

“আমি ছাড়া আপনি থাকতে পারবেন তো চাঁদ?আপনার আলো তখন তো ফিকে হয়ে যাবে না?আমাকে ছাড়া যে আপনার দুনিয়া অন্ধকার, অন্ধকার এবং অন্ধকার।”

গ্রীসে থাকতে একদিন তাদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের পর কথাগুলো ইয়াদ সাইরাহ্কে বলেছিলেন।বর্তমানে চারপাশে ফিনাইলের গন্ধে ভরপুর জায়গায় বসে কথাটা বড্ড মনে পড়ছে সাইরাহে্র এখন।ইয়াদকে একটু আগে আইসিইউ থেকে বের করে রুমে দিয়েছেন ডক্টররা।তার অবস্থা খুব খারাপ না হলেও শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো প্রচুর।পালস উঠা নামা করায় তাকে আইসিইউ তে রেখেছিল।আপাতত অবস্থা বেশ শিথিল।সাইরাহ্ যেন কাঁদতে ভুলে গিয়েছেন এমন অবস্থা তার।অথচ কেঁদেই বা কি হবে তিনি নিজেই ইয়াদকে বিষ দিয়েছিলেন।আজকে সকালে জুসের সাথে মিশিয়ে।ইয়াদ খাওয়ার পর বেশ কিছুসময় স্বাভাবিক ছিলেন।তারপর করা শুরু করলেন বমি এবং জলদি করে ড্রাইভারকে নিয়ে হসপিটালে এসেছেন।পরিবারের কাউকে সাথে আসার অবকাশ পর্যন্ত দেননি।ড্রাইভারের মতে গাড়ীতে আরো দুইবার বমি করেছেন ইয়াদ।

তারেক এসে নিজের বোনের পাশে দাঁড়ালেন।

“ভয় পাচ্ছিস?”

“ভাই আমি কীভাবে পারলাম তাকে বিষ দিতে?আমার হাত কাঁপলো না?মানুষটা আমাকে পাশে বসিয়ে পুরো গ্লাস শেষ করলেন।অথচ আমি চুপ ছিলাম।এমনকি প্রতিক্রিয়া শুরু হবে দেখে রুম থেকে চলে আসলাম।আমি নিজের হাতে কীভাবে আমার বাচ্চার বাবাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলাম?”

কথাটা বলেই সাইরাহ্ কান্নায় ভেঙে পড়লেন।ইনায়া তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বহু সময় আগে।

“তুমি কোন ভুল করোনি সাইরাহ্।উল্টো এক পাপী নিধন করেছিলে।খেয়াল করো তো লোকটা ঠিক কেমন ছিল?খুনি,প্রতারক।”

“যেমন ছিল আমার স্বামী ছিল।”

“সাইরাহ্ আমি তো থাকবো সারাজীবন তোর পাশে।তোর আর্থিক কোন সমস্যা হবেনা।যদিও ইয়াদের সব তোর।”

“ঠিক সাইরাহ্।আমি শুধু একটা জিনিসে ভয় পাচ্ছি।”

“কি?”

“ইয়াদ বাঁচলে আমাদের কাউকে বাঁচতে দিবেনা।”

“তোমাদের কাউকে আমি এমনিতেও বাঁচতে দিবো না।”

সাইরাহ্ এতোসময় একটা কেবিনে বসে ছিল অসুস্থ থাকায়।সেই কেবিনের ওয়াশরুমে যে ইয়াদের দাদু নূরেজাহান ছিলেন তা দিব্যি ভুলে গিয়েছিল সে।কিন্তু এখন নির্বিকার সাইরাহ্।তার ভয় বা অন্যকিছুই হচ্ছেনা।

অনেকটা উত্তেজিত হয়ে গিয়েছেন ইয়াদের দাদু।খোঁড়াতে খোঁড়াতে সাইরাহ্ এর সামনে দাঁড়ালেন।

“তোর কোন নাগরের কারণে তুই আমার কলিজার টুকরাকে বিষ দিলি?”

ইনায়া অন্তত ঠান্ডা স্বরে জবাব দিলেন।

“সাইরাহ্ কোন ভুল করেনি।আর তার চরিত্রেও কোন দোষ নেই।”

খেঁকিয়ে উঠলেন ইয়াদের দাদু।

“এই মেয়ে তুমি কে?”

“আপনার ইয়াদের প্রেমিকা।আর আমরা যা করেছি ভুল করিনি।”

ইতিমধ্যে ইয়াদের বাবা রুমে প্রবেশ করলেন।ভদ্রলোক বেশ ভেঙে পড়েছেন।একমাত্র ছেলের এহেন অবস্থা সহ্যকর নয়।তার উপর তার ফুফুর রাগারাগি আরো বিরক্ত লাগছে।

“সাইরাহ্ কে ধমকাচ্ছো কেন?”

“ওরে দেখ তোর ছেলে বিষ তোর ছেলের বউ দিয়েছে।”

“কি যা তা বলছো।”

“যা তা নয়।তুই জিজ্ঞেস করে দেখ।”

“জিজ্ঞেস করতে হবেনা।আমি সব বলছি।”

ইয়াদের বাবা ভ্রু কুঁচকে ইনায়ার জন্য প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন।

“তুমি কে?”

“আপনার খুনি ছেলের প্রেমিকা।”

“মানে?”

ইনায়া একে একে সব ভদ্রলোককে খুলে বললেন।সব শুনে ইয়াদের দাদু একটা চিৎকার করে উঠলেন।

“সব মিথ্যা কথা।আমার সূর্য এমন না।”

বেশ হাইপার হয়ে গিয়েছেন সে।

“কিছুই মিথ্যা না।আমি সব প্রমাণ দিচ্ছি।”

ইনায়া একে একে সব প্রমাণ দিলেন।জেরিনের খুন,তরুলতা সহ সব।ইয়াদের দাদু বেশ উত্তেজিত হলেও ইয়াদের বাবা বেশ ঠান্ডা ছিলেন।কঠিন এক স্বরে বললেন।

“তাই বলে তোমরা আমার ছেলেকে মেরে ফেলবে?ও যে একটাই আমার।”

“আর কোন উপায় ছিলনা।”

“আর সাইরাহ্ তোমার কি ক্ষতি করেছে?”

তার জবাব দেওয়ার আগে তারেক জবাব দিলেন।

“ইয়াদ যদি অন্ত্বসত্তা অবস্থায় জেরিনকে মারতে পারে তবে আমার বোন কি?”

“তোমাদের সকলের পায়ে ধরি চুপ যাও সকলে।আমার ছেলেকে বাঁচতে দাও।ও বিগত সব ভুলে যাবে।সাইরাহ্ তুমি কীভাবে ভুললে ও বাচ্চা আর তোমার জন্য কতোটা পাগল।যদি ও পাগল না হতো তাহলে কখনো আমাদের সাথে পরিচয় করাতো না।জেরিন বা ইনায়া মেয়েটার মতোই রাখতো।”

সাইরাহ কোন জবাব দিলেন না।প্রচন্ড খারাপ লাগছে এখন তার।

“এ ব্যাপার এখানে শেষ।আমি পরে কথা বলবো। কথা বলার সঠিক জায়গা না এটা।আর দাদু তুমি সাইরাহ্কে কিছু বলো না।ও কিন্তু গর্ভবতী।”

ইয়াদের দাদু কিছু বললেন না।আঁচলে মুখে লুকিয়ে কিন্নর কণ্ঠে কাঁদছেন।কিছু সময় সাইরাহ্ এর মা হসপিটালে আসলে সাইরাহ্ হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন।তার মা গ্রামে গিয়েছিলেন।সেখান থেকে আসতে যা দেরী হলো।
,
,

ইয়াদের বাবা ডক্টরের সাথে কথা বলে তার চেম্বার থেকে বের হলেন।প্রাইভেট হসপিটাল, এখানে কিছু শেয়ার তারও আছে।ডক্টরের কথা ইয়াদ যদি সঠিক সময় বমি না করতেন তাহলে বাঁচানো কঠিন হতো।ভাগ্য ভালো ছিল যে বমি করেছে।

হসপিটালের করিডরে বসে পড়লেন ইয়াদের বাবা।কঠিন পরিস্থিতিতে সে শান্ত থেকেছেন।এমনকি নিজের স্ত্রী নয়নাকে অন্য পুরুষের বিছানা মাতানোর সময়ও।কিন্তু আজ চুপ থাকতে পারছেন না।সে পুরুষ হিসেবে অক্ষম।,স্বামী হিসেবে অক্ষম,বাবা হিসেবেও অক্ষম।তার আদরের ছেলের এক খুন সে মাফ করেছিল।তাই বলে এতো খুন।এমনকি নিজের বাচ্চাকে কীভাবে মেরেছে।মাথা চাপড়ালেন সে এসব কথা মনে হওয়ায়।আশেপাশের লোক অবাক হয়ে তাঁকিয়ে আছেন।তার মনে হচ্ছে নয়না তাকে দেখছেন।ইশ!সুন্দর মুখটায় কি বিদ্রুপের হাসি।মেয়েটা কতো শান্ত ছিল যখন কলেজে একসাথে প্রেম করতো তারা।যখন তার ফুফু দিনের পর দিন তার স্ত্রীকে মারতো তখনও চুপ থাকতো সে।সে হিসেবেই মনে হয় আজ ইয়াদ এমন।আর কিছু ভাবতে পারছেন না সে।মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব হচ্ছে তার।শুধু একটা মৃদু চিৎকার দিয়ে ঢলে পড়লেন।

ইয়াদের বাবা মারা গিয়েছেন আজ সাতদিন।সেদিন হসপিটালে মেসিভ সেরিব্রালের কারণে সাথে সাথে মারা যান তিনি।ইয়াদ এতোদিন হসপিটালে ছিলেন সে জানতে পারেনি যে তার বাবা মারা গিয়েছেন।অসুস্থ হওয়ার কারণে তাকে কেউ জানায়নি।এই সাতদিন ইয়াদের দাদু সাইরাহ্কে ইয়াদের আশেপাশেও ঘুরতে দেননি।তিনি শুধু সাইরাহ্কে কিছু বলেননি কারণ সে গর্ভবতী ইয়াদের সন্তানের মা হবেন।

ইয়াদকে যখন বাড়ীতে নিয়ে আসা হলো তার দুই ঘন্টা পর তাকে জানানো হলো তার বাবার মৃত্যুর কথা।সে থেকে ইয়াদ একদম পাগলের মতো করছে।যে ছেলে কখনো কাঁদেনি সেই ছেলেও কাঁদছে।প্রকৃতি মনে হয় এবার নিজস্ব রুপ ধারণ করতে চলেছে।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here